আপনার হাতের স্মার্টফোন ব্যবহার করে ভিডিও, ছবি তুলে আমাদের কাছে পাঠিয়ে আপনিই হয়ে উঠুন একজন সাংবাদিক --- কিছুদিন আগে এইরকম একটা বিজ্ঞাপন চিত্র দেখে ভাবছিলাম কি সাংঘাতিক! স্মার্টফোন থাকলেই সাংবাদিক ? এত কি সহজ একজন সাংবাদিক হওয়া ? একজন সাংবাদিকের পথ কতটা সংগাম, সংশয়, ডেডিকেশন, প্রশিক্ষণ, সামাজিক দায়- দায়িত্বের কিন্তু প্রগ্রেসিভ বা প্রগতিশীল সমাজে তা এত সহজ হয়ে গেলো? কিন্তু সহসাই আমার অবাক হওয়ার ঘোর কেটে গেল যখন দেখি কোথাও আগুন লাগলে সবাই সাংবাদিক সেজে আগুন নিভানোর চাইতে ভিডিও বা ছবি তুলে প্রচার করাটাই জরুরি মনে করে । কেবলই প্রোপার্টিজে আগুনের তীব্রতার চিত্র নয় অনেক নির্লজ্জ ও বেগানা প্রোডাক্টসদের শরীরের উত্তাপ ছড়ানো ফেইসবুক লাইভ নামক আগুনের কুন্ডলীতে শরীরকে পাক খাওয়ানোকে কোন অবস্থায় বিকৃত রুচিবোধ বলা যাবে না! যার ফলশ্রুতিতে দেখা যায় কত শত নিজস্ব মিডিয়া চ্যানেল- প্যানেল, পেয়ার টিভি,পীর টিভি, মুরীদ টিভি, মহব্বত টিভি , এ টু জেড টিভি আরও কত শত রঙিন মিডিয়া হাউস খুলে বসেছে তার কোন হিসাব নেই !
শুধু কি তাই -
মৃত ব্যক্তির কবর খুঁড়া থেকে মাটিচাপা পর্যন্ত সচিত্র প্রতিবেদন, কোরবানির পশু জবাইের রক্তসহ দেহ থেকে মাংসের ভাগ বন্টন, নারীর বিকিনি থেকে ব্রন, বেডরুম থেকে পাকঘরের ছবি এমনকি রাষ্ট্রের কর্তা ব্যাক্তিকে আজেবাজে গালি, যেকোন ছোট, বড় এমনকি স্পর্শকাতর ইস্যু নিয়ে শুরু হয় রঙ বেরঙের ট্রল,বানোয়াট খবর,ছবি, ভিডিও, সমালোচনা, বিভিন্ন মিডিয়ায় যে যার মতো করে প্রকাশিত করছে - তাদেরকে আবার বিকৃত-মস্তিস্ক বা রুচিহীন বলা যাবেে না তাদের সপক্ষে কড়া যুক্তি হলো তারাই নাকি প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী এবং সমাজের সকলের বাক-স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে।
বিকৃত- বিব্রত প্রসৃতবাক্য শুধু কি সংবাদমাধ্যমে সীমাবদ্ধ - পেশার দিক থেকে সবচেয়ে নোবেল পেশা হলো চিকিৎসা আর সেক্ষেত্রে দেড় যুগ সফল বিশেষজ্ঞ হিসাবে রোগীর ঔষধ পথ্য দেওয়া থেকে অপারেশন করা চিকিৎসক যদি হয় সাবেক রেল কর্মচারী বা ওয়ার্ডবয় তবে কি অবাক হবেন ! সে তো মামুলি ঘটনা রোগীর ভেঙেছে ডানপা আর ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে দেয়া হয় বামপায়ে। না অবাক হবার কিছু নেই। চেম্বারে ডাক্তার নেই, ডাক্তারবাবু দীর্ঘদিন ছুটিতে বা অবসরে থেকেও কাজে উপস্থিত দেখিয়ে বেতন নেয়া , আর এপেন্ডিসাইটিসের অপারেশন করতে গেলো কিডনি হারানো, রোগীনীকে জোড় করে সিজারিয়ান অপারেশনে বাধ্য করানো, কমিশন বাণিজ্য, এইতো গত সপ্তাহে ফ্রান্স বেইজড প্রেসক্রিপশন বিক্রিতে বিশ্বের চতুর্থ ঔষধ কোম্পানি যাকে আগে এভেনটিস (Aventics ) বর্তমানে সানোফি (Sanofi) নামে পরিচিত সেই লাভজনক একটি কোম্পানি বাংলাদেশ ছাড়ার কারণ হিসাবে, এ দেশের অতি আধুনিকায়ন বা প্রগতিশীলতার ধ্বজাধারী বিপণন বিভাগের নৈতিকতার প্রশ্ন তুলেছে।