প্রাচীন মিশরের অষ্টাদশ রাজবংশের ফেরাউন মহারাণী হাতশেপসুত (Hatshepsut)। বিশাল নৌবহর নিয়ে লোহিত সাগর ধরে চলেছেন দক্ষিণ অভিমুখে, গন্তব্য আফ্রিকার শিং সোমালিয়ার পান্ট (Punt) রাজ্য। পান্টের রাজা পারাহু (Parahu)এবং রাণী আতি'র (Aati) নিমন্ত্রণে এই অভিযান। ফেরাউন রাণীর নতুন রাজপ্রাসাদের জন্য উৎকৃষ্ট মানের মেহগনি কাঠ সংগ্রহ আরেকটি লক্ষ্য।
মহারাণীকে সর্বোচ্চ সম্মানে বরণ করার জন্য পান্টরাজ্যে চলল বিশাল আয়োজন। পান্টরাজ, পান্টরাণী নিজে থেকে তদারক করছেন সব কিছু। মহারাণীর আগমন পান্টের জন্য যেমন সম্মাননা, তেমনি রাজকীয় আতিথেয়তায় বিন্দুমাত্র ঘাটতি পান্ট ও খেমেত (Khemet, মিশরের প্রাচীন নাম, যার মানে কৃষ্ণ ভূমি)-এর সম্পর্কে চিঁড় ধরাতে পারে। ফেরাউন রাণী দোর্দ্যণ্ড প্রতাপশালী, ভয়ংকর তার সৈন্যবাহিনী।
মহারাণীর আগমন ক্ষণ আসন্নপ্রায়। অনুসন্ধানকারী স্কাউট এসে খবর দিল, আর ১০-১২ ঘন্টার মধ্যেই খেমেতের নৌবহর ভিড়ে যাবে পান্টের তীরে। এমন সময় গুপ্তচরের মুখে ভয়ানক এক দুঃসংবাদ শুনলেন পারাহুঃ মহারাণীর সৈন্যদের জন্য ফলের রস থেকে প্রস্তুতকৃত পান্টের বিখ্যাত পানীয়ের যে ৫০০টি বোতল তৈরি করেছেন রাজা, তার একটিতে ফলের রসের পরিবর্তে বিষ রাখা হয়েছে। মারাত্মক এক বিষ, যার একটিমাত্র ফোঁটাও যেকোনো মানুষের নিশ্চিত মৃত্যু ডেকে আনবে।
৫০০ বোতলের কোনটিতে বিষ আছে কীভাবে বের করবেন, নির্ণয় করতে না পেরে অস্থির হয়ে উঠলেন পান্টরাজ। খাবারের তালিকা থেকে পানীয়টি বাদও দেয়া যাবে না, কারণ মহারাণী পান্টভূমির বিখ্যাত এই ফলের রসটি খাবার আগ্রহের কথা বিশেষ করে ব্যক্ত করেছেন চিঠিতে। একটিই পথ খোলা আছে এখন। কিছু দিন আগে এক যুদ্ধে, কুশ (Kush) রাজ্যের ১৫০ জন যোদ্ধাকে বন্দী করেছেন পান্টরাজ—প্রতি বোতল থেকে এদেরকে এক চুমুক করে রস খাইয়ে পরীক্ষা করতে হবে। খানিক পর রাজা বুঝলেন এতেও কাজ হবে না, কারণ মারাত্মক বিষটি কাজ করে ধীরে ধীরে, বিষ পানের ৬-৮ ঘন্টা পরই কেবল মৃত্যু ঘটে। সুতরাং প্রথম ১৫০ বোতলে বিষ না পাওয়া গেলে, বাকী ৩৫০ বোতল পরীক্ষা করার সময় আর পাওয়া যাবে না। রাজা এবার একেবারে পাগলপারা হয়ে উঠলেন।
এ ঘটনার কিছু দিন পূর্বে দেশ ভ্রমণে বেরিয়ে ঘুরতে ঘুরতে পান্টে এসে উপস্থিত হয়েছিল মীর-আল-যাবিখ (Mir-al-Zawikh) নামে পারস্যের এক যুবক। বিনম্র এই যুবক অল্প দিনেই জয় করে নেয় পান্টবাসীদের মন। গণিতে অত্যন্ত পারদর্শী সে, জগতের সব কিছুকে গণিতের মধ্যে প্রকাশ করতে চায়। গণিতের মধ্যেই সে খুঁজে ফেরে সৃষ্টি জগতের অপার রহস্য।
