বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদটি কোথায় অবস্থিত? এই প্রশ্নের উত্তর খুজতে গিয়ে ইতিহাস বই আবার নতুন করে পড়তে হল (পড়া এখনো শেষ হয়নি, প্রশ্নের উত্তরও এখনও পাওয়া যায়নি, কিন্তু যা পাওয়া গেল তাতে একটা জেলার ঐতিহ্য নিয়ে একটা ট্রাভেল ব্লগ লেখার কন্টেন্ট হাতে এসে গেল)
মাসখানেক আগে গেলাম মুন্সিগন্জে, যাওয়ার পর কেবল এটাই মনে হল যে ঢাকার এতো কাছে এই নিরীহ জেলাটি যে এতো ঐতিহ্য ধারণ করে রেখেছে তা জানলে অবাক হতে হয়...
বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরাতন মসজিদ কোনটি? এই প্রশ্নের উত্তর খুজতে গিয়ে বেশ খানিকটা পড়াশুনা করতে হল। সম্ভাব্য একটা নাম ছিল মুন্সীগন্জের বাবা আদমের মসজিদ। ৬০০ সালের মনে করা হলেও এটি আসলে খ্রিস্টীয় ১৪০০ সালের সুলতানি আমলের নির্মিত একটা মসজিদ। আরও জানতে পড়ুন: Previous Blog
পন্ডিতের ভিটা:
প্রায় ১১০০ বছর পূর্বে, বৌদ্ধ ধর্মের গুরু শ্রী অতীশ দিপংকর মুন্সীগন্জ জেলার বজ্রযোগীনি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কিশোর বয়সেই তিনি নালন্দায় লেখাপড়া করতে চলে যান আর যুবক বয়সে তিনি ইন্দোনেশিয়ায় অধ্যাপনা করেন। বাংলাদেশেও প্রায় একই সময়ে একাধিক বৌদ্ধ বিহার গড়ে ওঠে। এর মধ্যে মুন্সীগন্জে দুইটা বৌদ্ধ বিহার পাওয়া যায়। একটা হল অতীশ দিপংকরের জন্মস্থান যে গ্রাম সেই গ্রামের থেকে হাটার দূরত্বে, রঘুনাথপুর গ্রামে। আরেকটা কিছুটা দূরে নাটেশ্বরে, টুংগীবাড়ী উপজেলার মধ্যে পড়ে গেছে। এর মধ্যে নাটেশ্বরেরটা বড় আর রঘুনাথপুরেরটা ছোট।
বিক্রমপুর বৌদ্ধ বিহার:
পাঁচটি বর্গাকার মূল কক্ষ নিয়ে গঠিত হয়েছে রঘুরামপুর বিহার। অন্যান্য বৌদ্ধ বিহারের মতই এই বিহারটিও ব্যবহৃত হত একটি বিদ্যালয় বা ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে। এখনকার দিনের মাদ্রাসার মত, আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
পাহাড়পুরের বৌদ্ধ বিহারের মতন এখানেও দেখবেন লাল ইটের টালি দেওয়া দেওয়াল
বর্তমানে বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত ডিপার্টমেন্ট ছাড়াও আরেকটা এনজিও, "অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন"ও এই পূরাকীর্তিটি রক্ষায় এগিয়ে এসেছে...
হরিশচন্দ্রের দিঘী:
যায়গাটার নাম রামপাল। এই রামপালেই বেশ বড় বড় তিন চারটা দিঘী রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় হয় রামপাল দিঘী যা এখন শুকিয়ে গেছে। কোদঅ ধোওয়া দিঘী নামেও আরেকটা দিঘী ছিল যেটাও এখন মৃতপ্রায়। যে দিঘীটির কথা আমি এখন বলব সেটার নাম হরিশচন্দের দিঘী। এটি অবশ্য খুব বড় নয়, দিঘী বলা যায় না, বড়জোড় বড় পুকুর বলা যায়।
রঘুরামপুর থেকে আপনি ৫ মিনিট পায়ে হাটলেই পাবেন এই দিঘীটি। মানুষ এখনও এই পুকুরের পানি ব্যবহার করে দৈনন্দিন কাজে। গোসলের জন্য, রান্নার জন্যে, কাপড় ধোওয়া বা থালা বাসন ধোওয়া। এককথায়, আপনি যখন আপনার চোখে দেখবেন তখন বাংলাদেশের একটা সাধারণ পুকুর বলেই মনে হবে আপনার।
দিঘীর পিছনের কিংবদন্তী: সেন আমলের রাজা হরিশচন্দ্র প্রজাদের পানির অভাব পূরনের জন্যে কাটান এই দিঘী। সাড়াবছর পানির লেভেল সমান থাকলেও কেবল মাঘি পূর্ণিমার সময় এই পুকুরের পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেত! আমরা জানি চাদের সাথে জোয়ার ভাটার সম্পর্ক রয়েছে। তাই আমাবস্যা- পূর্ণিমার সময় সাধারণত সব নদী বা জলাশয়ের পানিই একটিু বেড়ে থাকে। আরেকটা ঘটনা হল: অবিবাহিত হিন্দু কুমারী মেয়েদের বিয়ের জন্য ৭ বার পুকুরের চারপাশে পাক খাওয়া। যাই হোক, সেই মাঘী পূর্ণিমার সময় প্রতি বছর সেখানে মেলা হত। এখন পুকুরের চারপাশে বাড়ী উঠে গেছে। সেই মেলাও আর এখন নেই...
