ইউনিভার্সিটির শেষ পরীক্ষাটা দিয়ে এলাম গতকাল। খুব যে ভাল হয়েছে তা বলতে পারছি না। ফার্স্টক্লাস তো গেছেই, সেকেন্ড ক্লাসই থাকে কি না তাই ভাবছি। হঠাৎ করেই মা অসুস্থ হয়ে গেল পরীক্ষার মাঝামাঝি এসে। তাকে নিয়ে টেনসন, হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি, খরচ যোগাড়। ভাগ্য আমার সাথে বরাবর এরকম সব তামাশা করে গেছে। এসএসসি পরীক্ষার মাঝে এসে বাবার চাকরি থেকে ছাটাই হয়ে গেল, হাতে টাকা-পয়সা নেই, ওর মধ্যেই ছেড়ে দিতে হল বাড়ি, ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় বাবা হার্ট এ্যাটাক করে বসল; আমার এত ভাল প্রিপারেসনের পরীক্ষা তখন খিচুড়ি পাকিয়ে গেল। ইন্টারমিডিয়েটে পড়লাম নিজের খরচে, টিউশনি করে। বাবা আর তেমন কোন চাকরি যোগাড় করতে পারে নি, কোনরকম এদিক ওদিক করে সংসারের খরচ চালানো হতো। বহু সংগ্রাম করে দুই বছর পার করলাম, ভাবলাম পড়ালেখা ছাড়া আর কি আছে জীবনে, পরীক্ষাটা ভালভাবে দেই। কিন্তু সেসব তো আর আমার ভাগ্যে নাই। এইচএসসি পরীক্ষার এক মাস আগে মারা গেল বাবা। ওই অবস্থাতেই পরীক্ষা দিলাম। রেজাল্ট কেমন হল বলাই বাহুল্য। আমার ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ার স্বপ্ন ধূলায় মিশে গেল। ভার্সিটির সাধারণ একটা সাবজেক্টে ভর্তি হলাম। নিজের খরচের সাথে সংসারের খরচও চালাতে হল এরমধ্যেই। আর এই শেষ মূহুর্তে এসে মা এইরকম একটা বিট্রে করে বসল! এই হল আমার কপাল!
লোকটা নাকি আমার বাবার বন্ধু ছিল। একসাথে পড়ালেখা করেছে। সে কিভাবে এত অল্প সময়ের মধ্যে মসৃণগতিতে লিমুসিন চালানো শুরু করল, আর আমার বাবা সেই আদ্যিকালের লক্কর ঝক্কর সুজুকি নিয়ে মাঝপথে এইরকম হার্ড ব্রেক কিভাবে করল এই হিসাবই আমি মিলাতে পারি না। এতক্ষণ বসিয়ে রাখল, সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। এই রাস্তাটা বেশ রিস্কি, এতগুলো টাকা নিয়ে যাওয়া। এতগুলো টাকা! এত টাকা আমি জীবনে একসাথে দেখিনি। কত কি করা যায় টাকাগুলো দিয়ে। জীবনটাকেই বদলে ফেলা যায়। ইস, যদি মা'র অপারেশনটা না করা লাগতো! টাকাগুলো নিয়ে আমি আর মা কোথাও চলে যেতে পারতাম! টাকা ফেরত দেয়ার চিন্তা কে করে!
মনে ফুরফুরে একটা ভাব আনতে শিষ দেয়ার চেষ্টা করছি, কিন্তু কেমন যেন ফ্যাসফ্যাসে শব্দ বেরুচ্ছে। সামনে আধা অন্ধকার নির্জন একটা রাস্তা। দুইদিকে গুচ্ছের ঝোপঝাড়। চোর-ডাকাতের ভয়ের সাথে কেমন একটা ভূতের ভয় যোগ হল এখন। জোরে পা চালালাম। হঠাৎ করেই নিজের পায়ের শব্দ ছাড়াও বাড়তি একজোড়া পায়ের শব্দ পেলাম। কে রে? কে! কে জানে। পথটুকু পার হতে পারলেই বাঁচি।
কিন্তু আমার বাঁচা হল না। কে যেন হ্যাঁচকা টানে আমাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল একটা ঝোপের মাঝখানে। কাঁটার ঘষায় ছড়ে গেল মুখে-হাতে। চোখে অন্ধকার সয়ে আসতে সামনে তাকিয়ে দেখি আমারই মত একটা অবয়ব। পার্থক্য শুধু একটাই, তার হাতে একটা পিস্তল। সে উত্তেজনায় কাঁপছে, গলা দিয়ে ঘড়ঘড় শব্দ বেরুলো, 'যা আছে বাইর কর। শিগগির দে, শিগগির.....'। শিগগির...শিগগির...ভঙ্গিটা খুব পরিচিত লাগছে। খুব কাছাকাছি সময়ে কোথাও শুনেছিলাম নাকি! মনে পড়ছে না, লোকটার পিস্তল নাচানো দেখে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। ব্যাটা পাঁড় মাতাল মনে হচ্ছে, কখন বেখেয়ালে গুলি বের হয়ে যায় কে জানে! লোকটাকে সিরিয়াস মনে হচ্ছে বেশ। এইসব মাতাল-টাতালকে বিশ্বাস কি! দেখা যাবে খামোখাই মজা করার জন্য গুলি করে দিল। কি করবো!
