"আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো
ছোট ঘাসফুলের জন্যে
একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো চৈত্রের বাতাসে
উড়ে যাওয়া একটি পাঁপড়ির জন্যে
একফোঁটা বৃষ্টির জন্যে
...
আমি সম্ভবতখুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
এক কণা জ্যোৎস্নার জন্যে
এক টুকরো মেঘের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো টাওয়ারের একুশ তলায়
হারিয়ে যাওয়া একটি প্রজাপতির জন্যে
এক ফোঁটা সবুজের জন্যে"
দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারটা আসলে খুব মজার। কিভাবে দেখা হচ্ছে তার উপর ভিত্তি করে একটা ঘটনাই একেক জনের কাছে একেক রকম ভাবে ধরা দিতে পারে। প্রতিদিনকার উঠোন, ঘাস, দুর্বোলতা কিংবা চিলেকোঠার ছোট্ট পুতুল খেলার ঘরটাই হয়ে উঠতে পারে সুবিন্যস্ত মই, বিস্তীর্ণ জঙ্গল অথবা ছোট্ট সুখের সংসার।
"The Secret World of Arrietty" বিলুপ্তপ্রায় ছোট মানুষদের একটা পরিবারের গল্প; ছোট্ট, সুন্দর, ছিমছাম। বাবা, মা আর ১৪ বছরের আরিয়েত্তিকে নিয়ে এই ছোট মানুষদের পরিবারের বাস শহরতলীর একটা বাগানবাড়ির কুলুঙ্গিতে, সাধারণ মানুষের দৃষ্টিসীমার বাইরে। সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে তাদের অগোচরে দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো ধার করেই এদের জীবন-যাপন। কিন্তু সবকিছু বদলে যায় যখন শো নামের একটা বালক এসে উপস্থিত হয় সেই বাড়িতে; এবং ঘটনাক্রমে আরিয়েত্তিকে আবিষ্কার করে। এক অদ্ভুত কিন্তু অনন্য সাধারণ বন্ধুত্বর সুচনা হয় এদের মাঝে; যেটা কিনা দিনশেষে আরিয়েত্তির পরিবারকে বিপদের মুখেই ঠেলে দেয় এক রকম।
মুভির সবচেয়ে চমৎকার দিকটা বোধহয় ছোট মানুষদের অস্তিত্বকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য ছোট ছোট দিকগুলোর দিকে দেওয়া প্রচন্ড মনোযোগ। আরিয়েত্তিদের জীবনযাপনের এবং মানুষের কাছ থেকে ধার করার সময় তাদের বাড়িতে সহজে চলাচলের সৃজনশীল অথচ খুবই সহজ পদ্ধতিগুলো ছিল রীতিমত মুগ্ধ করার মতন; মাছ ধরার হুক থেকে শুরু করে ডাবল সাইডেড স্কচটেপ কিংবা ছোট ছুরি থেকে শুরু করে একটা পিন - প্রত্যেকটা জিনিস ছোট মানুষদের চরিত্রগুলোকে দেয় আলাদা মাত্রা।
সাউন্ডট্র্যাকগুলো এক কথায় অসাধারণ। প্রত্যেকটা মিউজিক পিস আমার খুব খুব খুব বেশি পছন্দ হইসে। আর এনিমেশন? দুর্দান্ত ! এনিমেশনের দিক থেকে আমার দেখা কোন জিবলী মুভিই এক বিন্দুও ছাড় দেয় নাই; এইটাও না। বাড়ির পিছনের উঠোন অথবা শান্ত জলস্রোত - সবকিছু এত উজ্জ্বল আর এতো ভিন্নভাবে দেখানো হয়েছে যে ৯০ মিনিটের পুরোটা সময় স্ক্রিনের সামনে আঠার মতন আটকে রাখবে।
মুভির দুর্বলতার দিকটা বোধহয় সংঘাতের অনুপস্থিতি আর আর ভিলেন চরিত্রের প্রায় কমিকাল রুপ, যেটা মুভির অন্তরদন্দকে আরো ম্লান করে দেয়। ছোট মানুষদের প্রতি হারুর কি এত ক্ষোভ ছিল যে তাদের ধরে ধরে বয়ামে পুরে রাখতে হবে? শুধু "তারা বাসা থেকে জিনিসপাতি চুরি করে; আমার ধারনা" লাইনে এইরকম ঘটনা পুরোপুরি জাস্টিফাই হয়ে যায় না। এর বাইরে পুরো মুভির সবচেয়ে এক্সাইটিং মোমেন্ট বোধহয় ছিল মানুষ আর একটা কাকের মাঝে ছোট্ট একটা যুদ্ধ - ব্যাপারটা বেশ খানিকটা হতাশাজনকই বটে। আরিয়েত্তি একটা পিনকে তলোয়ার হিসেবে ব্যাবহার করে; যদিও পুরো মুভিতে কখনই তা ব্যাবহারের প্রয়োজন পরে নি; কারণ তার শত্রুরা কম বেশি অজানা; এবং কেউই পিনের গুতো খেয়ে কুপকাত হবার মতন নয়। আরিয়েত্তির কিছু সিদ্ধান্ত খুব একটা মেক সেন্স করে না; শো যখন তাকে দেখে ফেলসে বলে মনে হল তখন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সে কি করল? সরাসরি ফেইস টু ফেইস দেখা করে তাদের বিরক্ত করতে মানা করল ! কেন? কি বুঝে সে এই কাজ করল যখন তার বাবা মা তাকে ছোট বেলা থেকে যদি একটা শিক্ষাই দিয়ে থাকে তাহলে সেটা ছিল মানুষের ধারে কাছেও না যাওয়া এবং তারা প্রচন্ড রকমের ভয়ঙ্কর? এছাড়া মুভিটা অনেক জায়গাতেই অনেকের কাছে কিছুটা স্লো মনে হতে পারে; যদিও আমার কাছে স্বাভাবিকই লেগেছে।
সামগ্রিক বিচারে গভীর ভাব অথবা রুপক বর্জন করে আরিয়েত্তি বুঝি ঐন্দ্রজালিক এক রুপকথাই হতে চেয়েছে শেষতক। যদি তাই হয়ে থাকে তবে মুভিটা পুরোপুরি সার্থক তার আবেদনে। জিবলীর মুভিগুলো সবসময়েই আমাদেরকে সাথে করে অভিযানে বেরিয়ে পড়ে; কখনও বড় পরিসরে; কখনও বা একেবারে ক্ষুদ্র সীমায়। আরিয়েত্তি দুটো কাজই করেছে এই মুভিতে; পুরোপুরি সফলতার সাথেই। আর কিছু না হোক; দেড় ঘন্টার জাদুকরী অভিযান শেষে মুখের কোনে যে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠবে আপনার, আরিয়েত্তিকে অন্ততপক্ষে ভালবেসে ফেলবেন তার সরলতার জন্য, তার অভিযানগুলোর জন্য, লুকিয়ে থাকা বিষণ্ণতা কিংবা শো এর সাথে অদ্ভুত কিন্তু মিষ্টি বন্ধুত্বর জন্য; সে কথা বোধকরি লিখে দেওয়াই যায় !
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:৫১