উল্লেখ্য, বন্ধুমহলে সেই ছিল একমাত্র ব্যাচেলর। সবাই যেখানে, ছেলেমেয়ের বাবা ডাক শুনে ফেলেছে, কিংবা শোনার পথে, সেখানে জায়েদ সবে বিয়ে করল। যদিও সেটা বিষয় নয়, মা বলে বিয়েতে ছেলেদের আবার বয়স কি!! তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রায় পঁয়ত্রিশ ছুঁই ছুঁই জায়েদের এইসব আনুষ্ঠানিকতা করতে হল, বন্ধুবান্ধবদের চাপে পড়ে। হারাধনের একমাত্র বলে কিনা জানা নাই, কিন্তু জায়েদ কে তার বন্ধুরা বেশী বেশী রকমের পছন্দ করে।
কারণ হিসেবে বন্ধু তন্ময় একদিন ওকে বলেছিল, “কঠিন সময়ে কিভাবে ধৈর্য ধরতে হয়, বুকে চিনচিন ব্যাথা নিয়েও মুখে কিভাবে হাসি রাখতে হয়, তা আমরা তোর থেকেই শিখেছি।“
মন্তব্যটায় যুক্তি আছে বৈকি। এই যেমন, জায়েদ কাওকেই বুঝতে দিচ্ছে না যে, ওর প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা করছে, সেই সাথে চোয়াল ও!! বন্ধুদের ডার্টি জোকস শুরু হয়েছিল সেই বিয়ের ষ্টেজ থেকেই। তখন থেকেই ক্রমগত হেসে চলেছে সে!! মেয়েপক্ষের কয়েকজন তো রীতিমতো বাঁকা চোখেই তাকিয়ে ছিল, “বুইরা জামাই এমন হাসে কেন, নির্লজ্জ!” এমনকি, তার বৌ যখন সাথে বসেছিল, আচমকা পনের মিনিট আগে রনির বলা একটা জোক মনে পড়ে গেল। ফিক করে হেসে উঠল জায়েদ। নতুন বৌ বাঁকাচোখে ছোট্ট করে একটা কাশি দিয়ে সাবধান করে দিল।
জায়েদের না হেসে উপায়ও নেই, সবাই তাদের বেস্ট কালেকশন অব ডার্টি জোকস, নিয়ে এসেছে জায়েদের বিয়েতে শোনাবে বলে। অবশ্য এই ট্র্যাডিশনটা জায়েদেরই আবিষ্কার।
অন্যবন্ধুদের বিয়েতে, ও এরকম জোকস বলে বলে আসর মাতিয়ে আসত। আরেকটা কাজ (কারও কারও মতে অকাজ) করতো। তার যেসব বন্ধুদের প্রেমের বিয়ে ছিল, মানে বাসর নিয়ে যাদের নানা কল্পনা- পূর্বপরিকল্পনা ছিল, তাদের বাসর ঘরে ঢোকার আগে, বন্ধুরা যে আড্ডাটা মারত, সেখানে পেপসির সাথে ও ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিত! স্বপ্নের বাসরে তার বন্ধুটি ঘুমিয়ে কাটাতো! আর সকালে প্রাক্তন প্রেমিকা প্লাস নববধূ দ্বারা গালি ভক্ষণের গল্প যখন সবাই জায়েদের সাথে করত, তখন ও কিযে মজা পেত।!
অবশ্য, পরে পরে জায়েদের এই বাসর ভণ্ডুল করার প্ল্যান সবাই জেন গেল। এমনকি প্রেম করে বিয়ে করতে যাওয়া বন্ধু থেকে শুরু করে সেটেল ম্যারেজের বন্ধু- সবাই বাসর ঘরে ঘুমানোর ভয়েই, জায়েদ কে বিয়েতে একপ্রকার নিমন্ত্রন-ই জানাত না। ব্যাচারা জায়েদ, অলক্ষ্যেই তার এই দুষ্ট বুদ্ধি বিসর্জন দিল।
বিপদের কথা হল, যাদের বাসর সে ভণ্ডুল করেছিল, তারা সব্বাই আজ উপস্থিত! একেই বলে পরের জন্য খোঁড়া গর্তে নিজে পড়া! অবশ্য, ওসব বাঁদরামি অনেক অনেক আগের কথা, সবার কি আর মনে আছে? যদিও সেলফ প্রটেকশন স্বরূপ, জায়েদ এখনো বন্ধুদের বাড়িয়ে দেওয়া কিছুই পান করে নাই। এমনকি পানিও না।
জায়েদের প্রচণ্ড তৃষ্ণা পেয়েছে, এবং ঘুমও আসছে। তার বন্ধুদের প্ল্যান মনে হয়, কথা বলে বলে ওকে আটকে রাখা। তিনটা বাজে, এখন পর্যন্ত কেও-ই যাবার নাম করছে না। সর্বনাশ, ওরা দেখি বুদ্ধিতে আরও এক ডিগ্রী সরেস!