ইদ্রাকপুর দূর্গ:
আপনি যদি আমার কথার ফ্লো লক্ষ্য করে থাকেন তাহলে দেখবেন আমি বাংলার প্রাচীনতম ইতিহাস নিয়ে কথা বলতে বলতে এগোচ্ছি। পাল বংশ, সেন বংশ, সুলতানি আমলের পর এবার আমি বলব মোঘল আমলের কথা। আজ থেকে প্রায় চারশো, সাড়ে চারশো বছরর পূর্বে বাংলা শাসিত হত মোগল শাসকদের দ্বারা। সেই সময় মোগল শাসকদের প্রতিনিধি ছিলেন মীর জুমলা। মীর জুমলার পরেই শায়েস্তা খান আসেন। যাইহোক, ঢাকার লালবাগ কেল্লা আর মুন্সিগন্জের ইদ্রাকপুর কেল্লা ছিল সমসাময়িক।
জলদূর্গ কি জিনিস সেটাও বলে নিচ্ছি: আমরা প্রায়ই টিভিতে ভা কার্টুনে দেখি চারপাশে পরিখা বা খাল কেটে কেল্লাকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতন করে রাখা হয় যাতে শত্রুরা হঠাৎই আক্রমন করতে না পারে। এই ইদ্রাকপুরের কেল্লাও একটি জলদূর্গ। আরেকটা মজার ব্যপার হচ্ছে, এটি ছিল এক প্রকার প্রাকৃতিক জলদূর্গ অর্থাৎ, একপাশে নদী থাকায় এটি ছিল নদী দ্বারা সুরক্ষিত। বলতে ভুলে গেছি, বর্তমান ইদ্রাকপুর দূর্গ শহরের মাঝখানে হলেও সেই সময় কিন্তু এটা শহরের মাঝে ছিল না, ছিল নদীর মোহনায়। মেঘনা-শীতলক্ষা নদীর মোহনা ছিল তখন ঐ এলাকা। এখন যেমন ঢাকার লালবাগের কেল্লাও শহরের মাঝে বলে মনে হলেও তখন নদী ছিল একদম দেয়াল ঘেসে। এখন জিওগ্রাফি চেইন্জ হয়ে গেছে।
সড়কপথ তো এখন হয়েছে, আগে কিন্তু এক শহর থেকে আরেক শহরে যেতে নদী পথই প্রধান ছিল। তাই ঢাকার লালবাগ থেকে নারায়ন গন্জের সোনাকান্দায় বা মুন্সিগন্জের ইদ্রাকপুর দূর্গে যেতে মূলত নৌকা বা জলযানই ব্যবহৃত হত। আরেকটা কথা, নারায়ংন্জের সোনাকান্দা দূর্গও একপ্রকার জলদূর্গ। মুন্সিগন্জ থেকে এর দূরত্বও বেশি না। যদি নদীপথে লন্চে করে নারায়ংন্জ থেকে মুন্সীগন্জে যান তাহলে বুঝতে পারবেন। They all are connected, তাই কথা প্রসংগে নারায়নজন্জের কথাও এসে গেল।
এখন দূর্গের সামান্য বর্ণনা দিচ্ছি: এই দূর্গ সমন্ধে বলতে গেলে শেষ হবে না, সময় ফুরিয়ে যাবে। তারপরও একটা বিশেষ বিষয় না বললেই নয়। মুঘল আর্কিটেক্চারের নানা দিক এখনও আবিস্কৃত হচ্ছে। মাত্র চার মাস আগে কেল্লার মেঝে খুড়তে গিয়ে উল্টা করে রাখা কলস পাওয়া গেছে। পরে ধারণা করা হচ্ছে, এটা ছিল দুর্গের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার একটা অংশ। আমরা মর্ডাণ আর্কিটেকচারে ফলস সিলিং বা ফলস ফ্লোরিং ব্যবহার করি। বিশেষ করে সার্ভার রুমে ফলস ফ্লোরিং এর খুব প্রয়োজন হয়, যেটা কিনা একেবারেই আধুনিক যুগের একটা প্রযুক্তি। কিন্তু মুঘল আমলে এই বুদ্ধি কার মাথা থেকে বেরুলো এটা নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে। তাই আমি বলতে পারি, মুন্সীগন্জ জেলা সদরে ঘুরতে গেলে এই ইদ্রাকপুর দূর্গ একটা মাস্ট ওয়াচ প্লেস...।
