রোববার রাতে দুই টক শো। ‘একাত্তর’ ও ‘ইন্ডিপেনডেন্ট’ টিভিতে। স্টুডিওতে ঢুকেই দেখি সঞ্চালকদের হাত ভরে আছে ‘আমার দেশ’-এর গত কয়েকদিনের শিরোনামের ফটোকপি। যেসবে শাহবাগ আন্দোলন এবং এর অন্যতম উদ্যোক্তা রাজীবের ইসলামবিদ্বেষী লেখাগুলোর সমালোচনামূলক প্রতিবেদন রয়েছে। সঞ্চালকদের প্রশ্নে এবং প্রকাশিত মতামতে মনে হলো, ধর্ম ও দেশ বাঁচানোর অগ্রগণ্য কলম-সৈনিক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের পক্ষে মত সৃষ্টির মিথস্ক্রিয়া চলবে। ভাবখানা এই, এখনও কেন ওই মানুষটিকে ধরা হচ্ছে না? আগামী কয়েকদিনের মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাসহ নানা ফালতু মামলায় অথবা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের দোহাই দিয়ে মাহমুদুর রহমানকে যদি গ্রেফতার করা হয়, তবে তার দায় এই মত কারিগরদের ওপরও বর্তাবে। ওইসব টক শো’র নিয়ন্ত্রকদের প্রশ্ন শুধু এরকম—কেন মাহমুদুর রহমান শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চকে ফ্যাসিবাদী বললেন? কেন ব্লগার রাজীবের ইসলামবিদ্বেষী লেখাগুলো ছেপে উসকানি (এ শব্দটা হালে পুলিশের দায়ের করা মামলাগুলোর আর্জি থেকে উত্সারিত) দিচ্ছেন? অথচ মাহমুদুর রহমানকে হত্যার হুমকি দেয়া হলো, ‘আমার দেশ’, ‘সংগ্রাম’, ‘নয়া দিগন্ত’, ‘দিনকাল’-এর কপি পৈশাচিক উল্লাসে কেন পোড়ানো হচ্ছে, চট্টগ্রামে এসব মিডিয়া হাউসে কেন আগুন দেয়া হলো, কেন আজ সেখানকার সাংবাদিকরা রাস্তায় বসে সাংবাদিকতা করছে—সে সম্পর্কে কোনো আলোচনা নেই।
রোববার মানিকগঞ্জে পুলিশের গুলিতে পাঁচজন বিক্ষুব্ধ আলেম ও সাধারণ নাগরিক মারা গেছেন। এর আগে কক্সবাজারে তিনজন, পাবনায় দু’জন। ’৬৯-এর অভ্যুত্থানের সময় সেখানে ইপিআরের গুলিতে কয়েকজন মারা গিয়েছিল বলে শুনেছি। কিন্তু সেসব নিয়ে ওইসব মিডিয়ায় কোনো কথাই নেই। শুক্রবার ঢাকায় পুলিশের সরাসরি গুলিতে তিনজন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। ‘আমার দেশ’-এর প্রধান ফটো সাংবাদিক এবং বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর আহাম্মদ মীরু জানালেন, তোপখানা রোডে মেহেরবা প্লাজার সামনে পুলিশের গুলিতে আহত এক মুসল্লির ছবি তুলতে গেলে এক পুলিশ তাকে বারণ করে। বারণের উচ্চারণ শেষ না হতেই গুলি করে বসে। মীরু পড়ে গেল। সাতটি গুলি মীরুর পা থেকে অপারেশন করে বের করেছেন নিকটবর্তী ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের ডাক্তাররা। উল্টোদিকে বিক্ষুব্ধ মুসল্লিদের হাতে এটিএন বাংলা, একাত্তর ও ইন্ডিপেনডেন্ট টিভির সাংবাদিকরা লাঞ্ছিত ও আহত হয়েছে। আমরা এই হামলার তীব্র প্রতিবাদ করি। কিন্তু এই সরকারের আমলে পেশাদারী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশের গুলি সাংবাদিকদের আঘাত করেছে তার প্রতিবাদ তো দূরের কথা, খবরটির উল্লেখেও শাহবাগী জোয়ারে ভাসা গণমাধ্যমগুলো নীরব। যেন পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা। এর আগে ‘নয়া দিগন্ত’ পত্রিকার অফিস ও প্রেসে আগুন দেয়া হলো। কোনো সাড়া-শব্দ নেই। আজ এসব কুলীন মিডিয়া সাংবাদিকদের মধ্যে অভিজাত ও নিম্নবর্গ এই শ্রেণী সৃষ্টি করতে চায়। অভিজাত সাংবাদিকদের এক ফোঁটা রক্ত সাধারণ সাংবাদিকের মৃত্যুর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। শাহবাগীরা কী জিঘাংসাই না ছড়িয়ে দিয়েছে!
