বিকেল গড়িয়ে নগরীতে সন্ধ্যা নামে। ভোরের আবছা অন্ধকার গড়িয়ে নেমে আসে আলো। কিন্তু কাইকরের জীবনে নেই সম্প্রতি আলো বা আধার! কিন্তু কেন?
খুব অল্প মাইনের চাকরি করে কাইকর। এক বিষন্ন বাতাসের সন্ধায় মা-বাবাকে হারিয়ে অবলীলায় ঘুরে বেড়ায় এখন পুরোটা শহর। শীত এসে শীত যায় কিন্তু একটিবার খোঁজ নেবার মতো কেউ নেই তার।
কাইকরের মাইনে অল্প তাই তার স্বপ্ন অল্প। এক সন্ধ্যায় ভাড়া মিটাবার সময় দু'টাকার জন্য রিকশাওয়ালার গালে ঠাটিয়ে একটা চড় বসিয়ে দেয়। ভাবটা এমন যেন রোজকার রিকশাওয়ালাদের গালে নিয়ম করে চড় বসিয়ে বেড়াই। হাজার তিনেক টাকার বিনিময়ে রাতে মাথা গোঁজার জন্য একটা ছোট্ট রংহীন রুম নিয়ে থাকে। বেতনের অবশিষ্ট যা থাকে তা দিয়ে কোনরকম মোটা চালের ভাতের সঙ্গে কিচমিচু তরকারি দিয়ে মাস পার করে।
মেঘহীন বৃষ্টির মতই তার জীবনে আগমন ঘটে অপ্সরার! দেখতে শেষ বিকেলের শেষ রোদের মতো। কপালে ছোট্ট কালো টিপের সঙ্গে কায়দা করে কুচি দিয়ে শাড়ি পরে। নিয়ম করে রোজকার তারা টিএসসি চত্বরে বসে খুনসুটির প্রেম করে। কখনোসখনো অপ্সরার কপালে উপচে পড়া গুটিকয়েক সোনালি চুলের মাঝবরাবর ঠোঁট চুবিয়ে চুমু খাই। কাছেপিঠের কিছু মানুষ ওদের চুমু খাওয়া দেখে অল্প সময়ের জন্য দাঁড়িয়ে আবার হাটা শুরু করে। দুষ্টুমির ছলে অপ্সরা মুখভার করে বলে, কাইকর সাহেব! আমি যদি তোমাকে রেখে এক জীবনের জন্য চলে যাই তাহলে কি করবে? অপ্সরার মুখে অমন কথা শুনে, সে ভরা মানুষের ভিড়ে চোখের জল ফেলে খুব করে। কাইকরের শিশুসুলভ আচরণ দেখে অপ্সরা লোকলজ্জার ভয় ফেলে তার ঠোঁটে ঠোঁট পুরে দেয় শহরের সমস্ত কিছুকে নিস্তব্ধ করে দিয়ে।
মাস শেষে মাইনে হাতে পাবার পর খুশিমনে শাহবাগের আজিজ মার্কেট থেকে গোটা কয়েক নীল চুড়ি, লাল লিপস্টিক ও গিয়া কালারের একটা শাড়ি কিনে অপ্সরার জন্যে।
ছোট স্বপ্নের ছোট মানুষটা ছোট ছোট কিছুমিছু তার জন্য কিনতে পেরে একপৃথিবী খুশি। ধুলিমাখা শহরের সুরুচিসম্পন্ন বাতাস গিলতে গিলতে সে বড় শহরের ছোট গলির সামনে গিয়ে দাঁড়ায় অপ্সরার জন্য।
অদূরে থেকে আসা অপ্সরার আগমনী গন্ধ পেয়ে কাইকর সবুজ শ্যাওলাযুক্ত দেয়ালের সঙ্গে মিটিমিটি হাসতে হাসতে জড়োসড়ো ভাবে হেলান দিয়ে বসে।
সেদিন খোলা আকাশে বড় সাইজের একখানা সাদা চকচকে চাঁদ ভরা জোৎস্নার যৌবনে ভাসিয়ে দিচ্ছে পুরোশহর। ল্যাম্পোস্টের হলুদ আলো লম্বাটে হয়ে গলির মোড়ের মাঝবরাবর পড়েছে। পাশের পরিত্যক্ত বিল্ডিং থেকে কিছু পাখির দল বেসুরা গলায় গান গাই।
অপ্সরা গলির মোড়ে পা রাখতেই তার মন গহীনের প্রেমের বাতাস উথালপাতাল ভাবে দোলা শুরু করে। খানিকটা সময়ের জন্য যান্ত্রিক নগরী ল্যাম্পপোস্টের আলো অন্ধকারে রূপ নেয়! কিছু মুখোশধারী নরপশুর দল অপ্সরাকে কষে-টষে বেঁধে নিয়ে যায় দূর দেশের দূরে কোথাও!
জান্তব নগরীর জান্তব উল্লাসগুলো বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেনা। কোনো এক শহরীক ঝরে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়ে থাকে নর্দমার এক কোণে!
তার কিছুদিন পর থেকেই কাইকর শহরের ছোট-ছোট গলির মোড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে! কিছু সময় হাসে, কিছু সময় কাঁদে আবার কিছু সময় চোখ বুজে থাকে। নগরীর মানুষজন এখন তাকে গলির পাগল কাইকর হিসেবে চেনে।
ময়লা গন্ধযুক্ত ছেঁড়া শার্ট-প্যান্ট ও উস্কোখুস্কো জটলা চুল নিয়ে পড়ে থাকে শহরের অলিতে গলিতে। পেটের দায়ে শহরের বউওয়ালা পুরুষদের চাহিদা মেটানো নাসরিন ভাই ডেকে রাতের খাবার দেই। তা দেখে চোখে জল জমে কাইকরের। ল্যাম্পপোষ্টের আলো ও চাঁদের জোসনা আড়াল করে চোখের জল ফেলে নিরবে।
ভোর সকালের সোনালী রোদ প্রথম এসে পড়ে তার চোখের উপরে। কাইকর তারপরেও চোখ বুজে, পেট বুঝে ঘুমিয়ে থাকে বিচক্ষণ।
এখন আর চোখের কোণে লেপ্টে থাকা জলের দাগ দেখবার কেউ নেই! নেই বাবা-মা ও সেই অপ্সরা।
কাইকর এখনো রোজ স্বপ্ন দেখে, একদিন খুব সকালে অপ্সরা এসে তার জটলা চুলগুলো ছাড়িয়ে দিয়ে নতুন করে নতুন ভাবে জড়িয়ে ধরে বেঁচে রবে আজীবন।
~আব্দুল্লাহ আল মামুন(কাইকর)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:৪৩