পড়তে খুব ভালোবাসেন উনি। যেকোনো কিছুর উপর বই হলেই হল- আদ্যোপান্ত মনোযোগ দিয়ে পড়ে ফেলেন! ইদানিং কিছুদিন হলো পড়তে কিছুটা কষ্ট হচ্ছে, মনে হচ্ছে চশমার পাওয়ার ঠিক নেই! কিন্তু চোখ দেখাবার কথাটা কাউকে বলছেন না, ইচ্ছেই করেনা। চিরদিনের স্বাবলম্বী তিনি, কিন্তু হাঁটুর অপারেশনের পর থেকে ধীরে ধীরে তার চলার শক্তি কমে গেছে। প্রথমে ঘরের ভিতরে ওয়াকার নিয়ে হাঁটতেন, তারপর হুইল চেয়ার, আর এখন পুরোপুরি ঘরে বন্দী বিছানাটাকে আশ্রয় করে। চোখ দেখাতে হলে তাকে তিন তালার ঘর থেকে নামাতে হবে সিঁড়ি বেয়ে, সেই ঝঞ্ঝাটে কাউকে ফেলতে তার বড় সংকোচ হয়, অতএব ছানি পড়া চোখ দিয়ে কষ্ট করে দেখা!
এমনিতে দুজন গৃহকর্মী নিয়ে তার দিন দিব্যি চলে যায়। বিছানাতে বসেই তিনি তাদের দিয়ে সমস্ত বাড়ি পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখেন, নানা রকম খাবার তৈরি করে রাখেন যেগুলো আজকাল আর কেউ তৈরি করে না। কারণ তার ঘরে আত্মীয়-স্বজন চেনা পরিচিত জনের আনাগোনা লেগেই থাকে, তারা সেসব খাবার খেয়ে খুব তৃপ্তি পায়, তাদের তৃপ্তিতে তিনি আনন্দ পান।
দেশে বিদেশে থাকা কাছের- দূরের সমস্ত আত্মীয় স্বজন তার সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখে; তিনি ও নিয়মিত তাদের খবরাখবর রাখেন। টিভির সমস্ত খবর দেখেন, আবার সেগুলো বিশ্লেষণ করেন। এইসব আত্মীয়-স্বজনদের নানা খবর, দেশের নানা খবর, ফোন করে তিনি অন্যদের সাথে আলোচনা করেন। সময় কাটাতে হবে তো!! ভাই বোনেরা তার নাম দিয়েছে রয়টার্স!! মাত্র ৩৭ বছরে নাবালক কয়েকজন সন্তান নিয়ে বিধবা হয়েছিলেন, তাদের প্রত্যেককে উচ্চশিক্ষিত করে তুলেছেন। কখনো সন্তানদের গায়ে কষ্টের আঁচ লাগতে দেননি, সমস্ত কষ্ট নিজে পিঠ পেতে নিয়েছেন।
এক সময় তার সন্তানেরা দূরে দূরে চলে গেল; তারও বয়স বাড়তে লাগলো, সেইসাথে বাড়তে লাগলো সন্তানদের দেখার আকাঙ্ক্ষা। চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলার পর তিনি আর বিদেশে ছুটে যেতে পারতেন না, তাই ছানি পড়া চোখ নিয়ে বসে বসে সন্তানদের মুখ কল্পনায় দেখতেন, প্রতীক্ষা করতেন তাদের আসার। রত্নগর্ভা মা উপাধি দেবার জন্য যখন তাকে প্রস্তাব দেয়া হল, তিনি শুনে প্রচন্ড রেগে গেলেন, "কিসের রত্নগর্ভা!! আমি কোন উপাধি চাই না।"
সন্তানদের সামনাসামনি দেখতে না পেলেও তাদের দেখার একটা ব্যবস্থা হল; ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট করে। তাদের দেখার আকাঙ্ক্ষা এত তীব্র ছিল যে, আশি বছর বয়সেও তিনি শিখে নিতে পারলেন কিভাবে ফেসবুক ব্যবহার করতে হয়। তারপর থেকে সব সময় তার প্রিয় মুখগুলোকে দেখতে থাকেন ফেসবুকে। মাঝে মাঝে ছবি দেখতে না পেলে খুবই বিরক্ত হন, " এতো লেখে কেন এরা... বেশি করে ছবি দিতে পারে না!!"
একদিন কিন্তু সবাই ফেসবুকে অনেক ছবি দিল, সব ছবিতেই তিনি আছেন। আরো অবাক কান্ড!! বাড়ি ভর্তি লোকজনের মধ্যে তার সব কজন সন্তান আছে!! বহুদিন পর তারা একত্রিত হয়েছে এ বাড়িতে।
এমন আনন্দের দিন, তবু তিনি কিছু জানতে পারলেন না। শুয়ে রইলেন চুপচাপ- কর্পূর আর লোবানের গন্ধে মাখামাখি হয়ে!!
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১৯ রাত ৯:৫২