হরিণের মৃত্যুর জন্য তার মাংসের মধ্যে দোষ না খুঁজে, যার হাতে বন্দুক, তাঁর খিদের খোঁজ রাখাটা জরুরি। কারণ খিদের সাথে অর্থনীতি জড়িত। পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে, তার নিশ্চিত একটা অর্থনৈতিক কারণ থাকে। বর্তমান রোহিঙ্গা ইস্যুকে তাই শুধুমাত্র ধর্ম বা জাতি বিদ্বেষের আঙ্গিক থেকে না দেখে, এর অর্থনৈতিক দিকটিও খুঁজে বের করা প্রয়োজন। চোখের সামনেই এমন উদাহরণ যখন রয়েছে, ভারতে মুসলমান বিদ্বেষ কারো কারো ক্ষমতায় যাবার ও ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করার প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছে তখন এর পেছনে আমরা বিপুল পরিমাণ কর্পোরেট বাণিজ্যকেই খুঁজে পাই। এই কর্পোরেট বাণিজ্যই আবার ভারতের আকরিক অঞ্চলগুলোতে মাওবাদী ধোয়া তুলে ভূমিপুত্রদের উচ্ছেদ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, বছরের পর বছর। কর্পোরেশন তার স্বার্থ হাসিলের জন্য ভারতে যেমন সরকারি সহয়তায় সেনাবাহিনীকেও ব্যবহার করে থাকে। মিয়ানমারে আবার সেনাবাহিনীই কর্পোরেশনকে অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ করে দিচ্ছে। উদাহরণ দেয়া যাক।
২০০৯ সালে নার্গিস ঝড়ে মিয়ানমারে ১ লক্ষ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য সে দেশের সরকারের প্রয়োজন ছিল, ৬৯৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। দেখা গেল সরকার জনগণের পাশে না দাঁড়িয়ে ৬৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে রাশিয়ার কাছ থেকে ২০টি মিগ-২৯ ও এমআই-৩৫ এটাকিং হেলিকপ্টার কিনেছে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ যুগিয়েছে ইয়াদানা গ্যাস ফিল্ডের গ্যাস। যেটি রাখাইন রাজ্যের কাছাকাছি সমুদ্র থেকে উত্তোলন করে এই রাজ্যের উপর দিয়েই পাইপ লাইন দিয়ে চীনে পাঠানো হয়েছে। বার্মায় সেসময় সামরিক শাসন ছিল। জেনারেলরা প্রাকৃতিক সম্পদ বিক্রির সমস্ত টাকাই মিলিটারি অস্ত্র বা ব্যক্তিগত এ্যাকাউন্টে বিদেশে পাচার করেছেন। দেশটি দিনদিন গরীব থেকে গরীব হয়েছে। আরাকান অঞ্চলে ৭৮% লোক দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে।
২০১৪ সালে প্রায় একই অঞ্চলের ভিন্ন ব্লক থেকে আরেকটি বিতর্কিত গ্যাসক্ষেত্র চালু করা হয় ভারত, চীন ও মিয়ানমার সরকারের উদ্যোগে। কোন রাজ্যের প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন করলে, স্বাভাবিক ভাবেই সে রাজ্যের একটি বড় হিস্যা প্রদান করাই নিয়ম, যা সে অঞ্চলের জনগণ ও অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যবহার করা হবে। মিয়ানমারে সেসবের কিছু বালাই নাই। এই সকল গ্যাস বিক্রির টাকা তো দূরে থাক, গ্যাসে সাধারণ জনগণের এক্সেস পর্যন্ত প্রদান করা হয় নি। প্রকল্পের আগে যদিও বলা হয়েছিল, জনগণ রাস্তা, স্কুল কলেজ হাসপাতাল পাবে।
এ বছরের শুরুতে দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বে অধ্যাপক সাস্কিয়া সাসেন এর একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছিল। ভদ্রলোক দীর্ঘদিন ধরে বৈশ্বিক অর্থনীতি কতটা নিষ্ঠুরভাবে মানুষের ভূমির অধিকার কেড়ে নিয়েছে, সে বিষয়ে গবেষণা করেছেন, বই লিখেছেন। তিনি মিয়ানমারের আরকান অঞ্চলেও গবেষণা চালিয়েছেন।
সাস্কিয়া সাসেন এর গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯২ সাল থেকেই মিয়ানমারের সামরিক সরকার কোন ধরনের ক্ষতিপূরণ ছাড়াই রাখাইন রাজ্যের ভূমি অধিগ্রহণ করা শুরু করেছে। এর শিকার মুসলিম রোহিঙ্গারা তো বটেই এই অঞ্চলের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছোট ছোট মহাজনরাও ব্যাপকভাবে জমি হারিয়েছেন সামরিক বাহিনীর কাছে। ২০১০ সাল থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে এই অধিগ্রহণের পরিমাণ আগের তুলনায় অন্তত ১৭০% বেড়ে যায়। এবারের অধিগ্রহণের জন্য মায়ানমার আর্মিকে মানুষ হত্যা করতে, ঘরবাড়িতে আগুন দিতে, শিশু ও নারীকে হত্যা করতে দেখা যায়।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, আরাকান অঞ্চলেই কেন এই ধরনের অধিগ্রহণ ? এর কারণ হচ্ছে রাখাইন স্টেট প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। কৃষিতে অপার সম্ভাবনাময় জায়গা হিসেবে ছাড়াও এখানকার পুকুর, নদী, লেক সবই সমুদ্রের সাথে সংযুক্ত। প্রাকৃতিক তেল, গ্যাস ছাড়াও বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য এর যেমন রয়েছে চমৎকার সামুদ্রিক পথ, তেমনি রয়েছে অভ্যান্তরীন বাণিজ্যের জন্য প্রয়োজনীয় লিঙ্ক রোড।
