দত্তক
(১)
সালটা ঠিক মনে নেই। আমার বয়স তখন আট। সেই হিসাবে,আনুমানিক আটত্রিশ বছর আগের পুরানো কাসুন্দি।তবে পুরো ঘটনাটি এখনো মনের মধ্যে গেঁথে আছে। মনে হয় এই'তো গতকাল ঘটে যাওয়া এক বিপত্তিকর মুহুর্ত মনের মাঝে বিদ্ধ হয়ে আছে । আজকাল মনের পর্বত সমান ভারে এমনিতেই ভুলোমনা। কোনকিছু হারিয়ে গেলে তা খুব সহজে ভুলে যাই। গত সপ্তাহের কোন ঘটনা মাঝে মাঝে মনে করতে শ্বাসকষ্ট হয়। আর সেই আটত্রিশ বছর আগের বিস্মৃতি আটপৌরে গল্পের মতো আজোও টিঁকে আছে। আর সেই অচেনা বিভীষিকাময় ফোঁড়া আঁতে লেগে আছে। সেটা মনে করে প্রায় রাতেই বিমূর্ত রূপের ভয়ে আঁতকে ওঠি। আমার জন্ম আফগানিস্তানের পশতুন এলাকায়। আমার বাবা রহমত মোল্লা ছিলেন সরকারি ভূমি অফিসের কানুনগো। মা একজন গৃহিণী। বাবা আদর করে আমার নাম রাখেন রহিম মোল্লা। আর আমার চেয়ে দু বছরের ছোট ভাইয়ের নাম রাখেন করিম মোল্লা। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের ছোট গৃহে বিশাল বিস্তৃত সুখ ছিলো। তবে ঘরের বাইরের প্রতিদিন ছিলো অস্হিরতায় ভরপুর। আমাদের চারপাশে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকতো। মোল্লা আর মুজাহিদদের মারামারি,কলহ, বিরোধ, ছিলো প্রতিদিনকার সমাজের নির্মম প্রতিচ্ছবি। আমাদের এলাকার বেশিরভাগ মানুষ আফিমের চাষাবাদ,পশুপালন, ও শাকসবজিসহ নানাবিধ কৃষিকার্য করে জীবন নির্বাহ করেন। আবার অনেকে সরকারি পতিত জমি জবরদখল করে আফিমের চাষাবাদ করে। তেমনি পাহাড়ের কুল ঘেঁষে থাকা বিশাল সরকারি জমি মুজাহিদরা দখল করে আফিমের চাষাবাদ করে। সরকারি আদেশ পেয়ে বাবা আইনানুযায়ী ভুমিতে নোটিশ টাঙিয়ে দেন। সেই রাতে প্রতিশোধপরায়ন মুজাহিদদরা যা করলো তাতে আমার মনে হলো বন্য প্রাণী চেয়েও ওরা হিংস্র। সেদিন রাত আনুমানিক সাড়ে সাতটা। আমাকে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হলো। যথারীতি কাজটি সারতে বাবাকে বললাম। রাত হলো বাবা আমাদের দু ভাই'কে বাড়ির পূর্ব কোণের আম গাছটির নিচে নিয়ে প্রকৃতির কাজ সারাতেন। হারিকেনের মিটি মিটি আলো। তাতে আমার ঝাপসা ঝাপসা চোখে একদল মুজাহিদ বাহিনীকে আমাদের ঘরে ঢুকতে দেখলাম। মুহুর্তের মধ্যে গুলির শব্দ। বিকট শব্দে আম গাছের ফাঁকটাকে মায়ের গর্ভ মনে করে তার ভেতরে ঢুকে গেলাম। ভয়ে বিহ্বলল, বিধ্বস্ত হয়ে কাঁপতে থাকলাম। মুজাহিদদের চলে যাওয়ার বুটের শব্দ শুনে চোখ মেলে তাকালাম। দেখলাম লোকজনের এদিকে ওদিকে দৌড়াদৌড়ি। দূর থেকে লেখলাম আমাদের লাল মাটির মেঝেতে নিথর হয়ে শুয়ে আছেন প্রাণপ্রিয় মা,প্রাণাধিক বাবা,প্রিয়মুখ ভাইটি। পরিবারবর্গকে হারিয়ে ক্ষত বিক্ষত হলাম। অনেককিছু শেষ হ'য়ে গেলো। পায়ের নিচের মাটি, বাবার ভিটা হারালাম। পুরো আকাশকে ছাদ হিসাবে নেয়া ছাড়া কোন উপায় দেখলাম না । একে একে আমার পুরো পরিবারের সদস্যের দাফন সম্পন্ন হতে দেখলাম । খুব বেশি শোকে নাকি চোখের পানিরও অভিমান হয়। তাই এতটুকু বয়সে কোন কান্না পেলো না। পরবর্তীতে স্থানীয় এনজিও সংগঠনের সহায়তায় আমাকে একটি মিশনারী রিফিউজি ক্যাম্প ঠাঁই দেয়া হয়।
