হাসপাতালে কেউ সুখে যায়না অ-সুখে যায় । আর এই অসুখ থেকে সারিয়ে তোলার জন্য নানা কাজ কারবার । অসুখের জীবাণু আর কারণ নির্ণয়ে রক্ত পরীক্ষা আর নির্ণয়ের পরে সুখে প্রত্যবর্তনের জন্য ঔষধ, ইন্জেকশন, স্যালাইন সঙ্গে নানা রকমের পথ্য । অবশেষে সুখে প্রত্যবর্তন, সুস্থ মানুষ হিসাবে সমাজ সংসারে সরব উপস্থিতি । এইতো হবার কথা সুখ-অসুখ চক্রের স্বাভাবিক গতিপ্রকৃতি। কিন্তু তাই কি হচ্ছে? হচ্ছে না ।
মাঝে ঢুকে পড়েছে অনেকগুলি চক্র । যারা সহজ মুনাফার এক জীবনধ্বংসী ব্যবসার খোজ পেয়েছে । মানুষের অসুখ এখানে ব্যবসার মুল উপজীব্য । এদের একটি চক্র নিয়ে এই সিরিজের প্রথম পোষ্টটিতে আলোচনা করেছিলাম । আজকে আরেকটি পর্ব নিয়ে লিখছি ।
আজ যেই চক্রটির কথা বলছি সেটির অবস্থান সুখ-অসুখের চক্রের একেবারে কেন্দ্রে । শরীরে অসুখ বাসা বাধলে সবার প্রথমে দরকার রোগ নির্ণয় আর কেবল মাত্র সঠিক রোগ নির্ণয়ের পরই চিকিৎসক সঠিক ওষুধ দিতে পারেন অসুখকে বিদায় দিয়ে রোগীকে সুখের পথে আনতে । আর এখানটিতেই চলছে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা এক নির্লজ্জ প্রতারণা । রোগ নির্ণয়ে ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে প্যাথলজি পরীক্ষার নামে চলে এই প্রতারণা ।
এই প্রতারণার অংশ চিকিৎসক, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, একশ্রেণীর মুনাফালোভী ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, মধ্যস্বত্বভোগী দালাল এবং অতি অবশ্যই আমাদের আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা । আর এই প্রতারণার সবচেয়ে বড় শিকার যথারীতি সাধারণ গরীব মানুষ যাদের কন্ঠ সবসময়েই পকেটের যোগানের স্বল্পতার কারণে অনুচ্চ এবং নিজের বা বা প্রিয়জনের সুখের আশায় পকেটের শেষ সম্বলটি দিয়েও তাদের ভাগ্যে চিকিৎসার নামে জোটে অপ-চিকিৎসা । চিকিৎসার খরচ যোগাতে সর্বস্ব খুইয়ে অনেক সময় প্রিয়জনের লাশের সৎকারের জন্যও তাদের হাত পাততে হয় অন্যদের কাছে । দেশের কিছু অভিজাত হাসপাতাল ছাড়া সর্বত্র এদের দৌরাত্ব চরমে, সেটা সরকারী হাসপাতালই হোক আর ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা বেসরকারী ক্লিনিকই হোক ।
এদের পদ্ধতি খুব সোজা । সরকারী হাসপাতালে রোগী ধরার জন্য দালাল থাকে যাকে এরা সাংকেতিকভাবে বলে মুরগী ধরা । সরকারী হাসপাতালেই প্যাথলজি পরীক্ষার নিয়ম থাকলেও হাসপাতালের কর্তাব্যক্তি ও চিকিৎসকরা কমিশন নামের চকচকে বস্তটির কাছে নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে এইসব দালালদের অবাধ বানিজ্যের সুযোগ করে দেন । হাসপাতালের প্যাথলজি পরীক্ষার ইচ্ছাকৃত সীমাবদ্ধতাকে দেখিয়ে এরা গরীব রোগীদের ফুসলিয়ে রক্ত, মল মূত্র ইত্যাদি সংগ্রহ করে চড়া মূল্যে রাখে সেইসব স্যাম্পলের প্যাথলজি পরীক্ষার জন্য । মৃত্যু-পথযাত্রী বা অসুস্থ প্রিয়জনের মুখের দিকে তাকিয়ে শেষ সম্বলটিও তুলে দেয় এইসব প্রতারকদের হাতে ।
আর বেসরকারী ক্লিনিকেতো এত ঝামেলাই নেই । সরাসরি ক্লিনিক কর্তৃপক্ষই বলে দিচ্ছে কোথায় যেতে হবে, কি পরীক্ষা করতে হবে । এর অন্যথা হবার জো নেই ।
এরপর কোন রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই মনগড়া রিপোর্ট দেয়া হয় ওইসব সরল লোকদের হাতে । বিভিন্ন খুপড়িতে বা ক্ষেত্র বিশেষ কোন বিল্ডিং এর দু-একটি কক্ষে অবস্থিত এইসব ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের অধিকাংশটিতেও পরীক্ষা চালাবার মত কোন সুবিধার অস্তিত্বও নেই । এদের আছে মনোহর প্যাড এবং কিছু ডাক্তারের সিল-ছাপ্পর । কিছু ডাক্তারও আছেন যারা নিয়মিত টাকার বিনিময়ে এইসব রিপোর্টে নির্দ্বিথায় সই করে যান । অনেক ক্ষেত্রে তারও দরকার হয়না, এরা নিজেরাই কেউ একজন ডাক্তার বনে যান ।
আর ভুল-ভালে ভরা সেইসব রিপোর্ট এর ভিত্তিতে ভুল চিকিৎসায় স্বাভাবিকভাবে পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করে । ফলশ্রুতিতে আরো টেস্ট... আরো টাকা... জমি বেচে... বসত ভিটা বেচে... তারপর আবারো সেই একই চক্র । অনেকের চোখের সামনে.. অনেকের চোখের আড়ালে চলছে এই মৃত্যু বেচার বানিজ্য ।
পুরো ব্যাপারটা বেআইনী । হা হা হা কি হাস্যকর কথা । এইখানে আইন মানার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে। অধিক মুনাফা বলে কথা !! জায়গামত মাসোহারা পৌছে যাচ্ছে... হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, ডাক্তার, ব্যবসায়ী এরা সব জানার পরও অধিক মুনাফার জন্য এই রমরমা মৃত্যু বানিজ্যের পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে । আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথা না হয় নাই বললাম । সেটা সবাই জানে । এর যে ব্যতিক্রম নেই তা নয় । কিন্তু এটি আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় একটি ক্রমবর্ধমান ক্যান্সারের মত বেড়ে চলছে । অল্প পুজিতে বেশী লাভ.. নৈতিকতা চিন্তার সময় কোথায়?
এই সুখ - অসুখের চক্রের গাতিপ্রকৃতিকে সঠিক পথে ফেরাতে আমাদের কি কিছুই করার নেই!!!
এই মৃত্যু-বানিজ্যকে রুখতে হবে। নীরবে অশ্রু ফেলা আমাদের মাটির মানুষগুলি সারা জীবন এরকম অন্যায়ের শিকার হতেই থাকবেন? কেউ শুনতে পাচ্ছেন কি!!!!
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মার্চ, ২০০৮ রাত ২:১৮