somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মহাকবি শেখ সাদি

১৬ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১২:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগে(১১৭৫-১২৯২) পারস্যে তথা ইরানের সুপ্রসিদ্ধ সিরাজ নগরের তাউস নামক স্থানে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে শেখ সাদী জন্মগ্রহণ করেন। পুরো নাম আবু মুহাম্মদ মুসলিহ আল দীন বিন আবদাল্লাহ শিরাজি (শেখ সাদি বা সাদি শিরাজি বলেও পরিচিত) ছিলেন মধ্যযুগের গুরুত্বপূর্ণ ফার্সি কবি তার লেখার মান এবং সামাজিক ও নৈতিক চিন্তার গভীরতার জন্য তাকে কদর করা হয়। ধ্রুপদি সাহিত্যের ক্ষেত্রে সাদিকে একজন উচু মানের কবি ধরা হয়।

শেখ সাদীর প্রাথমিক শিক্ষা সিরাজ নগরেই লাভ ঘটে। এরপর তিনি উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য এলেন তদানীন্তন মুসলিম বিশ্বের সেরা জ্ঞানকেন্দ্র বাগদাদে। বাগদাদে এক পর্যায়ে তিনি বিখ্যাত নিযামিয়া মাদরাসায় শিক্ষা লাভ করেন। অল্প দিনের মধ্যেই তিনি এই মাদরাসায় শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি মেধাবী ছাত্র হিসেবে মশহুর হয়ে পড়েন এবং শিক্ষাবৃত্তি লাভ করেন। মাদরাসায় কুরআন, হাদিস তাফসিরশাস্ত্র, ফিকাহ, উসুল, ফারায়েজ, হিকমা, দর্শন, ভাষাবিজ্ঞান, ধ্বনিবিজ্ঞান, অলঙ্কারশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে তিনি গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। বাগদাদে অবস্থানকালে শেখ সাদী গাউসুল আযম হয়রত আবদুল কাদির জিলানীর সান্নিধ্যে গিয়ে দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন।

পোশাকের গল্প --
শেখ সাদী একবার বাদশাহর বাড়িতে দাওয়াতে যাচ্ছিলেন। মাঝপথে রাত হলে এক বাড়ির ছোট্ট একটি ঘরে আশ্রয় পেলেন তিনি। বাড়ির পক্ষ থেকে সামান্য কিছু খাবারও জুটল। পরের দিন শেখ সাদী বিদায় নিলেন। শেখ সাদীকে পেয়ে বাদশাহ অনেক খুশি। সেজন্য বিদায় বেলায় কবিকে বাদশাহ বেশ দামি উপহার ও একটি জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক দিলেন। শেখ সাদী সেই পোশাক পরে উপহার নিয়ে বিদায় নিলেন। ফেরার পথে সেই একই বাড়িতে আবার রাত্রিকালীন আশ্রয় নিলেন।

বাড়ির লোকেরা এবার তাকে দেখে সম্মানের সঙ্গে নিজেদের ঘরে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দিলেন। একই সঙ্গে অনেক ধরনের রাতের খাবারের ব্যবস্থাও করলেন। সবার সঙ্গে খেতে বসে শেখ সাদী না খেয়ে সব খাবার পোশাকের পকেটে রাখতে লাগলেন। তা দেখে বাড়ির একজন কৌতূহল ধরে না রাখতে পেরে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা আপনি না খেয়ে খাবারগুলোকে পোশাকের পকেটে কেন রাখছেন?

শেখ সাদী বললেন, 'আমি যখন কয়দিন আগে এ বাড়িতে রাত্রিযাপন করেছিলাম তখন আমার অবস্থা খুব সাধারণ ছিল। তাই আমার সমাদরও হয়েছিল খুব সাধারণ। আজ আবার যখন এ বাড়িতে আসলাম তখন আমার অবস্থা খুব উচ্চ অবস্থায়। এর সবই পোশাকের গুণেই হয়েছে। তাই খাবারগুলো তারই প্রাপ্য। তাই আমি না খেয়ে পোশাককে তা খাওয়াচ্ছি।'
একথা শুনে তাদের খুব লজ্জা হলো এবং এ রকম ব্যবহারের জন্য তারা শেখ সাদীর কাছে ক্ষমা চাইলেন।

ফার্সি সাহিত্যে একটি প্রবাদ আছে— ‘সাতজন কবির সাহিত্যকর্ম রেখে যদি বাকি সাহিত্য দুনিয়া থেকে মুছে ফেলা হয়, তবু ফার্সি সাহিত্য টিকে থাকবে। এই সাত জন কবি হচ্ছেন মাওলানা জালালুদ্দিন রুমী, ফেরদৌসী, হাফেজ, নিজামী, শেখ সাদী, রুদাকি এবং জামি।
তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ বোস্তানে তিনি বলেছেন-----
নানান দেশে ঘুরে ঘুরে জীবন হল গত যে
নানান রকম লোকের সাথে দিন কেটেছে কত যে।
যেথায় গেছি কিছু কিছু নিয়েছি মোর থলিতে
নিয়েছি ভাল যা পেয়েছি পথের ধারে চলিতে।


