মধ্য ইউরোপোর লোককাহিনীতে ক্র্যাম্পাস হলেন "অর্ধ-ছাগল ও অর্ধ-মানুষের" মতো দেখতে একটি শিংযুক্ত বিশেষ পৌরাণিক দৈত্য। যিনি ক্রিসমাসের মৌসুমে মা-বাবার অবাধ্য ও দুষ্ট শিশুদের শাস্তি দেন। আমরা জানি, পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে ডিসেম্বরের মাসের ২৫ তারিখে সান্তা ক্লজের আগমন ঘটে। বিশেষ করে ছোট বাচ্চারা সারা বছর সান্তা ক্লজের অপেক্ষায় থাকে। ক্রিসমাসে বুড়ো দাদু সান্তা ক্লজ তাদের পছন্দের উপহার নিয়ে আসবে এই প্রতাশায়। বাড়ির মুরব্বীজনেরা বাচ্চাদেরকে বলে সান্তা ক্লজের উপহার পেতে হলে তাদেরকে অবশ্যই ভালো কাজ করতে হবে এবং মা-বাবার কথা শুনতে হবে। নতুবা কোনো উপহার পাবে না। অনেক মা-বাবা হয়তো মাঝে মাঝে দুষ্ট বাচ্চাদের ওপর বিরক্ত হয়ে মনে করতে পারে, উপহার না দেওয়ায় যথেষ্ট নয়, দুষ্ট বাচ্চাদেরকে সান্তা ক্লজের শাস্তি দেওয়া উচিত। সম্ভবত সেই চিন্তাভাবনা থেকে ক্রিসমাসে দুষ্ট বাচ্চাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য মধ্য ইউরোপের কিছু দেশে সৃষ্ট সান্তা ক্লজের মন্দ সংস্করণ হচ্ছেন ক্র্যাম্পাস।
সান্তা ক্লজ এবং ক্র্যাম্পাস দুজনেরই আগমন এই ডিসেম্বরেই ঘটে, তবে সান্তা ক্লজ হচ্ছেন দয়ার সাগর এবং তিনি আসেন উপহার দিতে, আর ক্র্যাম্পাস হচ্ছেন খুবই নিষ্টুর এবং তিনি আসেন দুষ্ট শিশুদের শাস্তি দিতে। তার দেহগঠন, চেহারা, পোশাক-পরিচ্ছদ কুৎসিত এবং ভয়ঙ্কর। আর যে উৎসবে এই ক্র্যাম্পাসের আগমন ঘটে তার নাম ক্র্যাম্পাসনাট বা ক্র্যাম্পাস নাইট। এটি ক্রিসমাসের মতো আনন্দের উৎসব নয়, ভয় ও আতঙ্কের উৎসব।
উৎপত্তির ইতিহাস
ক্র্যাম্পাস-এর উৎস সম্পর্কে সঠিক কোনো ইতিহাস নেই। এর প্রচলন আসলে কোথা থেকে তা নিয়ে এখনও বিতর্ক রয়েছে। তবে বেশিরভাগ ইতিহাসবিদের মতে, ক্র্যাম্পাস নাইট খ্রিস্টান ধর্ম প্রবর্তনের আগের কোনো ঐতিহ্যের অংশ। তাদের মতে, পৌত্তলিক পুরাণ থেকেই এর আগমনের উৎস পাওয়া যায়। খ্রিস্টান ধর্ম প্রবর্তনের পূর্বে ইউরোপে কোন ধরনের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বা সংস্কৃতি কিংবা কার পূজা করা হতো এবং কী রকম ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহারের প্রচলন ছিল তা ঐতিহাসিকদের কাছে স্পষ্ট নয়।
ক্র্যাম্পাস (Krampus) শব্দটি এসেছে জার্মান শব্দ ‘ক্র্যাম্পেন’ থেকে, যার অর্থ থাবা। ‘ক্র্যাম্পাস’ হলো একধরনের পৌরাণিক দৈত্য, যা দেখতে শয়তান এবং ছাগলের সম্মিলিত কোনো রূপ বলেই বোধ হবে। গ্রিক পুরাণের কিছু প্রাণীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিল রয়েছে এই ক্র্যাম্পাসের সাথে, যার রয়েছে বড় বড় বিষদাঁত, মাথায় বিশালাকারের শিং এবং কোমরে বাঁধা থাকে একটি ঘণ্টা। তার হাতে থাকে বার্চ বা ভুজ গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি চাবুক, যা ক্র্যাম্পাস দুষ্ট বাচ্চাদেরকে শাস্তি দেওয়ার কাজে ব্যবহার করে। আর গায়ে ভেড়ার বা ছাগলের চামড়া দিয়ে তৈরি একটা মোটা চাদর জড়ানো থাকে।
