Children Who Chase Lost Voices - মুলত জাপানিজ একটা উপকথার উপর ভিত্তি করে তৈরি মুভি, যেখানে গল্পের দুই প্রধান চরিত্র তাদের প্রিয়জনকে ফিরিয়ে আনতে রওনা হন মৃতদের দেশে।
অন্ধকারে অদ্ভুত আওয়াজ আর ক্রিস্টাল রেডিও থেকে ভেসে আসা অপার্থিব এক সুর - শুধু এইটুকুর উপর ভর করেই আসুনার যাত্রা শুরু হয় পৃথিবীর নিচে হারিয়ে যাওয়া কিংবদন্তীর জগতে। অদ্ভুত প্রাণী দ্বারা আক্রান্ত আর রহস্য ঘেরা এক বালকের মাধ্যমে উদ্ধার পাওয়া আসুনা নিজেকে আবিস্কার করে শতাব্দী পুরোনো এক রহস্যের মাঝে; যেটা কিনা তাকে দাঁড় করিয়ে দেয় এমন এক সত্যের মুখোমুখি যেটার সাথে জড়িত আছে খোদ জীবন আর মৃত্যুর রহস্য।
আসুনা পাহাড়ী এক গ্রামের সাধাসিধে কিন্তু মেধাবী এক মেয়ে। বাবা নেই; মায়ের কর্মক্ষেত্রে বিশাল ব্যস্ততার কারণে মোটামুটি একাকীই দিন কাটে আসুনার। পড়াশুনায় ভীষণ মেধাবী আসুনা তাই সময় পেলেই মাঝে মাঝে ছুটে যায় পাহাড়ে, ক্রিস্টাল রেডিও আর একটা বিড়ালকে সঙ্গী করে একাকী সময় কাটায় দূরদেশের সুর শোনার অপেক্ষায়।
গল্পের অন্য মুল চরিত্র রিউজি – যিনি আসুনার স্কুলে বদলি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। স্ত্রীর মৃত্যুর ১০ বছর পরেও তার স্মৃতি আর শোক বয়ে চলা ভদ্রলোকের অন্যতম লক্ষ্যই হল মৃতদের জগত থেকে তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনা। এই নিয়ে সব রকম গবেষণা এবং খোঁজাখুঁজিতেই সময় কাটে তার। রিয়ুজির চরিত্রের মাঝে সব সময়েই আমরা একটা অন্তদ্বন্দ্ব দেখতে পাই। সে তার লক্ষে অটল, কিন্তু সেটা পাগলামির পর্যায়ে না; কিন্তু আবার অবসেসডও। এর মাঝেও সে আসুনার দিকে খেয়াল রাখে, দেখাশুনা করে; তাকে রক্ষা করে।
মৃত ব্যাক্তিকে মৃতদের রাজ্য থেকে ফিরিয়ে আনা কিংবা পুনর্জন্ম - চলে যাওয়া প্রিয়জনকে ফিরিয়ে আনার চিরন্তণ যে মানব আকাঙ্ক্ষা; তার কথা ঘুরে ফিরে এসেছে সব ধর্মেই, সব কালেই, সব পুরোকথাতেই। জাপানিজ, গ্রীক কিংবা রোমান - সব মিথোলজিতেই অনেক আকর্ষণীয় গল্প আছে এই বিষয়টা নিয়ে।
জাপানিজ শ্রুতিমতে, ইজানাগি আর ইজানামি জাপান এবং এর সব দেবতাদের সৃষ্টিকর্তা। এই জুটি প্রথমে আটটা ফুটফুটে বাচ্চার জন্ম দেন, যারা কিনা পরে জাপানের আটটা দ্বীপে পরিণত হন। ইজানাগি ইজানামি এর পর একে একে জন্ম দেন পাহাড়, উপত্যকা, জলপ্রপাত, ঝর্ণা, বাতাস, এবং অন্যান্য দেবতার। সমস্যাটা বাঁধে আগুনের দেবতা কাগুতসুচি(Kagutsuchi)র জন্মের সময়; ইজানামি খুব বাজেভাবে আগুনে পুড়ে যান। তারপরেও থেমে থাকেন নি ইজানামি; এই অবস্থাতেও আরও দেবতার জন্ম দিতে থাকেন এবং কিছুদিনের মাঝেই মারা যান।
মৃত্যুর পর ইজানামির জায়গা হয় ইয়োমি সু কুনি(Yomi-tsu Kuni)তে। তাকে ফিরিয়ে আনতে ইজানাগি রওনা হন ইয়োমির পথে। সেখানে ইজানামি অন্ধকারের মাঝে তাকে বরণ করে নেন। ইজানামি তাকে অনুরোধ করেন যতক্ষণ না ইয়োমির দেবতার কাছ থেকে অনুমতি আদায় করতে পারেন ততক্ষণ যেন তার দিকে না তাকান ইজানাগি। কিন্তু স্ত্রীকে দেখার পরম আকাঙ্ক্ষায় ইজানাগি আলো জ্বেলে ইজানামিকে দেখতে উদ্যত হন। কিন্তু ইজানামির পচা গলা মৃতদেহ দেখে আতঙ্কিত ইজানাগি পালিয়ে আসেন ইয়োমি থেকে।
ফিরে এসে ইজানাগি নিজেকে পবিত্র করার জন্য স্নানের ব্যাবস্থা করেন। এ সময় ইজানাগির কাপড় এবং শরীর থেকে আরও কিছু দেবতার সৃষ্টি হয় যাদের মধ্যে ছিল সূর্যদেবী আমাতেরাসু ( Amaterasu), চন্দ্রদেবতা সুকিয়মি(Tsuki-yomi) এবং ঝড়ের দেবতা সুসানো (Susano-ô) - যাদের মাঝে পরে ইজানাগি তার রাজত্ব ভাগ করে দেন।
