১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ, লন্ডন শহর, ব্রিটেন
“জনাব,
অধীনের সবিনয় নিবেদন এই যে, আমি মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্ট অফিসের হিসেবরক্ষণ বিভাগে বাৎসরিক মাত্র ২০ পাউন্ড বেতনে কর্মরত একজন কেরানি। আমার বয়স ২৩। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার কোনো সুযোগ আমার হয় নাই, তবে বিদ্যালয়ে সাধারণ বিষয়সমূহ আমি পড়িয়াছি। বিদ্যালয় ছাড়িবার পর অবসর সময়ে আমি গণিত চর্চা করিয়া থাকি। বিদ্যাশিক্ষার গতানুগতিক যে পথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুসরণ করা হইয়া থাকে, উহা আমি অবলম্বন করি নাই, বরঞ্চ নিজের জন্য নতুন একটি পথ নিজেই আমি সৃষ্টি করিয়া লইয়াছি। অপসারী ধারার উপর আমি কিছু কাজ করিয়াছি এবং স্থানীয় গণিতবিদগণ উহার ফলাফলকে "বিস্ময়কর" বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছে।
আপনাকে অনুরোধ করিতেছি আমার কাজগুলি দয়া করিয়া একটু দেখিবার জন্য। আমার নিজের সামর্থ্য নাই, যদি আপনি মনে করিয়া থাকেন ইহাদের কিছুমাত্র গুরুত্ব আছে, তাহা হইলে আমি বাধিত হইব যদি উপপাদ্যগুলি প্রকাশিত হয়। আমার অভিজ্ঞতা তেমন নাই, আপনার যেকোনো উপদেশ আমার কাছে অমূল্য হিসেবে গৃহীত হইবে।
আপনাকে বিরক্ত করিবার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি।
আপনার একান্ত বাধ্যগত,”
____________________
মাদ্রাজ থেকে ১৬ই জানুয়ারি ১৯১৩ তারিখে পোস্ট করা বিরাট খামটি খুলে চিঠিটি পড়লেন জি. এইচ. হার্ডি (Godfrey Harold Hardy)। পাঁচ হাজার মাইল দূরে মারী ও মন্বন্তরের ভারতবর্ষ, সেখানকার অখ্যাত এক কেরানি চেষ্টা করছে একসাথে তার করূণা ও বিস্ময় উদ্রেক করতে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হাসলেন হার্ডি। ৩৬ চলছে তাঁর বয়স; এ বয়সেই দুনিয়াজোড়া নাম ছড়িয়েছে তাঁর গণিতবিদ হিসেবে, তিন বছর আগে সভ্য নির্বাচিত হয়েছেন ব্রিটেনের সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদ রয়্যাল সোসাইটির। খ্যাতির সাথে অবশ্য আসছে নানা বিড়ম্বনা। কত পাগল আর চালিয়াত যে রয়েছে দুনিয়াতে! উঠকো এসব চিঠি প্রায়ই আজকাল আসছে তার কাছে: ফারাও খুফুর পিরামিডের দৈবজ্ঞান আয়ত্ত করেছে কেউ, কাব্বালাহ'র রহস্য ভেদ করে ফেলেছে কেউ, কেউ বা আবার খুঁজে পেয়েছে শেক্সপিয়ারের নাটকে ঢুকিয়ে দেয়া বেকনের ধাঁধা।
হার্ডি জানেন না ভারতবর্ষের দরিদ্র যুবকটি কেমব্রিজের আরো দুজন প্রখ্যাত গণিতবিদ, ই. ডব্লিউ. হবসন ও এইচ. এফ. বেকারের কাছে অনুরূপ সাহায্যের আবেদন পাঠিয়েছিল; তারা তাকে পাত্তা দেননি।
খামটির ভেতর থেকে এক টুকরো কাগজ পড়ল মাটিতে। উবু হয়ে কাগজটি তুলে চোখের সামনে মেলে ধরলেন হার্ডি, টানা হাতের অক্ষরে ছোট্ট একটি সমীকরণ লেখা তাতে:
১+২+৩+৪+⋯∞=-১/১২
কৌতুকের দমকে খানিকটা বিষমই খেলেন হার্ডি। প্রথম চারটি পদ যোগ করলেই ধারাটির যোগফল আসে ১০। এরপর পদ যত বাড়বে যোগফলও তত বাড়তে থাকবে, বাড়তে বাড়তে তা ধাবিত হবে অসীমের দিকে; একটি শিশুও ধরতে পারবে এটি। যোগফল ভগ্নাংশ, তাও আবার ঋণাত্মক, পাগল আর কাকে বলে!
