আজ থেকে ১০ বছর আগেও এ দেশের মানুষ কল্পনা করতে পারেনি যে, এদেশ একদিন শতভাগ বিদ্যুতায়ন হবে। যে দেশের প্রতিটি মানুষের DNA-র মধ্যে দুর্নীতি করার জিনগত নির্দেশ ধারণ করা থাকে, নিজের দেশের উন্নয়ন দেখলে যে দেশের বেশিরভাগ মানুষের গাজ্বালা শুরু করে, জন্মভূমিকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা যে দেশের মানুষের কাছে বিনোদন, যে দেশের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মানুষ বাস করে সাগর-নদীর বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চল কিংবা দুর্গম পাহাড়ি এলাকা বা বনাঞ্চলে - 'ফকিরনী' দেশের তালিকা থেকে সদ্য উত্তরণ পাওয়া সে দেশকে শতভাগ বিদ্যুতায়ন করে বর্তমান সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা "অসম্ভবকে সম্ভব করার" আরো একটি বিরল নজির স্থাপন করলেন।
পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় নির্মিত পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র
আজ ২১ মার্চ ২০২২, সোমবার পটুয়াখালীর পায়রায় দেশের সবচেয়ে বড় ও সর্বাধুনিক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পায়রা নদীর তীরে এক হাজার একর জমিতে গড়ে তোলা আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির এ বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন ক্ষমতার দিক দিয়ে বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র। বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় পায়রার এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে চীনের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এনইপিসি ও সিইসিসি কনসোর্টিয়াম। নির্মাণ ব্যয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ ঋণ হিসেবে দিয়েছে চীনের এক্সিম ব্যাংক ও চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্ধেক মালিকানা বাংলাদেশের, বাকি অর্ধেক মালিকানা চায়না পাওয়ার কোম্পানির (বিসিপিসিএল)।
কর্মকর্তারা বলছেন, এ তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বাংলাদেশ বিশ্বের ত্রয়োদশ এবং এশিয়ায় সপ্তম দেশ। দক্ষিণ এশিয়াতে বাংলাদেশ ছাড়া শুধু ভারতে এ ধরনের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। ২০২০ সালের ১৫ মে প্রথমে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাণিজ্যিকভাবে এই কেন্দ্র থেকে উৎপাদন করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। পরে একই বছরের ৮ ডিসেম্বর আল্ট্রা সুপার প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্বিতীয় ইউনিটের ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র। পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রকল্পের ২য় অংশে আরও ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি এটি চালু হতে পারে।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেছিল ২০০৯ সালে। বর্তমান ২০২২ সালে এসে অর্থাৎ ১৩ বছরে বিদ্যুৎ খাতে কতটুকু উন্নয়ন হয়েছে তার একটি তুলনামূলক চিত্র:
শতভাগ বিদ্যুতায়নের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা
হাওড়-বিলে ঘেরা বসতি, দুর্গম পাহাড় ও বিচ্ছিন্ন সব চরে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ–সংযোগের সুবিধা। গ্রিড–সুবিধা না থাকায় এসব এলাকায় কোথাও নদী পারাপার লাইন এবং কোথাও সাগর-নদীর তলদেশ দিয়ে টানা হয়েছে সাবমেরিন কেব্ল। কোথাও কোথাও তা করা যায়নি। তাই বসানো হয়েছে সৌরবিদ্যুৎ (সোলার হোম সিস্টেম)। আর এভাবেই দেশের প্রতিটি জনপদে পৌঁছানো হয়েছে বিদ্যুৎ–সুবিধা। আজ সোমবার শতভাগ বিদ্যুতায়নের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দেশে মোট উপজেলার সংখ্যা ৪৯২। এর মধ্যে ৪৬২টি উপজেলায় বিদ্যুৎসেবা দিচ্ছে দেশের আরইবি। এ সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যুৎ সরবরাহের গ্রিড নেই, এমন ১ হাজার ৫৯টি গ্রামে তাঁরা সংযোগ নিয়ে গেছেন। ফলে বিচ্ছিন্ন এসব গ্রামে দুই লাখের বেশি পরিবার বিদ্যুৎ পাচ্ছেন। নদী পারাপার লাইন তৈরি করতে হয়েছে ৯০টি জায়গায়। টানা হয়েছে মোট ১৮২ কিলোমিটার সাবমেরিন কেব্ল।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে কর্মসূচি নেওয়া হয়। এর আগে ২০১৬ সালে ‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ শীর্ষক কর্মসূচি শুরু হয়। বাড়ি বাড়ি ভ্যান নিয়ে গিয়ে বিদ্যুৎ–সংযোগ দিতে আরইবি চালু করে ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ কর্মসূচি। তারা এভাবে ২১ লাখ সংযোগ দিয়েছে। সব মিলে বেঁধে দেওয়া ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই শতভাগ বিদ্যুতায়ন নিশ্চিত করা হয়েছে।
বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দিচ্ছে আলোর ফেরিওয়ালা
আগে যেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে হলে স্থানীয় পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে দিনের পর দিন ঘুরতে হতো, লাইনসম্যানকে ঘুষ/বকশিস না দিলে সংযোগ পাওয়া যেত না। এখন বিদ্যুৎকর্মীরা আলোর ফেরিওয়ালা সেজে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘরে ঘরে গিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে একটি ফরম পূরণ করে ৫শত ৫০ টাকার বিনিময়ে বিদ্যুতের সংযোগ দিয়ে যাচ্ছেন। উপরের ছবিতে দিনাজপুরে আলোর ফেরিওয়ালা সেজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দিচ্ছেন দিনাজপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ (গোবিন্দ্রপুর প্রধান কার্যালয়) এর সংশ্লিষ্টরা। শতভাগ বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া সদর উপজেলার আস্কারপুর ইউনিয়নের জাকিরপাড়া গ্রামের গ্রাহকের দুয়ারে গিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করা হয়েছে।
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার পিঞ্জুরি ও কুশলা ইউনিয়ন দুটি বিলে ঘেরা। এমন বিস্তীর্ণ বিলের মধ্যেও কেউ কেউ বসবাস করে। দুই ইউনিয়নের ভিন্ন দুটি গ্রামে বিচ্ছিন্ন চারটি পরিবারকে খুঁজে পেয়েছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। বর্ষায় এসব গ্রাম থাকে প্লাবিত। প্রায় সব ধরনের নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত ওই চার পরিবারেও পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ–সংযোগ। সৌরবিদ্যুৎ–সুবিধায় তাদের ঘরেও জ্বলছে আলো।
নাটোর জেলার লালপুর উপজেলার বিলমাড়িয়া ইউনিয়ন একটি চর এলাকা। এই ইউনিয়নের কেন্দ্রস্থল থেকে আরও ৭ কিলোমিটার দূরের গ্রাম নওশারা সুলতানপুর। নদীভাঙা মানুষ এবং হাঁসের বাথানে কাজ করা লোকজনের বাস এখানে। মুঠোফোনে চার্জ দিতে হলেও নদী পার হয়ে বিলমারিয়ায় আসতে হতো তাঁদের। আর এখন সেখানে ৭০টি বিদ্যুৎ–সংযোগ। ৩০০ মিটার নদী পারাপার লাইন করে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে আরইবি।
শুধু আরইবি নয়, বিচ্ছিন্ন জনপদে বিদ্যুৎ–সুবিধা পৌঁছে দিতে কাজ করেছে আরও তিনটি বিতরণ কোম্পানি। সব মিলে দুর্গম চর ও দ্বীপের ১ হাজার ১৪৬টি গ্রামে গেছে বিদ্যুৎ–সংযোগ। এর মধ্যে সবার আগে বিচ্ছিন্ন জনপদ সন্দীপে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর কাজ শুরু করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। ২০১৮ সালে সাগরের তলদেশে ১৬ কিলোমিটার সাবমেরিন কেব্ল স্থাপন শুরু করে পিডিবি। ২০২০ সালের নভেম্বরে সন্দ্বীপে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়। চট্টগ্রাম জেলার দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপে প্রায় চার লাখ মানুষের বসবাস। বারবার ভাঙ্গনের কবলে পড়ে আয়তনে ছোট হয়ে আসা এই দ্বীপ এতদিন একপ্রকার বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরেই ছিল। এতদিন স্থানীয় পর্যায়ে তেলভিত্তিক জেনারেটরের মাধ্যমে উপজেলা সদরের শ চারেক গ্রাহককে সীমিত আকারে বিদ্যুৎ দেওয়া যেত। শহরাঞ্চলে যে বিতরণ লাইন রয়েছে তার বিদ্যুৎ গ্রহণের ক্ষমতা তিন মেগাওয়াটের মত। চট্টগ্রামের বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়নের অংশ হিসেবে সীতাকুণ্ড থেকে সন্দ্বীপ পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার এলাকায় সাগরের নিচ দিয়ে সাবমেরিন কেবল টানা হয়েছে। এই সাবমেরিন কেবলের সঞ্চালন ক্ষমতা ৫০ মেগাওয়াট, জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার পর এখন কয়েক ধাপে সন্দ্বীপের শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে।