প্রতিদিন কোনো না কোনো আলেম গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছেন। তাদের দোষ কোথায়? ইসলামকে রক্ষার জন্য তারা রাস্তায় নামছেন, যে দেশের সংবিধানে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম। পুরো বাংলাদেশ এখন আলেমদের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে। তাদেরকে শেখ হাসিনার পুলিশ বিনা উসকানিতে গুলি করছে। বাংলাদেশে তো এমন দেখিনি। শাহবাগীদের ইসলামবিদ্বেষকে প্রটেকশন দিতে গিয়ে জামায়াতে ইসলামী, সমমনা ইসলামী দল এমনকি আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ওলামা লীগকে সরকার এক অবস্থানে নিয়ে গেছে। জামায়াত হরতাল না ডাকলেও জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব বলে প্রচার করা হচ্ছে, হরতাল হলেও তারা নিজ দায়িত্বে বলছে জনগণ হরতাল প্রত্যাখ্যান করেছে। এক শ্রেণীর মিডিয়ার এমন হিংসাত্মক ও মিথ্যাশ্রয়ী অবস্থান বাংলাদেশের মানুষ কখনও দেখেনি।
একটি টক শোতে এমন বলারও চেষ্টা হলো যে, নিহত রাজীব রাসুলের চরিত্র নিয়ে লেখালেখি করেনি। তার হত্যার পর কেউ ব্লগ হ্যাক করে সেসব ঢুকিয়েছে। শাহবাগের ব্লগাররাও বলছেন তারা ইসলামবিদ্বেষী নন। খামোকা মাহমুদুর রহমান এসব লিখছেন। টক শো’র একজন সঞ্চালক বললেন, ওরা এসব ব্লগে লিখতেই পারেন, কিন্তু মাহমুদুর রহমান এসব ছাপলেন কেন? হায়রে, সারা বাংলাদেশকে ফাঁসির আওয়াজে কাঁপিয়ে দেবে যারা, তাদের সম্পর্কে জনগণকে জানানো অপরাধ? ব্লগ কি মিডিয়া নয়? এসব কি মানুষ দেখে না? ‘আমার দেশ’ সেই কাজটি সঠিকভাবে করেছে। আর রাজীবের ব্লগে এটা তার মৃত্যুর পর আসেনি। এখনও থাবাবাবা প্লাটফর্মে গেলে দেখা যাবে, রাজীবের ‘নূরানি ছাপা শরিফ’ শীর্ষক আপত্তিকর লেখা রয়েছে। সরকার অনেক ফেসবুক ও ব্লগ বন্ধ করেছে। কিন্তু শাহবাগীদের গুলো বন্ধ করেনি। কেন? অন্যদের দাবির কথা বাদ দিন, সরকারি দলের অঙ্গ সংগঠন ওলামা লীগ এসব নাস্তিক-ধর্মদ্রোহী ব্লগ বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে। রাজীবের মৃত্যুর পর তার বন্ধুরা ওইসব লেখা শেয়ার করে করেই মানুষকে প্রথম জানিয়েছে। অন্য কেউ নয়।
গত বছরের মার্চ মাসে হাইকোর্টের বিচারপতি মির্জা হোসেন হায়দার ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলমের সমন্বয়ে গঠিত একটি বেঞ্চ একটি রিট আবেদনে সাড়া দিয়ে ইসলাম-বিদ্বেষী ৫টি ফেসবুক পেজ ও একটি ব্লগ বন্ধের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওসব যারা চালায় তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের জন্যও বেঞ্চ বলেছিল। কিন্তু আদালতের আদেশ সরকার শোনেনি। আজও শুনছে না। শাহবাগের আন্দোলনের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ওইসব ফেসবুক ও ব্লগার রয়েছে। সরকারের কি এটি স্ববিরোধী নীতি নয়? স্কাইপি সংলাপ কেলেঙ্কারির হোতা পদত্যাগকারী বিচারক তদন্তের মুখে পড়লেন না, কিন্তু তা প্রকাশ করে মাহমুদুর রহমান রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় জর্জরিত। কী অদ্ভূত এই সরকার! একদিকে সরকার বলছে নাস্তিকদের শাস্তি হবে, অন্যদিকে সরকারপ্রধান রাজীবের অনুভূতিকে সহানুভূতির মোড়কে স্বীকৃতি দিচ্ছেন। ওলামা লীগের দাবির চেয়ে সরকারের পছন্দ কতিপয় শাহবাগীর ধর্মদ্রোহিতা, বিরোধী দলকে শায়েস্তা করতে ঈমান-আমানের বিসর্জন।
ব্রিটেনের সাবেক কূটনীতিক কেয়ার্ন রস তার ‘লিডারলেস রেভ্যুলুশন’ গ্রন্থে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণঅভ্যুত্থান এবং অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের তত্পরতা পর্যালোচনা করে মত দিয়েছেন, মনে করা হয়েছিল ইন্টারনেট ডেমোক্রেসি বিতর্ক ও সংলাপ সৃষ্টি করে সমাজের স্থিতি ও অগ্রসরতা নিশ্চিত করবে। যারা নানা মত ধারণ করে, তাদের মধ্যে মতৈক্য সৃষ্টি করে সমাজের স্থিতি ও অগ্রসরতা নিশ্চিত করবে। যারা নানা মত ধারণ করে, তাদের মধ্যে ঐকমত্য সৃষ্টি করবে। কিন্তু এর উল্টোটা ঘটছে। তিনি বলছেন, The web offers multiple locations to find those one agrees with and to avoid those one does not.... One result is that any clash of opinions, especially in the anything - goes anonymity of the web is increasingly violent, hostile and insulting, Name calling is frequent; reasoned debate, rare.