কৌতুকের প্রভাব অবশ্য স্থায়ী হলো না বেশিক্ষণ; বিরক্তে কুঞ্চিত হলো হার্ডির কপাল ও মন। ভারতবর্ষের ছোকরাটি একটি চালিয়াত ছাড়া আর কিছুই নয়। সময় নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না, আলমিরার এক কোণে খামটি ছুঁড়ে মেরে টেবিলের উপর থেকে লন্ডন টাইমস পত্রিকাটি তুলে নিলেন তিনি।
বিকেলে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্টে টেবিল টেনিস খেলতে গেলেন হার্ডি। কিন্তু কেন যেন খেলায় মন বসছে না তাঁর, অস্পষ্টভাবে মনে হানা দিচ্ছে হতদরিদ্র, ছেঁড়া পোশাকের রোগা এক যুবকের মুখ।
অদ্ভুত এক সমীকরণ: ১+২+৩+৪+⋯∞=-১/১২
জিনিয়াস, চালিয়াত, জিনিয়াস, চালিয়াত...?
হঠাৎই বিদ্যুত চমকের মতো কী এক চিন্তায় কেঁপে উঠলেন হার্ডি, মনে পড়ে গেল তাঁর সোয়া দু'শো বছর পূর্বে বেরনুলি ভাইদের কথা। তবে কী? খেলা অসমাপ্ত রেখেই দ্রুত উঠে পড়লেন হার্ডি।
১৬৮৯ খ্রিস্টাব্দ, ব্যাসেল শহর, সুইজারল্যান্ড
পড়ন্ত বিকেলে চেয়ার পেতে বাগানে বসে আছেন বেরনুলি পরিবারের জ্যেষ্ঠ ছেলে জ্যাকব বেরনুলি (Jacob Bernoulli) আর কনিষ্ঠ জোহান বেরনুলি (Johann Bernoulli)। তের বছরের ছোট জোহানকে কোলে পিঠে বড় করেছেন জ্যাকব, শিখিয়েছেন তাঁকে গণিতের নানা রহস্য; শুধু তাই নয়, জোহান এখন পিএইচডি করছেন জ্যাকবেরই তত্ত্বাবধানে। চিন্তা-ভাবনায় তুখোড় জোহান, তবে আদরে আদরে পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তানদের ক্ষেত্রে যা হয়—এই বয়সেও প্রচণ্ড একরোখা রয়ে গেছেন। গবেষণা, পড়াশোনা নিয়ে প্রায়ই তীব্র ঝগড়া বেঁধে যায় দু'ভাইয়ের, কথা, এমনকি মুখ দেখাদেখিও, বন্ধ থাকে বেশ কিছুদিন।
আজকে অবশ্য দু'জনের মেজাজ কিছুটা ফুরফুরে। বাগানে বসে নানা মজা করছেন দু'ভাই, খোঁচাচ্ছেন একে অপরকে বেশ। কিছুক্ষণ পর জোহান বেরনুলি একটি কৌতুক বললেন:
পানীয় কেনার জন্য একদা অসীম সংখ্যক গণিতবিদ আসলো এক দোকানে।
"আমাকে ১ ইমমি (তরলের আয়তন পরিমাপকারী প্রাচীন সুইস একক, যা ১.৫ লিটারের সমপরিমাণ) আপেলের রস দিন।" প্রথম জন বলল।
দোকানি তাক থেকে এক ইমমির বোতল নামাতে যাবে, এমন সময় দ্বিতীয় জন বলল, "আমাকে দিবেন এর অর্ধেক, মানে ১/২ ইমমি।"
"আমাকে দেবেন এর অর্ধেক, অর্থাৎ ১/৪ ইমমি।" তৃতীয় জন দাঁত বের করে হাসে।
"আমাকে ১/৮ ইমমি।" তীর্যক হেসে চতুর্থ জন দাবি পেশ করে।
গণিতবিদদের লাইনে হাস্যরসাত্মক গুঞ্জনে একের পর এক দাবি উঠতে থাকে; দোকানের মালিক লাইনের দিকে তাকিয়ে শেষ দেখতে পায় না।