ফার্সি গদ্যের জনক মহাকবি শেখ সাদি দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাভাষী পাঠকের কাছে অতি প্রিয় কবি। শুধু বাঙালিই নয় বিশ্বজুড়ে তিনি অত্যন্ত সমাদৃত।
তার কিছু বিখ্যাত উপদেশ।
১. তিন জনের নিকট কখনো গোপন কথা বলিও না- (ক) স্ত্রী লোক (খ) জ্ঞানহীন মূর্খ (গ) শত্রু।
২. অকৃতজ্ঞ মানুষের চেয়ে কৃতজ্ঞ কুকুর শ্রেয়।
৩. আমি আল্লাহকে সবচেয়ে বেশী ভয় পাই, তার পরেই ভয় পাই সেই মানুষকে যে আল্লাহকে মোটেই ভয় পায় না।
৪. এমনভাবে জীবনযাপন করে যেন কখনো মরতে হবে না,আবার এমনভাবে মরে যায় যেন কখনো বেচেই ছিল না।
৫. হিংস্র বাঘের উপর দয়া করা নীরিহ হরিনের উপর জুলুম করার নামান্তর।
৬. যে সৎ, নিন্দা তার কোন অনিষ্ট করতে পারে না।
৭. প্রতাপশালী লোককে সবাই ভয় পায় কিন্তু শ্রদ্ধা করে না।
৮. দেয়ালের সম্মুখে দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় সতর্ক হয়ে কথা বলো, কারন তুমি জান না দেয়ালের পেছনে কে কান পেতে দাঁড়িয়ে আছে।
৯. মুখের কথা হচ্ছে থুথুর মত, যা একবার মুখ থেকে ফেলে দিলে আর ভিতরে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই কথা বলার সময় খুব চিন্তা করে বলা উচিত।
১০. মন্দ লোকের সঙ্গে যার উঠা বসা, সে কখনো কল্যানের মুখ দেখবে না।
১১. পরিক্ষা ভিন্ন কিছু বিশ্বাস করিও না।
১২. বাঘ না খেয়ে মরলেও কুকুরের মতো উচ্ছিষ্ট মুখে তুলে না।
১৩. না শিখিয়া ওস্তাদি করিও না।|
১৪. কোন কাজেই প্রমাণ ছাড়া বিশ্বাস করিও না|
১৫. অজ্ঞের পক্ষে নীরবতাই হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম পন্থা। এটা যদি সবাই জানত তাহলে কেউ অজ্ঞ হত না।
১৬. তুমি বদ,লোকে বলে সৎ-ইহা অপেক্ষা তুমি সৎ, লোকে বলে বদ, ইহা ভালো”।
১৭. মিথ্যাবাদীর স্বরণশক্তি অধিক|
১৮.বল অপেক্ষা কৌশল শ্রেষ্ঠ ও কার্যকারী।
১৯.বানরকে স্নেহ করিলে মাথায় উঠে, বিড়ালকে স্নেহ করিলে কোলে উঠে।
২০.বিদ্যা এমন সম্পদ যা বিতরণে বাড়ে।
২১.একজন ঘুমন্ত ব্যক্তি আর একজন ঘুমন্ত ব্যক্তিকে জাগ্রত করতে পারে না।
২২.এক জনের জুতো নেই। এই নিয়ে তার আক্ষেপ। তার আক্ষেপ ঘুচল। কেননা সে দেখল এক জনের পা-ই নেই।
২৩.লৌহদন্ড প্রস্তরগাত্রে যেমন বিদ্ধ হয় না, তেমনি কৃষ্ণ অন্তরেও সদুপদেশ ক্রিয়া করে না
২৪.অযোগ্য লোককে দায়িত্ব দেওয়া চরম দায়িত্বহীনতা।
২৫. ভদ্র লোক সেই, যে সত্যের উপাসক
২৬, নিজের হাতের উপার্জিত একটি রুটি, অন্যের দয়ায় দেওয়া কোরমা পোলাওয়ের চাইতেও উত্তম।
২৭. আগন্তুকের কোনো বন্ধু নেই,আরেকজন আগন্তুক ছাড়া।
২৮. দুই শত্রুর মধ্যে এমন ভাবে কথাবার্তা বল, তারা পরস্পরে মিলে গেলেও যেন তোমাকে লজ্জিত হতে না হয়।
২৯,সকল কাজেই মধ্যপন্থা অবলম্বন করিও।
৩০.তুমি যদি উচচ সম্মান লাভ করিতে চাও তবে অধীনস্থ ব্যক্তিকে নিজের মতো দেখতে অভ্যাস করো। তাকে সামান্য মনে না করিয়া সম্মান করিবে।
৩১.ইহ- পরকালে যাহা আবশ্যক তাহা যৌবনে সংগ্রহ করিও।
৩২.যে ব্যক্তি কাউকে গোপনে উপদেশ দিল সে তাকে খুশি করল ও সুশোভিত করল আর যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে কাউকে উপদেশ দিল সে যেন তাকে লাঞ্ছিত ও কলঙ্কিত করল।
৩৩.পথের সম্বল অন্যের হাতে রাখিও না।
৩৪.প্রতিশ্রুতি খুব কম দিও। দয়া করবার আগে ন্যায়বান হও।
৩৫.স্ত্রী লোককে বেশী বিশ্বাস করিও না।

