রাত ১ টা ৪৫; কমলাপুর রেল স্টেশন। চাকরীর একটা ইন্টারভিও দিয়ে চিটাগং ফিরব। কুলিল্লায় ইউ পি নির্বাচনীয় সহিংসতা কারণে ট্রেন ৫ ঘণ্টা লেট ! ১১ টার ট্রেন আসবে ২ টায়! ১২ টা পর্যন্ত লোকজন ষ্টেশন খুব সরব ছিল। এখন যেন কেউ ক্লান্ত, কেও বিরক্ত, কেও উত্তেজিত! রাত বাড়ার সাথে সাথে সবাই যেন চুপসে গেছে। যে যার মত ঝিমুচ্চে। অন্য সব ট্রেন ছেড়ে গেছে। বিশাল এক ফ্লাটফর্মে আমরা কিছু যাত্রী যে যার মত অপেক্ষারত।
একা দেখে বোধ করি, ঘুম আসছিল না। লম্বা প্ল্যাটফর্ম ধরে হাঁটছি এ মাথা থেকে ও মাথা। এ জায়গাটায় আলো তুলনামলক কম। নিয়নের মৃদু একটা আলো। হঠাৎ কি যেন একটা ঝলসে উঠল। সবুজ জরির কাজের সাড়ি পরে একটা মেয়ে রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কপালে বড় একটা লাল টিপ। হাত ভর্তি চুড়ি। ঠোঁটে কটকটে লাল রঙের লিপস্টিক। আমার বয়সী একটা মেয়ে। এত কাছাকাছি একটা বারবনিতাকে এই প্রথম দেখলাম। এরা বরাবরই সমাজে গোপন, নিশাচরী, যেন এক নিষিদ্ধ ফল ! প্রথমে আমিও মুখ ফিরিয়ে নিলাম। জায়গাটা বোধ করি নিরাপদ নয়। আশেপাশে মাংসাশী শিকারি প্রাণী আছে নিশ্চয়। প্ল্যাটফর্মের প্রথম দিকে ফিরে যাওয়াই নিরাপদ।
‘’উফ! কী মশা, জ্বালা।‘’ এটা শুনেই পিছন ফিরে তাকালাম। আশ্চর্য ! দ্বিতীয়বার তাকাতেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠল। কী সুন্দর লাগছে মেয়েটিকে ! মাকে দেখেও মাঝে মাঝে ঠিক এরকম অবাক হই আমি। বুকে সাহস নিয়ে বললাম, ‘’আপনি কী ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন? নীচে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’’
‘’ঢং করেন আমার লগে? কেন দারাই আচী বুজেন না, খুকী না?’’
‘’ও আচ্ছা, সরি।‘’
‘’আফা শোনেন, আমিও সরি। তিনদিন পর স্টেশন আইলাম। এই টাইমে বালো কাশটোমার পাওয়ন যায়। সুট-বুট ওলা সাবদের ও পাই। কিন্তু আইজগা নাকি ট্রেন লেট? লাস্ট ট্রেনটা যায় নাই দেখি। লোকজন সব দেখি বইয়া রইচে।‘’
‘’হূম। ট্রেনটা লেট করেছে। announce করেছে অবশ্য আর ১৫ মিনিট লাগবে।‘’
‘’উফ! মশা।‘’
‘’আপনি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? উপরে এসে এখানে বসুন না।‘’
‘’না না। এইখানেই ভাল আচি। আফনে একা নাকি? বাফ-বাই কেউ সাতে নাই? এত রাইতে একা ডর লাগতেচে না?’’
‘’আমি ঠিক একা না। আমার পরিবারে সবই আছে। আমি চিটাগং থাকি। ঢাকায় দুদিনের জন্য এসেছি চাকরীর একটা ইন্টারভিও দিতে। আর একা কই। মামা পৌঁছে দিল। ওদিকে আবার ভাই এসে নিয়ে যাবে।‘’
‘’এন্টারভু!? গলাটা একটু নামিয়ে বলল, ‘’দশ বচর আগে আমিও এই লাইনে আসচি এক এন্টারভু দিয়া। হুম.................. নাইন পাসের পরই বাপে মরল। তিন বোইন, দুই ভাই আমরা। আমি সবার বড়। ভাই দুইটা মাটির লগে। চোড ভাইটারে জন্ম দেওয়নের পর থাইকাই মায়ের কিচুনি বেরাম ধরল। কি যে অভাব শুরু হইল আফা! পারলে মাডি কামরাইয়া খাই অবস্থা। আব্বার এক মামতো ভাই আইসা একদিন কইলো, ’’ ঢাকা চল। ওইখানে চাকরির অভাব নাই।।‘’
‘’মায়ে জোর কইরা পাঠাই দিল। কিচুদিনের পরই একটা গার্মেন্টসে চাকরি পাইলাম। ৯০০ টাকা দিত। ৫০০ টাকা বারিত পাঠাইতাম। নিজে ১৫ দিন খাইতাম আর ১৫ দিন খাইতাম না। আম্মায় কয়, এই টাকায় কিচু হয়না। আমি কোন ছাতার কাম করি! চোড বোইন দুইটা মেটটিক দিব। ভাই দুইটারও খরচ বারতেচে। মেনেজার রে একদিন কইলাম,’’ স্যার, বেতন বারাইয়া দেন। এই টাকায় চলে না।‘’
দুইদিন পর মেনেজার কয়, ‘’মাসে দুই হাজার করে পাবি। একটা বাসায় কাজ করবি। খাওয়া দাওয়া ফ্রী। কাজও কম। কাল আমার সাথে যাবি। একটা ছোট ইন্টারভিও হবে শুধু। রাজী? ‘’
"পরেরদিন স্যারের লগে গেলাম। বিশাল এক বাড়ি। মানুশজন নাই। একটা লুলা বেডি। হেরে আমার দেকতে হইব। অবশ্য সেদিন আমার ইন্তারভু লাগে নাই। মেনেজারের পরিচিত, তাই কাজটা নাকি হইয়া গেচে!"