টাকাটা যদি দিয়ে দেই তাহলে দুইদিন বাদে মা'র অপারেশন করা সম্ভব না। আর না দিলেতো মনে হচ্ছে নিজেকেই শহীদ হয়ে যেতে হবে। আমি সময় কাটানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। গলা যতটা পারা যায় করুণ করে বললাম, 'ভাই, আমি সাধারণ এক ছাত্র। আমার কাছেতো কিছু নাই।' কিন্তু তার যে বিশ্বাস হবে না এটাই স্বাভাবিক। সে আরো জোরে পিস্তলের ঝাকি মেরে চিৎকার করে উঠল, 'চোওওওপ। কথা কম। তুই যে কাতলা মাছটার কাছে খামাখা যাস নাই, এইডা জানি ভাল কইরাই। দিয়া দে, জানে বাঁচতে চাইলে দিয়া দে যত বাগাইছোস।' আমি গলাটাকে আরো করুণ, প্রায় কান্না কান্না করে তুলি, 'ভাই বিশ্বাস করেন। চাচা আমাকে একটা টাকাও দেয় নাই। ব্যাটা একটা কঞ্জুস।' কথাটা উচ্চারণ করতে পেরে খুব শান্তি লাগল। কতবার যে মনে মনে বলেছি, উচ্চারণ করার সাহস পাইনি। কিন্তু লাভ হল না, সামনে দাঁড়ানো এলো চুলের, টলায়মান ভদ্রলোকের মন গলাতে পারলাম না। জড়ানো গলায় হড়হড় করে আরো কি কি যেন সব বলতে লাগল, তারমধ্যে শিগগির কথাটাই আমি ধরতে পারলাম কেবল। শিগগির...শিগগির...শিগগির পালানোর একটা উপায় বের করা লাগে।
'আমার মা অসুস্থ ভাই। আমি ছাড়া তার আর কেউ নাই। আমাকে যাইতে দ্যান, প্লীজ।'
'কথা কম...কথা কম...'
কথা বেশি বলতে আমারও ভাল লাগে না। কিন্তু কি করি! অসহায় চোখে চারদিক দেখছি। অন্ধকার আরো ঘুটঘুটে হয়েছে, কিছু দেখাও যায় না। হঠাৎ শুনি পিস্তলধারী ভদ্রলোক কি যেন সব বিড়বিড় করছে। কানটা একটু এগিয়ে দিলাম শোনার জন্য। 'ছাত্র! ছাত্র আমি ছিলাম না? কি হইসে তাতে!' বলতে বলতেই পিস্তলটায় আরেকটা ঝাকি। ভয় না পেয়ে উপায় কি? 'ভাই আমি অসহায়। বাবা নাই আমার, মা-ই সব। আমাকে ছাইড়া দ্যান ভাই।' হা হা...নিজের অভিনয়ে নিজেই মুগ্ধ আমি। কিন্তু ব্যাটার মন গলানো শক্ত হয়ে যাচ্ছে। 'মা! আমার মা নাই। সে আমারে ত্যাগ করছে। আর কারো মা থাকা লাগবে না...' আহা, বেচারার জীবনটা বেশ করুণ মনে হচ্ছে। যে কোন মূহুর্তে আমার জীবন নিয়ে নিতে পারে, তবু সামনের লোকটার জন্য আমার বেশ মায়াই লাগছে। কিন্তু কথা হচ্ছে মায়া দিয়েতো চিড়া ভিজবে না। কি করি! কি করি!
