পুরো বিশ্ব যখন বিশ্বকাপের উন্মাদনায় ব্যস্ত ঠিক তখনই সুযোগবুঝে বিশ্বের একমাত্র অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল আবার শুরু করেছে ফিলিস্তিনের গাজায় নিরীহ মানুষদের ওপর বর্বরোচিত হামলা। প্রাপ্ত খবর অনুসারে ইসরাইলি হামলায় নারী,পুরুষ শিশুসহ দুইশত এরও বেশি জন মারা গেছেন আর আহত হয়েছেন হাজারেরও বেশি’ ফিলিস্তিনি।
বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত ও নির্যাতিত জাতি ফিলিস্তিনিরা । গত ২০১২ সালে হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর ইসরাইলের ফিলিস্তিনিদের উপর নতুন করে গাজায় গণহত্যা শুরু করেছে। আমাদের মুসলমানদের মধ্যে একটা প্রবণতা হলো ইসরাইল রাষ্ট্রটিকে যতটা না ঘৃণা করি তারচেয়ে বেশি ঘৃণা করি ইহুদিদেরকে, কিন্তু ইসরাইল রাষ্ট্রের সঙ্গে ইহুদি নয় বরং ইহুদিবাদের সম্পর্ক জড়িত। ইহুদি আর ইহুদিবাদ দুটো এক নয়। ইহুদি ধর্মের দু’টি শাখা আছে। একটিকে বলা হয় জায়নিজম বা ইহুদিবাদ আর অন্যটিকে বলা হয় জুডায়জম যা আদি ইহুদি ধর্মের অনুসারী। ইহুদিবাদের ইউটোপিয়ান হলো বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্ঠা। সত্যিকারভাবেই ইহুদিবাদ বলতে এক বিশেষ রক্ষণশীল ইহুদি সম্প্রদায়কে বলা হয় যারা বৃহত্তর ইসরাইর সম্পর্কে অবগত যা আজকের মিশর, জর্ডান, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন ও ফিলিস্তিন নিয়ে গঠিত হবে এবং এর বাস্তবায়ন করাকে ‘ঈশ্বরের পবিত্র দায়িত্ব’ বলে মনে করেন। অনেক ইহুদি রাব্বী বিশেষ করে যারা জুডায়জমের অনুসারীরা মনে করেন না এই তত্ত্ব ইহুদি ধর্মের কোন অংশ বরং তারা ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধী ও ইসরাইলের ধ্বংস কামনা করেণ। World without Zionism শিরোনামে ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ ২০০৫ ও ২০১০ সালে পরপর দু’টি সেমিনারের আয়োজন করেছিলেন যে সেমিনারে মূল বক্তা ছিলেন জুডায়জমের অনুসারী ইহুদি রাব্বীগণ!
ইহুদিবাদ তত্ত্বের তাত্ত্বিক ও দার্শনিক হলেন থিওডোর হার্জেল। ১৮৯৬ সালে তিনি The Jewish state নামে একটা বই লেখেন এবং তিনি ঘোষণা দেন যে, The cure for anti-semitism was the establishment of a Jewish state. As he saw it, the best place to establish this state was in Palestine.এই তত্ত্বের মূল লক্ষ্য ঈশ্বরের রাজ্য প্রতিষ্ঠা, আধ্যাত্মিক বা নিছক ধর্মীয় উপদেশ প্রদানের মাধ্যমে নয়, বরং সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের পথে প্রথম পদক্ষেপ হলো বিশ্বের ইহুদিসমূহকে একত্র করা যা শুরু হয়েছিল সেই বেলফোর ডিক্লারেশনের মাধ্যমে ১৯১৭ সালে। বেলফোর ডিক্লারেশনের পর থেকে সারা বিশ্বের ইহুদিরা জড়ো হতে শুরু করে ফিলিস্তিনে। ১৯০৫ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা ছিল মাত্র কয়েক হাজার। ১৯৪৮ সালে সেখানে ইহুদীদের সংখ্যা ৬ লাখে উন্নীত হয়। সেই যে শুরু ইসরাইলের ফিলিস্তিনি ভূমি দখল, অবৈধ বসতি স্থাপনের কাজ তা এখন পর্যন্ত জোর গতিতে এগিয়ে চলেছে। এক মুহূর্তের জন্য থেমে নেই ইসরাইলের সম্প্রসারণবাদী নীতি। ইসরাইলের প্রচুর জমি দরকার কারণ ইসরাইল বিশ্বের সমগ্র ইহুদীদের নিজ নাগরিক মনে করে। তারা মনে করে একদিন বিশ্বের সমগ্র ইহুদী সম্প্রদায় একত্রিত হবে আর প্রতিষ্ঠা করবে বৃহত্তর ইসরাইল রাষ্ট্র। এরকম ভাবনা বিশ্বের আর দ্বিতীয় কোন নজীর নেই।
আপনি যদি ইহুদী হন তাহলে আজই ইসরাইলের সাথে যোগাযোগ করুন। আপনার সমস্ত খরচ ইসরাইল রাষ্ট্রয়ভাবে বহন করে ঐ ইহুদী রাষ্ট্রটিতে আপনাকে নিয়ে যাবে এবং আপনি পাবেন ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করা কোনো এক বাড়ি। আর থাকা, খাওয়া ও জীবিকা অর্জনের সব ব্যবস্থা তো আছেই!