"এই দুই বোতল নিয়ে বিদায় হও তোমরা, যত্তসব!" গজগজ করতে করতে এক ইমমির দুইটি বোতল নামিয়ে রাখে বিক্রেতা।
পরস্পরের দিকে হেসে উঠেন জ্যাকব ও জোহান বেরনুলি। এক সাথেই তারা উপলব্ধি করেছেন দোকানি, বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক, ভুল কিছু করেননি, কারণ (১ ইমমি+১/২ ইমমি+১/৪ ইমমি+১/৮ ইমমি+⋯∞) অসীম এ ধারাটির যোগফল বাস্তবিকই ২ ইমমি। গণিতের অপার সৌন্দর্যের এক নিদর্শন এটি: অসীম সংখ্যক সংখ্যার যোগফল সসীম। নানাভাবেই এটি প্রমাণ করা যায়, যেমন ১+(১/২)+(১/৪)+(১/৮)+⋯∞
=১+(১-১/২)+(১/২-১/৪)+(১/৪-১/৮)+⋯∞
সমমানের ধনাত্মক ও ঋণাত্মক পদগুলো কাটাকাটি করলে, অবশিষ্ট থাকে কেবল প্রথম দু‘টি ১, আর তা থেকে বাদ যাবে অসীম দূরের একটি পদ। সুতরাং ধারাটির যোগফল =(১+১-অসীম দূরের একটি পদ)।
পদগুলো যেহেতু ১/২,১/৪,১/৮,১/১৬,⋯এভাবে ক্রমাগত ছোট হয়ে যাচ্ছে, কাজেই অসীম দূরের পদটির কথা চিন্তা করলে, তা এতই ছোট হবে যে একেবারে শূন্যে মিলিয়ে যাবে। ফলে ধারাটির চূড়ান্ত যোগফল পাওয়া যায় ২।
এটি বিপরীত দিক থেকেও ভাবা যায়। ধরা যাক, একজন লোকের ২ ফুট লম্বা একটি লাঠি রয়েছে। তিনি এটি সমান দু'ভাগ করলেন। তাহলে
২=১+১
লোকটি তারপর প্রথম ভাগটিকে ঠিক রেখে দ্বিতীয় ভাগটিকে আবার সমান দু'ভাগে ভাগ করলেন। এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি
২=১+(১/২+১/২)
লোকটি দ্বিতীয় ১/২'কে আবার সমান দু‘ভাগে ভাগ করতে পারেন এভাবেঃ ১/২=১/৪+১/৪
ফলে ২=১+১/২+(১/৪+১/৪)
এভাবে ক্রমাগত ভাগ করে গেলে দেখা যায়,
২=১+১/২+১/৪+১/৮+⋯∞
সুতরাং আলোচ্য অসীম ধারাটি আসলে ২'কে নিরন্তর ভাগ করে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। কতই না সুন্দর গণিত—সসীমের ভেতর লুকিয়ে অসীম!
এবার বড় ভাই জ্যাকব বেরনুলি একটি কৌতুক বললেন:
অসীম সংখ্যক থেলার (ব্যাসেল শহরে প্রচলিত প্রাচীন মুদ্রা) পুরস্কার, এ ঘোষণা দিয়ে লটারির আয়োজন করেন এক গণিতবিদ। অবিশ্বাস্য পুরস্কারটিতে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করতে থাকে, কিন্তু লটারির টিকেট মাত্র ১০ থেলার হওয়ায় অভূতপূর্ব টিকেট বিক্রি হয়। যথারীতি ফল ঘোষণার পর বিজয়ী ব্যক্তি আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে তার পুরস্কার আনতে যায়। গণিতবিদ তখন থেলার পরিশোধের শর্তটি তার কাছে ব্যাখ্যা করেন: "আজকে ১ থেলার, আগামিকাল ১/২ থেলার, পরশু ১/৩ থেলার, তার পরদিন ১/৪ থেলার...!"