(২)
আমি মোল্লাবাড়ির ছেলে হিসাবে স্বভাবতই লাজুক স্বভাবের। বড় মোল্লা হওয়ার অভিপ্রায়ে স্হানীয় মাদ্রাসায় পড়তাম। কিন্তু জীবনের অনভিপ্রেত পরিস্থিতিতে এখন মিশনারী স্কুলে ভর্তি হলাম। ক্লাসে চুপচাপ ও ঘাপটি মেরে বসে থাকতাম। কারো সাথে মিশতে চাইতাম না। শুধু নিজেকে নিয়ে থাকতে চাইতাম এমন করে প্রায় দু'তিন মাস কেটে গেলো। আমাদের স্কুলে সুইডিশ ইরানিয়ান দম্পত্তি বেড়াতে আসলো। তাদের উভয়েই আমার সাথে কথা বলতে চাইলেও আমি চুপচাপ হয়ে রইলাম। কিছুদিন পর সে দম্পতি আমাকে তাদের দত্তক সন্তান হিসাবে নিতে ইচ্ছে পোষণ করলেন। তারপর চার থেকে পাঁচ মাসের মাথায় মিশনারী আবাসস্থল ছেড়ে আমার নিবাস হলো সুইডেনের স্টকহোমে। তারপর ভর্তি হলাম স্টকহোমের নামকরা 'সেন্ট জোসেফ' স্কুলে।আমি আধুনিক আর আভিজাত্যের মধ্যেই বেড়ে ওঠতে লাগলাম। নতুন স্কুলে নানান দেশের, নানান বর্ণের ছেলেমেয়ে পড়ে৷ সব ছেলেমেয়েদের তুলনায় আমি হলাম বয়সে সিনিয়র। অদ্ভুত ব্যাপার হলো,আমাকে নিয়ে মেয়েতে মেয়েতে ঝগড়া চলে। প্রায় সব মেয়েরা আমাকে বয়ফ্রেন্ড হিসাবে চায়। এক আফগান রিফিউজি থেকে রাজকীয়, অনাথ বয় থেকে অনুপম হয়ে উঠলাম। মেয়েদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় এই আমি হৃদয় বিছিয়ে দেই বাঙালি রমনী সাহারার বুকে। সাহারা,নামটি মরুভূমির হ'লেও রমনী সাহারার ভালোবাসা ছিলো সমুদ্রের উন্মাদনার মতো। একসাথে স্কুল, কলেজ শেষ করার পর। সাহারার পরিবার থেকে আমাদের বিয়ের ব্যাপারে সম্মতি না থাকাতে একসময় সে পরিবার ছেড়ে আমার কাছে চলে আসে। আমি প্রফুল্লচিত্তে সাহারাকে সারাজীবনের সঙ্গীনী হিসাবে গ্রহন করি। দুজনের চাকরি, এদিকে ওদিকে ঘুরাঘুরি এসব করে ভীষণ সুন্দর দিন কাটতে লাগলো। বিয়ের দুবছর পর থেকে সাহারা নিজের সন্তান নিতে চায়। বহু ডাক্তার, আয়ুর্বেদ,ইমাম দেখিয়ে কোন লাভ হলো না। একটা অতৃপ্তি যেন বিতৃষ্ণার জন্ম দিতে লাগলো। সংসারে ধূমকেতুর কোন আর্বিভাব না হওয়াতে চলে অনভিপ্রেত পরিস্থিতি।সন্তানহীন সাহারার মরুবুকে সন্ন্যাসীর মতো অভিযান। বীজে পুষ্টিগুন না থাকাতে, রসদ যোগাতে অক্ষম হওয়াতে আমি হই অভিযুক্ত। সংসারের চরম রিক্ত তিক্ত খেলাতে বহুবার খেই হারিয়ে ফেলি। সাহারাকে অনেকবার বুঝিয়েছি।