কি দেখলামঃ Tokyo Godfathers
পরিচালকঃ সাতোশি কন
মানুষর জীবনের চিত্রনাট্যটা বড়ই অদ্ভুত। খুব অল্প সময়ের ব্যাবধানেই সব হিসেবনিকেশই উলট পালট হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় এক দিন; শুধু একদিন; মানুষের গোটা জীবনটাকেই এলোমেলো করে দিতে পারে। আমরা যতই অতীতকে চিন্তা করে ভবিষ্যতের ভাবনায় বুঁদ হয়ে থাকি না কেন, আমাদের বসবাস সবসময়েই বর্তমানে, যে কারণে বেশিরভাগ সময়েই নিজেদের ভেতরের, নিজেদের জীবনের আমুল পরিবর্তনগুলো অনেক সময়েই টের পাই না।
যারা এই মুহূর্তে এই পোস্ট পড়ছেন কম বেশি সবাই-ই হয়ত নিজের রুমে অথবা অফিসে আরাম করে বসে বা শুয়ে পোস্টটা পড়ছেন। এই অবস্থায় আসলে চিন্তা করা কষ্টকর; তাও একটা দৃশ্যর কথা চিন্তা করুন। ধরুন এই মুহূর্তে আপনি গৃহহীন; রাস্তায় রাস্তায় দিন কাটে। ভিক্ষা করে, কুড়িয়ে - যেভাবে পারেন এটা সেটা যোগাড় করে বেঁচে থাকেন। একদিন প্রচন্ড শীতের রাতে আবর্জনার ভিতর খাবার কুড়োতে গিয়ে একটা বাক্সের ভিতরে খুঁজে পেলেন এক শিশুকে। কি করবেন তখন? পুলিশের হাতে তুলে দিবেন, যখন আপনি জানেন যে তার জায়গা হবে কোন এতীমখানায় অথবা মায়াদয়াহীন কোন পরিবারে? নাকি বাচ্চার বাবা মা কে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করবেন? অথবা নিজেদের ছোট্ট খুপড়ি ঘরে রেখে বড় করে তোলার কথা চিন্তা করবেন?
সাধারণত শিবুইয়া; ইকেবুকোরোর মতন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কিংবা রোপ্পঞ্জি বা আকিহাবারার মতন বিনোদন এলাকাগুলো দেখতে দেখতে জাপানের আরেক্টা পাশ আমাদের অজানাই রয়ে যায়, ঘনবসতিপূর্ণ টোকিও; আর সেখানকার অভিভাসী শ্রমিকদের ঘিঞ্জি বস্তি এলাকা; কিংবা বাস্তুহারা লোকদের জীবন যাপন; যারা নিয়মিত পদে পদে লাঞ্চিত হয়; হয়রানি হয়; বেঁচে থাকার জন্য প্রবল সংগ্রামে লিপ্ত হয়।
মুভিটির গল্প আবর্তিত হয় মুলত তিন গৃহহীনকে ঘিরেঃ মিয়ুকি - দলের সবচেয়ে নবীন সদস্য। হানা - ড্র্যাগ কুইন, যে কি না তার মেয়েলি ধাঁচের কথা বার্তা এবং কাজকর্ম দিয়ে সবসময় মনোযোগের কেন্দ্রে থাকার চেষ্টা করে। গিন - হতাশ মদ্যপ বয়স্ক ভদ্রলোক; যে সব সময়েই তার নিজের জীবন নিয়ে হাহুতাশ করতে থাকে।
আপাত দৃষ্টিতে খুব অচিত্তাকর্ষক এই তিনটি চরিত্রের পেছনে লুকিয়ে থাকা সত্যগুলো, তাদের রাস্তায় নামার কারণগুলো একে একে আমাদের সামনে উন্মোচিত হতে থাকে। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বোধহয় হানার চরিত্রটিই। এনিমে ড্র্যাগ কুইন ধাঁচের চরিত্রগুলোর মুল লক্ষ্যই থাকে কমিকাল রিলিফ; তাদের জীবনের পিছনের গল্প, সংগ্রাম বা মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো ঘুরে দেখার চেষ্টা থাকে খুব কমই। এই মুভিটা অবশ্য সে পথে না হেঁটে হানার নিজেকে খুজে পাওয়ার সংগ্রামটা দেখিয়েছে যথেষ্ট যত্নের সাথেই।
গল্পের মাঝখানে একটা দৃশ্যে মিয়ুকি স্প্যানিশ এক মহিলার কাছে তার দুঃখগুলো, স্মৃতির কথাগুলো বলতে থাকে, জাপানিজে। ভদ্রমহিলা স্প্যানিশে তাকে সান্ত্বনা দিতে থাকেন। কারো কথাই কেউ বুঝতেসে না; অথচ কে কি বলতে চাচ্ছে আন্দাজ করে নিতে মোটেও কষ্ট হচ্ছে না। দৃশ্যটা আমার কাছে পুরো মুভির হাইলাইট হয়েই থাকবে।
তবে একটা জিনিস কিছুটা চোখে লাগার মতন - একদিনের মধ্যে সব ঘটনার দৃশ্যপ্রবাহ দেখাতে গিয়ে মুভিটা নিয়মিতই কোইন্সিডেন্সকে কাজে লাগিয়েছে। শুরুতে ব্যাপারটা আকর্ষণীয় থাকলেও শেষ দিকে এসে খানিকটা একঘেয়ে হয়ে যায়। এবং এই জিনিসটা চরিত্রগুলোর ক্রেডিবিলিটিও খানিকটা খাটো করে দেয় বৈকি।
আর্টওয়ার্ক এবং ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের কাজ চমৎকার। চরিত্রগুলোর ফেশিয়াল এক্সপ্রেশন বেশ কিছু জায়গাতেই অতিরঞ্জিত হলেও অভিব্যাক্তি ফুটিয়ে তুলেছে চমৎকারভাবেই।
দিনশেষে টোকিও গডফাদার ঘরছাড়া একদল ছন্নছাড়া মানুষের গল্পকে ছাপিয়ে হয়ে উঠেছে ঘরের গল্প, পরিবারের গল্প, ভালবাসা আর মানবতার গল্প।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৩:৫৮