সাদীর রচিত মোট ২২ খানা গ্রন্থের নাম শোনা যায়। শেখ সাদীর শ্রেষ্ঠগ্রন্থ গুলিস্তা বিশ্বসাহিত্যের এক অতুলনীয় সম্পদ। ইংরেজি, ফরাসি, ডাচ, জার্মান, আরবি, উর্দু, তুর্কি, স্প্যানিশ ইত্যাদি বহু ভাষায় এ জনপ্রিয় গ্রন্থের অনুবাদ হয়েছে। দ্য গার্ডিয়ান অনুসারে, তাঁর রচিত বুস্তান বইটি সর্বকালের সেরা ১০০ বইয়ের মাঝে স্থান পেয়েছে। মাস্টার অফ স্পিচ,দ্য মাস্টার ইত্যাদি বহু খেতাবেই তিনি পরিচিত। আজও তাঁর কবিতা বিশ্বের কাব্যাঙ্গনে উচ্চারিত হচ্ছে সমগ্র আবেদন নিয়ে। শেখ সাদীর ভাষা ছিল অত্যন্ত অলঙ্কারময়। আর প্রকাশভঙ্গির জাদুকরী প্রভাব পাঠকচিত্তকে মোহিত করে রাখতো। শেখ সাদীর হৃদয় ছিল উদার ও মহৎ। তাঁর দৃষ্টিতে সকল মুসলমান ছিলেন সমান।তার রচিত বুস্তাঁ গ্রন্থে বলেন, ফুলের সংস্পর্শে মাটির ঢেলা যেমনিভাবে সুগন্ধি প্রাপ্ত হয়,অনুরূপ জ্ঞানী-গুণীর সংস্পর্শে থাকলে মানুষের চরিত্রেও এ প্রভাব পড়াটা স্বাভাবিক। আবার ‘গুলিস্তাঁ’ গ্রন্থে বলেন,একদা গোসলখানায় এক মাটির ঢেলা হাতে নিয়ে শুঁকে দেখলাম অফুরন্ত খুশবু, তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি আতরদানি, না সুবাসে ভরা গুলিস্থান? মাটির ঢেলা বলল, এসব আমি কিছু নই, আমি অতি নিচু মাটি, ফুলের সঙ্গে থেকে আমার সুবাস খাঁটি হয়েছে।

শেখ সাদী দীর্ঘজীবনের ৩০ বছর লেখাপড়ায়, ৩০ বছর দেশ ভ্রমণে, ৩০ বছর গ্রন্থ রচনায়, ৩০ বছর আধ্যাত্মিক চিন্তায় একনিষ্ঠ সাধনা চালিয়ে ১২৯২ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের সিরাজ নগরে মহাকবি শেখ সাদী ইন্তেকাল করেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৫৯
২৩টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় দেশনায়ক তারেক রহমানকে সম্পৃক্ত করার নেপথ্যে  

লিখেছেন এম টি উল্লাহ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:০৮


আগেই বলেছি ওয়ান ইলেভেনের সরকার এবং আওয়ামীলীগের যবনায় জনাব তারেক রহমানের বিরুদ্ধে পৌনে একশ মামলা হলেও মূলত অভিযোগ দুইটি। প্রথমত, ওই সময়ে এই প্রজন্মের নিকট উপস্থাপন করা হয়েছিল দেশনায়ক তারেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পকে নিয়ে ব্লগারদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



**** এডমিন টিমের ব্লগারেরা আমাকে বরাবরের মতোই টার্গেট করে চলেছে, এভাবেই সামু চলবে। ****

ট্রাম্পের বিজয়ে ইউরোপের লোকজন আমেরিকানদের চেয়ে অনেক অনেক বেশী শংকিত; ট্রাম্প কিভাবে আচরণ করবে ইউরোপিয়ানরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পের বিজয়, বিশ্ব রাজনীতি এবং বাংলাদেশ প্রসংগ

লিখেছেন সরলপাঠ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২১

ট্রাম্পের বিজয়ে বাংলাদেশে বা দেশের বাহিরে যে সব বাংলাদশীরা উল্লাস করছেন বা কমলার হেরে যাওয়াতে যারা মিম বানাচ্ছেন, তারাই বিগত দিনের বাংলাদেশের ফ্যাসিস্টের সহযোগী। তারা আশায় আছেন ট্রাম্প তাদের ফ্যাসিস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঠেলার নাম বাবাজী !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩১

এক গ্রামীণ কৃষক জমিদার বাড়িতে খাজনা দিতে যাবে। লোকটি ছিলো ঠোটকাটা যখন তখন বেফাস কথা বা অপ্রিয় বাক্য উচ্চারণ করে ক্যাচাল বাধিয়ে ফেলতে সে ছিলো মহাউস্তাদ। এ জন্য তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×