৩০ মার্চ, ২০১২ সালে মিয়ানমারের সামরিক সরকার ব্যাপক বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য মিয়ানমারের কৃষি জমি ও খালি জমি সংক্রান্ত দুটি আইনের সংশোধন করে। এর ফলে, ৭০ বছর লিজ গ্রহণের মাধ্যমে ১০০% বিদেশী বিনিয়োগের দ্বার যেমন উন্মুক্ত হয়, তেমনি যারা এতদিন ভূমির ভোগ দখল ও পরিচালনা করছিলেন (অধিকাংশই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী), তারা ভূমির অধিকার হারিয়ে দরিদ্র হয়ে পড়েন। বিনিয়োগকারীরা সুযোগ পান ৫০০০ একর এর পরিবর্তে ৫০০০০ একর জমিতে ৩০ বছরের জন্য বিনিয়োগ করতে। অতি সম্প্রতি মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অঞ্চলে ৩১ লক্ষ একর জায়গা কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মিয়ানমারের সাথে যাদের খুব ভালো বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে, তাদের ভেতরে এই মুহূর্তে ভারতকেই বেশি আগ্রহী দেখা যাচ্ছে। ভারতের বিনিয়োগও রাখাইন রাজ্যকে ঘিরে। বিতর্কিত শিউ গ্যাস ক্ষেত্রে বিনিয়োগের পাশাপাশি ভারতীয় কোম্পানি এসার গ্রুপ এই অঞ্চলে জোরে সোরে কাজ করছে। উপকূলীয় ব্লক এ-২ অঞ্চল থেকে বাংলাদেশের উপর দিয়ে গ্যাসের পাইপ লাইন নিয়ে ভারতে নিয়ে যাবার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা আছে। এখান থেকে তাদের ১৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন ও ভারতে নিয়ে যাবার ইচ্ছা। কোম্পানিটি ব্লক-এ এরও পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্পন্ন করছে। এই কোম্পানিটি রাখাইন রাজ্যে এবছরই সিটিওয়ে নামে একটি সামুদ্রিক বন্দর নির্মাণের কাজ শেষ করেছে। এখান থেকে ভারতের মিজোরাম ও কলকাতা বন্দরে যোগাযোগের খুব ভালো ব্যবস্থা রয়েছে। এবছরই ভারত রাখাইন রাজ্য থেকে ১০০০০ টন মিটপি মটরশুঁটি আমদানি করার চুক্তি করেছে। ভারত এখানকার কৃষিতেও বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করছে।
নরেন্দ্র মোদীর গত সপ্তাহের মিয়ানমার সফরেই রাখাইন অঞ্চলের ব্যাপক সোশিও –ইকোমনিক উন্নয়নে বিনিয়োগ করার আগ্রহ দেখান। স্বাস্থ্য কৃষি ও এই সংক্রান্ত উদ্যোগ, এগ্রো প্রোসেসিং, কমিউনিটি ডেভলপমেন্ট, ব্রিজ ও রাস্তাঘাট নির্মাণ, ছোট ছোট পাওয়ার প্লান্ট, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ ইত্যাদি বিষয়ে বিনিয়োগ করার জন্য মোদী আগ্রহ দেখান।
কিন্তু এই সকল বিনিয়োগের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে এ অঞ্চলের রোহিঙ্গাদের সাথে সরকারের সংঘাত পূর্ণ সম্পর্ক। এখন আমরা প্রশ্ন করতে পারি, তাহলে এই সকল বিনিয়োগ নিশ্চিত করার জন্যই এই ব্যাপক রোহিঙ্গা নিধন ? তাদেরকে ভিটেমাটি ছাড়া করা? সারা পৃথিবীতেই তো মুসলিমদেরকে টেরোরিস্ট আখ্যা দিয়ে তাদের সম্পদ লুট করা হয়েছে। প্রয়োজন শুধু ক্যামোফ্লাজটা যাতে মাপমতো ফিট করে। যদিও তার কোন প্রয়োজনই নাই। কারণ মুসলিম হত্যায় কেউ কাউকে প্রশ্ন করে না।
এদেশে যাঁরা মনে করেন, রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচারের কারণে দেশের বৌদ্ধদের হত্যা করা উচিত। তাঁদেরকে গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত সাস্কিয়া সাসেন এর আর্টিকেল থেকে বলতে চাই, ২০১২ সালে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য মিয়ানমার সরকার যখন সেদেশের ভূমি আইন সংস্কার করে, সেসময় রাখাইন রাজ্যের কিছু বৌদ্ধ সন্ন্যাসী তিনজন রোহিঙ্গা মুসলমানের উপর বৌদ্ধধর্মাবলম্বী আরকানী মহিলাকে ধর্ষণের অভিযোগ এনেছিল। যার ফলশ্রুতিতে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। সেসময় মিয়ানমারের সামরিক সরকার. সিভিল সোসাইটি, কয়েকজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী মিলে এমন আলোচনাও করেছিলেন যে, বৌদ্ধের বাণীর রি-এন্টারপ্রেশনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নিধন করার কোন উপায় বের করা যায় কি’না ? সেসময় অধিকাংশ বৌদ্ধরা এটাতে সম্মতি দেননি।
( মেহেদী হাসানের ফেসবুক পোষ্ট থেকে Click This Link )
সূত্রঃ
১। Click This Link
২। Click This Link
৩। Click This Link
৪। Click This Link
৫। Click This Link
৬। Click This Link
৭। Click This Link
৯। Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:৫৯