বলা বাহুল্য ওষুধ কম্পানিগুলোকে তাদের ওষুধ প্রেসক্রাইবে করার জন্য ডাক্তারদের বড় অঙ্কের কমিশন, মাসোহারা ও উপহারসামগ্রী দিতে হয়। তবেই শুধু রোগীদের ওই কম্পানির ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন। সানোফি সহ যেকোনো প্রতিষ্ঠান যদি এইসব কমিশন বা উপঢৌকন না দেয় তাহলে উদ্ভাবন ও মার্কেটিং কোনোটিতেই এদেশে টিকতে পারবে না। কেবল ঔষধ কোম্পানি থেকে নয় মৃত লাশ থেকেও নেয়া হয় কমিশন, এম্বুলেন্স কোম্পানি, প্যাথলজিকাল সেন্টার, মুলত কমিশন বাণিজ্যের উপর ভর করে টিকে আছে। এসবের সামান্যই খবরে প্রকাশ হয় আর এমন অনেক মহৎকর্মের অজানা,অদেখা রহস্যময় কত উৎপাত রয়ে গেছে তবুও তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা অপরাধ কারণ এগুলো চলছে সমসাময়িক কালের বিবর্তনে।
এবার আসি সকল বিভাগের চালিকাশক্তি বা প্রাণশক্তিপূর্ণ বিভাগ হিসাবে খ্যাত শিক্ষাখাতে,
একটি জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাতটি অসৎ চরিতার্থের লোকবল ও অস্ত্র ঝনঝনাতির ফলে অনিয়ম, অপবাদের বোঝা নিয়ে অক্ষম-অসহায় অবস্থায় পরিণত হয়ে গেছে। এমন কোন পাবলিক পরীক্ষা নেই যেখানে পরীক্ষার অনেক আগেই প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যায়। কিছুদিন আগে এক সাংবাদিক একজন ছাত্রকে জিজ্ঞেস করছিলো আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি এর ইংরেজি কি, ছাত্র উত্তরে বলেছিল- I am GPA 5. এটাই হচ্ছে তথাকথিত জিপিএ -৫ পাওয়া মেধাবী শিক্ষার্থীরা নমুনা। প্রশ্নফাঁস ছাড়াও মরন ফাঁদ রাজনীতি কোমলমতি ছাত্রদেরকে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে চলছে। দেখা যায় আমাদের এমন কোন দিন নেই যেদিন কোনও না কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন ছাত্র রাজনৈতিক নিপীড়ন বা গণহত্যার শিকার হচ্ছে। একজন সহপাঠীকে এক গ্রুপ কোন ঠুনকো কারণে অমানুষিক ভাবে পেটালে অন্য সহপাঠী হয় ছবি ও ভিডিও তুলাতে ব্যস্ত কিংবা দাড়িয়ে উপভোগ করবে। এই অধঃপতন ও অমানবিক মনোভাবাপন্ন জংলিদের সংখ্যা যে হারে এসব বেড়ে চলছে তার ভয়াবহতা বলতে গিয়ে প্রগতিশীল ঘরনার লেখক, ব্লগার ঠাকুর মাহমুদ বলেন, অচিরেই বাংলাদেশের ৩৬৫ দিনই কলঙ্কের দিন হিসাবে গণ্য হয়ে যাবে। তার উপর জোর যার মুল্লুক তার নীতি, সব পাশ ও নকলের মহোৎসব, পেশী শক্তির ইশারা, দেহব্যবসা, ইয়াবা, ড্রাগস, হল-দখল,জবর - দখল জীবনের কানাগলি, চোরাগলি আরও অজানা কতকিছু!
