পত্রিকা তিনটে হাতে নিয়ে বসে আছে অহম। সামনে একটা কাপে আধখাওয়া চা; আর চোখেমুখে রাজ্যের বিরক্তি।
"এই মরার দেশে কোন একটা কাজ যদি ঠিকমতন হত" - রাগে গজগজ করে বিড়বিড় করল সে।
"১০৮ টা পদ্ম জোগাড় করে দিলেই পুরষ্কার" বলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিল সে। নাতাশা একদিন কথায় কথায় বলেছিল সুনীলের কবিতার কথা; তার খুবই পছন্দের কবিতা। সেদিনই সে ঠিক করে রেখেছিল নাতাশার জন্মদিনে সে যে করেই হোক ১০৮টা পদ্মই উপহার দিবে। কিন্তু নীলপদ্ম খুজে পাওয়া যে এতো মুশকিল কে জানতো ! পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও কাজ হচ্ছে না।
"স্যার; ফুল ম্যানেজ কইরা দেওয়া বিষয় না; কিন্তু ঘটনা হইল ট্যাকা লাগব কিছু" - ফোনের ওপাশে কেউ একজন গলায় মধু ঢেলে বলল। "কত?" "অনেক কষ্ট স্যার জোগাড় করা; ৫ হাজারের কমে তো হইবই না।" "আচ্ছা; ৫ হাজারই পাবা; আগে ফুল ঠিকানামতন নিয়ে আস"। বলেই ফোন রেখে দিলো সে।
আপাতত সিডির প্যাকেটটা চেক করল সে। পুরো ৫টা গান লিখে সুর করে গেয়ে রেকর্ড করেছে শুধু আজকের জন্য। গোটা ২ মাস এইটার পিছনে ব্যয় করেছে সে; নিজের সবটুকু দিয়ে গানগুলাকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছে। এখন নাতাশা গানগুলো পছন্দ করলেই হয়।
পুরো দিনের প্ল্যান ঠিক করে রেখেছে মনের মধ্যে। এখন বাজে সকাল ৭টা। তার সবচেয়ে চমৎকার স্যুটটা পরে ঠিক ১০ টার সময় হাজির হয়ে যাবে নাতাশাদের বাসার সামনে। হাতে থাকবে রাশেদকে দিয়ে গত সপ্তাহে আমেরিকা থেকে আনানো চকলেটের প্যাকেট। এরপরে ওরা যাবে গুলশান লেকে। সেখানে নৌকায় ঘুরাঘুরি করে দুপুরে খেয়ে দেয়ে দু'জনে হাত ধরে হাটবে কিছুক্ষণ। আর সন্ধ্যায় ক্যান্ডেললাইট ডিনার। আজকে পুরো দিনটা সে নাতাশাকে দিবে; তার সবগুলো মুহূর্ত সে স্মৃতিময় করে রাখবে।
...............................................
"আরে অহম; তুই এইখানে? পরীক্ষা দিলি না যে আজ?"
চোখের ইশারায় মানা করতে করতেই বুঝে গেল দেরী হয়ে গেসে। ফাহাদ আর কণিকা বসে আছে দরকার ঠিক পাশের টেবিলটাতেই। ফাহাদ আর অহম ক্লাসমেট; একজন আরেকজনের খুব ভাল বন্ধু।
নাতাশা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কিসের পরীক্ষা? অহমের ইশারা না বুঝেই ফাহাদ গড়গড় করতে থাকে "আজকে আমাদের ইকো ফাইনাল ছিল তো ! ফাহাদ অনেক আগে থেকেই আজকের পরীক্ষাটা পিছানোর জন্য হেডস্যারকে রিকুয়েস্ট করতেসিল। স্যার রাজি হয় নাই। আজকে হলে ও-কে না দেখে সবাই কত ফোন দিলাম। ওর ফোন বন্ধ ছিল। পাওয়াই গেল না ও-কে।"
"তুমি এই কাজটা কেন করলা?" - নাতাশার গলায় রাগ, অভিমান আর একরাশ চাপা কান্না।
"বাবু; আজকে তোমার স্পেশাল দিনে আমি কি করে অন্য কিছু করি বলতো?"
"তাই বলে তুমি পরীক্ষা দিবা না? একটা বছর এইভাবে নষ্ট করবা শুধু আমাকে খুশি করার জন্য? নিজের জীবনটাকে নিয়ে এইভাবে খেলবা আমার একটা সকাল স্মৃতিময় করার জন্য?" - বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পরে নাতাশা।
"কিন্তু তুমি তো আমার পুরো পৃথিবী; তোমার হাসিমুখ দেখার জন্য আমি যে সব ছেড়ে দিতে পারি" - নাতাশাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে বলতে থাকে অহম। ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে নাতাশা; চোখে মুখে রাজ্যের অভিমান।
...............................................
৪ মাস আগের ঘটনা। কয়দিন ধরে অহমের শরীরটা খারাপ । শরীর খারাপ কে খুব একটা গা করে না সে। লোহার শরীর বলে খুব ভাব সে বন্ধুমহলে নিয়ে থাকে। ঠান্ডা জ্বর এসব বলে তাকে যেন ছুতেই পারে না। জীবনের প্রতি খুব একটা যে ভালোবাসা ছিলো তাও না অহমের। কিন্তু নাতাশা জীবনে আসার পর খুব বাঁচতে ইচ্ছে করে তার। খুব। প্রতিটি দিন নাতাশাকে ভালোবেসে কাঁটিয়ে দিতে চায় সে। নাতাশাকে সে কথা দিয়েছে আজীবন সে ভালোবেসে যাবে। আমৃত্যু।
নাতাশার জোড়াজোড়িতেই সে হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে এসেছে। নাতাশা বলেছে ডাক্তার না দেখালে সে আর কথা বলবে না ওর সাথে। সব সহ্য করা যায় নাতাশার অভিমান সহ্য করা যায় না। ওয়েটিং রুমে বসে বসে ফেসবুক গুতাচ্ছিলো সে। নাতাশাকে জানায়, "বাবু রাগ করো না আর। ডাক্তার দেখাতে এসেছি।"
ভারী ভারী একগাদা রাজ্যের টেস্ট নিয়ে অহম চেম্বার থেকে বের হলো। নাতাশাকে কিছু জানালো না সে তখনো।
.......................................
বাসায় ফিরে বিছানায় শুয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে অহম; হাতে চার মাস আগের একটা টেস্ট রিপোর্ট। রিপোর্টের নিচে মন্তব্যের ঘরে "আনুমানিক আয়ুঃ ৬ মাস" লেখাটা তীব্রভাবে উপহাস করতে থাকে যেন। এইরকম একশটা পরীক্ষার চেয়ে নাতাশার সাথে কাটানো একেক্টা দিন যে অহমের কাছে কতটা মূল্যবান সেটা যদি নাতাশা জানত
আগের পর্বের লিঙ্কঃ মেঘকুমারীর বৃষ্টিকাব্য - ১
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ১২:৩৪