জোহান ভাবতে লাগলেন ধারাটির কথাঃ (১+১/২+১/৩+১/৪+⋯∞)। ঐকতানিক ধারা (Harmonic Series) নামে পরিচিত দেখতে নিরীহ এ ধারাটি গণিতবিদদের কাছে বিস্ময়, সংগীতবিশারদদের চোখের মনি, স্থপতিদের পরম প্রিয়, দার্শনিকদের ধাঁধা, যা কাজ করে স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধির বাইরে । কারণ এ ধারাটির পদগুলোও দ্রুত ছোট হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তথাপি আগের ধারাটির মতো এর নির্দিষ্ট কোনো মান নেই। আগের ধারাটির যোগফল যেখানে মাত্র ২, ঐকতানিক ধারার যোগফল সেখানে অসীম। যদিও যোগফল খুবই আস্তে আস্তে বাড়ে—যেমন, ধারটির প্রথম ১০,০০০ পদ যোগ করার পরও যোগফল ১০ পাওয়া যায় না; প্রথম ১০০ কোটি পদের যোগফল ৩০ থেকেও কম—তারপরও মান বেড়ে বেড়ে ঠিকই অসীমের দিকে রওয়ানা হয় এটি।
জ্যাকব ও জোহান অবশ্য বহু বছর ধরেই চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন ঐকতানিক ধারাটি যে অপসারী (divergent), অর্থাৎ এর কোনো নির্দিষ্ট কোনো মান নেই, তা প্রমাণ করার জন্য। সরাসরি প্রমাণে সফল না হয়ে তাই বুদ্ধিদীপ্ত এক পদ্ধতির আশ্রয় নেন তারা—অন্য একটি ধারার সাথে তুলনা করেন একে:
ঐকতানিক ধারা, S=১+(১/২)+(১/৩+১/৪)+(১/৫+১/৬+১/৭+১/৮)+(১/৯+⋯∞
অন্য ধারা, ধরা যাক, T=১+(১/২)+(১/৪+১/৪)+(১/৮+১/৮+১/৮+১/৮)+(১/১৬+⋯∞
পদে পদে ধারা দু'টি তুলনা করে বোঝা যাচ্ছে, S>T।
এখন T=১+(১/২)+(১/৪+১/৪)+(১/৮+১/৮+১/৮+১/৮)+(১/১৬+⋯∞
=১+(১/২)+(১/২)+(১/২)+(১/২)+⋯∞
= ১ + ১ + ১ + ..., যা নিঃসন্দেহে অসীম মানের একটি অপসারী ধারা। S যেহেতু T-এর চেয়ে বড়, সুতরাং Sও অসীম মানের একটি অপসারী ধারা।
জ্যাকব হঠাৎ বলে উঠেন, "আচ্ছা, জোহান, তোর কী মনে হয়, ঐকতানিক ধারার প্রতিটি পদকে বর্গ করে যদি আরেকটি ধারা তৈরি করি, সেটি কি অপসারী না অভিসারী হবে? অভিসারী হলে তার মান কতো?"
চোখ বন্ধ করেন জোহান, কল্পনা করেন ধারাটির কথা:
(১)^২+(১/২)^২+(১/৩)^২+(১/৪)^২+⋯∞
=১+১/৪+১/৯+১/১৬+⋯∞
ঐকতানিক ধারার চেয়েও প্রখর গতিতে দ্রুত ছোট হয়ে যাচ্ছে এটি। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলেন তিনি, দ্রুত বলে উঠেন, “এটি অভিসারীই হবে। হওয়াই তো উচিত!” কিছুটা অনিশ্চয়তা তার কন্ঠে।
পরবর্তী কয়েক ঘন্টা মেতে উঠলেন দু'ভাই ধারাটি নিয়ে। কাগজের স্তুপ জমে উঠল টেবিলে, তর্ক হলো, মনকষাকষি হলো, ঝগড়া হলো, কিন্তু আসলো না কোনো ফল। শুধু ঘন্টা নয়, মহাকালের পথে চলে গেল কত না দিন মাস, বছরের পর বছর—না, কিছুই হলো না! ১৭০৫ খ্রিস্টাব্দে যক্ষ্মার হিমশীতল স্পর্শে চিরনিদ্রায় শায়িত হন জ্যাকব বেরনুলি, কিছুটা আক্ষেপ আর অনেকটা আশা নিয়ে: কেউ না কেউ একদিন সমাধান করবে এটি। ব্যর্থ হন বৃদ্ধ জোহান বেরনুলি, ব্যর্থ হন মহান দার্শনিক গণিতবিদ লিবনিটজও। বেরনুলিদের শহর ব্যাসেল-এর নামানুসারে ব্যাসেল সমস্যা (Basel Problem) নামে গণিতের আকাশে জ্বলজ্বল করতে থাকল সংখ্যাতত্ত্বের জটিল এ সমস্যা, পিয়েরে দ্য ফামার বিখ্যাত শেষ উপপাদ্যের মতো।