পান্টরাজের আমন্ত্রণে মীর-আল-যাবিখ সে সময় রাজপ্রাসাদেই অবস্থান করছিল। রাজার ক্রান্তিলগ্নে এগিয়ে আসল সে। গণিতের সাহায্যে প্রমাণ করল ১৫০ জন লোক আসলে প্রয়োজন নেই, এবং এক গ্রুপ বোতল পরীক্ষার পর বাকী বোতল পরীক্ষার জন্য অপেক্ষারও প্রয়োজন নেই। মীর-যাবিখের পরামর্শ মোতাবেক সর্বনিম্ন সংখ্যক বন্দীকে দিয়ে নির্দিষ্ট নিয়মে ক্রমাগত বোতলের রস খাওয়ানো হতে লাগল। ৮ ঘন্টা পর রস পানকারী কয়েক জন বন্দী ঢলে পড়ল, এবং এদের দেখে সঠিকভাবে বিষাক্ত বোতলটি নিরূপণ করতে পারলেন রাজা।
প্রশ্ন
১।ফেরাউন রাণীর আগমনের পূর্বেই, ৫০০ বোতল থেকে বিষাক্ত বোতলটি সন্দেহাতীতভাবে বের করতে, সর্বনিম্ন কত জন মানুষকে দিয়ে বোতলগুলি থেকে রস পান করাতে হবে?
২। সর্বনিম্ন সংখ্যক মানুষ কাজে লাগানোর মানে হলো, একেক জন বন্দী একাধিক বোতল থেকে পান করবে। কে কোন কোন বোতল থেকে পান করবে, এটি কীভাবে নির্ধারণ করতে হবে? ঢলে পড়া বন্দীদের দেখে কীভাবে বোতলটি শনাক্ত করা যাবে?
ঐচ্ছিক প্রশ্ন
মীর-আল-যাবিখ একজন বিনম্র মানুষ হওয়া সত্ত্বেও, নিছক পরীক্ষার খাতিরে বন্দীদের উপর এই অমানবিক পরীক্ষাটি সম্পন্ন করলেন কেন?
তথ্যগত সতর্কতা
ফেরাউন রাণী হাতশেপসুতের পান্টদেশে গমন ইতিহাস সমর্থিত তথ্য, তবে ফলের রস সংক্রান্তটি ঘটনাটি নিছকই গণিতের খাতিরে তৈরি করা হয়েছে। মীর-আল-যাবিখ নামে পারস্যের কোনো গণিতবিদের কথা ইতিহাসে পাওয়া যায় না, চরিত্রটি তৈরি করা হয়েছে সর্বকালের অন্যতম সেরা গণিতবিদ, বীজগণিতের জনক, এলগোরিদমের উদ্ভাবক, আল-খোয়ারিজমি'র আদলে। মীর-যাবিখ (Mir-al-Zawikh) শব্দটির বর্ণগুলি পুনর্বিন্যাস করলে খোয়ারিজমি (al-Khwarizmi) নামটি পাওয়া যাবে।
ঐচ্ছিক প্রশ্নের উত্তর
রাজা পারাহু ক্ষিপ্ত হয়ে সব বন্দীর উপর, কোনো সুশৃঙ্খল নিয়ম ছাড়াই পরীক্ষাটি করতে চেয়েছিলেন। এতে সঠিক বোতলটি বের করা তো যেতোই না, বরং বিক্ষিপ্ত পানের ফলে আরো বেশি বন্দীর প্রাণহানি ঘটত। এছাড়া সে সময় মীর-যাবিখের সাথে ছিল তার বন্ধু, উপমহাদেশের গঙ্গারিডি এলাকার বিখ্যাত চিকিৎসক 'ধন্বন্তরী', যিনি ঢলে পড়া বন্দীদেরকে বনজ ঔষধ খাইয়ে দ্রুত সুস্থ করে তুলেছিলেন। ফলে শেষ পর্যন্ত কোনো বন্দীই মারা যায়নি।
বাকি প্রশ্নের উত্তর
পাঠকদের প্রচেষ্টার জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০০৯ রাত ৮:১০