বিদ্যুৎ–সুবিধায় চরের মানুষের জীবনযাত্রা বদলে যেতে শুরু করেছে। কয়েক বছর আগেও গ্রামের মানুষের একমাত্র জীবিকা ছিল কৃষি। সেখানে এখন ছোট আকারে ধানকল থেকে শুরু করে হাঁস-মুরগির খামার, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, কারখানা, তাঁতশিল্প, খামার, যন্ত্রচালিত যানে বিদ্যুতের ব্যবহার হচ্ছে। গ্রামে গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা, ইউনিয়ন পরিষদে তথ্যসেবা কেন্দ্র, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া পাঠদান সুবিধা নিশ্চিত হচ্ছে।
ফিরে দেখা - বিদ্যুতের জন্য মানুষের হাহাকারের দিনগুলি
শত শত বছর বৈদেশিক শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতন-নীপিড়নের পর ৩০ লক্ষ মানুষের জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়ে এ দেশের মানুষ ভেবেছিল এবার তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। আর কোনোদিন ন্যায্য দাবী-দাওয়া আদায়ের জন্য রাজপথে নামতে হবে না, পুলিশের গুলিতে জীবন দিতে হবে না। কিন্তু বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাস দেখলে বুঝা যায় যে, স্বাধীনতার পরও এ দেশের মানুষকে প্রতিটি ন্যায্য দাবি ও অধিকার আদায়ের জন্য, এমনকি বিদ্যুতের জন্যও রাজপথে নামতে হয়েছে, নির্বিচারে কারাবরণ থেকে শুরু করে পুলিশের গুলিতে জীবন দিতে হয়েছে। এখন একবার ফিরে দেখি বিদ্যুতের দাবীতে বাঙালি জাতির উত্তাল রক্তঝড়া সেই দিনগুলি:
২০০৬ সালের। জোট সরকারের আমলে (২০০১-২০০৬) এ ধরনের খবর ছিল নিত্ত-নৈমত্তিক ব্যাপার। বাংলাদেশের বর্তমান বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং পানির মহাসংকট একদিনে সৃষ্টি হয় নি। এর জন্য দায়ী পুরানো সরকারগুলোর দুর্নীতি, দায়িত্বহীনতা, অপরিণামদর্শী কার্যকলাপ, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাব।
আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬-২০০০ সালে বিশেষ করে বিদ্যুৎখাতের কয়েকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিলো। কিন্তু তার জন্যে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়া যায়নি। সহায়তা পাওয়া গেলেও সেইসব শর্ত মানতে সম্মত হয়নি তৎকালীন অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া সাহেব। ফলে বিদ্যুতের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর প্রকল্পগুলো যেন টাকার অভাবে অবাস্তবায়িত থেকে না যায়, সেজন্যে তিনি বিকল্প উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেন। যাইহোক এর মধ্যে আওয়ামী লীগের মেয়াদ শেষ হলে লতিফুর রহমানের তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অর্থমন্ত্রনালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা হাফিজ উদ্দিন নিজের এখতিয়ারের মধ্যে না পড়লেও কিবরিয়া সাহেবের সময়ে নেওয়া বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোকে "দেশের স্বার্থবিরোধী" আখ্যায়িত করে স্থগিত করে দেন। অথচ জাতীয় নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে তিন মাসের একটি তত্ত্ববধায়ক সরকার নির্বাচিত কোনো সরকারের নেওয়া প্রকল্প এভাবে স্থগিত করে দিতে পারে না। পরে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি (২০০১-২০০৫) ক্ষমতায় এলে নতুন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান চিরশত্রু আওয়ামী লীগের ওই প্রকল্পগুলো কোন যাচাই-বাচাই না করেই বাতিল ঘোষণা দেন। জোট সরকার বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি কোন বিকল্প পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি। এরপরের ইতিহাস আমরা সবাই জানি। দেশ অলিখিত এক দ্বৈত শাসনের কবলে পতিত হল। বিশেষ করে ক্ষমতাশীল হাওয়া ভবনের অবৈধ হস্তক্ষেপ, চাঁদাবাজি ও স্বজনপ্রীতির কারণে অনেক পরিকল্পনার মত সাময়িক বিদ্যুৎ পরিকল্পনার বেশিরভাগ টাকাও লুঠপাট হয়ে গেল। বিদ্যুতের নামে মানুষ কিছু খাম্বা দেখলো, কিন্তু সেখানে বিদ্যুৎ দূরে থাক তারও ঝুলানো হয়নি। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং পানির সমস্যা যে কত ভয়াবহ হয়েছিল তা বিস্তারিত উল্লেখ না করে শুধুমাত্র ২০০৫ ও ২০০৬ সালের পুরানো পত্রিকার কিছু সংবাদ শিরোনাম ও সংবাদের অংশবিশেষ এখানে হুবহু তুলে ধরলাম:
