কদিন ধরেই কোন একটি বিশেষ কারণে মন মেজাজ খুব বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে আছে আমার । এই ক্ষিপ্ত মন মানুষিকতা থেকে কিছুটা সময় মুক্তি পাওয়ার জন্য দীর্ঘ ১৩ বছর পর সিলেটের বিজিবি অডিটোরিয়াম (বিডিআর অডিটোরিয়াম) সিনেমা হলে গেলাম সদ্য মুক্তিপাওয়া তন্ময় তানসেনের ‘রানআউট’ ছবিটা দেখতে । তন্ময় তানসেনের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘পদ্ম পাতার জল’ দেখতে গিয়েছিলাম কদিন আগে যেখান থেকে হতাশ হয়ে ফিরে এসেছিলাম ছবিটির অতিরিক্ত স্লো হওয়ার কারণে । তবে ‘রানআউট’ দেখে ‘পদ্ম পাতার জল’ ছবির তন্ময় তানসেন’কে মেলাতে পারলাম না । কারণ এই রানআউটের তন্ময় তানসেন যেন ঠিক আমি যেমনটা চেয়েছিলাম তেমনই কিছু ।
প্রশংসাঃ ‘রানআউট’ ছবিটির অনলাইনে পোস্টার দেখে বিরক্ত হয়েছিলাম যতবেশি ঠিক তারও চেয়ে বেশি ছবিটি দেখে খুশি হয়েছি । কিশোর নামের একটি খুব সাধারন ভালো ছেলের পরিস্থিতির কারণে অন্ধকার জগতে পা বাড়ানোর গল্প ‘রানআউট’ যা পূর্বেও আমাদের গুণী নির্মাতা কাজী হায়াতের রাজনৈতিক ছবির গল্পে আমরা দেখেছিলাম ( পুরো গল্পটা দেখতে আপনাকে অবশ্যই হলে যেতে হবে ) তবে কাজীর ছবির সাথে ‘রানআউট’ মেলালে ভুল হবে কারণ এখানে তন্ময় তানসেন গল্পটা বলেছেন হলিউডের ‘ট্রান্সপোর্টার’ এর মতো অ্যাকশন থ্রিলার ছবির আদলে কিন্তু গল্পটা আমাদের দেশের যার ফলে ছবিটিকে কোন ভাবেই নকল বলা যাবে না বরং বলতে হবে বিশ্বের ১নং চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির গল্প বলার চমকপ্রদ ধরনটাকে আমাদের ছবিতে যুক্ত করা যাকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে সমর্থন করি । কারণ আপনাকে সেরা কিছু দিতে হলে ১নং ইন্ডাস্ট্রির বিশ্বকাঁপানো বাণিজ্যিক ছবিগুলো থেকে ভালোটা শিখতে হবে এবং আপনার লক্ষ্য থাকতে হবে ১ নং ইন্ডাস্ট্রিকে স্পর্শ করার মতো বিশাল স্বপ্ন । কিন্তু ছবিটিকে যতটুকু অ্যাকশন পাবো ভেবেছিলাম ততটুকু অ্যাকশন নেই বা ৪/৫টি অ্যাকশন দৃশ্য নেই তবে থ্রিল আছে পর্যাপ্ত যার কারণে মাঝে মাঝে ছবিটা স্লো হতে গিয়েও হয়নি । ছবিটির অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সমসাময়িক রাজনীতির অন্ধকার দিক যা খুব কৌশলে পরিচালক তন্ময় তানসেন গল্পে যুক্ত করেছেন যা ছোট ছোট সংলাপে উপস্থাপনের ধরনটাও ছিল চমৎকার ।
