দ্যা নোটবুক - জুয়ার জৌলুস কতদূর !
'খেলাধুলা' আমাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আবশ্য এটি প্রতীয়মান সত্য যে, মানুষের দেহ,মন, চিত্ত ও বিত্তের খোরাক যোগানোর সর্বজনীন এক মাধ্যমেই খেলাধুলা। আধুনিক যুগে খেলাধুলা নিছক বিনোদনের সীমারেখার অতিক্রম করে বরং কৃত্রিমতা ও আদিমতায় ভরপুর সামাজিক বলয় ও অসৎ তরুণ প্রজন্মে তৈরি করে চলছে। ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকার ২০১৪ সালে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (আইআইটি) ৫০তম ‘স্পোর্টস মিট’ উপলক্ষে বক্তব্য বলেছেন, খেলাধুলা শুধু সুস্থতাই দেয় না, সুখও দেয়। আমরা পুরো জাতি খেলোয়াড় হতে পারব না। কিন্তু একটা সুখী জাতি তো আমরা হতেই পারি। এতে বুঝা যায় জাতি গঠনে খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তা।কোন খেলায় যদি বাজী ধরা বা টাকাপয়সার লেনদেন জড়িত থাকে তখন খেলাটি অসাধুদের মেলায় পরিণত হয়। দুর্ভাগাজনকভাবে ঠিক কবে থেকে খেলাধুলায় আসক্তি বাড়ানোর উপকরণ হিসাবে টাকা পয়সার সখ্যতা গড়ে ওঠেছে তা বলা মুশকিল । সময়ের পরিক্রমায় বিভিন্ন মধ্যস্বত্ব ভোগী ও সুবিধাবাদিরা তাদের স্বার্থের স্বাদ বাড়াতে পরিকল্পনামাফিক যোগ করে "পে এন্ড প্লে" আর খেলাধুলাকে অসাধু ব্যবসা-সম্পৃক্ত পণ্য হুসাবে চলে "ফ্রডিং এন্ড ফিক্সিং"। পশ্চিমা বিশ্বের আনাচে কানাচে থেকে শুরু করে অনলাইনসহ হরেক পন্থায় বুকিজ হাউস, ক্যাসিনো ও রুলেট মিশিনে শত শত কোটি পাউন্ডের জুয়ার ব্যবসা চলছে। এতে দেখা যায় অনেকেই নিঃস্ব ও সবসুদ্ধ হারিয়ে পাগল হয়ে যায়। ইংল্যান্ডের একজন ঘরোয়া ফুটবলারের নিলামে যা দাম হয় তা হয়তে বাংলাদেশের কোন বড় শহরের বার্ষিক বাজেটের সমতুল্য বা কম- বেশি হতে পারে৷ জুয়া হলো পুঁজিপতিদের টাকা বানানোর মাধ্যম। কোন ব্যবসায় পুঁজিপতিরা বিনিয়োগ করবে লাভের আশায় নাকি নিছক বিনোদনের জন্য? সে যাই হোক জুয়ারীদের কাছে জুয়া খেলে আখেরে কে লাভবান হয় তা আদৌও ভাবার কোন বিষয় নয়।
ঘটনা -
আমার এক মিউচুয়াল বন্ধু মিঃ ছমীর উদ্দিন ( ছদ্মনাম), যাকে আমি মামা বলে ডাকতাম । ভদ্রলোক কুষ্টিয়া ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে গ্রেজুয়েশন সম্পন্ন করে যুক্তরাজ্য পড়তে আসে। সদাহাস্যজ্বল ও নামাজি লোকটাকে আমার কাছে বেশ আপন আপন ও বন্ধুবৎসল বলে মনে হতো। রাজনীতি, ধর্মনীতি ও লেখাপড়ার বিভিন্ন বিষয়ে নিয়ে তার সাথে বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা ও সমালোচনা হতো। মিঃ ছমীর উদ্দিন একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে ওয়েটার হিসাবে কাজ করে। সপ্তাহে বেতন বড়জোড় ২০০-২২০ পাউন্ড পায়। ২০০৯ সালে কোন একসময় সে আমাকে জানালো হঠাৎ করে বিয়ে করে বৌকে এদেশে নিয়ে এসেছে। শুধু তাই নয় তার একমাত্র ছোট ভাইকেও প্রায় আট লক্ষ টাকা খরচ করে এদেশে স্টুডেন্ট ভিসায় নিয়ে আসছে। হঠাৎ করে তার এত টাকার কর্ম সাধনে বেশ অবাক হলাম ! তার বদলে যাওয়ার গুপ্ত রহস্যের উৎস সন্ধানে মিঃ ছমীরের কাছের বন্ধু মামুন'কে জিজ্ঞেস করি ঘটনা কি? সে এত টাকা কোথায় পেলো? রহস্য উদঘাটনের ফলাফলে জানতে পারি মিঃ ছমীর লন্ডনের নামকরা একটি ক্যাসিনোতে খেলে এক রাতে পনেরো হাজার পাউন্ড আয় করে পুরো টাকা দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে আর সেই টাকা দিয়ে বিয়ে ও ভাইয়ের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা। জুয়ার টাকাটা অন্তত কাজে লাগিয়েছে জেনে ভালোই লাগলো। এরমধ্যে বেশ কয়েকবছর ছমীরের সাথে তেমন কোন যোগাযোগ নেই। ২০১৩ সালে কোন এক রাতে তাকে লন্ডনের চায়না টাউনে বাংলাদেশি রিকশার মতো (টমটম) চালাতে দেখি। মলিন চেহারা আর কাঁচাপাকা দাঁড়ি -গোঁফে তাকে অন্যরকম লাগছিলো। তাকে দেখে বড় করুণা হলো। আবারো মামুন'কে ফোন দিয়ে মিঃ ছমীরের বর্তমান হালহকিকত সম্পর্কে জানতে চাইলাম। মামুন জানালো মিঃ ছমীরের স্ত্রী তার সাথে ঝগড়া করে বাচ্চা নিয়ে শেলটার হোমে চলে গেছে। তার ছোট ভাই এদেশে একটি মেয়েকে বিয়ে করে। বিয়ের কিছুদিন পর জানতে পারে তার স্ত্রী মানসিক বিকারগস্ত তাই ছোটভাই সে স্ত্রীকে ফেলে ফ্রান্সে চলে গেছে। কার্যত মিঃ ছমীর একজন অসহায় মানুষ রিক্সা চালিয়ে যা রোজগার করে তা জুয়া খেলে শেষ করে দেয়। এই শিক্ষিত লোকটার এখন আগ- পিছ বলতে কিছু নেই। সবকিছু শুনে মিঃ ছমীরের জন্য যতটুকু করুণা হয়েছিল ততটাই তিরস্কার করতে ইচ্ছে করলো। ভাবলাম জুয়ার জৌলুস কতদূর !
নোট-
(১) অবৈধ কাজকারবার কখনোই মানসিক স্বস্তি ও সুখ কোনটাই দিতে পারে না ।
(২) জুয়ার খোয়াবে শুধু খোয়ানো ছাড়া কোন অর্জন নেই।
(৩) নিষিদ্ধ বিজ্ঞাপনে বিজ্ঞের বিজয় আর অজ্ঞের আহাজারি ।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৯ বিকাল ৫:০৪