এই বিশষে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমরা এমন একটি শিল্প নিয়ে কথা বলছি যা আমাদের রপ্তানির প্রায় ৭৭ শতাংশ দখল করে রেখেছে। যদিও নীট রপ্তানি আয় হিসাব করলে ( অর্থাৎ আমদানিকৃত কাঁচামালের অংশ বাদ দিলে) এটি হ্রাস পেয়ে দাড়াবে সবনিম্ন ৩০ শতাংশের। ( যদি আমরা ধরে নেই যে মোট রপ্তানি মুল্যের ৬০ শতাংশ ব্যয়িত হয় আমদানিকৃত কাঁচামাল তথা কাপড় এবং অন্যান্য অনুষংগ দ্রব্যাদি আমদানির জন্য) তবে আমাদের দেশে একসময় প্রায় ৮০ শতাংশই ছিল আমদানিকৃত ব্যয়।
মাত্র ২০ শতাংশ মূল্য সংযোজন দিয়ে আমাদের এই পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু করা হয়েছিল। এখন ধীরে ধীরে নানা ধরনের পশ্চাদবর্তী সংযোগ শিল্প গড়ে উঠেছে। ফলে অনুমান করা হয় যে বর্তমানে গড়ে মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৬০ শতাংশ পুনরায় বাইরে চলে যায়। ২০ শতাংশ মুল্য সংযোজন দিয়ে শুরু করে ১৯৮০ থেকে ত্রিশ বছরের মধ্যে ৪০ শতাংশ মুল্য সংযোজনে পৌছানোর প্রবনতাটি নি:সন্দেহে ইতিবাচক বলে বিবেচিত হবে। পোষাক শিল্পের দুটি শাখা রয়েছে ওভেন শাখা ও নীট শাখা। নীট শাখায় প্রযোজনীয় কাঁচামাল অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের হওয়ায় সেই কাপড় ক্রমবর্ধমান হারে দেশে তৈরি হচ্ছে এরং সেখানে তাই নীট রপ্তানির অংশ অপেক্ষাকৃত বেশি। স¤প্রতি কোটা উঠে পাওয়ার পর যেহেতু এ দেশের পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানির কাঠামো ক্রমাগত নীট শাখার দিকে ঝুঁকছে সে জন্য মোট রপ্তানিতে নীট শাখার উৎপাদনের অংশও বাড়ছে ফলে মোট রপ্তানিতে আমদানির অংশও হ্রাস পাচ্ছে।
কেউ কেউ তাই মনে করেন যে গড়ে এই মুহূর্তে হয়তো পোশাক শিল্পের মোট উৎপাদনে আমদানিকৃত কাঁচামাল বিষেশতঃ কাপড়ের/সুতার জন্য ব্যয়ের পরিমান সব মিলিয়ে ৫০ শতাংশ বা তার নীচেই নেমে গেছে। একথা সত্য হলে পোশাক শিল্পের সংযোজিত মূল্য দাঁড়াবে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ। তখন মোট রপ্তানিতে এর নীট রপ্তানির অংশ দাঁড়াবে সর্বোচ্চ ৪৬ শতাংশ! দেশের মোট রপ্তানিতে ৭৭ শতাংশ বা নীট হিসাবে ৪৬ শতাংশ কোনটিই খুব অনুল্লেখযোগ্য নয়।
বি.বি.এস. হিসাব থেকে আরো জানা যায়--
ক্স এ সব পেশায় ২০০৪ সালে মোট প্রায় ১৮ লক্ষ শ্রমিক নিয়োজিত ছিল।
ক্স এদের মধ্যে ৩৮ শতাংশ পুরুষ শ্রমিক, ৬২ শতাংশ মহিলা শ্রমিক। নিটিং কাজটি অপেক্ষাকৃত কঠিন ও ভারি কাজ বলে সেখানে অবশ্য পুরুষ শ্রমিকরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু আবার সেলাই ও এমব্রয়ডারিতে প্রায় ৮০ শতাংশই হচ্ছে মহিলা শ্রমিক। কিন্তু সব মিলিয়ে এই শিল্পে মহিলা শ্রমিকরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমশক্তি।
ক্স এই শিল্পের (মহিলা+পুরুষ) শ্রমিকদেও মধ্যে ৩৫ শতাংশের বাড়ি শহরে অর্থাৎ শহরেই তাদের স্থায়ী ঠিকানা এবং ৬৫ শতাংশের মত শ্রমিকের স্থায়ী ঠিকানা গ্রামে এবং গ্রামের সঙ্গে তাদের রয়েছে সক্রিয় যোগযোগ।
সুতরাং শহরে ও গ্রামের নিম্নবিত্ত বিশাল এক জনগগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের জন্য এই শিল্পের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
করণীয় প্রসঙ্গ উন্নত দেশগুলির ইতিহাস দেখলে দেখা যায় এগুলি প্রথমে পোশাক শিল্প দিয়ে শুরু করেছিল। দ্বিতীয় ধাপে তারা বস্ত্র শিল্প গড়ে তুলেছে। শেষে গিয়ে মেশিন ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করেছে। বাংলাদেশের সামনেও ওই একই পথ খোলা রয়েছে।
তবে এই পথে এগুনোর জন্য কতকগুলি অনুকুল নীতি সমর্খন দরকারঅ সেগুলি হচ্ছে-
ক) অনুকুল ভৌত অবকাঠামো : বন্দর রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ ইত্যাদির সুবন্দবস্ত।
খ) ব্যাংকের সুদের হার হ্রাস করে প্রতিযোগি দেশগুলির সমান করা। প্রতিযোগি দেশগুলি তাদের সমধর্মী খাতকে যে সব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে, ততটুকু অনুরুপ সুযোগ সুবিধা আমাদের সরকারকেও দিতে হবে।
গ) পোশাক শিল্পে দক্ষ শ্রমিকের অভার পূরণের জন্য উপজেলায় উপজেলায় সর্বত্র প্রশিক্ষন কেন্দ্র স্থাপন করা দরকার। এটা ছাড়া ইতোমধ্যেই এই খাতে দক্ষ শ্রমিকের যে ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়-তা আরো প্রকট হবে। তাছাড়া বর্মমান বাংলাদেশের শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা অন্য শ্যমিকদের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। সেটি পরিবর্তনের জন্যও প্রশিক্ষন ও নতুন যন্ত্রের প্রয়োজন।
ঘ) পোশাক শিল্পের জন্য আরো ইপিজেড ও প্রয়োজনীয় পৃথক জমি বা এলাকা বরাদ্দ করা দরকার।
শ্রমিক
ক) মাসিক ১৬৬২ টাকা নিম্নতম মজুরি কোনক্রমেই শ্রমিকদের জন্য গ্রহনযোগ্য ছিল না। শ্রমিকদের দাবি ছিল মাসিক ৫০০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি করা। সরকার ন্যুনতম মজুরি প্রায় দ্বিগুন বৃদ্ধি করে ৩৩২০ টাকা করেছেন। এইভাবে শিল্পখাতটি নৈরাজ্য ও ধ্বংসের হাত থেকে তখনকার মত রক্ষা পেয়েছিল। বিন্তু পুরোপুরি অসন্তোষ তখনো মিটে নাই। বর্তমানে দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকলে, বাড়ি ভাড়া বাড়তে খাকলে মালিকরা এই মজুরি দিয়ে শ্রমিকদের সন্তুষ্ট রাখতে পারবেন না। এ বিষয়ে সময়মত ব্যবস্থা না নিলে আবার শিল্পে অশান্তি ও সংকট দেখা দিতে পারে।
খ) এই অবস্থায় মালিকদের হয় মুনাফার হার কমিয়ে শ্রমিকদের উচ্চতর মজুরির ব্যবস্থা করতে হবে অথবা সরকারকে এগিয়ে এসে শ্রমিকদের জন্য সস্তাায় রেশন ও স্বল্প ভাড়ায় বাড়ির ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
গ) এই মুহুর্তে সরকারের কাছে এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকলে সরকার প্রচলিত আইন অনুসারে পোশাক শিল্পের মালিকদের মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিক কল্যান তহবিলের জন্য আদায় করে নিতে পারেন এবং সেটা দিয়ে শ্রমিকদের শুধু রেশন ও বাসস্থান নয়; উপরন্তু শিক্ষা, চিকিৎসা, ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থাও গ্রহন করতে পারেন।
ঘ) শ্রমিকদের ট্রেড-ইউনিয়ন গঠনের অধিকার বাংলাদেশে স্বীকৃত এবং অন্য শিল্পে তা আছে। এটা পোশাক শিল্পকেও দিতে হবে। এটা না দিয়ে ‘শিল্প পুলিশ” গঠন করে বা বল প্রয়োগ করে শ্রমিক দমনের মাধ্যমে এই শিল্পে শান্তি রক্ষা সম্ভব হবে না।
(ঢাবি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশের একটি লেখার অংশবিশেষ)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০১২ রাত ১২:৫৪