তার আধুনিক বিজ্ঞানের কোন টেস্টটউব বেবি নিতে অস্বীকৃতি ভালো কথা, বাংলাদেশ থেকে একটি শিশুকে তো দত্তক নেয়া যায়৷ আমি একজন দত্তক সন্তান হয়ে গত বছর ইরানিয়ান- সুইডিশ মা-বাবা বিমান দূর্ঘটনায় মারা যাবার আগ পর্যন্ত তাদের দেখভাল করি। এই প্রাচুর্য আর সুখের মধ্যে থেকে অযথা অসুখ টেনে নিয়ে আসার কি দরকার? জীবনের অন্বেষা কি শেষ হবার ? তারচেয়ে এভাবেই চলে গেলে ক্ষতি কি? তার কথা, এক ভাই আরেক ভাইয়ের ছেলেকে আপন ভাবে না। চৌদ্দ গোষ্ঠীর কেউ পালকসন্তান নেয়নি। সে কেন অন্যের ঝামেলা নিজের ঘাড়ে নেবে ? নিজ গর্ভের সন্তান হলে সম্পদ আর অন্যের সন্তান হলে সমস্যা ! মনুষ্য সমাজের কি অমার্জনীয় অপরাধ! একটি সাঁকোর অভাবে পাড়ি দেয়া হয়নি সংসারের সারথি। সহসাই ভেঙে পড়ে বহুদিনের লালিত সুখস্বপ্ন। অন্য ভেলায় চড়ে বসে প্রিয়তমা সাহারা।
ছোট বেলায় পিতাকে হারালাম। পিতা হতে না পারার অভিযোগে প্রিয়তমা বান্ধবীকে হারালাম। এমন অমানিশার মাঝে দিকবিদিকশুন্য আমি হাহাকার করতে লাগলাম। চরম ভীতসন্ত্রস্ত ও বিকৃত-মস্তিস্কে নারীর একমাত্র বিকল্প সারাব হতে পারে। তাই বাঁচার অবলম্বন হিসাবে মদ'কেই আপন করে নিলাম।
(৩)
প্রতিদিন সূর্য ডোবার সাথে সাথে ব্রাকহোলম্যান নদীর পাড়ে গিয়ে বসি। রয়েল ন্যাশনাল পার্কের কূল ঘেঁষে এই পোতাশ্রয়ের শুনশান নীরবতা মনে হলো কষ্টের কথা বুঝবে। একা-একা বসে জ্যাক ড্যানিয়েল, ভডকা,বেলস যে মদ পাই তাই খাই। খেয়াল করে দেখলাম আমি যে কোণায় বসি, প্রতিদিন সেদিক দিয়ে এক মা ও মেয়ে আমাকে পাশ কেটে যায়৷ শ্যাম বর্ণের রমনীর মেদযুক্ত শরীরের ভাঁজ যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। সাথের মেয়েটির বয়স দেখে আমার ছেলেবেলার কথাই মনে হয়। ঠিক এই বয়সেই মা-বাবাকে হারাই। একদিন, দুদিন তিনদিনের দিন ইচ্ছে করে শ্যামা মেয়েকে জিজ্ঞেস করি,
- Have you got any lighter? তার স্পষ্ট উত্তর
- I Don't Smoke.. Why are you having drinks here?
- মানে কি Means what?
- পুলিশ দেখলে জেল-জরিমানা হয়ে যাবে। If police see you, Than you gonna get punishment.
আমার কথা শেষ হতে না হতেই সে চলে গেলো। আমি তার প্রস্থান চেয়ে দেখলাম। সত্যি তো নদীর পাশে মদ্যপ অবস্থায় দেখলে এদেশে পুলিশ থানা হাজতে নিয়ে যাবে। মদ খাওয়ার অনুমোদিত নিদিষ্ট জায়গা আছে। কি সিস্টেম ! মদ খেতে হ'লেও আইন মানতে হবে। অতিরিক্ত মদ খেয়ে ডাইভিং করলে জরিমানা। সব ভুলেই বসেছি।
পরদিন মদের বোতল একটি প্লাস্টিকের ডোঙা দিয়ে মুড়িয়ে একটু আগে গিয়ে বসে থাকি। আমি মনে মনে মেয়েটির আসার অপেক্ষায় ছিলাম। এবার তাকে দেখামাত্র বলতে লাগলাম,
- মনের দুঃখে মদ খাই। আগে মদ,সিগারেট কিছুই খেতাম না । মনের দুঃখগুলো বড়ই বেয়াড়া।
- মনের দুঃখ হ'লেই মদ খেতে হবে, খারাপ কাজ করতে হবে, অসৎ হতে হবে। এটা কেমন যুক্তি ?
