somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বলছি স্বাধীন বাংলার শ্রেষ্ঠ '৩ জন ও ১টি দল' এর গর্বিত ইতিহাস

০৩ রা জুন, ২০১২ রাত ১০:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
এবি (আইয়ুব বাচ্চু) ঃ
বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের কিংবদন্তী ও সেরা লীড গিটারিস্ট। চট্রগ্রামের ছেলে এবি'র যাত্রা শুরু মূলতঃ ততকালীন সময়ের জনপ্রিয় ধারার ব্যান্ড সোলস দিয়ে, যার উত্থান চট্রগ্রাম থেকে। বাংলাদেশের মিউজিক ইন্ড্রাস্টীতে যদি একক ভাবে কোন ব্যান্ডকে সন্মাননা দেওয়া হয় তবে সেটা নির্ধিদ্বায় সোলসের ঝুড়িতে গিয়ে পড়বে। লুলু, নেওয়াজ, রনি, তাজুল ও সাজেদ যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে গড়ে তোলেন ব্যান্ড দল সোলস। এরপর একে একে জয়েন করেন নকীব খান, পিলু খান, আইয়ুব বাচ্চু, কুমার বিশ্বজিৎ, তপন চৌধুরী, নাসিম আলী খান এবং পার্থ বড়ুয়া। নকীব খান ও পিলু খান সোলস ছেড়ে গড়ে তোলেন বিকল্পধারার ব্যান্ড দল রেঁনেসা। তপন চৌধুরী (ভোকাল), কুমার বিশ্বজিৎ(ভোকাল) সোলস ছেড়ে গড়ে তোলেন সলো ক্যারিয়ার। কুমার বিশ্বজিৎ আজও ঠায় দাড়িয়ে আছেন এই বাংলা মিউজিকে। তপন চৌধুরী ততকালীন সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় সলো আর্টিস্ট অনেক অভিমান নিয়ে পড়ে আছে বিদেশে। নাসিম আলী খান ও পার্থ বড়ুয়া আজও সোলসের হাল টেনে চলছে। সোলসের জনপ্রিয় গানের অভাব নেই। লিখতে গেলে পুরো একটা পোষ্ট লিখতে হবে এই সোলসকে নিয়ে। তবুও কিছু গানের কথা উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছিনা। মন শুধু মন ছুয়েছে, তোরে পুতুলের মত করে সাজিয়ে, আইছ্যা পাগল মনরে, নদী এসে পথ, এই মুখরিত জীবনের, সুখ পাখি এলো উড়িয়া, সাগর বেলায়, একটি ঝিনুক মালা, ভালবাসি এই সবুজ মেলা, সাগরের ঐ প্রান্তরে, কুহেলী জানে কি, এই এমনও পরিচয়, কেউ নেই করিডোরে, আজ দিন কাটুক গানে, নীরবে, ব্যস্ততা, কেন এই নিঃস্বঙ্গতা, এরই মাঝে, আইয়্যোনা আইয়্যোনা, ঐ দূর নীলে, যেতে যেতে পরিচয় সহ এমন আরো অনেক অনেক অনেক গান। সদ্য সোলস ছেড়ে আসা এবি নতুন উদ্দ্যম নিয়ে গড়ে তোলে ব্যান্ড দল এল.আর.বি। প্রথম ব্যান্ড অ্যালবামেই জানিয়ে দেয় "ঝরে পড়ার জন্য আসেনি। এসেছি তারুণ্যের উন্মদনা নিয়ে।" ১৯৯২ সালে এল.আর.বি প্রকাশ করে তাদের ব্যান্ডের প্রথম ডাবল অ্যালবাম "হকার" ও "ঘুম ভাঙ্গা শহরে"। এল.আর.বি-ই বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম ব্যান্ড যাদের ফার্স্ট অ্যালবাম ছিল ডাবল। এবং এল.