গত দশকে এশিয়ায় দ্রুত অগ্রসরমান অর্থনীতিগুলোর অন্যতম হলো বাংলাদেশ। এশিয়ার অর্থনীতিতে বাংলাদেশকে ‘উদীয়মান বাঘ’ (ইমার্জিং টাইগার) বলে আখ্যায়িত করেছে বিশ্ব অর্থনৈতিক সংস্থাগুলো। ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি আর প্রতিটি খাতে অপার সম্ভাবনা এ দেশকে পৌঁছে দিচ্ছে উৎকর্ষতার শীর্ষে। সস্তা শ্রমমূল্য, শিল্প উন্নয়ন এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ হওয়ায় বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগ সংস্থাগুলো। আমাদের দেশের কিছু মানুষ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও নেতিবাচক মন-মানসিকতার কারণে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে উগান্ডা-বুগান্ডা হয়ে যাবে মনে করলেও বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা বাংলাদেশ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে আসছে।
৭০'র দশক থেকে কম দামের শিল্পপণ্য রপ্তানির মধ্য দিয়ে মুক্তবাজার ও উন্নত অর্থনীতিসমৃদ্ধে অগ্রসরমান এশিয়ার চারটি দেশ সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং ও তাইওয়ানকে এশিয়ার ফোর ইমার্জিং টাইগারস বলা হতো। কারণ ১৯৬০ ও ১৯৯০ এর দশকে এই অঞ্চল ও দেশগুলোতে দ্রুত শিল্পায়ন ঘটে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। একবিংশ শতাব্দীতে এই চারটি দেশ উচ্চ আয়সম্পন্ন উন্নত অর্থনীতি অর্জন করে। বর্তমানে হংকং ও সিঙ্গাপুর পৃথিবীর শীর্ষ অর্থনৈতিক কেন্দ্র এবং দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় তথ্য-প্রযুক্তি পণ্য নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এই চারটি দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার ঘটনা বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। এই দেশগুলো এখন চার এশীয় বাঘ (Four Asian Tigers) হিসাবে পরিচিত।
সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের বিরাট বিস্ময়। ১৯৭১ সালের জন্মলগ্নে যে দেশটি বিশ্বের জনগণের সহায়তা ছাড়া টিকে থাকতে পারবে না বলা হচ্ছিল, সে দেশটি এই ৫০ বছরে উন্নয়নের মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারী আঘাত হানার আগে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। মহামারীর অভিঘাত সত্ত্বেও বিশ্বের যে কয়েকটি দেশ জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে ধনাত্মক রাখতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ তার অন্যতম। আরো বিস্ময়কর হলো, মহামারী চলাকালীন ২০২০ সালে বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী রেমিট্যান্স ২৩ শতাংশ বেড়ে ২১ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে। ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের মার্চে ৪৪ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
২০১৮ সালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার শর্ত পূরণকারী বাংলাদেশ ২০২১ সালে ওই উত্তরণ নিশ্চিত করেছে। ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান বাড়তে বাড়তে দেশের জিডিপির ১৩ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। তা ক্রমান্বয়ে কমে এখন জিডিপির ২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। পাকিস্তানকে উন্নয়নের প্রায় সব সূচকে পেছনে ফেলে এসেছে বাংলাদেশ। মাথাপিছু জিডিপির বিচারে বাংলাদেশ ভারতকে ২০২০ ও ২০২১ সালে টপকিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তাই এখন বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার ‘ইমার্জিং টাইগার’ বা উদীয়মান বাঘ অভিহিত করা হচ্ছে। কম দামের শিল্পপণ্য রপ্তানির মধ্য দিয়ে গত দশকজুড়ে গড়ে ৬ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশ, যেমনটি হয়েছিল হংকং, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের শিল্পায়নের সময়। ‘বাংলাদেশ : দ্য নেক্সট এশিয়ান টাইগার?’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে যুক্তরাজ্যভিত্তিক খ্যাতনামা গবেষণা সংস্থা ‘ক্যাপিটাল ইকোনমিকস’ বলেছে, বাংলাদেশও হতে পারে এশিয়ার নতুন টাইগার।
বাংলাদেশের উন্নয়নের যেসব চমকপ্রদ বিষয়গুলোর কারণে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ 'এশিয়ার উদীয়মান বাঘ' হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে সেগুলো হলো:
১. ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার ৮২ শতাংশের অবস্থান ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। ২০২০ সালের মার্চে করোনাভাইরাস মহামারীর তাণ্ডব শুরু হওয়ার পর্যায়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যা হচ্ছে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। (গত দুই বছরে মহামারীর কারণে দারিদ্র্য ৫ শতাংশ বেড়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে)।
২. ১৯৭৬-৭৭ থেকে ১৯৮১-৮২ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপির অনুপাত হিসেবে বৈদেশিক ঋণ-অনুদান ১০ শতাংশের বেশি ছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা জিডিপির ২ শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। বাংলাদেশ এখন আর সহায়তানির্ভর দেশ নয়; একটি বাণিজ্যনির্ভর দেশ।