এ পর্যবেক্ষণের মানে হলো, ওয়েবগুলো অনেকগুলো পথের সন্ধান দেয়, যেসব মারফত খুঁজে নেয়া যায় সমমনাদের এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের বর্জন করা যায়। ফলটা দাঁড়ায় এমন, মতের সংঘাত হলে, যাচ্ছেতাই প্রচার করা ওয়েবগুলো সহিংস, বিদ্বেষপূর্ণ এবং অপমানজনক হয়ে ওঠে। ঘন ঘন গালি দেয়া হতে থাকে, যুক্তিপূর্ণ বিতর্ক কমই দেখা যায়। কী নির্মম সত্য উচ্চারণ করেছেন এই ব্রিটিশ কূটনীতিক। শাহবাগীদের একাংশ সম্পর্কে হুবহু খাটে।
ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ এবং বই লিখে যথেষ্ট নাম করেছেন নিয়াল ফার্গুসন। তার নতুন বই ‘দি গ্রেট ডিজেনারেশন’। সিভিল এবং আনসিভিল সোসাইটির ব্যাখায় তিনি বলছেন, গণতন্ত্রের জন্য সক্রিয় অভিজন সমাজ তথা সামাজিক সংঘ সমিতির অবদান সবচেয়ে বেশি। সম্প্রতি অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা বিকল্প সুশীল সমাজ হতে চাইছে। কিন্তু তার মতে— Face books and ilk create social networks that are huge but weak.... I doubt very much online communities are a substitute for traditional forms of association.
‘ডেমোক্র্যাসি ইন আমেরিকা’ বইটির স্বনামধন্য লেখক ফরাসি রাজনৈতিক-চিন্তক টকভিলকে উদ্ধৃত করেছেন ফার্গুসন। টকভিল ১৭৫ বছর আগে তার বইটিতে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন—আমেরিকার গণতন্ত্রের বড় ভিত, এই সংঘ-সমিতিগুলো এক সময় বিপর্যয়ে পড়বে। তখন দেখা যাবে সমমতের-সমচেহারার একদল জনতাকে, যারা নিজেদের নিয়ে থাকবে এবং অশ্লীলতা বিনিময় করবে— Each of them withdrawn and apart, is like a stranger to the destiny of all the others... as for dwelling with his fellow citizens, he is beside them, but he doest not see them, he touches them and does not feel them, he exists only in himself alone... and finally reduces each nation to being more than a herd of timid and industrious animals of which the government is the she-herd অর্থাত্ ওই যে জনতা (আজকের ইন্টারনেট সমাজের একাংশ) তাদের প্রত্যেকে জনবিচ্ছিন্ন থাকবে, অন্যসবের নিয়তির ক্ষেত্রে অপরিচিত আগন্তুক হিসেবে চিহ্নিত হবে। তার সহযোগী নাগরিকদের পাশে থাকবে সে, কিন্তু তাদের দেখতে পাবে না। তাদের স্পর্শ করতে পারবে কিন্তু অনুভবে অক্ষম থাকবে। সে বেঁচে থাকবে শুধু তারই জন্য। শেষমেশ তারা প্রত্যেক জাতিকে এমন অবস্থায় নিয়ে যাবে, যেখানে জাতি বলতে বোঝাবে একদল নির্জীব পরিশ্রমী গবাদিপশু, যার রাখাল হবে সরকার।
শাহবাগ দিয়ে সরকারের উগ্রবৃত্তির প্রতিপালন, সংসদ দিয়ে তার বাস্তবায়ন সর্বোপরি ‘আমার মন পড়ে আছে শাহবাগে’ প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে কি মনে হয় না, জাতিকে বন্দুকের নলে ঠেকিয়ে, ভিন্নমতের মানুষদের মেরে-কেটে, ধর্মপ্রাণ মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করে এই সরকার ২০২১ পর্যন্ত আমাদের সবাইকে গবাদিপশুর মতো রাখার ব্যবস্থা করতে চায়?
এ কেমন মিডিয়া?