আর.বি- ই প্রথম বাংলা ব্যান্ড যারা এ পর্যন্ত দুটি ডাবল অ্যালবাম প্রকাশ করে। দ্বিতীয় ডাবল অ্যালবামটি প্রকাশ পায় ১৯৯৮ সালে "আমাদের" ও "বিষ্ময়" শিরোনামে। "হকার" অ্যালবামের আড্ডা, হ্যাপি, হকার, স্মৃতি নিয়ে, পেনশান, রিটায়ার্ড ফাদার ও "ঘুম ভাঙ্গা শহরে" অ্যালবামে ঢাকার সন্ধ্যা, ফেরারী মন, ঘুম ভাঙ্গা শহরে, মাধবী, শেষ চিঠি সহ সর্বাধিক শ্রোতানন্দিত গান "সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে"। এক একটি গান শুধু গান নয়, শুধু বাদ্য যন্ত্রের যান্ত্রিকতা নয়, নয় চিৎকার করে চেঁচিয়া যাওয়া। একটি গান কথা, সুর ও সঙ্গীতায়োজনে ছিল অনন্য। প্রতিটি গানের কথায় আবেগ খেলা করে, প্রতিটি গানের সুর বুকের ভিতরে গিয়ে আঘাত করে, প্রতিটি ইন্সট্রুমেন্ট বিভোরতায় মুগ্ধকরে।। আর গায়কী ! ! ! সে আপনাদের বিবেচ্য।



এরপর একে একে নিয়ে আসে "সুখ(১৯৯৩)", "ঘুমন্ত শহরে(১৯৯৪)", "ফেরারী মন(১৯৯৬)", "স্ক্রু-ড্রাইভার(১৯৯৬) with Feelings","ক্যাপসুল-৫০০mg(১৯৯৬) with Feelings","স্বপ্ন(১৯৯৬)","আমাদের(Second Double-1998)","বিষ্ময়(Second Double-1998)","মন চাইলে মন পাবে(২০০১)","অচেনা জীবন(২০০৩)","মনে আছে নাকি নাই(২০০৫)","স্পর্শ(২০০৮)"। প্রতিটি অ্যালবাম এক একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে বাংলা ব্যান্ড মিউজিকে। ময়না(১৯৮৬), কষ্ট(১৯৯৫), একা(১৯৯৯), সময়(১৯৯৯), প্রেম তুমি কি?(২০০০), দুটি মন(২০০২), কাফেলা(২০০২),প্রেম প্রেমের মত(২০০৩) সহ বেশ কিছু সলো অ্যালবাম উপহার দিয়েছেন।
অন্যদিকে বাংলা ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবামের সূচনা লগ্ন থেকে ২০০৪ পর্যন্ত ম্যাক্সিমাম ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবামের ফার্স্ট ট্র্যাক ছিল এবি'র করা। এমন মিক্সড অ্যালবামের সংখ্যা কম যেখানে এবি পারফর্ম করেনি। মিক্সড অ্যালবামে করা জনপ্রিয় গানগুলোর কিছু তুলে দিলামঃ "এখন অনেক রাত(অ্যালবাম-টুগেদার), তখনো জানতে বাকী(ঝড়), সারারাত তুমি(স্টার্স ২), ভাঙ্গা মন(ভাঙ্গা মন), সুখের পৃথিবী(সুখের পৃথিবী), কোথাও নেই আমি তুমিহীনা(তুমিহীনা সারাবেলা), ঈশারায় ডেকোনা(রাজকুমারী), রাজকুমারী(রাজকুমারী), সেই তারাভরা রাতে(তারা ভরা রাতে), পালাতে চাই(শক্তি),কার কাছে যাবো(ওরা ১১ জন), শেষ দেখা(শেষ দেখা), কতদিন দেখেনি দুচোখ(এখনো দু'চোখে বন্যা), বেলা শেষে(দাগ থেকে যায়), তুমি সেই মেয়ে(মিলেনিয়াম), মেয়ে(মেয়ে), ও আমার প্রেম(ও আমার প্রেম), কি করে বল্লে তুমি(বিতৃষ্ণা জীবন