তন্বী নিশ্চয় কত আশা ভরসা নিয়ে বসে আছে রুমে, নাকি অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে! কে জানে!! তন্বী ছিল জায়েদের বন্ধু মিরাজের ফেসবুক বন্ধু। নানা কমেন্টে ওদের দেখা হত, সেই থেকে বন্ধুত্ব। কয়েক মাসের মাথায়, তন্বীই বলে বসল, চলো বিয়ে করি। জায়েদ হ্যাঁ, না কিছুই বলল না। কিভাবে কিভাবে যেন মিরাজ আর তন্বী মিলেই সব করে ফেলল। মেয়েটার সাহস দেখে জায়েদ একপ্রকার মুগ্ধই হল। মেয়েটা যদি অমন ক্রেজি আর ডেসপারেট কিছু না করতো, তবে ওর ভাগ্যে যে বিয়ে ছিলনা এটা প্রায় নিশ্চিত-ই ছিল।
যদিও কিছু কথা বলার ছিল তন্বীকে, কিন্তু অসম্ভব সাহসী এই মেয়েটা বলে বসল, “যা বলার, বিয়ের পর বলবে।“
জায়েদের সেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো আজই বলবে তন্বীকে, এই রাতেই। ওর কষ্টমাখা একটা অতীত আছে, বিশ্বাস ভাঙার একটা বেদনা আছে। কেন তার বিয়ে করতে এত দেরী হল। কেন সে, মেয়েদের কে বিশ্বাস করতে পারে না। তার মনে আসলে সম্পর্কের বিষয়গুলো নিয়ে খুব একটা ভালোবাসা কাজ করে না। সেইসব সব গাঙ্গা গড়ার অতীতের সব গল্প-ই সে তন্বীকে আজ বলবে। কিচ্ছু লুকানো উচিত নয়। অন্যদের কাছে ভুল ভাবে শুনে পরে কষ্ট পাবার চেয়ে, আজ রাতেই সে সব বলে দেবে। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, অথচ কিছুই হচ্ছে না।
সবাই যখন, জায়েদ কে বাসর রাতে বিলাই মারার কলাকৌশল বর্ণনা করছিল, তখনি শেষমেশ মিরাজ ই ত্রাণকর্তা রূপে আবারো হাজির।
“শালার পুত, মাথা খাইসস নাকি সব গুলান, টাইম দেখসস?? যা, বাড়িত যা। যা শুরু করসস তোরা, জায়েদের বিলাই মারা অন্তত এই রাতে আর হয়ে উঠবে না। তিনটা বাজে, ওরে এবার বাসরে যাইতে দে।“
সবাই তৎক্ষণাৎ যে যার ঘড়ির দিকে তাকাল। অবশেষে, সেই সুবর্ণক্ষণ এল! বন্ধুরা সব বিদায় নিল। এই কৃতিত্বটাও তন্বী আর মিরাজের যৌথ কৃতিত্ব। তন্বীই নাকি, মিরাজকে ভেতর থেকে ফোন করে জানিয়েছিল, “অনেক আড্ডাবাজি হল তোমাদের। এবার তোমার বেহুশ বন্ধুকে আসতে বল। আনেক রাত হয়েছে।“
তন্বীর কয়েকটা মেসেজ জায়েদও পেয়েছিল। কিন্তু, কি করে যে বন্ধুদের যেতে বলে!!