কিছু লোকবিজ্ঞানী এবং নৃবিজ্ঞানীর ধারণা - অস্ট্রিয়া, বাভারিয়া, ক্রোয়েশিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি, দক্ষিণ ইতালি, ট্রেন্টো, স্লোভাকিয়া এবং স্লোভেনিয়াসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলের প্রাক-খ্রিস্টীয় আমলেও এই ক্র্যাম্পাসনাট উদযাপন করা হতো। তবে তখন তা ছিল মুলতঃ পৌত্তলিক ধ্যান-ধারণার ওপর ভিত্তি করে। কিছু ইতিহাসবিদের মতানুসারে, ১১ শতকের দিকে মধ্যযুগীয় বিভিন্ন পথনাট্যে বেশিরভাগ আলপাইন শহরে প্রথমবারের মতো শিংযুক্ত শয়তানদের দেখা যায়। পরবর্তীতে আঞ্চলিক লোকজনের সঙ্গে সহজে মিশতে পারার জন্য কিংবা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীরা তাদের এ সকল প্রতীক বা ঐতিহ্যকে ব্যবহার করতে শুরু করেন।
ক্র্যাম্পাস নামক এই দৈত্য সম্পর্কে একটি কাকতালীয় ব্যাপার হলো, এর সাথে পেনসিলভানিয়া ডাচ কমিউনিটির একটি চরিত্র ‘পেলসনিকেল’ বা ‘বেলজনিকেল’ এর বেশ মিল রয়েছে। এজন্য ধারণা করা হয়, এই ঐতিহ্যটির সাথে জার্মানবাসী যখন আমেরিকায় বসবাস করছিল তখন পরিচিত হন। আবার নর্স পুরাণ মতে, এই ক্র্যাম্পাস হচ্ছে হেলের পুত্র।
প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, ৫ ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় ক্র্যাম্পাস তার চাবুক দিয়ে সেসব শিশুকে শাস্তি দেয়, যারা কোনো খারাপ কাজ করেছে। পরে তাদেরকে বস্তায় করে নিয়ে যায় নিজেদের ডেরায়। সেখানে সেই শিশুদেরকে মেরে ফেলা হয় বা খেয়ে ফেলে এ পৌরাণিক দৈত্যরা। আর সেন্ট নিকোলাসের আগমন ঘটে এর পরের দিনই। তাই ৬ ডিসেম্বরকে বলা হয় 'সেইন্ট নিকোলাস ডে'। ভালো এবং সৎ মানুষদেরকে, বিশেষ করে ভালো শিশুদেরকে পুরস্কৃত করার জন্যই তার এই আগমন। আবার অনেক সময় সেন্ট নিকোলাস ও ক্র্যাম্পাস একসাথেও পরিভ্রমণ করতেন। তখন সেন্ট নিকোলাসের কাছে থাকে ভালো পুরস্কারগুলো আর ক্র্যাম্পাসের কাছে থাকে শিশুদেরকে শাস্তি দেওয়ার জিনিসপত্র। তাই আলপাইন এলাকার অস্ট্রিয়া এবং জার্মানির কিছু অংশে, এই দিনটি (৫ ডিসেম্বর) ক্র্যাম্পুসন্যাচট বা "ক্র্যাম্পাস নাইট" নামে পরিচিত। আলপাইন অঞ্চলগুলিতে এভাবে এটি এখন খ্রিস্টান এবং পৌত্তলিকের সংস্কৃতির মিশ্রনে গড়ে উঠা একটি প্রতিষ্ঠিত সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে।
