অনেক কায়দা করে বারান্দার রেলিং বেয়ে দেলু উপরে। আজকালের বাড়িগুলোর এইটা একটা বাড়তি সুবিধা, বারান্দায় গ্রীল লাগায় না। আর ঘরে ঢোকার জন্য স্লাইডিং ডোর। আহা, আরাম আর আরাম! হালকা একটা চাপ দিয়ে দেলু নিশ্চিত হল গ্লাস লক নাই। পুরো গ্লাস অবশ্য ভারী পরদা দিয়ে। ভিতরে খুব আবছা একটুখানি আলো। ডিম লাইট জ্বালানো! তা জ্বালাইতেই। নয়া দম্পতির শোয়ার ঘর যখন। এ কথাটা মনে হতেই লোভীর মত দেলু জিভ। তবে এরা দুইজন ঘুমিয়ে থাকলেই ওর সুবিধা।
নিচু হয়ে বসে দেলু সাবধানে হালকাভাবে ঠেলে ঠেলে গ্লাসটা আধা ফুট। কাত হয়ে নিজের দেহটা ঢুকাতে এর বেশি দরকার নাই তার। এটা হল মাস্টার বেডরুম। দেলুর মুখ দিয়ে অস্ফুটে বের হয়ে আসে শব্দটা "শালার বড়লোক!" কিন্তু সাথে সাথেই নিজের কাল, প্রায় উলঙ্গ দেহটা মিশিয়ে পরদার জংলা প্রিন্টের সাথে। বিশাল কিং খাটে জড়াজড়ি করে শুয়ে বউটা বিড়ালের বাচ্চার মত কিঁউ কিঁউ করে উঠে বেশ একটা মোড়ামুড়ি। অন্ধকারে দেলুর ঠোঁট বেঁকে যায়। "বেটি ভাবছে হেতির জামাই বুঝি কোন আল্লাদের কথা কইচে! খিক, খিক..." আরো মিনিট দশেক অপেক্ষা করে দেলু। বিছানার উপরের হুসহুস ফোঁস ফোঁস খচর মচর বন্ধ হতে হতে পুরো ঘরে চোখ। দেলুর বস্তির চারটা ছাপড়ার সমান হবে পুরো ঘরের আয়তন। ঘরের মাঝখানে ফুটবল মাঠের সমান একটা বিছানা, এক লাইনে বিশাল স্টিলের আলমারি, তার পাশে টিভি, ডিভিডি প্লেয়ার, আরেক দিকে দেয়ালজোড়া ওয়ার্ডড্রোব, ড্রেসিং টেবিল, ড্রেসিং টেবিলের উপরে রাজ্যের কসমেটিকস। এর মধ্য থেকে তিনটা বোতল সরাতে পারলেই হাজার ছয়েক টাকার মামলা, দেলু জানে। সমস্যা হল ড্রেসিং টেবিল খাটের ওইপাশে। বউটা যেমন বিলাইয়ের মত কিঁউ কিঁউ শুরু বাতাসের সাথেই, স্টিলের আলমারি খোলার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু খোদেজা বুয়া বলছিল স্টিলের আলমারির মধ্যেই সব সোনার গয়না। কি আর করা! তারচেয়ে ড্রেসিং টেবিল সাফা করা হোক, সেটা ভাল বুদ্ধি। দেলু হামাগুড়ি দিয়ে খাটের দিকে। ফর্সা, ধবধবে টাইলস বিছানো মেঝেতে। দেলুর কুচকুচে দেহটা এত সুন্দর ফুটে উঠেছে, কল্পনার বাইরে! খাটের তল দিয়ে ওইপাশে যাওয়াটা সবচেয়ে সহজ। বিছানার একদম ছায়ায় আসতেই বিলাইটা আবার কুঁউউ করে! "এ্যাঁইইই শোনো না........" জামাই বেচারাও সাড়া দেয় কোনরকম "উঁ!" তারপরে কি কি জানি সব ফিসফাস। এইসব দেলু ভালই বোঝে। কিন্তু এখন কেন? "শালী আর টাইম পাইল না!" হঠাৎ করে জামাইটা বলে উঠল, "একটু ওয়েট কর বেবি, আমি ওয়াশরুম থেকে।" ব্যাটা উঠে গেল বাথরুমে আর বিলাইটা বিছানায় উল্টা হয়ে শুয়ে কুঁ কুঁ করতে।
এই সুযোগ.......এক গড়ানে দেলু চলে গেল ঘরের দরজার কাছে। নি:শব্দে দরজা খোলার অভ্যাস আছে ওর। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে ওই ঘর থেকে বেরিয়ে। মোটামুটি মাঝে দাঁড়িয়ে দেলু বোঝে এটা হল খাওয়ার ঘর। বাহির থেকে আসা আবছা অন্ধকারে হাতড়ে ডানের দিকে একটা ঘর, ভিতর থেকে বন্ধ। সাথে নিয়ে আসা তারটা দিয়ে কারিকুরি করতেই তালাটা খুলে। ছোটবোনটার রুম এটা। দেলু আশা করেছিল এ হয়তো ঘুমায়। কিসের কি! টেবিলের ওপর ল্যাপটপ খুলে রেখে গভীর মনোযোগে ওটার ওপর উপুড় হয়ে। ঘরে ওই নীলাভ আলো ছাড়া আর কোন আলো নাই। ড্রেসিং টেবিল, সিডি র্যাক...সবই মেয়ের চোখের সামনে। দেলুর নি:শব্দে কিছু গায়েব করার উপায়।