‘’ বাড়ির সাব মাইজ রাতে আসে মাইয়া নিয়া। ওই টাইমে আমার ও কাজ পরে। সাবরে চা-কফি বানাই দিতে হয়। পরে পরে সাবরে বাইরে থিকে আর মাইয়া আনতে হইত না। আর আমার বেতন হইয়া গেল চাইর হাজার টাকা!! বাড়িটাতেও মানুশজন আসতে লাগল !!
মায়ে এখন পাকা বাসায় থাকে। বোইন দুইটা বিয়া করসে আফা। মাশাল্লা, পোলাপাইনও হইসে। ভাইটা আবার ডিগ্রি দিব। ছোটটা কলেজে পরে। হেরাও ঢাকা আইতে চায়। চাকরি করতে চায়। আমি মানা করি। কইচি, যতদিন আমি আচি চাকরির দরকার নাই। তোমরা আগে পইরা নাও।।‘’
‘’এখন তো সবাই ভাল আছে , এই পেশা ছেড়ে দেন না কেন?’’ প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম।
‘’আমি চাড়তে চাইলেও পেশা আমারে ছাড়বে না, আফা। মা রে এখনও আমার দেকতে হয়। এখনও আমার কাজ শেষ হয়নাই। আর নষ্ট মাইয়া গুলারে কেউ কাজ দেয় না। এইটা একটা। এইটা একটা ভয়াবহ চক্কর আফা। যে একবার এই চক্করে পা ফেলচে, মরণ পর্যন্ত আর শান্তি নাই। কাজ করলেও বদনাম, আবার কাজ ছাইরা দিলেও আপনার এই বদনাম যাইব না আফা।।"
ঘোষণা হচ্ছে, কিছুক্ষণ পরই ট্রেনটা আসবে। আমাকে মূল ফ্লাটফর্মে ফিরে যেতে হবে। কিভাবে বিদায় নেব ভাবছি। ওর জন্য কি করা যায় ভাবছি।
‘’উফ! মশা রে মশা, খাইয়া ফেললো একদম।‘’
‘’আপনি উপরে উঠে আসুন তো। ধরুন, আমার হাতটা ধরুন।‘’
‘’ না! ’’ চেঁচিয়ে বলল। ‘’লোকে আমার লগে আপনারে দেখলে, আপনার বদনাম হবে। কি দরকার সব মাইয়াগো বদনামের ভাগী হইবার। আফনে চইলা যান। ট্রেন আক্ষুনি চইলা আইব। ওই দেখেন বাঁশি বাজতাচে। ট্রেনের আলো আসার আগেই আমারে সইরা যাইতে হইব। আপনি ভাগেন তো। নিজের বদনামী কইরেন না।।‘’
‘’হুম, যাচ্ছি। আচ্ছা, আপনার নাম কি?’’
‘’কেন? গল্প লিখবেন? নাটক সিনেমা বানাইবেন? এটাই শুধু পারে এই সমাজ। আমাদের কোন নাম থাকে না। আপনার ইচ্ছা মতো একটা নাম দিয়া দিয়েন।‘’
অন্ধকারে আমি মেয়েটির মিলিয়ে যাওয়া দেখলাম।।
** অনেক আগের একটি লেখা। বলা যায় রিপোস্ট! তখন সামুতে কেও আমাকে চিনতো না। কেউ লেখাও পড়ত না আমার। একটা দুটা কমেন্ট পেলেই কি যে খুশী হতাম। যেমনটা এখনো হই।
যদিও সামুর অসাধারণ সব ব্লগারদের লেখাগুলো পড়ে, লেখালেখিতে নিজেকে এখনো শিশুই ভাবি। ভালো-খারাপ যাই হোক, আমার লেখা গুলোতে সব সময় একটা নাম থাকেই, তিনি মাহী ফ্লোরা আপু। লেখাটা তাই ওনাকে উৎসর্গ করলাম।
আপনাদের সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ, যারা কষ্ট করে পড়ে যান! বিশ্বাস করুন, আপনাদের সবার জন্যই আমি অপেক্ষা করি! আপনাদের নামগুলো আমার অনেক প্রিয়!
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:৪৯