মুভির ঘটনাপ্রবাহ যথেষ্ট সহজ সরল এবং কিছুটা একমুখী। এবং বেশ কিছু জায়গায়ই অনেক প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টাও করে নি। ক্লাভিস নিয়ে মুভিতে এতো ঘটনা ঘটল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্লাভিস কি জিনিস ("মাটির নিচের পৃথিবীর চাবি" - শুধু এইটুকুতে আসলে সব প্রশ্নের উত্তর হয় না) কিংবা আসুনা কি করে ক্লাভিসের অংশ হাত করে নিল - সেই প্রশ্নের কোন জবাব নেই গোটা মুভি জুড়ে। আসুনা আর রিয়ুজি একবার আগার্থায় (By the way, মাটির নিচের পৃথিবীর আরেক নাম আগার্থা) প্রবেশ করার পর উপরের পৃথিবীর কথা একেবারে বেমালুম ভুলে গেল সবাই। উপরে আসুনার মায়ের কি হল, রিয়ুজির সাথে থাকা সঙ্গী সাথীদের কি হল - মুভির শেষেও এইরকম কোন কিছুরই উত্তর পাওয়া যায় না। মুভির কিছু কিছু জায়গায় পানি সংক্রান্ত জটিলতাও ছিল; কিছু পানিতে শ্বাস নেওয়া যায়, কিছু জায়গায় সেভাবে যায় না; আগার্থার যে যে জায়গায় দরকার সেখানে সেখানে ভিটা আকুয়া(শ্বাস নেওয়া যায় এমন পানি)র ব্যাবস্থাটা খানিক্টা হলেও কাহিনীর বিশ্বাসযোগ্যতা কমিয়ে দেয়।
মুভিটা প্রথম প্রায় ৩০ মিনিট ব্যয় করে চরিত্রগুলোকে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে; এবং এই ৩০ মিনিটে আমরা আসলে কোন আভাসই পাই না সামনে কি হতে যাচ্ছে। এবং এই প্রথম পর্বে আমরা আসুনার জীবন যাপন দেখতে পাই, তার চারপাশের পরিবেশ দেখতে পাই – যেটার আসলে বাকি মুভিতে মোটেও খুব একটা গুরুত্ব নেই। এবং এই সময়ের মাঝে এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছুও ঘটে না যেটা আসলে বাকি মুভিতে তেমন প্রভাব ফেলে। দু’তিনটে চরিত্রকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য এতো লম্বা সময় নিয়ে নেওয়াটা খানিকটা হতাশাজনকই ছিল।
মুভিটা চরিত্রনির্ভরতার বদলে পুরোপুরিই গল্প নির্ভর ছিল। সমস্ত সময় জুড়েই আসুনা এবং রিয়ুজির অভিযানই ফোকাসে ছিল, চরিত্রগুলো নয়। সেই কারণে কোন চরিত্রই খুব বেশি স্বতন্ত্রতার সুযোগ পায় নি। মাঝে মাঝে ফ্ল্যাশব্যাক এবং পিছনের ঘটনার যে সব বর্ণনা এসেছে তাও গল্পের প্রয়োজনেই।
শিনকাই এর অন্যান্য মুভির মতন এই মুভিরও আর্টওয়ার্ক খুবই চমৎকার; যদিও "হারিয়ে যাওয়া জগত" কিংবা "মাটির নিচের রাজ্য" চেনাজানা পৃথিবীর মতনই ছিল অনেকটা। এনিমেশন খুব ফ্লুইড, সিজি থেকে শুরু করে সব কাজই খুব যত্ন নিয়ে করা ছিল; কোথাও কোন কিছু বেখাপ্পা লাগে নি। চরিত্র রুপায়ন অবশ্য খুব একটা আহামরি ছিল না; আসুনা, শিন, শুন বা রিয়ুজি - সবগুলো চরিত্রের ডিজাইনই কম বেশি একমুখী ছিল। তবে মিমি এবং গেটকিপারদের ডিজাইন ছিল খুব রিফ্রেশিং। আর সিমপ্লিসিটি থাকার কারণে প্রত্যেকটা চরিত্রকেই আলাদা করা গিয়েছে খুব সহজেই। কিছু কিছু দৃশ্য, বিশেষ করে আগার্থার চম্পকরথ কিংবা রাতের আকাশ অথবা সামনের খোলা প্রান্তরের নিখুঁত চিত্রায়ন – রীতিমত শ্বাসরুদ্ধকর। আরেকটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হল পুরো মুভি জুড়েই উজ্জ্বল রঙের ছড়াছড়ি – পুরো গল্পটাকে একেবারে জীবন্ত করে তুলেছে যেন !
সাউন্ডট্র্যাকও বেশ ভাল ছিল, বিশেষ করে থিম সং "Hello, Goodbye and Hello" দুর্দান্ত ছিল।
খুব আহামরি কোন কিছু হয়ত না; কিন্তু শিনকাইর নামই বোধহয় জানিয়ে দেয় একটা দুর্দান্ত সেটিং এ স্নিগ্ধ একটা গল্পের কথা। দুটো চমৎকার ঘন্টা কাটাতে এর চেয়ে বেশি আর কি লাগে?
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:২৫