আমার'তো মন খারাপ আছে। আমি মুক্ত বাতাস খাচ্ছি। আমার মতো বাতাস খেতে পারো না ?
- সবাই তো তোমার মতো সুস্থ চিন্তা করতে পারে না। আচ্ছা তোমার মন খারাপ কেন?
- তোমারটা আগে বলো, শুনি
- একটা ঝাঁকুনি খেয়ে বলতে লাগলাম, একটি অপূর্ণতা আমাকে অপবাদি করে সংসারত্যাগী করে। বারবার সবকিছু হারাই আর হেরে যাই। এটাই হলো আমার বিষাদের গল্প।
আমার কথা শেষ হবার সাথে সে কেঁদে চললো - আর বললো আমার ব্যাপারটি তোমারটার ঠিক বিপরীত। আমি ভালোবেসে বিয়ে করি আমার কলিগকে। সে আমার মতো সোমালিয়ান। এক বাচ্চা হবার পর তার বদলে যাওয়া দেখি ৷ আস্তে আস্তে আমার কাছে আসা বন্ধ করে দেয়। শেষে জানতে পারি সে আমি ছাড়াও আরো পাঁচটি বিয়ে করে। আরো পাঁচটি সন্তান আছে। সন্তান হবার পরপরই সব স্ত্রীর কাছ থেকে কেটে পরে। দু'জনে একসাথে বলে উঠলাম "অদ্ভুত"
দু'টি অদ্ভুত এক হলে জীবনের বোধ মনে হয় দর্শনীয় হতো একথা বলে সে চলে গেলো। আমি সেদিন আর মদ খাইনি। কান্না জড়িত কন্ঠে নিজেকে বলি নাহ, কোন আক্ষেপ নেই ! জীবনে আক্ষেপই মানুষকে অকারণে আহত করে। আজ একসপ্তাহ হলো সেই মেয়েটি আর আসেনি, সে কি অভিমান করলো? আমি কেন তার আসার অপেক্ষায় থাকি? তার জন্য আমার কিসের টান?
হঠাৎ করে পিছন থেকে কে বলেলো,
Hi, Are you my father? হেই, আর ইউ মাই ফাদার? তুমি কি আমার পিতা? মা মেয়ে দু'জন দাড়িয়ে আছে। আধো আধো চোখে মেয়েটার দিকে তাকালাম। আর তন্ময় হয়ে তার নিস্পাপ মুখের দিকে চেয়ে থাকলাম। শ্যামা ঝিনুকের উদর থেকে যেন মুক্তোর দানা। এত ঝকঝকে হাসি জীবনে আর দেখিনি। মনে হয় কত চেনা, কত পরিচিত এই মুখ। শরীরের লোমকূপ জেগে ওঠেলো। প্রতিদিন এভাবে কত যুদ্ধাহত শিশুপ্রাণ অকালেই ধুলোয় মিশে যাচ্ছে। সেই শিশু আমার মতো পিতৃহারা হয়। আমার মতো পিতার জন্য হাহাকার করে। আমার মতোই কেউ একজন আবার পিতা হবার জন্য চরমভাবে পাগলপারা হয়। সব শিশুকে কেন তবে পিতার দৃষ্টিতে দেখি না ! কেন একজন শিশুকে বঞ্চিত করি পিতার কোলের ওম থেকে!! পিতৃভক্তি মনের হীনমন্যতা দূর করতে পারে। সে যারই সন্তান হোক। যেকোনো শিশুর সুন্দর মুখশ্রী পরিশুদ্ধতা অর্জনের তন্ত্রমন্ত্র শেখায়।সৃজনশীলতার চর্চার অসীম সাহস যুগায়। এসব ভেবে ছলছল চোখ,জড়তা সম্বলিত কন্ঠে-
আমি মৃদুস্বরে বলি -Yes, I am your father.. এক মানব শিশুর কোমল শরীরে হাত বুলালাম। সেই সুশীতল পরশে পিতৃহীনের পিতৃত্বের পিয়াসী মন পরিশুদ্ধ ও পরিপুষ্ট হলো।আমি উশৃংখলতার শেকল ছিড়ে শৃঙ্খলাবদ্ধতায় আবদ্ধ হলাম। জন্মান্তরের চরম অস্থিরতার দোলাচাল শেষে স্বস্তির অনুভবে স্নিগ্ধ ও স্নাত হলাম। এক নিস্পাপ মানব শিশুর চোখে,আমার চিরজনমের হারিয়ে যাওয়া পিতাকে খুঁজে পেলাম।
কপিরাইট @রহমান লতিফ,
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ২:৪৮