জ্যাকব বেরনুলির আত্মা শান্ত পায় ১৭৩৫ সালে, যখন জোহানেরই ছাত্র, ব্যাসেল শহরের বিস্ময়কর যুবক লিউনার্দ অয়লার (Leonhard Euler), জ্যাকবের মৃত্যুর দুবছর পর যাঁর জন্ম, সমস্যাটির সমাধান করেন। ম্যাকলরিনের ত্রিকোণমিতিক সাইন (sin) ফাংশনের অনন্ত ধারার উপর ভিত্তি করে অয়লার প্রমাণ করেন, ব্যাসেল ধারা, অর্থাৎ
১+১/৪+১/৯+১/১৬+⋯∞=π^২/৬
সমস্যার মতো সমাধানটিও চমকে দিল সমগ্র গণিত জগতকে কারণ যুগ-যুগান্তরের রহস্যময় সংখ্যা π, এতদিন যা ছিল কেবল জ্যামিতির একচ্ছত্র সম্পদ, রহস্যময়ভাবে আজ আবিষ্কৃত হলো বীজগণিতের সীমানায়, এ এক কল্পনাতীত ঘটনা।
অয়লার অবশ্য শুধু ব্যাসেল ধারারই সমাধান করেননি, বরং এ জাতীয় সকল ধারাকে প্রকাশ করার জন্য একটি সাধারণ ফাংশন প্রস্তাব করেন এবং তা থেকে বিভিন্ন ধারার যোগফল তথা ফাংশনটির মান বের করার জন্য একটি সূত্রও আবিষ্কার করেন। অয়লারের ফাংশনটি হলো:
E(n)=১+১/২^n +১/৩^n +১/৪^n +⋯∞।
অয়লারের নামানুসারে ফাংশনটির নাম হয় অয়লার জেটা ফাংশন।
যখন n = ১, তখন অয়লারের ফাংশনটি ঐকতানিক ধারায় পরিণত হয়, যার কোনো নির্দিষ্ট মান নেই।
যখন n = ২, তখন অয়লারের ফাংশনটি ব্যাসেল ধারায় পরিণত হয়, যার মান π^২/৬।
যখন n = ৪, তখন অয়লারের ফাংশনটির মান π^৪/৯০।
যখন n = ২৬, তখন অয়লারের ফাংশনটির মান (১,৩১৫,৮৬২×π^২৬)/(১১,০৯৪,৪৮১,৯৭৬,০৩০,৫৭৮,১২৫)!
১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ, লন্ডন শহর, ব্রিটেন
ভারতবর্ষের যুবকের কাগজগুলো ঘরের কোণা থেকে কুড়িয়ে নিলেন হার্ডি। কৌতূহলবশতঃ অয়লার ফাংশনে n=-১ বসিয়ে হার্ডি দেখেন,
E(-১) =১+১/২^(-১) +১/৩^(-১) +১/৪^(-১) +⋯∞
=>E(-১)=১+২+৩+৪+⋯∞
প্রথমে কিছুটা চমকে গেলেও হাসলেন হার্ডি, কারণ অয়লার ফাংশনে এভাবে n=-১ বসানো যায় না; অয়লার ফাংশনে n-এর মান অবশ্যই ধনাত্মক হতে হবে।
অয়লার জেটা ফাংশনে n=-১ বসানো না গেলেও রীমান জেটা ফাংশনে n-এর মান ঋণাত্মক, এমনকি কাল্পনিক সংখ্যাও, বসানো যায়। রীমান জেটা ফাংশনটি, যা মূলতঃ কাল্পনিক সংখ্যার জন্যই সংজ্ঞায়িত, আসলে অয়লার জেটা ফাংশনেরই বিস্তৃতরূপ, যেখানে n-এর পরিবর্তে s প্রতীকটি ব্যবহার করা হয় এবং s=-১ বসানো যায়।
রীমান জেটা ফাংশন:
ζ(s)=১+১/২^s +১/৩^s +১/৪^s +⋯∞
s=-১ হলে, ζ(-১)=১+২+৩+৪+⋯∞
ζ(-১) কিংবা s-এর অন্য কোনো মানের জন্য রীমান জেটা ফাংশনের মান সরাসরি বের করার সূত্রটি খুব জটিল, তবে একটি জেটা ফাংশনের মান আগে থেকেই জানা থাকলে তার সাথে সংশ্লিষ্ট অন্য একটি জেটা ফাংশনের মান নিচের সূত্রের সাহায্যে পাওয়া যায়ঃ
ζ(s)=২^s.π^(s-১).sin(πs/২).Г(১-s).ζ(১-s)
সুতরাং ζ(১-s) এর মান জানা থাকলে উপরের সমীকরণের সাহায্যে ζ(s) এর মান নির্ণয় করা সম্ভব।
সমীকরণটিতে s=-১ বসিয়ে হার্ডি পান,
ζ(-১)=২^(-১).π^(-২).sin(-π/২).Г(২).ζ(২)
=১/২∙১/π^২∙-১∙Г(২)∙ζ(২)
এখন ζ(২) আসলে E(২) তথা বিখ্যাত সেই ব্যাসেল ধারা, যার মান π^২/৬। বাকি থাকল কেবল Г(২)। Г প্রকাশ করে বিখ্যাত গামা ফাংশন যা গৌণিক ফাংশনের (একের পর এক ক্রমিক সংখ্যা গুণ করার ফাংশন) অনুরূপ, তবে তা বাস্তব ও কাল্পনিক উভয় ধরণের সংখ্যার জন্য প্রযোজ্য। m ধনাত্মক পূর্ণ সংখ্যা হলে,
Г(m)=(m-১)(m-২)(m-৩)⋯⋯⋯৩.২.১, অর্থাৎ ১ থেকে শুরু করে (m – ১) পর্যন্ত সবগুলো পূর্ণ সংখ্যার গুণফল।
m = ২ বসালে, Г(২)=১।
সুতরাং ζ(-১)=১/২∙১/π^২∙-১∙১∙π^২/৬=-১/১২
অর্থাৎ ১+২+৩+৪+⋯∞=-১/১২, ভারতবর্ষের যুবকটি এ জিনিসই আবিষ্কার করেছে।
বিস্ময়ে স্তম্ভিত, আপ্লুত হলেন হার্ডি। ভারতবর্ষের হতদরিদ্র যুবকটি আসলে অদ্ভুত সুন্দরভাবে অয়লার জেটা ফাংশন, রীমান জেটা ফাংশন, ব্যাসেল সমস্যা আর শতশত বছর ধরে নিবেদিত মহান গণিতজ্ঞদের বহু বছরের সাধনার গল্পটি শিল্পীর নিপুণ তুলিতে এক নিমিষে মূর্ত করে তুলেছে। কী অদ্ভুত, কী সুন্দর! মোনালিসাও তো এর চেয়ে বেশি সুন্দর হতে পারে না!
কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়লেন হার্ডি, গণিতের নতুন এ রাজপুত্রকে মহাসমাদরে নিজের মাতৃভূমিতে আনার অনন্য সম্মানই কেবল তাঁর নিজের লজ্জা আর গ্লানি দূর করতে পারে। গভীর সম্ভ্রম-শ্রদ্ধায় শুরু করলেন হার্ডি,
“Dear Sir, …
তারপর, কাবেরীর জলে বেড়ে উঠা ভারতের ছেঁড়া পোশাকের যুবকটি, শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার রামানুজন তাঁর নাম, সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে টেমসের তীরে যখন পা রাখে একদিন—মহত্তম বন্ধুত্বের এ তো অমর গাঁথা এক, বলা যাবে আরেক দিন।
[সংক্ষেপিত]
তথ্যসূত্র:
The Man Who Knew Infinity, Robert Kanigel
A Mathematician's Apology, G. H. Hardy
http://www.wikipedia.org
"এস্কাইলিসকে যখন মানুষ ভুলে যাবে, তখনও তারা আর্কিমিডিসকে ঠিকই মনে রাখবে, কারণ ভাষা মারা যায়, গণিত বেঁচে থাকে।"—জি. এইচ. হার্ডি
"আমার কাছে কোনো সমীকরণের অর্থ নেই যদি না তা স্রষ্টার চিন্তাকে প্রকাশ করে।"—শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার রামানুজন।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০১০ রাত ৮:৫০