রুমে এসে জায়েদ দেখল, ফুল দিয়ে সাজানো ঘরে, তন্বী খাটের ঠিক মাঝে অর্ধেক একটা ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। খাটের পাশে গ্লাস ভর্তি দুধ, মিষ্টি, এমনকি পান ও রাখা আছে!! ঠিক বাংলা সিনেমার বাসর রাতের দৃশ্য গুলার মতো। হিসেব মতে, জায়েদের এখন তন্বীর কাছে যাওয়া উচিত, এবং পরের দৃশ্যে তন্বী জায়েদের পা ধরে সালাম করতে গিয়ে বলবে, “তুমি আমার স্বামী, আমি তোমার বউ// খোদার পর তোমায় আমি বড় বলে জানি।।”
জায়েদ তখনি বলে উঠবে, “আরে আরে! কি করছো!! তোমার স্থান আমার পায়ে নয়, বুকে।“
তারপর আরেকটা গান হবে, “শত জনমের ভাগ্য, তুমি আমার জীবনে এলে, কত সাধনায় এমন ভাগ্য মেলে!! ”
সবশেষে ডুয়েট একটা গান হবে, “আজ রাত সারারাত জেগে থাকব, দুচোখের ইশারায় কাছে ডাকব। ভুল যদি হয়ে যায় অজান্তেই, হুম...... ভালোবাসা তারেই আমি বলব।”
অজান্তেই জায়েদের একটা হাসি পেল। তখনি তন্বী ঘোমটা সরিয়ে বলল,
“আচ্ছা, তোমার কি বিবেক বুদ্ধি কিছু নাই, নাকি?? রাত তিনটার সময় তুমি বাসর রাতে আসছো!! আমি দুই দফা ঘুমিয়েও নিয়েছি। আর তুমি এক মাইল দূরে দাঁড়িয়ে আছো কেন?? কাছে এসো। আমি চিৎকার করে পাড়া জাগাতে পারব না। আমার কিছু কথা আছে।
যেগুলো তোমাকে এইরাতেই জানানো দরকার। বিয়ের আগেও জানাতে পারতাম, কিন্তু খুব একটা জরুরি মনে করিনাই বিধায়, বলি নাই। তাও একটা নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছি, আমার সবকিছুই তোমার জেনে রাখা ভাল। পরে কার থেকে, কি না কি উল্টা পাল্টা শুনতে পাও। শেষে কষ্ট পাবে। ”
"আমার প্রেম ঘটিত একটা সম্পর্ক ছিল। ঐ যা হয়, ছেলেটা বিশ্বাসঘাতকতা করল। তারপর থেকেই, ছেলেদের ঘেন্না হয়। সম্পর্ক ফালতু লাগে। কিন্তু পরিবার সমাজ তো কিছু বুঝতে চায়না। তাই বিয়ে করা। জীবন কাটানো। আমি তোমাকে ঠকাতে চাই না। আমি জানি, দুনিয়ার সব পুরুষ ঘৃণিত নয়, খারাপ নয়। সর্বত্রই ভালো খারাপ আছে।
আর তাই, এটা মেনে নিয়েই এত কাল পরে বিয়ে করলাম। তোমাকে আমার ভালো লেগেছিল। তাই সাহস করলাম আবার স্বপ্ন দেখার। শুধু তোমার একটু সাহায্য চাই, একজন বন্ধুর মতো। মানসিকভাবে আমাকে গুছিয়ে উঠতে একটু সময় দিবে প্লীজ। আবার যেন, আমি ভালবাসতে পারি। সুন্দর সুখী একটা ঘর, সংসার সব মেয়েরই লালিত স্বপ্ন থাকে। আমারও আছে, কিন্তু একটু সময় লাগবে, বুঝলে? তোমার সহযোগিতা লাগবে।“
জায়েদ একপ্রকার হ্যাঁ করেই তাকিয়ে রইল তন্বীর দিকে!! কি এই মেয়ে!!?? ঠিক যে কথাগুলো জায়েদ ভেবেই পাচ্ছিলো না কিভাবে বলবে, কোত্থেকে শুরু করবে, উচিত হবে কি, হবে না! অথচ কি অবলীলায়, সাহস আর সততায় তন্বী সব গড়গড় করে বলে দিল!!
তার বন্ধুদের কথা মনে পড়ে গেল, “দোস্ত, বিলাই কিন্তু প্রথম রাতেই মারবি!” কাল সকালে কিভাবে বন্ধুদের বলবে যে, বিলাইটা তন্বী-ই আগে মেরে দিয়েছে!!
তন্বীর কাছে বিলাই শিকার জনিত এই পরাজয়ে জায়েদ অবশ্য খুব একটা বিব্রত নয়। বরং কি জানি তার হঠাৎ কেন যেন মনে হচ্ছে, এরকম একটা মেয়ের কাছে সে জীবনের বাকিদিন গুলোতেও হারবে। এই হারার মাঝেও আনন্দ আছে। ভালোবাসায় সেই জেতে বেশী, যে ভালোবাসার মানুষের কাছে হারে বেশী।
তাদের ঘটক বন্ধু মিরাজের একটা মেসেজ আসে, “wts up, dost! ” জায়েদ তন্বীর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বন্ধুকে রিপ্লে পাঠায়, “For god’s sake hold your tongue, and let me love.”
*** আশা করছি, লেখাটার হিওমার সবার ভালো লাগবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৩৪