আমার), অভিমান নিয়ে(স্রোত), কোন অভিযোগ(আলোড়ন), ১২ মাস(১২ মাস), জানার কথা নয়(তারকা মেলা), তোমাকে ডেকে ডেকে(একটি গোলাপ), লোকজন কমে গেছে(ধুন), নীলাঞ্জনা(শুধু তোমারই কারণে), চিরদুঃখী(চিরদুঃখী), ফেরারী আমি তোমারই জন্য ফেরারী(চিরদুঃখী), হাসতে দেখ গাইতে দেখ(ক্যাপসুল ৫০০মিলিগ্রাম), নীল বেদনায়(ক্যাপসুল ৫০০মিলিগ্রাম), আহা ! জীবন(ক্যাপসুল ৫০০মিলিগ্রাম), জয়ন্ত(স্ক্রু-ড্রাইভার), নীরবে(স্ক্রু-ড্রাইভার), আমার ভালবাসা(স্ক্রু-ড্রাইভার), কিশোর কিশোরী(হারজিৎ), চোখের জলের কোন রং হয় না(মেহেদী রাঙ্গা হাত), আজ থেকে আর কখনো বলবো না ভালবাসি(দহন শুধু তোমার জন্য), বাড়ালে হাত বন্ধু সবাই হয় না(চিঠির উত্তর দিও), একা উদাসী মনে(একা উদাসী মনে), মন কেন যেতে চায় উড়ে(প্রেম), কেউ ভালবেসে কাছে টানে(টি & টি), সবুজ ঘর(টি & টি), একটায় মনে(অপরিচিতা), কিছু আশা ছিল(অপরিচিতা), অতশী(নীরবতা), যে রাতে রাত ছাড়া(ফিরে আয়), নীরবতা(নীরবতা), উদাসী মনে(নেই তুমি), দক্ষিণা বাতাস(দুঃখিনী মা), একটি নারী অবুঝ(একটি নারী অবুঝ) সহ এরকম শ-খানেক চরম শ্রোতানন্দিত গানের কথা বলা যাবে। এখানে উল্লেখ করা এক একটি গান এক একটি মাইলস্টোন। প্রতিটি গানের কথা নিয়ে আলাদা ভাবে গল্প তৈরী করা যাবে। এই গানগুলো যেমন ছিল। ঠিক তেমনই আছে। এই গানগুলোর স্থায়িত্ব কমে যায়নি। আবেদন কমে যায়নি। কমে যায়নি ভাললাগা। আমি চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি এই গানগুলো আপনাকে সতেজ ভাললাগা দেবে। কোন কৃত্রিমতার ছোয়া নেই এই গানগুলোতে।।। প্রতিটি গানের কথা আপনাকে ভাবাবে।। প্রতিটি সুরে আপনি যত্ন ও আবেগের ছোয়া পাবেন। প্রতিটি গান আপনাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে।। কিছু কিছু গান আপনার বুকের ভেতরে জমিয়ে রাখা অব্যাক্ত কথা গুলো বলে যাবে গানে গানে কানে কানে। কিছু গান হয়তো আপনাকে চোখের বর্ষায় ভাসাবে। হয়তো এই বর্ষার জন্য-ই আপনি অপেক্ষায় ছিলেন।।।
জেমস-
যার পুরো নাম ফারুক মাহফুজ আনাম জেমস। তাঁর বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরেজীবি, সেই সুত্রে ছোট বেলা থেকেই দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেরিয়েছিলেন। তাঁর বাবা যখন চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারমান ছিলেন তখন সেই চট্টগ্রাম থেকেই তাঁর সঙ্গীতের পাগলামি শুরু মানে সেখান থেকেই তারে সবাই চিনতে শুরু করে। ৯ম শ্রেণী পড়া অবস্থায় বাবা তাঁর বখে যাওয়া সন্তান টিকে একদিন ঘর থেকে বের করে দেয় পড়াশুনায় মনোযোগ না থাকায়। সেই সময় চট্টগ্রামের “আজিজ বোর্ডিং” হয় তাঁর গানের কারখানা । যে “আজিজ বোর্ডিং “ নিয়ে সম্পূর্ণ একটা গান তিনি পরে গেয়েছিলেন। “আজিজ বোর্ডিং” এর সব গুলো কথা তাঁর সৃতিময় সেই দিনগুলো থেকে নেয়া যা সব সত্যি ঘটনা। তাঁর উপর ক্ষুব্ধ থাকা তাঁর সেই স্বর্গীয় পিতা নিশ্চয় আজ স্বর্গ থেকে ছেলের সফলতা দেখে খুশী মনে আছেন! তিনি যাকে শিক্ষিত করে তাঁর মতো বড় কোন সরকারী কর্মকর্তা বানাতে চেয়েছিলেন আজ হয়তো তাঁর সেই দুঃখ নেই। কারন তাঁর ছেলে যে আজ বাংলাদেশের সঙ্গীতের অভিভাবক হয়ে বিদেশেও সমান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন।
১৯৮৭ সালে বের হয় জেমস এর প্রথম একক অ্যালবাম “অনন্যা”। যার সবগুলো গান ছিল আসলেই অনন্যা ও ব্যতিক্রম। আজ যদি কেউ সেই অ্যালবাম প্রথম শুনে তাহলে তারও বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে যে গানগুলো জেমস এর গাওয়া। এর মূল কারন সেই গানগুলোতে ছিল সদ্য টগবগে এক তরুনের মিষ্টি মধুর পরিশীলিত সুর। আজ জেমস এর মাঝে খুব কম গানে পাওয়া যায়। ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রামের জনপ্রিয় ব্যান্ড 'ফিলিংস' এ যোগ দেন। তখন কুমার বিশ্বজিৎ বিহীন 'ফিলিংস'এর ভোকাল ছিলেন আরেক অসাধারণ প্রতিভা ও কণ্ঠ পাবলো। সে সময় ঘর ছাড়া জেমস ও' ফিলিংস' ব্যান্ড যাদের অনুশীলন থেকে শুরু করে থাকা ,খাওয়া সব হতো সেই “আজিজ বোর্ডিং” এর এক কামরায়। সেই কামরায় তাঁদের কত বিনিদ্র রাত কেটেছে শুধু গান তৈরির নেশায়। ১৯৮৯ সালে বের হয় “ফিলিংস’ এর ১ম অ্যালবাম “স্টেশন রোড”। যেখানে সেই “অনন্যা জেমস” আবারো একইরকম অন্য কিছু ভালোলাগা নিয়ে হাজির হয়। সেই অ্যালবাম এর “ঝর্না থেকে নদী”, “স্টেশন রোড” “দুঃখ কেন কররে মন” “আমায় যেতে দাও” “রুপসাগরে ঝলক মারিয়া” “সত্যই সুন্দর” সহ সবগুলো গানই ছিল অপূর্ব। যেখানে জেমস এর নীরব হাহাকার, প্রেমের আকুতি,অন্যায়ের প্রতিবাদ সব কিছু ফুটে উঠেছে এক অদ্ভুত সুন্দর ভাবে। এরপর টানা ৯০-৯২ জেমস এবং ফিলিংস এর কোন নতুন খবর তাঁদের ভক্তরা পায়নি। এর মধ্যে ৯২ সালে জেমস ভালোবেসে বিয়ে করেন মডেল ও পরবর্তীতে অভিনেত্রী ও রথি(চাঁদনী) কে (১৯৯২ সালে নায়ক আমিন খান এর সাথে জুটি হয়ে “অবুজ দুটি মন” ছবিতে অভিনয় করেন যা ছিল তাঁর একমাত্র ছবি ও সুপারহিট) বিয়ে করেন এবং ২০০১ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। যিনি পেশগত ভাবে একজন শিক্ষিকা ছিলেন। ১৯৯৩ সালে আবার চুপচাপ থাকা জেমস ও “ফিলিংস” শ্রোতাদের সামনে নিয়ে আসেন “জেল থেকে বলছি “ অ্যালবাম। মুলত এই অ্যালবাম দিয়ে নতুন দশকের শ্রোতাদের কাছে জেমস ও ফিলিংস এর পরিচয় ঘটে। তখন এই অ্যালবামটি কিছুদিন আগে বাজারে আসা এল.