সেন্ট নিকোলাস (২৭০ – ৬ই ডিসেম্বর, ৩৪৩) ছিলেন একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক। তার জন্ম হয়েছিল আধুনিক তুরস্কের নিকটবর্তী সমুদ্রবর্তী 'পাতারা' নামক এক গ্রামে। সম্ভবত তিনি ছিলেন মায়রার বিশপ। তার পিতা ছিলেন ধনাঢ্য ব্যক্তি। কিন্তু তিনি সেন্ট নিকোলাস খুবই দয়ালু ছিলেন। কথিত আছে যে, সেন্ট নিকোলাস উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সব তার সকল ধন-সম্পত্তি গরিব-দুঃখীদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। এক সময় সারা ইউরোপে তার নামে পরম পরোপকারী হিসাবে ছড়িয়ে পড়ে। সেন্ট নিকোলাস পরিচিতি পেতে থাকেন বাচ্চাদের পরম বন্ধু ও সবার দুর্দিনের সাথী হিসেবে। কালক্রমে সেন্ট নিকোলাস থেকে সান্টা ক্লজ নামেই সেই এই সেন্ট মার্কিন সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করেন। সান্টা ক্লজ নামটি এসেছে নিকোলাসের ওলন্দাজ নাম "সিন্টার ক্লাস" থেকে।
ক্র্যাম্পাসের বেশ-ভূষণ
ক্র্যাম্পাসের পোশাকগুলি নান্দনিকভাবে বৈচিত্রময় - এগুলি শয়তান, বাদুড়, ছাগল, জঘন্য তুষারমানব বা ভৌতিক চলচ্চিত্রের উদ্ভট জীবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। যদিও ক্র্যাম্পাস বিভিন্ন রূপে উপস্থিত হয়, তবে বেশিরভাগ ভাগ ক্ষেত্রে কিছু সাধারণ শারীরিক বৈশিষ্ট্যের মিল থাকে। ক্র্যাম্পাস লোমশ ও সাধারণত বাদামী বা কালো রংয়ের হয়ে থাকে। তার এক পা মানুষের মতো এবং অন্য এক পায়ে ছাগলের খুর ও শিং থাকে। তার মুখে বড় বড় বিষদাঁত এবং লম্বা জিহ্বাটি নিচের দিকে ঝুলে থাকে। ক্র্যাম্পাস একটি শিকল বহন করে, এটাকে খ্রিস্টান চার্চ কর্তৃক শয়তানকে আবদ্ধ করার প্রতীক বলে মনে করা হয়। মাথায় বিশালাকারের শিং এবং কোমরে বাঁধা থাকে একটি ঘণ্টা। দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য চেইনগুলিকে আঘাত করে। তার হাতে থাকে বার্চ বা ভুজ গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি চাবুক এবং পিঠে ঝুলানো থাকে একটি ঝুড়ি। ক্র্যাম্পাস এটি দুষ্ট শিশুদের ঢুকিয়ে ঢেরায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করে।
উপরোল্লখিত বেশভূষার সাথে মিল রেখে ক্র্যাম্পাসনাটে পুরুষেরা ব্যবহারের জন্য মুখোশ এবং সাজসজ্জার উপকরণগুলো এখন বিভিন্ন দোকানে বিক্রি হয়। মুখোশটি সাধারণত তৈরি হয় কাঠ দিয়ে। এই মুখোশ বা চাদর ইউরোপে বেশ চড়া মূল্যেই বিক্রি করা হয়। তবে সুলভমূল্যে চাইলে ব্যবহার করতে হবে নকল পশমের চাদর এবং মুখোশের বদলে সাধারণ রঙ। এভাবেই যুগের পর যুগ ক্র্যাম্পাস নাইটে এরকম রূপধারণের ব্যাপারটি চলে আসছে। অবশ্য আধুনিক যুগে নারীরাও ক্র্যাম্পাসের মতো সাজে সজ্জিত হয়। তবে এক্ষেত্রে তাদের সাজসজ্জা এবং নামের কিছুটা পরিবর্তন থাকে। যেমন- এই নারী ক্র্যাম্পাসদের বলা হয় ‘ফ্রাউ পার্চটা'। দীর্ঘদেহী ফ্রাউ পার্চটাও একটি পৌরাণিক চরিত্র, যাকে জার্মানবাসী উর্বরতা ও যুদ্ধের দেবী হিসেবে মান্য করে। তাদেরকে ক্রিসমাস উইচও বলা হয়।
