লাল ইটের খোয়া বসেছে কেবল-
গেল বর্ষার ধকলটা তাই সামলাতে পারল না। গুছিয়ে উঠেছিলো বেশ, সরকারী অনুদানে পিচঢালার স্বপ্নে বিভোর। শেষ শ্রাবণের ঢলের ক্ষতচিহ্ন গুলো বয়ে বেড়াচ্ছে সে এখন।
ভেবে দেখতে গেলে একটি প্রায় মেঠোপথের এর চাইতে বেশী আশা করাও ঠিক না। নিজের ২১ বছরের জীবনটা ও এই প্রায় মেঠোপথ’ই ; না রইলো গ্রাম্য সরলতা না পেয়েছে শহুরে চাকচিক্য। এসব ভাবতে ভাবতে, দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সাবধানে দেখতে ফ্যাশেনেবল হালকা ফোমের স্যান্ডেল জোড়া বাঁচিয়ে পথটুকু পার হলো রুবিনা। চোখের আয়নায় এখন ও লেগে আছে নিম দূরত্বে বাইকে বসা একজন।
এক ঢাল চুল মাথায় শ্যামা এক অপূর্ব সুন্দরী তন্বী রুবিনা, অসম্ভব সপ্রতিভ আর প্রখরতা চোখে মুখে সব কিছু ছাপিয়ে ওর জন্য যে শব্দ টা প্রযোজ্য সব চাইতে বেশি মানায় তা হচ্ছে মায়াবতী সে ।
শহরতলীর বিকেল গুলো সব সময় অন্য রকম হয় চা এর সুবাস পুরী পিঁয়াজু র তেলে ভেজা নিউজপেপারের গন্ধ, পরে আসা ছায়া নিয়ে কাঁচা সবজীর দুরন্ত সবুজ রঙ আর সাচরা মাছের বৈকালিক বানিজ্য। সাগর পাড়ের নোনা হাওয়া নিয়ে বসত হলেও মিঠে মৌরি ,মৌটুসি ডাক, গভীরতায় কালো হয়ে আসা শীতল জলের দীঘি খুব ঘুপ চুপচুপ বাতাসে দূরের বাঁশি বাঁজায়। সে বাঁশিতে আনন্দ সুর যত’টা চাপিলা মাছের সুবাস কে ইলিশের ঘ্রানে ভ্রম আনে তত’টাই ভরা বর্ষায় নিঃশব্দ পাঁজর ভাঙার ঢেউ।
পাড়ায় ঢুকতেই ছোটভাই জয়নাল কে দেখতে পেলো বঁড়শি হাতে বাড়ির দিকে ছুটছে , নির্ঘাত আজ ও স্কুল মিস দিয়েছে পাঁজি ‘টা। নিজেদের টিনশেড বাড়ি’ মায়ের কোল হয়ে ডাকছে। আহা! কতদিন হয় মা নিজেকে ভুলেছে , আমাদের ভুলেছে, হয়ত বাবা'কে ও শুধু ভুলতে পারে নি বাবা’র দেয়া আঘাত। বাইক আর রুবিনার মাঝে কেবল এক আধভাঙা খোয়া ছড়ানো লাল ইটের রাস্তা। দু’পাড়ের ডাকে’ই ভালোবাসা প্রবল।
টিনশেডের বাড়ি’র দিকে সাথে আছে প্রগাঢ় মায়া আর দায়িত্ব।
মাছ ভাঁজার কড়া ঘ্রান খিদে বাড়িয়ে দিয়েছে, হাতের ব্যাগ আর ছাতা ফেলে রান্নাঘরের লাগোয়া বারান্দায় ঝুপ করে নিজেকে নিয়ে ফেলল। জানিস নূরজাহানের আজ বিয়ে কথা ‘টা ধক করে বুকে লাগলো! একবারের নিঃশ্বাস ও মিস করলো বুঝি!
কি রে কি হলো বলেই ভাই বোনের হাসি, আরেয়ে আজ টি ভি “নুরজাহান” সিরিয়ালে ওর বিয়ে।
আপু মনে হয় ম্যানেজারের মেয়ে নুরজাহান ভেবেছে, তাই না ? আরেয়ে ধুর! ও তো পিচ্চি মেয়ে সাজিয়ার চেয়ে ছোট, অমন কেন ভাববো ? আজ কি রান্না!!!