আর.বি এর প্রথম ২টা অ্যালবাম এর জনপ্রিয়তায় ভাগ বসায় এবং অডিও বাজারে একটা বড় ধরনের ঝাঁকুনি দেয়। যার ফলে ১ম অ্যালবাম দিয়ে চুপ করে থাকা “মাইলস” তাদের প্রত্যাশা অ্যালবাম প্রকাশ করে সেই ঝাঁকুনিটা আরও বাড়িয়ে দেয়। শ্রোতারা তখন একসাথে ৪ টি অ্যালবাম (হকার, ঘুম ভাঙা শহরে (এল.আর.বি), জেল থেকে বলছি (ফিলিংস), প্রত্যাশা (মাইলস) নিয়ে দিশেহারা হয়ে যায়, কোনটা রেখে কোনটা শুনবে এই ভেবে। আর অডিও বাজারও তখন চরম সফলতার যুগে প্রবেশ করে। সেই “জেল থেকে বলছি’ এক ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর করুন অনুভুতি ও আর্তনাদ নিয়ে জেমস তাঁর আসন পাকাপোক্ত করে নেন। তখন ব্যান্ড এর কন্সার্ট এ জেমস কে পাওয়া মানে শ্রোতাদের অন্যরকম উম্মাদনা। ১৯৯৫ সালে বের হয় জেমস এর ২য় একক অ্যালবাম “পালাবে কোথায়” যেটি ছিল এক প্রেমিকের প্রেমিকার প্রতি কঠিন প্রশ্ন ! যে তাঁর ভালোবাসার অস্রু ও সুখময় সৃতি দিয়ে তাঁর প্রেমিকাকে বেঁধে রাখতে চায়। এই অ্যালবাম টিও তখন শ্রোতা প্রিয়তা পায়। জেমস তখন হয়ে যায় “গুরু জেমস”। যেন নতুন যুগের এক কাণ্ডারি যে কিনা যেমন নাচাতে চায় শ্রোতারাও তেমনি নাচে। একই বছরে বের হয় প্রিন্স মাহমুদের প্রথম ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম “শক্তি” যেখানে জেমস এর গান ২টি ছিল শ্রোতাদের আকাশের চাঁদ হাত পাওয়ার মত। একই বছরে মিক্সড ও একক অ্যালবাম এর মাধ্যমে জেমস শ্রোতাদের কাছে এক উম্মাদ ঝড়ের নাম হয়ে উঠে। চারিদিকে তখন ২টা পক্ষ “জেমস এর ভক্ত” ও “জেমস এর বিরোধী” স্পষ্টত মুখোমুখি অবস্থান নেয়। হয়তো এই অনিবার্য সংঘাত এড়ানোর জন্যই সেই ফেলে আসা ৯৬ তে জেমস আরও একটি চমৎকার উপহার দেন ফিলিংস এর ৩য় অ্যালবাম “নগর বাউল” যেখানে “মান্নান মিয়ার তিতাস মলম” , “আমি এক নগর বাউল”, “আমি তারায় তারায় রটিয়ে দিবো”, “নাগ নাগিনির খেলা” “হুমায়রা নিঃশ্বাস চুরি হয়ে গেছে” গানগুলো । জেমস তাঁর বিরোধী শিবিরে যে আঘাত এনেছিলেন তাঁর শেষ আঘাত দিয়ে বিরোধী শিবির কে একেবারে নিশ্চিনহ করতে তিনি নিয়ে আসেন তাঁর একক অ্যালবাম “দুঃখিনী দুঃখ করোনা”। যা দিয়ে তিনি তাঁর বিরোধী শিবির কে একেবারে লণ্ডভণ্ড করে দেন। সেই অ্যালবাম এর সবগুলো গান এতোটাই জনপ্রিয় হয় যে তাঁর বিরোধী শিবির এর লোকেরাও সবাই তাঁর ভক্ত হয়ে যায়। বিশেষ করে “যদি কখনও ভুল হয়ে যায়” গানটি জেমস এর সর্বকালের সেরা একটি গানে পরিণত হয়। যে গানে জেমস এর আবেগ এতোটাই ভয়াবহ ছিল যে কোন মানুষ এর চোখে জল আনতে বাধ্য করতো।