আকাশ-পাতাল ভাবছি, অবলোকন করছি...এমন সময় শুনি লোকটা আউ করে এক বিকট লাফ দিয়েছে। কিরে, কি হল রে? পাগলের মত হাত ঝাড়ি দিচ্ছে সে পিস্তলটা ফেলে দেয়ার চেষ্টায়, কিন্তু পারছে না। একটু চোখ কুঁচকে তাকাতেই শিউড়ে উঠলাম। পিঁপড়া! এই বিশাল সব লাল পিঁপড়া। ঝোপের ভিতর থেকে সারি সারি বের হয়ে এসে লোকটাকে আক্রমণ করেছে। উঠছে পা বেয়ে, তারপর পিস্তলে, সেখান থেকে হাতে। ওহ খোদা! পিঁপড়াগুলো দেখি পিস্তলটা অর্ধেক খেয়ে ফেলেছে। এখন লোকটাকেও খাওয়া শুরু করল। পালানো দরকার, এইরকম দৈত্যের মত পিঁপড়া দেখাতো দূরে থাক, শুনিওনি কোনদিন। কিন্তু কেমন যেন সম্মোহিতের মত লাগছে। পা নাড়াতে পারছি না। ওদের প্রতি কিছুটা হলেও কৃতজ্ঞ বোধ করছি যদিও। ভয়ংকর মাতালটার হাতে টাকাগুলো তুলে দিতে হচ্ছে না। আমার মা'র অপারেশনটা হবে তাহলে।
মাথায় বিদ্যুৎ চমকের মত চিন্তাটা খেলে গেল। আমাকে সাহায্য করতেই এই গায়েবী সাহায্য পাঠানো হয়েছে। যদিও আমি জীবনে এমন কোন পূণ্য করিনি যে গায়েবী সাহায্য পাবো। সম্ভবত আমার মায়ের পূণ্যের জোর। আর টাকাটা কিংবা আমার বেঁচে থাকা তো মা'র জন্যই বেশি দরকার। কথাটা মনে হতেই বেশ রিলাক্স হয়ে গেলাম। ফ্যাসফ্যাসে গলায় শীষ বাজাতে লাগলাম আবার। সাথে ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে পিস্তলবাজের আর্তনাদ। অসাধারণ একটা রিমিক্স হয়েছে কিন্তু। আয়েশ করে দেখছি লোকটার নর্তন-কুর্দন, ব্যাপক বিনোদন! আজব ব্যাপার, আধাঘন্টাও লাগেনি বোধহয়, রাক্ষুসী পিঁপড়ার দল ব্যাটাকে সাবাড় করে ফেলল। এখন ওখানে পড়ে আছে কতগুলো সাদা হাড়গোড়। চোখ সরু করে দেখছি আমি। হঠাৎ দেখি পিঁপড়াগুলা সব একসাথে ঘুরে তাকিয়েছে আমার দিকে, না ঠিক আমার দিকে না...যে পকেটে টাকাটা লুকানো আছে সেইদিকে। বাপরে, এরা কি টাকাটা চায় নাকি! না আমাকেও?