মনে মনে সেই শোনা কথা কে কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারে না রুবিনা। ভাইয়ের ট্রেনিং শেষেই ম্যানেজারের মেয়ে র সাথে বিয়ে। এ সংসারের হাল ধরে গোছাতে গেলে আর বিয়েই করা হবে না। তাই নিজের টা আগেই গুছিয়ে নিতে চাপ দিচ্ছে মেয়ের বাপ ।
তিন বোন দু’ভাই নিয়ে সংসারে রুবিনা বড় মেয়ে , চার বছর আগে ও বেনীদুলিয়ে স্কুলের সবচাইতে সম্ভাবনাময় কিশোরীর একজন, সৈনিক বাবার দুঃসাহসিক কন্যা উপাধি ছিল । বড় ভাইটা সবে প্রাইমারি স্কুলে আর দু বোন স্লেট পেন্সিলে। খুব মনে করতে পারে জয় এর জন্মসাল সেটা, ছুটি’তে ভাই কে দেখতে আসাবার সাথে সাথে নিয়ে এলো পাড়াপ্রতিবেশি’র গুঞ্জন,বাবা’র নতুন বিয়ে’র গুঞ্জন, আমাদের অকুল পাথারের গুঞ্জন। একটা অসমাপ্ত বাড়ি’র হাহাকার, মায়ের অস্থির হবার, নির্ঘুম হবার শুরু সেটা।
এরপর থেকে বাবা আসা কমিয়ে দিলো, মা কমিয়েদিলো নিজের যত্ন করা, বাবা টাকা পাঠতে প্রায়’ই ভুলে যেতে লাগলো আর মা ভুলতে বসল রান্না। বাবা খোঁজ নেয়া বন্ধ করলো আর মা!!! পারিপার্শ্বিকতা। স্কুল ফাইনাল কোনমতে শেষ হয়েছিলো মামা’দের দয়ায়, কলেজ শুরু এলাকার দুঃস্থ ফান্ডে । ততদিনে ভাই কে স্কুল ছাড়িয়ে কারখানায় দিতে হয়েছে নিত্যদিনের তেলনুন খরচা উঠানোর জন্য। চাল ডালের বাৎসরিক যোগান মামাবাড়ি , শাক লতা পাতা উঠোন পেরুনো ছোট্ট ক্ষেত। মা সব ভুলে নিজেকে উজাড় করেছিলো লাউ কুমড়ার মাচাতে, পুই পালঙের সবুজে আর ডাটা লালশাঁকের রক্তিমভায়।
চব্বিশের শুরু’তে জীবন টা অনেক হালকা মনে হয় আজ , এক বছরে বড় ভাই’টা ট্রেনিং শেষে স্থায়ী একটা চাকরী তে যাচ্ছে , বছর ঘুরতেই সাজিয়ার প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারি। মায়ের জটাচুলে তেলের ছোঁয়া, লম্বা সিঁথির দুপাশে মসৃণতা, বুকের জমে থাকা অযাচিত বাতাস কে দূরে ঠেলে দেয়। আহা! কি স্বস্তি ! সফলতার ক্ষীণ হলেও আলোর রেশ। কর্তব্য থেকে মুক্তি।
তারপর !! তারপর, তাপসের সাথে স্বপ্ন ছবি’র রংতুলি নিয়ে বসা।
জয়নাল কে বলতে গেলে কোলে পিঠে মানুষ করলো সাজিয়া, আর রুবিনা মা কে সামলেছে। বাকি ভাই বোনেরা নিজেরা ই কেমন করে নিজেদের কে বড় করে তুললো সে খবর রাখার আগে’ই স্থানীয় এন জি ও তে তথ্য সংগ্রাহকের এই চাকরী’টা নড়বড়ে সংসারকে জীবন নামক রেললাইনে উঠিয়ে দিলো। সংসারে স্বস্তি এলো সাজিয়ার কলেজ খরচ আর মায়ের ঘুম। আলগোছে পায়ে পায়ে এলো ভাবনার অবসরের সাথে লজ্জার লালিমা, ঘেমে আসা উত্তাপের সাথে এসেছিলো তাপস ।
তাপস ‘ রুবিনার সহকর্মী, টিম লিডার আর একলা আকাশের রঙিন ঘুড়ি। নিরন্তর বয়ে চলা প্লাবিত সুখ, কঠোর বাস্তবতার সহযোদ্ধা। গত পাঁচ বছর থেকে অপেক্ষায় আছে রুবিনার ভাই বোনদের নিয়ে একটু গুছিয়ে উঠার।
কিছু সকাল আলাদা! ভাদ্রের তালপাকা গরমে ও এক পশলা বৃষ্টি আনে, অগ্রিমের শরতের শিউলি ঘ্রান টানে, জানালায় উঁকি দেয়া চোখ লাল করা সূর্যের চোখে, চোখ রাখতে চায় এমন এক একটা দিন। কাঁধে ব্যাগ আর ছাতা নিয়ে রোদ্দুরে মিশে যাবার আগেই, মনে পরে যায়, বিকেলের ট্রেনে ঢাকা যাবার কথা আজ। কাল পরশু দু’দিন ট্রেনিং………
কিছু কিছু মানুষের জীবন চক্র গোলক ভেঙে দারিয়ায় মেশে না। ঘূর্ণিঝড়ের ঘূর্ণিপাকে অতলে তলায়। অফিস থেকে পাওয়া কালো রঙের ছাতা ‘ই রয়ে যায় কিছু কিছু জীবন। কারন সেসব জীবনে যাদের লাল নীল প্রিন্টেড ছাতা হয়ে মাথার উপর ছায়া দেবার কথা, তারা ই কেড়ে নেয় স্বপ্ন জলরঙ।
তাপস এখন অন্য জেলায় পোস্টিং নিয়েছে, পাঁচ বছরের অপেক্ষা যখন দশ বছর হয়, হয়ত তখন সম্পর্কের উত্তাপে ও দীর্ঘ শীতকাল নামে। সেদিন রাতেই নুরজাহানের বিয়ে হয়েছিল, আমার ভাইয়ের সাথে'ই সেদিন থেকেই এ সংসারের দায়ভার থেকে সে মুক্তি নিয়েছিলো।
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ গুগল
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:৫৪