৩. এক দশক ধরে প্রায় প্রতি বছর বাংলাদেশ তার লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত অর্জন করে চলেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের বাণিজ্য ভারসাম্যের ঘাটতি এখন আর সংকটজনক নয়। প্রবাসী বাংলাদেশীদের বৈধ পথে প্রেরিত রেমিট্যান্সের চমকপ্রদ প্রবৃদ্ধির হার এবং বাংলাদেশের রফতানি আয়ের ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেশের লেনদেন ভারসাম্যের এ স্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি করেছে।
৪. দেশের জনসংখ্যা সাড়ে সাত কোটি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৬ কোটি এবং চাষযোগ্য জমির ক্রমসংকোচন সত্ত্বেও বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করে এখন ধান উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হয়েছে। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে। শাক-সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ। নিত্য-নতুন উন্নত জাতের ফলনশীল শস্যের উদ্ভাদনের ফলে বলতে গেলে বাংলাদেশে একটি কৃষি বিপ্লব চলমান।
৫. ২০১৮-১৯ অর্থবছরে (করোনা মহামারীর আগে) জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। মহামারী সত্ত্বেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে মাথাপিছু জিএনআই প্রাক্কলিত হয়েছে ২ হাজার ৬৪ ডলার, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ১ হাজার ৯০৯ ডলার।
৬. ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিল ৪২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। অথচ ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে রফতানি আয় ছিল মাত্র ৭৫২ মিলিয়ন ডলার রফতানি আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশই আসছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। চীনের পর বাংলাদেশ পোশাক রফতানিতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ, সিরামিক পণ্য, জাহাজ নির্মাণ ও কৃষিভিত্তিক খাদ্যপণ্য রফতানি বাজারে ভালোই সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
৭. বাংলাদেশের ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষ বিদেশে কাজ করছেন ও বসবাস করছেন। ২০২০ সালে প্রাতিষ্ঠানিক পথে রেমিট্যান্সপ্রবাহ ২১ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
৮. ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের সাফল্যে গ্রামের ভূমিহীন নারীদের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে গেছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর এক-চতুর্থাংশের বেশি ঋণগ্রহীতা তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সাফল্য অর্জন করেছেন। ক্ষুদ্রঋণের সহায়তায় নারীর স্বকর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও বাংলাদেশ বিশ্বে সফল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে।
৯. বাংলাদেশের নারীদের প্রায় ৩৮ শতাংশ বাড়ির আঙিনার বাইরে অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে ক্রিয়াশীল। দেশের দ্রুত বিকাশমান পোশাক শিল্পে ৩৩ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আর এ শ্রমিকদের ৬০ শতাংশেরও বেশি নারী।
১০. বাংলাদেশে এখন ১৬ কোটি মোবাইল টেলিফোন রয়েছে, ১১ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারের আমলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেশের কিছু কিছু উন্নতি হলেও দীর্ঘমেয়াদি টেকসই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন ও অর্থনীতিকে প্রশংসনীয়ভাবে গতিশীল করার প্রধান কৃতিত্ব বর্তমান সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকই দিতে হবে। দীর্ঘদিন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও একই সরকার দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হয়ে উন্নয়নের গতি আরো বেগবান হয়েছে। তবে উন্নয়নের পাশাপাশি এখন সরকারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত ধনী-দরিদ্র ব্যবধান কমানো, আয়বৈষম্য নিরসন, কঠোরভাবে দুর্নীতি দমন, গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর, দমন-পীড়ন নীতি বন্ধ করা, বিচারহীনতা দূর করা, কৃষিতে গণমুখী নীতি প্রণয়ন, শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্য হ্রাস, দরিদ্র জনগণকে সুলভে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, সুলভে উৎপাদনশীল জনগণের কাছে ব্যাংকঋণ পৌঁছানো, ব্যবসার পরিবেশ সহজ করা, সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, অগ্রাধিকার সহকারে প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ এবং সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাকে জোরদার করা।
তথ্যসূত্র:
বণিকবার্তা
বাংলাদেশ প্রতিদিন
Four-asian-tigers
উইকিপিডিয়া
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০২২ সকাল ৭:০০