নগর কসবা: আমরা সবাই পানাম নগরের নাম শুনেছি কিন্তু নগর কসবার নাম আমরা কয়জনই বা জানি? পানাম নগরী যেমন মার্চেন্ট বা ব্যবসায়ীদের তৈরী তেমনি নগর কসবাও মূলত ব্যবসায়ীদের তৈরী একটা ছোট্ট এলাকা। পানামের মত অবশ্য এতো বড় নয় বাট আর্কিটেকচার একই। ছোট্র একটা গলির দুপারে লাল ইতের ডুপ্লেক্স বাড়ী সেগুলো প্রায় আড়াইশো বছর পূর্বে নির্মিত। কোন কোন বাড়ীর সাথে আবার নিজস্ব পূজা মন্ডপও আছে! ছোট পূজার ঘর, যেগুলো সব হিন্দুবাড়ীতেই থাকে সেগুলোর কথা বলছিলা, মন্ডপ মানে বিশাল বড় মন্দিরের মতনই একেকটা...
অন্যান্য দর্শনীয় স্থান: এতক্ষন যা বললাম সবই মুন্সীগন্জ জেলা সদরে বা আসেপাশে। কিন্তু মুন্সীগন্জ আসলে আরও অনেক বড়। আমরা জানি দেশে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়েছে। এই পদ্মা সেতুর সংযোগস্থল এলাকার নাম হল মাওয়া। মাওয়া ফেরীঘাট দিয়ে প্রতিদিন অজস্র মানুষ চলাচল করে। আর ফেরী পার হবার সময় বিক্রমপুরের বিশেষ স্ট্রাকচারের একপ্রকার টিনের দোতলা বাড়ী দেখা যায়। এই সব বাড়ীগুলো লৌহজং উপজেলার অন্তর্গত। যদি কখনও নিজের গাড়ী নিয়ে পদ্মা রিসোর্টে ঘুরতে যান তাহলে লৌহজং এলাকায় ঘুরে বেড়াতে পারেন। তাহলে আপনার অবশ্যই ভালো লাগবে। আর এখানকার রসমালাইও যথেস্ট সুস্বাদু।
বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব: মুন্সীগন্জ জেলার শ্রীনগর হচ্ছে আরেকটা উপজেলা যেটা মাওয়া যাওয়ার পথেই পড়ে। এই শ্রীনগর উপজেলার রাড়ীখালে অবস্থিত স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর বাড়ী। এখানে অতি সম্প্রতি একটা পার্ক নির্মান করা হয়েছে। অনেকটা সোনারগাও এক মতই মনে হবে, তবে অনেক ছোট; এখানে পুকুর পারে বসে বিশ্রাম নিতে পারেন। এটা ভাগ্যকূল যাওয়ার রোডেই পড়ে। আর তাছাড়াও আছে লেখক হুমায়ূন আযাদের বাড়ী। এটাও রাড়ীখালে অবস্থিত। স্যার জগদীশচন্দ বসুর বাড়ী থেকে খুব কাছেই। আর তাছাড়া, যদি ভাগ্যকূল পর্যন্ত চলেই যান তাহলে বিক্রমপুর মিউজিয়ামও ঘুরে আসতে পারেন। এটা ভাগ্যকূল বাসস্ট্যান্ড থেকে তিন কিলোমিটার ভিতরে অবস্থিত। বিক্রমপুর জমিদারবাড়ী, যেটা আসলে যদুনাথরায়ের বাড়ী সেখানে অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন নামে এনজিওটি মিউজিয়ামটি তৈরী করেছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ১:৪৪