আলমারিটা উল্টা দিকে হলেও এখন খোলাতো খুবই রিস্কি। একটা যদি শব্দ কোনরকমে! দেলু অনেকক্ষণ চুপ করে বসে। মেয়েটা ল্যাপটপে খটর খটর, খুটুস খাটুস করেই। আবার নিজের মনেই দুলে দুলে হাসে, কথাও বলে। ভেবে পায় না দেলু কি করবে। জুলজুল চোখে মেয়েটার বাঁকানো কোমড়, পিঠ, বুকের আবছা ভাঁজ দেখে। তারপরে আলমারির গায়ে হেলান দিয়ে কতক্ষণ।
হি হি হি হাসির শব্দে আবার তন্দ্রা ছুটে। চোখ কচলে এদিক ওদিক। মেয়েটা বসে এখনো। কত সময় গেছে কে জানে! দেলু হাতের গামছাটা শক্ত করে ধরে সামনে। ইচ্ছা শক্ত করে মেয়ের মুখ বেঁধে ঘরের সব নিয়ে পালাবে, নিদেনপক্ষে ল্যাপটপ। কিন্তু পিছনে দাঁড়াতেই দেলুর ছায়া ল্যাপটপের ঝকঝকে মনিটরে। ভূতের মত আরেকটা মাথা পিছনে গজাতেই মেয়েটা প্রায় আঁআআ করে, তবে অতটা জোরে না। দেলু খুব সতর্ক। মেয়েটা ঝট করে মাথা ঘোরানোর আগেই একটা ডাইভ দিয়ে খাটের তলায়। মেয়ে রিভলভিং চেয়ার ঘুরিয়েই এদিক ওদিক পুরো ঘর ভালভাবে নিরীক্ষণ। বিছানার তলায় ঢোকার আগেই দেলু কোনায় মোবাইলটা দেখেছিল। ভেবেছিল হাত বাড়িয়ে ওটা অন্তত। কিন্তু তার আগেই মোবাইল মেয়েটার দখলে। সে কাকে ফোন করে নাকি গলায় বলতে শুরু, "এ্যাঁই জানো না কিঁ কাঁন্ড! ল্যাপিতে কাজ করছি, হঁঠাৎ দেখি মনিটরে কার যেন মাঁথা। উহ মাগো, কি ভয়টাই না....."
"যাহ দুঁষ্টু, তুমি কোঁত্থেকে আঁসবে এখন?"
"হিঁ হিঁ হিঁ" সারা শরীর দুলিয়ে মেয়েটা হাসে।
"আচ্ছা সোঁনা, আর রাত জাগবো না। এঁক্ষুণি ঘুমু। উমমমম"
এ বাড়ির সবাই কি এমন শাকচুন্নি নাকি! দেলু ভেবে পায় না। মোবাইলে যাকেই বলুক, ঘুমুর কোন লক্ষণ মেয়েটার মধ্যে দেখা। দেলু বোঝে না আর কতক্ষণ খাটের নিচে শুয়ে। দুয়েকটা তেলাপোকা সুড়সুড় করে গায়ে উঠানামা শুরু। দেলু নড়তেও পারে না। কতক্ষণ দেলু জানে না, বসার ঘরের ঘড়িতে ঢং ঢং করে তিনটা ঘন্টা। আরো বেশ কিছুক্ষণ পরে মেয়েটা আড়মোড়া ভেঙে উঠে। তারপর বাথরুমের দিকে এগোতেই দেলু পড়িমরি করে ঘর থেকে বেরিয়ে।
ড্রইং রুমের সোফার কোণায় রাখা ঘড়িতে তখন সাড়ে তিনটা। দেলু জানে উল্টোদিকের ঘরটা ছোট ভাইয়ের। খোদেজা বুয়া ওভাবেই খোঁজ। আর বেরুনোর মুখে ছোট্ট ঘরটা তাদের বুড়ো বাপের। দেলু ভাইয়ের ঘরের দিকে। ভাগ্য ভালই দরজাটা কেবলই ভেজানো। একটু ঠেলা দিতেই খুলে গেল। ছেলেটা বিছানার ওপর পিছ ফিরে বসে। সামনে আবছা আলো, নির্ঘাত ল্যাপটপ জ্বলছে। সারা শরীর কালবৈশাখী ঝড়ে ঢ্যাঙা তালগাছের মত কাঁপছে। আর মুখে হিসহিস একটা। মুখ গোল, চোখ বড় করে দেলু কতক্ষণ হা করে তাকিয়ে। ওই ঘরে ঢোকা বা সেখান থেকে কিছু সরানোর কথা ভাবনাতেই আসে না। বাইরে দাঁড়িয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে দেলু খিক খিক। "বেক্কল, দরজাডা তালাতো দিবি আগে!"