যত গায়েবী ফিলিংস সব মাথায় উঠল। এক ঝটকায় ইউ টার্ন নিয়ে ছুটতে শুরু করলাম। টের পাচ্ছি পিছনে পিঁপড়ার দল শনশন শব্দে ঝোপঝাড় ভেঙে এগুচ্ছে। 'না, আমাকে না...আমাকে না...আমার মা বসে আছে আমার জন্য অপেক্ষায়। আমার কাছে পিস্তল নাই।' দৌড়ের বেগে ফোসফোস নি:শ্বাসের সাথে কথাগুলো বের হয়ে আসছে। কি যে বলছি আমি নিজেই জানি না। একবার মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি, এমন কিছু কি ঘটা সম্ভব কখনো? কিন্তু অনুভূতিগুলো এত বাস্তব যে স্বপ্ন ভাবতেও পারছি না। দৌঁড়াচ্ছি; দম ফুরিয়ে আসছে কিন্তু পথ শেষ হচ্ছে না, পিছনে পিঁপড়াদের তাড়াও না। আমি মরবো, এতে ভুল নেই। মা'র কথা মনে পড়ছে হঠাৎ করেই। বেচারি, সেই বিকাল থেকে আমার অপেক্ষায় বসে আছে। ওহ, আর পারি না। কিসে যেন পা বেধে গেল, পড়ে গেলাম ধুপ করে। আতংকে চোখ বন্ধ করে ফেলেছি। পিঁপড়ার দল এখনই ঝাপিয়ে পড়বে জানি। এমন সময় হঠাৎ শুনি থপ থপ একটা শব্দ। চোখ খুলে দেখি বিচিত্র একটা প্রাণি, অনেকটা গুইসাপের মত দেখতে, পিঠে বড় বড় আঁশ, লম্বা সরু মুখ, হেলেদুলে হেঁটে আসছে। তারপরে সুরুৎ করে লম্বা জিভটা বের করে দিল আর কতগুলা পিঁপড়াকে টেনে নিল মুখের মধ্যে। পিঁপড়ার দল সব আতংকে দিশেহারা। কিন্তু পালানোর উপায় নাই। একেকবার জিভ বের করে আর একদলা পিঁপড়া সাবাড় করে জিনিসটা। এই আতংকের মধ্যেও মনে পড়ল 'প্রাণিজগৎ: এক বিস্ময়' নামে একটা বইতে ছোটবেলায় পড়েছিলাম জিনিসটার কথা। এর নাম বনরুই, পিঁপড়া খায়। বাহ! এটাও গায়েবী সাহায্য নাকি? এক সন্ধ্যায় দুই-দুইবার এমন গায়েবী সাহায্য পেয়ে কেমন জানি অবশ লাগছে। অবাক হওয়ার ক্ষমতাও হারিয়েছি এখন।
দশ মিনিটও লাগল না। আমার বন্ধু বনরুই রাক্ষুসী সব পিঁপড়াকে শেষ করে ফেলল। তারপরে সে একবার অলস চোখ তুলে তাকাল আমার দিকে। দৃষ্টি দেখে মনে হল সে বলছে, 'যাও বাছা, মা'র কাছে ফিরে যাও।' তারপর ঘুরে থপথপ করে আবার জঙ্গলের দিকে হাটঁতে লাগল। প্রায় যখন অদৃশ্য হয়ে গেছে তখন হঠাৎ মনে হল ওকে একটা থ্যাংকস দেয়া দরকার। আমি ছুটতে লাগলাম ওর পিছন পিছন। সে হারিয়ে গেছে, কিন্তু কিছুদূর যেতেই কিসে হোঁচট খেলাম। ওহ্ সেই মাতালটার হাড়গোড় নাকি! আবার আগের জায়গাতেই ফিরে এসেছি তাহলে! নিচু হয়ে দেখতে লাগলাম ভাল করে। চোখ কুঁচকে উঠল আমার। কঙ্কালটার গায়ের জামা-কাপড় বেশ পরিচিত লাগছে। এই হাল্কা নীল শার্টটা এককালে আমি খুব পরতাম মনে পড়ছে। এমনকি গেভার্ডিনের এই প্যান্টটাও.......পিস্তল হাতের পাঁড় মাতালটা তাহলে.........
হতভম্ব আমি নিজের দিকে তাকালাম, সেখানে আবছা একটা ছায়া...আমার হাত, পা, বুক, পেট, সবকিছু ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে। শার্টের লুকানো পকেটে টাকাগুলো নেই। লোভী পিঁপড়াগুলো সাবাড় করেছে আগেই। এই জীর্ণ জামা-কাপড় ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই আমার মাকে ফিরিয়ে দেবার মত। বেচারি মা, আমার জন্য অপেক্ষা করে ছিল। কতদিন ধরে কে জানে!
দূরে দেখলাম ভালমানুষ বনরুইটা করুণ চোখে দেখছে আমাকে, তারপরে হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে থপথপ করে হারিয়ে গেল আঁধারে।
.......................................................................................
একজন মানুষ আমার দিকে পিস্তল তাক করে আছে, এমন একটা স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম। তবে প্রায় পুরো থিমটা রানা ভাইয়ার, আর সম্পাদনা হাসান মাহবুবের। ছবিটা খুঁজে দিয়েছে দূরদ্বীপবাসিনী। এবং শেষ পর্যন্ত আমার হাতে জিনিসটা যে কি দাঁড়াল!!!
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১১ বিকাল ৪:২০