৯০ দশকে জেমস ও ফিলিংস নিয়ে আসে “লেইস ফিতা লেইস” অ্যালবামটি (যেটি ছিল ফিলিংস নাম নিয়ে সর্বশেষ অ্যালবাম) । যে অ্যালবাম এ “পথের বাপ” “বায়স্কোপ” “সিনায় সিনায়” “হাউজি” “পুবের হাওয়া” “দে দৌড়” “নিরান্নব্বই নামে তিনি” সহ সবগুলো গান চরম শ্রোতাপ্রিয়তা পায়। যার ফলে “গুরু” নামটি জেমসের সাথে পাকাপোক্ত ভাবে বসে যায়। তখন জেমস ছিল অবাধ্য ও বিশৃঙ্খল তরুণদের শান্ত করার এক যাদুকর। জেমস কন্সার্টে আসা আগ পর্যন্ত যে তরুণরা তাকে দেখার অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে থাকতো তাদের উদ্দেশে মঞ্চে উঠেই জেমস বলতেন” তোরা শান্ত হয়ে যা! আমি এসে গেছি!” ব্যস, সবাই সেই যাদুকরের কথায় শান্ত হয়ে যেত আর তাঁর গানগুলোতে ঠোঁট মিলিয়ে গাইত। “লেইস ফিতা লেইস “অ্যালবাম দিয়ে তাঁর আগে আরেকটি কথা না বললেই নয় তখনকার সমান জনপ্রিয় এল.আর.বি এর সাথে ফিলিংস এর পরপর ২ টি যৌথ অ্যালবাম “ক্যাপসুল ৫০০ এম.জি” এবং “স্ক্রু ড্রাইভার” নামক অ্যালবামগুলো। যা শ্রোতাদের কাছে আজো একটি লোভনীয় অ্যালবাম হিসেবে পরিচিত। গত দশকে এই গুরু জেমস কে আমরা যেভাবে পেয়েছিলাম এই দশকে তাঁর কোন ছিটেফোঁটাও আজো পাইনি। বিশেষ করে সেই দশকে জেমস এর ফিলিংস,নগরবাউল ও একক অ্যালবাম ছাড়াও প্রতিটি মিক্সড অ্যালবাম এ গাওয়া গানগুলো অসাধারণ! বিশেষ করে প্রিন্স মাহমুদের সুর ও সঙ্গীতের মিক্সড অ্যালবাম এর “ জানালা ভরা আকাশ”(শক্তি),”আমি ও আঁধার” (শক্তি),”শেষ দেখা “(শেষ দেখা),”মা”(এখনও দু চোখে বন্যা), “ফুল নিবে না অস্রু নিবে” (দেয়াল),”মন আমার পাথরের দেয়াল তো নয়” (দেয়াল),"কিছু ভুল ছিল তোমার" ( দাগ থেকে যায়)”নিশপাপ আমি” (স্রোত), জুয়েল বাবুর সুর ও সঙ্গীতে “ওরে দেখে যারে তুই” (মেয়ে),”পদ্ম পাতার জল” (ও আমার প্রেম), “আরও কিছুক্ষণ রবে কি বন্ধু” (নিরবতা),”তুমি বল বৃষ্টি পড়ছে” /সাদা কালো (নীরবতা), “কিছুটা আশা তুমি রেখো” (নীরবতা), “বর্ষা আমার চোখের প্রিয় ঋতু /বর্ষা” (সন্ধি), ‘’যত দূরে যাও বন্ধু আমার” (তারকা মেলা),লাকি আখন্দ এর সুর ও সঙ্গীতে “লিখতে পারি না কোন গান “ (বিতৃষ্ণা জীবনে আমার),”ভালবেসে চলে যেও না”(বিতৃষ্ণা জীবনে আমার) সহ আরও অনেক অনবদ্য অসাধারণ সব গান আজো সে যুগের এবং এ যুগের শ্রোতাদের মুখে মুখে ফিরে। প্রিন্স মাহমুদ ও জুয়েল-বাবু তাঁরা সব সময় তাদের মিক্সড অ্যালবাম এর গানগুলোতে জেমস কে তাঁর সেরাটা বের