ছবিতে অভিনয়ের ক্ষেত্রে মৌসুমি নাগ পাবেন ১০০ তে ১০০ তবে নাটকের রোমান্টিক অভিনেতা সজল অন্ধকার জগতের কিশোর হিসেবে (ছবির মূল অংশে) দুর্দান্ত করেছেন যার ফলে সজলকে আরও কাজে লাগানোর জন্য অন্য প্রযোজক পরিচালকদের কাছে আশা করতে পারি আমরা । সজল অপরাধ জগতের কিশোর চরিত্রটা নিয়ে অনেক খেটেছেন সেটা তাঁর লুক , ড্রেসআপ, সংলাপ বলার ধরন ও অভিনয় দেখে স্পষ্ট প্রমাণ মেলে যা আগামীতেও দেখতে চাই । কিশোর চরিত্রের জন্য তন্ময় তানসেন যে মূলধারার কোন খান টান’কে নির্বাচন করে টাকা নষ্ট করেননি সেজন্য ছবি শেষে দাঁড়িয়ে তন্ময় তানসেন ও সজলকে একটি করতালি দিয়েছিলাম । সজল মূলধারার তথাকথিত সুপারস্টার নায়কদের চেয়ে অনেক অনেক ভালো করেছেন এ ব্যাপারে কেউ দ্বিমত করবে না। গডফাদার তারিক আনাম খান খলনায়ক হিসেবে উৎরে গেছেন ফলে বাংলা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র একজন নতুন খলনায়ক পেলো তবে তানভির প্রবালকে মনে হয়েছে অভার অ্যাক্টিং করছে। পুলিশ কমিশনার ওমর সানিকে পর্দায় যতবার দেখেছি ততবারই চলে গিয়েছিলাম স্মরণীয় ৯০ দশকের সানির কাছে যে সানি ‘আখেরি হামলা’, ‘আত্মঅহংকার’, ‘প্রেমের অহংকার’ , ‘প্রিয় তুমি’র মতো ছবিগুলো দিয়ে বক্সঅফিস কাঁপিয়েছিলেন, আহ !! বদলে যাওয়া ওমরসানিকে দেখে বারবার মুগ্ধ হচ্ছিলাম ।
ছবিটির গানগুলোর চিত্রায়ন দারুন ছিল এবং কথা ও সুর কানে বিরক্তি ধরায়নি। ‘ভাইকিংস’ গানগুলোতে নতুনত্বের সাথে মেলোডিটাও দেয়ার চেষ্টা করেছে । তবে আইটেম গানটাকে তন্ময় বলিউডের আইটেম গানের আদলে নির্মাণ করেছেন যা দেখতে খারাপ লাগেনি বরং অন্যসব আইটেম গানগুলোর চেয়ে ভালো হয়েছে ( নায়লা নাইম’কে নিয়ে কিছু লিখে লিখাটা নষ্ট করতে চাচ্ছিনা) । বলতে পারেন আইটেম গানকে দৃষ্টিকটু ছাড়া যতটুকু জৌলুস ছড়িয়ে উপস্থাপন করা যায় তার সবটুকুই গানটিতে ছিল।
দেশের বিভিন্ন মনোরম লোকেশনে চিত্রায়িত ‘রানআউট’ ছবিটি অন্য প্রযোজক পরিচালকদের জন্য শিক্ষণীয় যে অযথা বিদেশে শুটিং এর নামে অর্থ অপ্রচয় না করে সেই অর্থটা টেকনিক্যাল দিকে ব্যয় করে ভালো ছবি কিভাবে নির্মাণ করা যায় তা। আমার সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে তন্ময় তানসেন নির্মাণে যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তার বড় একটা অংশ হলো সম্পাদনায় এবং ‘পরিস্ফুটনে’ যে কারণে ছবিটি দেখতে দর্শকদের কাছে আরও বেশি ভালো লেগেছে । অ্যাকশন দৃশ্যগুলোর জন্য ‘ফাইট ডিরেক্টর’ এর চেয়ে চিত্রগ্রাহক , সম্পাদক ও পরিচালক কৃতিত্ব পাবে বেশি। পুরো ছবিটাকেই বলতে গেলে সম্পাদনার টেবিলে বসেই ২য় বার নির্মাণ করা হয়েছে যেখানে মেধাবি কারিগর’রা বসে ধারনকরা চিত্রগুলো নিয়ে দারুন একটা ‘প্রজেক্ট প্রেজেন্টেশন’ তৈরি করেছেন বলা যায়। মেধা ও কারিগরি দক্ষতায় ‘ডিজিটাল’ চলচ্চিত্রের নামের ‘টেলিফিল্ম’ এর ধারা থেকে ‘রানআউট’ ছবিটিকে তন্ময় তানসেন খুব ঠাণ্ডা মাথায় যত্নের সাথে বের করে এনেছেন যা তাঁর সমসাময়িক ‘নতুনধারা’র পরিচালকদের কাছে অনুকরণীয় হতে পারে। আমার অভিজ্ঞতায় বলে ছবিটির বাজেট আজকের তথাকথিত ২/৩ কোটি টাকার সস্তা ছবির চেয়ে বেশি না বরং আরও কম হবে কিন্তু পরিচালক বুদ্ধিমত্তার সাথে সেইসব কোটি টাকার সস্তা তেলেগু গল্পের নকল ছবিগুলোকে ছাড়িয়ে গেছেন এবং ছবিটিকে খুব ব্যয়বহুল ছবি হিসেবে সফলতার সাথে উপস্থাপন করেছেন । প্রযোজক বাণিজ্যিক ছবির তথাকথিত সুপারস্টারদের পেছনে টাকা না ঢেলে সেই টাকাটা কারিগরি খাতে ব্যয় করেছেন আর পরিচালক টেলিভিশন নাটকের নায়ক নায়িকার কাছ থেকে সেরাটা আদায় করে নিয়েছেন যার ফলে একবারও মনে হয়নি যে ছবিটাতে বাণিজ্যিক ছবির জনপ্রিয় কোন জুটি থাকলে ভালো হতো বরং সেই একঘেয়েমি থেকেও দর্শকদের মুক্তি দিয়েছেন । এমন পরিচালক’কে যদি আগামীতে ছবি বানানোর জন্য ১০/২০ কোটি টাকার বাজেট দেয়া হয় তাহলে আমি নিশ্চিত বলিউড ও টালিউডের অনেক ছবিকেও আমরা ছাড়িয়ে যেতে পারবো খুব সহজে শুধু দরকার সাহস ও মেধার সমন্বয় ঘটানোর । বাণিজ্যিক ছবি বানাতে এসে অনেক পরিচালককে দেখেছি তালগোল পাকিয়ে ফেলতে এমনকি এই তন্ময় তানসেনও প্রথম ছবিতে খুব আলাদা কিছু মনে করাতে পারেনি কিন্তু ‘রানআউট’ দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন বিনোদনধর্মী বাণিজ্যিক সিনেমা নির্মাণ তিনি বুঝে গেছেন শুধু দরকার নিজের মেধাটাকে প্রয়োগ করার স্বাধীনতা দেয়ার । মজার ব্যাপার হচ্ছে আমাদের সুশিল সিনেমাবোদ্ধারা সবসময় চলচ্চিত্রের মাঝে জীবনঘনিষ্ঠ কিছু খুঁজেন এবং কোন বিশেষ বার্তা খুঁজেন যা তাঁরা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে খুঁজে পান না যার ফলে সবসময় ‘বিকল্প’ ‘বিকল্প’ বলে চিৎকার করেন । কিন্তু আমাদের বিনোদনধর্মী বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের মাঝেই যে সবচেয়ে বেশি বলিষ্ঠ বার্তা ও জীবনঘনিষ্ঠ গল্প ছিল সেটা তাঁরা একটিবারও খুঁজে দেখেন না। সেইসব বিনোদনধর্মী ছবির তালিকায় তন্ময় তানসেনের ‘রানআউট’ চলচ্চিত্রটি যুক্ত হলো যার বার্তাটি বুঝতে হলে আপনাকে সংকীর্ণ মানুশিকতা ছেড়ে ছবিটি দেখতে হবে তাহলেই দেখবেন অনেক বিকল্পধারা গল্পের স্লো ছবির চেয়েও বলিষ্ঠ কোন বার্তা রানআউটে পাবেন ।
নিন্দাঃ চমৎকার একটি ছবিকে বিতর্কিত বা সমালোচিত কোন একজন তারকার ছবি দিয়ে এবং ১৮+ লিখে পোস্টার অনলাইনে ছেড়ে দর্শক টানার অসৎ কৌশলটার জন্য তন্ময় তানসেনের তীব্র নিন্দা জানাই । বিশেষ করে আমার মতো যারা অসুন্দর ও খারাপের বিপক্ষে সবসময় খ্যাপাটে তাঁদেরকে এমন একটি পোস্টার দিয়ে অযথা ক্ষ্যাপানোটা তন্ময় তানসেনের উচিৎ হয়নি। ৫ মিনিটের একটি গানের তারকাকে হাইলাইট করার চেয়ে দুর্দান্ত অভিনয় করা মৌসুমি নাগ’কে গ্ল্যামার দিয়ে হাইলাইট করলে অনেক ভালো হতো । আইটেম গানটি দেখে দুষ্টু দর্শকদের মতো আমারও বলতে ইচ্ছে করে নায়লাকে আরেকটু বেশি সময় না দেখানোর জন্য পরিচালক’কে মাইনাস!!!!