দেয়ালে হেলান দিয়ে একটু বিশ্রাম কিছুক্ষণ। চারটার ঘন্টা পড়ল। সারারাত পার হয়ে গেল, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হল না। চোখে এখন ঘুম ঢুলুঢুলু। ভাবছে ড্রয়িং রুমের দু-একটা শো-পিসই। অমনি বাইরে ফজরের আজান। শোকেসের দিকে দেলু গুড়ি গুড়ি পায়ে এগুতে শুরু। তখনি গেস্টরুমের দরজা খুলে বুড়ো লোকটা বেরিয়ে। আহ্ আমাদের দেলুয়ার হোসেন দেলুতো এঁকে হিসাবের বাইরেই। তিনি উঠলেন, বসার ঘর লাগোয়া বাথরুমে মহা সমারোহে প্রাত:কৃত্য করতে শুরু। দেলু কতক্ষণ অপেক্ষা করবে! ভোরের আলো ইতোমধ্যেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু।
হাতের কাছে সাইড টেবিলে সাজানো একটা মাটির ছোট্ট হাতি। দেলু হাতিটাই হাতের তেলোয় পুরে। বুড়ো ভদ্রলোকের সাথে বেরুনো ছাড়া গতি নাই। আর সবদিকে দরজা-কপাট বন্ধ।
শুভ্র পাঞ্জাবী পরা সৌম্য ভদ্রলোকের পিছন পিছন ছায়ার মত দেলু এ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে। চোখে ছানি বলে ভোরের আবছা আলোয় ভদ্রলোক দেলুর ছায়া খেয়াল করেন না। দেলু দেয়ালে মিশে। তিনি গুড়গুড় করে লিফটে উঠে যেতেই দেলু এক দৌড়ে নিচের তলায় নেমে লিফটের বোতামে কল। তারপর গম্ভীর মুখে বুড়োটার সাথে লিফটে দাঁড়িয়ে। বুড়ো জানতে চায়, "কোন তলার তুমি? আগে দেখি নাই!"
দেলু গলা ভারী করে জবাব, "জ্বে, বেড়াইতে আসছি।"
"নামাজে যাও বুঝি বাবা?"
"জ্বে!"
"ভাল। ভাল! আমার ছেলেদেরতো শেখাতে পারলাম না।" বুড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতেই লিফট নিচে পৌঁছে। দেলু বুড়োর ছায়ায় ছায়ায় গেট পার হয়ে। দারোয়ান তাই কিছু বলে না।
রাস্তায় নেমে দেলু রাগে দাঁত কড়মড়। খোদেজা বুয়া বাড়ির কোন কানাচে কি আছে, কয়টা ঘর, কয়টা মানুষ...সব কইল, খালি কইল না এরা কেউ রাইতে ঘুমায় না। এইটা একটা!
.......................................................................................
প্রিয় পাঠক, গল্পের শুরুতেই আপনাদের বেশ খটকা লাগবে। কি যেন নেই, কি যেন নেই। তবে কিছুদূর গেলেই বুঝতে পারবেন লেখক ভুলক্রমে বাদ দিয়েছেন বেশিরভাগ ক্রিয়াপদ। জ্বী পাঠক, ক্রিয়াপদ বাদ পড়েছে। তবে ভুলক্রমে নয়, ইচ্ছাকৃতভাবেই। বহুদিন আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি বই 'মায়াকাননের ফুল' এ তাঁর এই ইচ্ছাকৃত পরীক্ষণটি দেখে আমারও লোভ জাগল 'দেখিই না করে, কেমন হয়!'
পাঠের অস্বাচ্ছন্দ্যের জন্য আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।
একটি ইনসমনিয়াক্রান্ত ব্যর্থ চুরি
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৫৫টি মন্তব্য ৫৫টি উত্তর
পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন
আলোচিত ব্লগ
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!
সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন
কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী
ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন