মূল নিয়ম
ণত্ব বিধান বা মূর্ধন্য-ণ এর নিয়ম কেবলমাত্র তৎসম শব্দের (যে সকল শব্দ সংস্কৃত থেকে অবিকৃত অবস্থায় এসেছে) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
অ-তৎসম তথা অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র শব্দের ক্ষেত্রে সর্বদাই দন্ত-ন ব্যবহৃত হবে।
___________________________________________
১. তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে ণ-এর নিয়ম
১.১ যুক্তব্যঞ্জনে ট-বর্গের বর্ণগুলির (ট ঠ ড ঢ ণ) পূর্বে মূর্ধন্য-ণ
ণ্ট (ণ+ট) ঘণ্টা, নিষ্কণ্টক, বণ্টন
ণ্ঠ (ণ+ঠ) অবগুণ্ঠন, উৎকণ্ঠা, লুণ্ঠন
ণ্ড (ণ+ড) কলকুণ্ডলি, ঠাণ্ডা, লণ্ডভণ্ড
ণ্ঢ (ণ+ঢ) ঢুণ্ঢি, ঢেণ্ঢন (তেমন প্রচলিত নয় এই শব্দগুলি)
ণ্ণ (ণ্ণ) অক্ষুণ্ণ, ক্ষুণ্ণ, বিষণ্ণ
দ্রষ্টব্য
(১) ক্ষুন্নিবৃত্তি (ক্ষুৎ+নিবৃত্তি) এবং ক্ষুণ্ণি শব্দের উৎস এক নয়। প্রথমটি সাধিত (উপসর্গ, সন্ধি বা সমাসযোগে গঠিত) শব্দ, যেখানে ৎ+ন=ন্ন, ন এর দ্বিত্ব হয়েছে।
(২) ওয়ারেন্ট, কমান্ডার, পান্ডা যেহেতু বিদেশি শব্দ, এদের বানানে মূর্ধন্য-ণ হবে না।
১.২ ঋ, র, ষ এর পর মূর্ধন্য-ণ
ঋ বা ঋ-কারের পর
ঋণ, ঘৃণা, মৃণাল
র, র-ফলা, রেফ এর পর
অরণ্য, আহরণ, উদাহরণ
ভ্রূণ, মিশ্রণ, স্ত্রৈণ
অর্ণব, পূর্ণিমা, বিশীর্ণ
দ্রষ্টব্য
এই নিয়মানুসারে রেফ এর পর মূর্ধন্য-ণ হয় বলে তৎসম শব্দে রেফ-যুক্ত দন্ত-ন সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু সাধিত শব্দে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়:
অহর্নিশ (অহ+নিশ), দুর্নীতি (দুর্+নীতি), দুর্নাম (দুর্+নাম)।
ষ এর পর
অন্বেষণ, নিষ্পেষণ, ভাষণ
দ্রষ্টব্য
ষ এর সাথে ণ যুক্ত হলে, যুক্তবর্ণের চেহারা হবে ষ্ণ: কবোষ্ণ, বৈষ্ণব, উষ্ণীষ।
ক্ষ=ক+ষ, সুতরাং ক্ষ এবং ষ এর নিয়ম একই:
ঈক্ষণ, তীক্ষ্ণ, সমীক্ষণ।
১.৩ একই শব্দে ঋ/র, র-ফলা, রেফ/ষ, ক্ষ/
এদের যে-কোনোটির পরে যদি স্বরবর্ণ, ক-বর্গের বর্ণ (ক খ গ ঘ ঙ), প-বর্গের বর্ণ (প ফ ব ভ ম), য য় হ ং এই সব বর্ণের এক বা একাধিক থাকে, তবে তার পরে মূর্ধন্য-ণ হবে। এই নিয়মটি আসলে ১.২ এর বিস্তৃত নিয়ম।
রোপণ (র+ও+প+ন্), শ্রাবণ (শ+র+আ+ব+ন্)
দ্রষ্টব্য
ঋ/র, র-ফলা, রেফ/ষ, ক্ষ/ এর পরে অন্য বর্গের বর্ণ থাকলে মূর্ধন্য-ণ হবে না:
দর্শন, প্রার্থনা।
সন্ধিজাত বা সাধিত শব্দের ক্ষেত্রেও ১.৩ প্রযোজ্য নয় [১.১ দ্রষ্টব্যের মতো] :
নিষ্পন্ন (নি:+পন্ন)।
শব্দের শেষ বর্ণটিতে হসন্ত-উচ্চারণ থাকলেও এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়:
শ্রীমান্।
১.৪ সাধিত শব্দে মূর্ধন্য-ণ
সাধিত শব্দে ঋ, র ষ ক্ষ এর পর সাধারণত মূর্ধন্য-ণ হয় না। তবে বিশেষ নিয়মে মূর্ধন্য-ণ হতে পারে।
১.৪.১ পরি-, প্র-, নির- এই ৩টি উপসর্গের পর ণ হয়:
পরিণয়, প্রণাম, নির্ণয়। [এটি আসলে ১.২ এবং ১.৩ কে অনুসরণ করছে]।
ব্যতিক্রম: পরিনির্বাণ, নির্নিমেষ।
১.৪.২ র বা র-ফলা'র পরপদে -অয়ন থাকলে এর ন মূর্ধন্য-ণ হবে: উত্তরায়ণ, চান্দ্রায়ণ, রবীন্দ্রায়ণ। [এটি ১.৩ কে অনুসরণ করছে: র+স্বরবর্ণ আ+য়]।
১.৪.৩ সাধিত কিছু শব্দে র এর প্রভাবে ন মূর্ধন্য-ণ'তে পরিণত হয়: অগ্রণী, গ্রামীণ।
ব্যতিক্রম: অগ্রনেতা।
১.৪.৪ সাধিত শব্দ কোনো কিছুর নাম বুঝাতে এক শব্দ বিবেচিত হলে ণ-ত্ব বিধান প্রযোজ্য:
শূর্পণখা (শূর্প+নখা), অগ্রহায়ণ।
দ্রষ্টব্য
গণ ধাতু সহযোগে গঠিত শব্দ সমূহে ণ হবে: গণিত, গণনা, গণ্য; গণৎকার; গণশক্তি, জনগণ, গণসংগীত।
১.৫ নিত্য মূর্ধণ্য-ণ
অণু, কণা, কোণ,ফণা, বেণী, শাণ, কঙ্কণ, বাণ, ভণিতা, শোণিত, ঘুণ, বীণাপাণি, লাবণ্য, বিপণি, মাণিক্য, চাণক্য, গণেশ প্রভৃতি।
[সিরিজটি ড. মাহবুবুল হকের "বাংলা বানানের নিয়ম" গ্রন্থের উপর মূলত ভিত্তি করে]