রাতদিন ৯শ’ মেগাওয়াট লোডশেডিং
প্রতিদিন ৫শ’ থেকে ৯শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে সারাদেশে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ঘন্টার পর ঘন্টা বিদ্যুৎহীন অবস্থা সারাদেশে জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। দেশের বিভিন্নস্থানে বিক্ষোভ ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটছে। অসহ্য গরমে তারাবীহর নামাজ পড়তে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের নিদারুণ কষ্ট হচ্ছে। অনেক স্থানে মসজিদের মুয়াজ্জিন আল্লাহু বলার সময় বিদ্যুৎ চলে যায়। আকরব শেষ করারও সময় হয় না। এই নাজুক পরিস্থিতি উত্তরণের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ সমস্যার ব্যাপারে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, মূলত: আর্থিক সহযোগিতার অভাবে নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়নি। তিনি উল্লেখ করেন, বিদ্যুতের অপচয়, সিস্টেম লসের নামে ব্যাপক বিদ্যুৎ চুরির অভিযোগ এনে দাতারা প্রায় এক দশক যাবৎ এই খাতে তেমন কোন সহযোগিতা করেনি। সূত্র: ইত্তেফাক ১৪-১০-২০০৫
বিদ্যুতের আলোতে আলোকিত হতে চেয়ে চাপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে কয়েকদিন ব্যাপী পুলিশের সাথে জনতার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ২৪জন নিরপরাধ মানুষের জীবনের আলো চিরতরে নিভে গেল।
বিদ্যুৎ ও পানির দাবিতে দিশেহারা রাজধানীর উপকক্ত শনির আখড়া এবং এর আশেপাশের বিশাল এলাকার হাজার হাজার মানুষ গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে প্রচণ্ড বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠলে দিবসব্যাপী সেখানে এক প্রলয়ংকরী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। জনতা সকাল থেকে রাত ৮টায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে এবং বিপুল সংখ্যক গাড়ি ও আশেপাশের দোকানপাটে ভাংচুর চালায়। সারাদিন দফায় দফায় পুলিশের সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষে আহত হয়েছে অসংখ্য মানুষ। অন্যদিকে বিক্ষুব্ধ জনতার আক্রমণের শিকার হয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ ও সেনা সদস্য। বিএনপির সন্ত্রাসী কিছু কর্মী ও স্থানীয় এমপি সালাউদ্দিন আহমেদ বিক্ষুব্ধ জনতার উপর মারমুখি হয়ে উঠলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সূত্র: ইত্তেফাক : ০৬-০৫-২০০৬
বিদ্যুৎ-পানির জন্য যখন সারাদেশ তোলপাড়, তখন খালেদা জিয়ার বাণী:
"বিদ্যুতের নামে জনগণকে উস্কে দিয়ে বিরোধী দল নির্বাচন বানচাল করতে চায়": জামালপুরের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, অক্টোবর ০১, ২০০৬
জোট সরকারের বিদায়লগ্নে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর শেষ বাণী :
"জানালা খুলে দিন, বাইরের আলো আসবে, এটাই এখন ভরসা।" : বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী,
(সূত্র: ইত্তেফাক - অক্টোবর ০৫, ২০০৬)
জোট সরকারের পাঁচ বছরে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নের জন্য ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও দেশের বিদ্যুৎ খাতের কোন উন্নতি হয়নি। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করার পরও দেশে বিদ্যুতের সমস্যার কোন সমাধান হয়নি। সরকারি খাতে গত ২০০১-২০০২ অর্থ বছর থেকে ২০০৬-২০০৭ সাল পর্যন্ত এতো অর্থ কিভাবে খরচ হলো এবং এ বিপুল ব্যয় থেকে কোন ফলই কেন এলো না, সেই বিষয়ে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। যারা এই প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ছিল তাদের বেশীরভাগই ছিল ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
সূত্র: ইত্তেফাক ০৫ জুন, ২০০৭
তথ্য ও ছবিসূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, প্রথম আলো, সমকাল, ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মার্চ, ২০২২ রাত ১১:০৫