করে আনতেন যা জেমস নিজেও খুব উপভোগ করতেন। তখনকার সেরা সব গীতিকার যারা ছিলেন তাঁর মধ্যে লতিফুল ইসলাম শিবলি,বাপ্পি খান,দেহলভি, আনন্দ,তরুন,মারজুক রাসেল, গোলাম মোরশেদ, প্রিন্স মাহমুদ ও জুয়েল-বাবু জেমস এর জন্য আলাদা ভাবে গান লিখতেন। যে গানের কথাগুলো ছিল একটার চেয়ে আরেকটা অসাধারণ সব কথায় ভরপুর যা একবার শুনে মন ভরতো না। শ্রোতারাও দ্বিধায় পড়ে যেতেন কোন গান থেকে কোন গান বেশি সেরা এই নিয়ে আড্ডায় তুমুল তর্ক চলতো। যা মনে পড়লে আজো খুব কষ্ট হয়।
আজ 'জেমস' বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে অন্য দেশেরও একটি প্রিয় কণ্ঠের নাম। ভারতের বিখ্যাত ও জনপ্রিয় প্রযোজক, পরিচালক মহেশ ভাট এর 'গ্যাংস্টার' ছবিতে 'ভিগি ভিগি' গান দিয়ে হয়েছেন ভারতের কোটি জনতার প্রিয় শিল্পী। এরপর একই প্রযোজকের 'ওহ লামহে' 'মেট্রো' ছবিতেও কণ্ঠ দিয়ে বিশ্বের মাঝে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছেন এবং প্রমান করেছেন যে ভারতের শিল্পীরাই শুধু হিন্দি গানের প্লেব্যাক এ সেরা নয় সুযোগ পেলে বাংলার শিল্পীরাও কাঁপিয়ে দিতে পারে। এখানেই ‘জেমস’ অন্য সবার চেয়ে আলাদা ও চিরস্মরণীয় একজন যাকে বাদ দিয়ে কোনদিন বাংলাদেশের পূর্ণ সঙ্গীত ইতিহাস লিখা সম্ভব নয়। কেউ যদি তা করার দুঃসাহস দেখায় আমি নিশ্চিত তাঁর লিখা সেই ইতিহাস কেউ গ্রহন করবে না।
জেমস এর অন্যান্য অ্যালবামগুলো-
ঠিক আছে বন্ধু (একক)
দুষ্ট ছেলের দল (নগর বাউল)
আমি তোমাদেরই লোক (একক)
জনতা এক্সপ্রেস( একক)
কাল যমুনা (একক)
তুফান (একক)
মাকসুদুল হকঃ-

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (পরবর্তীতে হোটেল শেরাটন এবং বর্তমানের রুপসী বাংলা) এ লাইভ মিউজিক প্রোগ্রাম হত নিয়মিত। সেখানে মূলত ইংরেজী গানের পরিবেশনা থাকত। একদল মানুষ সেই সব ইংরেজী গানের সাথে তাল মিলিয়ে ড্যান্স করত।। আর মঞ্চ থেকে ভেসে আসতো মেলোডিয়াস পপ, রক ও জ্যাজ ঘরানা'র গান; পরিবেশনায় তরুণ গানের দল "ফিডব্যাক"। ফিডব্যাকের দলনেতা প্রতিভাবান সুরকার, কম্পোজার ও কিবোর্ডিষ্ট ফোয়াদ নাসের বাবু, পিয়ারু খান(Drums & Vocal), সেলিম হায়দার(Guitars), মুরাদ রহমান (Bass) এবং সদ্য জয়েন করা মাকসুদুল হক(Main Vocal)। মাকসুদুল হক ফিডব্যাকে জয়েন করে ১৯৭৬ সালে। পরবর্তীতে তুমুল শ্রোতাপ্রিয়তা পাওয়া ও সারা বাংলাদেশ কাঁপানো ব্যান্ড ফিডব্যাক অবশ্য ১৯৮৫ সালের আগ পর্যন্ত কোন অ্যালবাম রিলিজ করেনি।
১৯৮৫ সাল। মাকসুদুল হক'কে ফিচার না করেই ফিডব্যাক নিয়ে আসে "ফিডব্যাক ভলিউম-১" নামে তাদের ব্যান্ডের প্রথম প্রকাশ।(অনেকের কাছেই শুনেছি ফিডব্যাকের প্রথম অ্যালবামের কথা।