শুধু কি ছাত্র -
"মানুষ গড়ার কারিগরি" বলা হয় যে সমস্ত শিক্ষকদের তারাই ''মানুষ মারার কারখানা" হয়ে গেছে। শিক্ষক কতৃক ছাত্রছাত্রীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, গ্রুপিং, শিক্ষক রাজনীতির নামে সাদা আর নীল দলের কাঁদা ছুঁড়াছুঁড়ি , মত আর মিলের চরম বিভক্তি শিক্ষক সমাজকে আলোকিত করার বদলে কলুষিত করছে তবুও তাদের বিকৃতরূপ বলা যাবে না। জাতির মেরুদণ্ড বলা হয় যে শিক্ষা খাতকে প্রগতিশীল সময়ে তাকে 'জাতীয় ক্যান্সার ' বললে ভুল হবে কি? শকুন শাবকের বুভুক্ষু থাবার শিকার এ খাতে প্রগতিশীলতার নামে বোধের দেয়ালে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া হয়েছে।
প্রগতিশীলতা ও পেশাদারিত্ব কি পরস্পর সাংঘর্ষিক -
মোটেই না। বরং পেশাদারিত্বর প্রভাব থাকলেই প্রগতিশীলতার আসল সৌন্দর্য ওঠে আসে। যেখানে পেশাদারিত্বের অভাব যতবেশি সেখানে সকল জাল ও ভেজালের রূগ্নরুপ ততইটাই আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। একজন ছাত্রের কাছে অধ্যায়ন হলো মূলকথা কিন্তু দুঃখজনক হলেও তাকে দেখা যায় রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার যন্ত্রপাতি হিসাবে ব্যবহার হতে। যাট ফলে মুলধন হারিয়ে যা হবার তাই হয় তাদের কেউ কেউ হয় চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ কিংবা পকেটমার। ঠিক তেমনি একজন সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা তার কাজের স্বচ্ছতাকে সিঁকেয় তুলে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে ঘুষ, নীতির বদলে দূর্নীতি, অহেতুক চামচামি,তেলা তেলি, রেশারেশি ও ব্যক্তি বন্দনা ফলে পাবলিক সার্ভিসের নাম হয়ে যায় পাবলিক ভোগান্তি। এ প্রসঙ্গে প্রফেসর ইউভাল নোয়া হারারি Sapiens: A Brief History of Humankind বলেছেন, প্রগতিশীল এ সময়ে যদিও মানুষ অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে অধিক ক্ষমতাবান কিন্তু কারো কোন দায়বদ্ধতা নেই ফলে বর্তমানে মানুষ নিজেকে ঈশ্বরভাবে তাই এখনকার সময়ের মানুষ সেইসঙ্গে সবচেয়ে বেশি দায়িত্বজ্ঞানহীন। আর একটু বেশি সুখ, আর একটু বেশি আমোদের জন্য আমরা আমাদের আশেপাশের প্রাণীকুলের জীবন ও পরিবেশের প্রতি ক্রমাগত হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছি। এতকিছুর পরেও কিন্তু আমরা তৃপ্ত নই, সন্তুষ্ট নই। আমরা অতৃপ্ত, অশান্ত।
আমাদের সমস্যার মূল কোথায় -
প্রতিটিকে কাজে, প্রতিটি সাজে জড়িয়ে আছে এথিক্স (Ethics) বা মূলনীতি নির্ধারনী সারবস্তু।এথিক্সকে বলা হয় নৈতিক দর্শন। নীতিগতভাবে একজন মানুষ ভালো-মন্দের তুলনা,কোনটি সঠিক -আর কোনটি ভুল তা অনুধাবন করবে যা তার (Moral Value or Principles) মূল্যবোধের সাথেও জড়িত। টপ জব থেকে লো' জব যথাযথ প্রশিক্ষণ, যাচাই- বাছাইয়ের পর নিয়োগের সময় হাতে একটা নিয়োগপত্র আবার কারো কারো শপথ বাক্য পাঠ করতে হয় তাতেই বলা হয় চাকরির বিশদ দায়দায়িত্ব । যেমন সেবাই ধর্ম, অতন্দ্র প্রহরী, জানমালের নিরাপত্তা এসব মূলমন্ত্র - মূলনীতির পরবর্তী সময়ে মুলা ঝুলানোর মতো মনে হয়। সমাজের সবাই যার যার পজিশন থেকে এথিকস ধরে রাখলে দেখা যাবে সবক্ষেত্রেই অস্তিত্বশীল মূল্যবোধ,কর্তব্যনিষ্ঠা,পক্ষপাতমুক্ত কালচার তৈরি হয়ে যাবে ফলে সমাজিক বিপর্যয়ের অনিবার্য পরিণতি থেকে মুক্তি সম্ভব । আপনি প্রগ্রেসিভ হন, প্রগতিশীল হোন ভালো কথা কিন্তু দয়া করে নিজের দায় অস্বীকার করবেন না। প্রতিটি পেশার মানুষ নিজের কাজের দায়িত্বের প্রতি নিষ্ঠুর হওয়ার বদলে নিষ্ঠাবান হলে অমানিশার ঘোর কেটে যাবে, নতুন দিগন্তে উদিত হবে রক্তিম সূর্য.....
রহমান লতিফ, লন্ডন, অক্টোবর ২০১৯.
কৃতজ্ঞতা - সামু কতৃপক্ষ।
ঋনের দায় - ব্লগার ঠাকুর মাহমুদ।।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৯ রাত ১১:৪৫