‘ক্র্যাম্পাসলফ’ বা ‘ক্র্যাম্পাস রান’
প্রায় হারিয়ে যাওয়া এই এই উৎসবকে ধরে রাখতে জার্মানি, অস্ট্রিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের কিছু শহরে পুরানো ঐতিহ্যের সাথে আঞ্চলিক বৈচিত্রের সমন্বয় ঘটিয়ে ঝাঁকজমকের সাথে পালন করা হয় ‘ক্র্যাম্পাসলফ’ (Krampuslauf) বা ‘ক্র্যাম্পাস রান’। এটি এখন আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা এমন কি দুষ্ট শিশুদের জন্যও একটি আমোদ-প্রমোদের উৎসব। ক্র্যাম্পাস নাইটের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় অংশ হলো ‘ক্র্যাম্পাসলফ’ বা ‘ক্র্যাম্পাস রান’। প্রায় ১,০০০ পুরুষ এই পৌরাণিক দৈত্যের সাজে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। যেসকল পুরুষ এই দৌড়ে অংশ নেয় তাদের বয়স সাধারণত ২০-৪০ বছরের মধ্যে হয়। এইসব উৎসবে ভয়ঙ্কর ক্র্যাম্পাসদের আকর্ষণীয় পোশাক-পরিচ্ছেদ ও আনন্দ উদ্দীপক কার্যকলাপে সবাই আনন্দ লাভ করে। এই উৎসবকে ঘিরে দেশ-বিদেশের অনেক পর্যটকেরও সমাঘম ঘটে। অনেক শহরে জনপ্রিয় ক্রিসমাস মার্কেটগুলোর সামনেও ক্র্যাম্পাস র্যালির আয়োজন করা হয়।
এর খ্যাতি বর্তমানে আমেরিকাতেও বেশ বেড়ে গিয়েছে। স্যান ফ্রান্সিস্কো এবং পোর্টল্যান্ডে এর জাঁকজমকভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তাছাড়া ওহাইয়ো প্রদেশের ক্লিন্টোভিলে ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো ক্র্যাম্পাস প্যারেড করা হয়। এরপর থেকেই এখানে প্রতি বছর এই উৎসব পালন করা হয়। আর সিয়াটল ও ফিলাডেলফিয়ায় ক্রিস্টমাস সিজনের শুরু হয় ক্র্যাম্পাসনাট দিয়েই। অস্ট্রিয়ায় ২০১৩ সালে ২০০ ক্র্যাম্পাসের অংশগ্রহণে প্রথমবারের মতো ক্র্যাম্পাস নাইট পালন করা হয়। বর্তমানে অস্ট্রিয়ায় এই উৎসবকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যায়ে উন্নীত করে বিদেশের পর্যটক আকর্ষণের চেষ্টা করা হচ্ছে। একে ঘিরে চকলেট, মদ, ক্ষুদ্র প্রস্তরমূর্তি, মুখোশ ও শিং ইত্যাদি বিক্রির ধুম পড়ে যায়। এইসব কারণে এই উৎসবটি এখন প্রাচীন ঐতিহ্য-সংস্কৃতির পরিবর্তে বাণিজ্যিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। ক্র্যাম্পােসের এই ঐতিহ্য ও লোকগাঁথার ওপর ভিত্তি করে ২০১৫ সালে ভৌতিক ও হাস্যরসাত্মক একটি মুভিও বানানো হয়েছে।
ছবি ও তথ্যসূত্র:
১। Wikipedia
২। Krampus-parade-in-austria
৩। www.history.com
৪। Roar.media
◄ আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব - ১ : সান্তা লুসিয়া | আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব ৩ - হগম্যানায় ►
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ভোর ৪:০৪