৬৬ বছর ধরে ফিলিস্তিনিরা নিজ বসতি ভিটা ছেড়ে শরণার্থী হয়ে আছে এবং এখনও হচ্ছে! আর ১৯৪৮ সালের আগে ইসরাইল নামে কোনো রাষ্ট্র পৃথিবীতে ছিল না! উড়ে এসে জুড়ে বসার মত ব্যাপারটা। ধরুণ, আপনি নিজ বাড়িতে বসবাস করেন। একদিন অচেনা অজানা একদল লোক এসে বলল, আজকেই আপনার বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে! এখন থেকে এ বাড়ি আমাদের। ফিলিস্তিনে এটা ঘটছে।
ফিলিস্তিনিদের ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া একটা নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার এমনকি ইসরাইলী কারাগার থেকে ফিলিস্তিনি নেতারাও রক্ষা পান না, স্পিকার, মন্ত্রী এমপিসহ যে কোনো রাজনৈতিক নেতাকে ইচ্ছে করলেই ইসরাইল ধরে নিয়ে যায় আর তাদের খোঁজ পাওয়া যায় না। এমনি একজন ফিলিস্তিনি ফাতাহ নেতা মারওয়ান বারঘুতি কয়েকযুগ থেকে ইসরাইলী কারাগারে। ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনিদের গুম, হত্যা, খুন যেন নিত্যসঙ্গী!
হিটলারকে যেভাবে ইহুদি হত্যাযজ্ঞের মূল নায়ক বলে প্রচার করা হয় আমার মনে হয় আসলে ঘটনা মোটেও তেমন নয়। হিটলার ইহুদিদের হত্যা করেনি এটা আমি বলছি না, বরং বলছি যেভাবে ঘটনাটা ফুলে ফেঁপে প্রচার করা হয় সেভাবে কি আদৌ ঘটেছিল? এটাও তো হতে পারে ইউরোপ ইহুদি মুক্ত হতে চেয়েছিল তাই এই ঘটনাকে এমনভাবে প্রচার করে যাতে সব ইহুদি ইউরোপ ছেড়ে পালায়! আদতে হয়েছেও তাই! ইহুদিরা দলে দলে পর্যায়ক্রমে ইউরোপ ছেড়ে ফিলিস্তিনে চলে যায়। ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরাইলের বর্বরতার কারণে হিটলারের ইহুদি নিধনের ঘটনাকে অনেকেই ফুলে ফেঁপে প্রচার করেন। আবার অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্রের যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে যেয়ে পুরো পশ্চিমা মিডিয়া ও ইউরোপ, আমেরিকা হিটলার কর্তৃক ইহুদি নিধনকে অজুহাত হিসাবে তুলে ধরেন। সেই দিক দিয়েও এই ঘটনাটা নতুন মাত্রা পেয়েছে। আর সারা বিশ্বের ইহুদি মিডিয়া ও ইহুদিবাদিরাও হিটলারের ইহুদি নিধন তথা হলোকাস্টকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাদের নির্যাতনের বৈধতা হিসাবে তুলে ধরেন। মানে দাঁড়ালো, হলোকাস্ট যদি সত্য হয়েও থাকে তার জন্য দায়ী জার্মান তথা ইউরোপিয়ানরা, সো প্রায়শ্চিত্ত করা উচিৎ তাদের, কিন্তু না ইউরোপিয়দের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করে যাচ্ছেই সে যুগের পর যুগ ধরে নিরীহ ফিলিস্তিনিরা! তারপরেও আমার প্রশ্ন হলো, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় ছয় কোটিরও বেশী মানুষ নিহত হয়েছিল, এই ছয় কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় বিশ লক্ষ লোক ছিল সেনা বা সামরিক বাহিনীর সদস্য। আর বাদবাকী সবাই ছিল বেসামরিক নাগরিক। এরা ছিল সাধারণ নাগরিক এবং যুদ্ধে তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। এই পৌনে ছয় কোটি মানুষকে বিভিন্ন পন্থায় হত্যা করা হয়েছে। তাই এরা সবাই সম্মান পাবার যোগ্য। কিন্তু কেন একটি বিশেষ শ্রেণীর প্রতি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে? দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো- যদি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে কেন নিরপেক্ষ গ্রুপগুলোকে ঐ বিষয়ে গবেষণা করতে দেয়া হচ্ছে না? কেন ইউরোপের নাগরিকদেরকে নিজ সরকারের মতের বিরোধী বক্তব্য রাখার দায়ে শাস্তি ও কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়? যেমন রগার গারুদী, রবার্ট ফাওরিসনসহ আরো অনেক গবেষকগণকে হলোকাস্ট নিয়ে রিসার্চ বা অস্বীকার করার কারণে কারাদণ্ড এবং জরিমানা প্রদান করতে হয়েছে! আর মূল যে প্রশ্নটি কেউ করছে না তা হলো, হলোকাস্টের ঐ ঘটনা যদি ইউরোপে ঘটে থাকে তাহলে ফিলিস্তিনের জনগণকে কেন এজন্যে ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে? ফিলিস্তিনের জনগণ কি অপরাধ করেছে? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে তো তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না, তবুও কেন ঐ ঘটনার অজুহাতে ৭০ লক্ষেরও বেশী ফিলিস্তিনিকে শরণার্থীতে পরিণত করা হলো এবং ৬৬ বছর ধরে তারা শরণার্থীর জীবন যাপন করছে?
আজকের যারা ফিলিস্তিনি তারা সেই চার হাজার বছরের আগে থেকেই সেখানকার অধিবাসী। গবেষণা করে এ কথা প্রমান করেছেন খোদ তেলআবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক শোলমো স্যান্ড। তিনি দেখিয়েছেন আজকের হিব্রু জাতির বর্তমান বংশধর যদি থেকে থাকেন তা হলো ফিলিস্তিনের বর্তমান মুসলিম ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়। আর আজকের ইসরাইলের ইহুদীরা তো এসেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এ কথা আগেই বলা হয়েছে। তারপরেও এই সব হাস্যকর যুক্তি কোন বিবেকবোধ সম্পন্ন মানুষ বিশ্বাস করতে পারে না। যদি তা মেনে নেই তাহলে বর্তমানের আমেরিকার উচিৎ রেড ইন্ডিয়ানদের আমেরিকা ছেড়ে দিয়ে তাদের পূর্বভুমি ইউরোপে চলে আসা। অস্ট্রেলিয়ারও উচিৎ তাদের আদিবাসীদের কাছে তাদের ভূমি ফিরিয়ে দিয়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে বিদায় নেয়া। ব্রিটেন, নিউজিল্যান্ড এরা বর্তমানে দখলকৃত সব ভূমি ফিরিয়ে দিক মাওরিদের কাছে। এরপরে আরো ইতিহাস আছে। ইহুদীদের জন্য যখন রাষ্ট্র খোঁজা হয় শুরুতে তখন ফিলিস্তিনের কথা বিবেচনায় আনা হয়নি। প্রথমে ইহুদীরা ব্রিটিশদের কাছে দাবি করেছিল উগান্ডা বা আর্জেন্টিনায় তাদের জন্য আলাদা একটা বাসস্থানের জন্য কিন্তু তা কোন কারণে প্রত্যাখ্যাত হয়। তৎকালীন তুর্কি সুলতান আব্দুল হামিদের কাছে জায়নিস্টরা আবেদন করেছিল তুর্কি সুলতানের কাছ থেকে কিছু জমি কিনে ইহুদী রাষ্ট্র পত্তন করার জন্য কিন্তু সুলতান জবাব দিয়েছিলেন, ‘ইহুদীদের এক ইঞ্চ ভূমিও দেয়া হবে না।’
প্রায় ৭০ লাখের মত ফিলিস্তিনি পার্শ্ববর্তী আরবদেশগুলোতে সেই ৬৬ বছর ধরে শরণার্থী জীবন যাপন করছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। ইরান-সিরিয়া বাদে আরবরা যেমন ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য বিপর্যয়ে ঘুমে আচ্ছন্ন, শুধু আচ্ছন্ন নয় আরব রাজা বাদশাহরা ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে ব্যস্ত কিভাবে ক্ষমতায় দীর্ঘদিন টিকে থাকা যায় তেমনি বিশ্ব বিবেক এখানে চুপ!#
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১২:৩২