আবদারঃ গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রকে পাল্টানোর জন্য ,এগিয়ে নেয়ার জন্য অনবরত যে কথাগুলো বলে চিৎকার করে আসছিলাম মনে হচ্ছে সেইসব কথা অন্তত তন্ময় তানসেনের কানে পৌঁছেছে যার একটা ঝিলিক ‘রানআউট’ ছবিতে তিনি দেখালেন । এই ধারনা থেকেই তন্ময় তানসেনের কাছে কিছু আবদার করবো (বাঙ্গালী বসতে দিলে খেতে চায় ,খেতে দিলে শুতে চায় !!!!!) একজন চলচ্চিত্র দর্শক হিসেবে । হলিউড, বলিউড এর মতো মাশালা ছবির বড় প্রতিপক্ষরা ৪০/৪৫ বয়সী বা তারও বেশি বয়সী নায়কদের দিয়ে যেখানে এখনও বক্সঅফিস কাঁপাচ্ছে সেখানে আমাদের দেশে সানি, আমিন খানের মতো যোগ্য ও অভিজ্ঞ নায়কেরা থাকা সত্ত্বেও তাঁদের সদ্ব্যবহার করা হচ্ছে না যা খুবই দুঃখজনক । নতুন ওমর সানি, আমিন খান এরা এখনও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সিনেমাকে অনেক কিছু দিতে পারেন যদি তাঁদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারেন । বলিউডে এখনও ১০০ কোটি রুপি আয় করার প্রতিযোগিতায় ৯০ দশকে আসা আমিন খান , শাহরুখ খান , সালমান খান , অজয় দেবগন,অক্ষয় কুমারের মতো তারকাদের উপর নির্ভর সেখানে আমাদের দেশে অন্ধ, অবুঝ দর্শকদের পাল্লায় পড়ে একনায়কতন্ত্রের সিন্ডিকেটের ঘূর্ণিপাকে পড়ে এক আলু দিয়েই বারবার ভর্তা, ভাজি, পুরি খাইয়ে বদহজম করিয়ে দিচ্ছে। অথচ সানি, আমিন খান , রিয়াজদের মতো অভিজ্ঞ তারকাদের ধুমধাম অ্যাকশন ধাঁচের মাশালা ছবি খুব ভালোভাবে সফল করার যোগ্যতা রয়েছে যা পূর্বে বহুবার তাঁরা প্রমাণ করেছেন এবং এই সময়ের তথাকথিত সুপারস্টারদের চেয়ে তাঁরা এখনও যোগ্যতায় অনেক অনেক এগিয়ে আছেন শুধু দরকার সাহস দেখানোর মতো প্রযোজক পরিচালক। ঐ এক আলু দিয়ে নকল রেসিপির খাবার খেতে খেতে দর্শক আজ বিরক্ত যা থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য আজ তন্ময় তানসেনের মতো তরুন মেধাবি পরিচালকদের কাছে অনুরোধ করবো । আগামীতে সানি, আমিন খানের মতো অভিজ্ঞ নায়কদের দিয়ে একটা ফাটাফাটি অ্যাকশন, থ্রিলার ছবি উপহার দিবেন এই আবদারটুকু রেখে গেলাম । নতুন মেধাবীদের সাথে অভিজ্ঞ, যোগ্যরা ফিরে এলে এই ইন্ডাস্ট্রি ঘুরে দাঁড়াবেই ।
সবশেষে ‘রানআউট’ সম্পর্কে একটি কথা না বললেই নয় তা হলো আজ যারা জমজমাট বাণিজ্যিক ছবি বলতে শুধু তামিল , হিন্দি ছবির গল্পকে নকল করে ভর্তা বানিয়ে ১৫০ সিনেমা হলে ছেড়ে দিয়েই বিরাট কিছু ভাবেন , কিংবা নতুনধারার ছবি বলে ‘নাটক’ ‘টেলিফিল্ম’ চালিয়ে দেন তাঁদের সকলের জন্য তন্ময় তানসেনে’র ‘রানআউট’ ছবিটি যেন চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি থেকে ‘অলআউট’ করার সতর্ক সংকেত ।
ফজলে এলাহী
১৭/১০/১৫
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:১৪