১৯৮৭ সালে আবারো ফিরে আসে ফিডব্যাক। সেই সাথে রদবদল ঘটে লাইন-আপে। মাকসুদুল হক ফিরে আসেন পুরোদস্তুর কন্ঠ নিয়ে (মেইন ভোকাল ), মুরাদ রহমান ব্যান্ড ছেড়ে চলে গেলে ফিডব্যাকে বেইজ গিটার নিয়ে জয়েন করেন সেকান্দর আহমেদ খোকা, লীড গিটারিস্ট ও ভোকার হিসেবে আসেন লাবু রহমান , ড্রামসের সেই পুরোনো পিয়ারু খান এবং কিবোর্ডিস্ট ও দলনেতা ফোয়াদ নাসের বাবু। নতুন আঙ্গিকে, নতুন কথা ও সুরে, নতুন সঙ্গীতের নতুন পরিবেশনায় ফিডব্যাক নিয়ে আসে বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের অন্যতম সফল অ্যালবাম ও বাংলা ব্যান্ডে বিকল্পধারার রক মিউজিকের উজ্জল দৃষ্টান্ত "উল্লাস"। সারগাম থেকে থেকে প্রকাশ পাওয়া এই অ্যালবামের কাভার পেইজটাও ছিল দীপ্ত ও বৈচিত্র্যময়। একদল মানুষ, কেউ গিটার বাজাচ্ছে, কেউ গাইছে, কেউ ড্রামস বাজাচ্ছে এরকম একটার উপড় আরেকটার অবয়ব। কভার দেখেই বোঝা গিয়েছিল "উল্লাসে" মেতেছে ফিডব্যাক। অ্যালবামের ফার্স্ট ট্র্যাক " মৌসুমি পর্ব ১"। জনপ্রিয় অনেক অনেক গানের গীতিকার ও বর্তমানের প্রথম আলো'র জ্যোতিশী কাওসার আহমেদ চৌধুরীর লেখা প্রথম গানটি দিয়েই সব-ঘরানার শ্রোতা হৃদয় কেড়ে নেয় ফিডব্যাক।। অসম্ভব চমৎকার এই গানের কথা, সুর ও সঙ্গীতায়োজনের তুলনা হতে পারেনা। আর মাকসুদুল হক তার তরুণ কোমল কন্ঠে এতটায় আবেগী কন্ঠে গেয়েছেন যে এর আর অন্য কোন বিকল্প থাকতেই পারেনা। এতো গেল শুধু প্রথম গান !!! এরপর একে একে "চিঠি", "চোখ", "মাঝি", "সেই দিনগুলি", "উদাসী", "জানালা", "ঐ দূর থেকে দূরে", "কেমন করে হায়", "আমার নতুন আকাশে", "এই দিন চিরদিন রবে", "ঝাউ বনে", "মহাশূণ্য" ও "দিন যায় দিন চলে যায়" আজও বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের এক একটি হীরাখন্ড। (পরবর্তী কালে ফিডব্যাকের সেরাগান নিয়ে করা অ্যালবাম "জোয়ার" এর সর্বাধিক গান নেওয়া হয় "উল্লাস" থেকেই)। উল্লাসে সর্বাধিক গানে কন্ঠ দিয়েছিলেন মাকসুদুল হক এবং নিজের কন্ঠ গাওয়া গানের লিরিকগুলোর সর্বাধিক-ই মাকসুদুল হকের নিজের লেখা। কোন কোন গানে উঠে এসেছে ভালবাসার উন্মাদনা, হাজারো প্রশ্নে জানতে চাওয়া নির্মম সত্য অথচ জানার কতই না আকুতি !!! "চোখ", "চিঠি", "উদাসী" সহ প্রতিটি গানের কথা এত বৈচিত্রময়, এত বাস্তবধর্মী এর আগে কোন ব্যান্ডের অ্যালবামে এত প্রকট ভাবে উঠে আসেনি। সেই দিক থেকে বলতে গেলে এমন অসম্ভব শক্তিশালী গানের কথায় খুব খুব নিয়মিত অ্যালবাম করেছে এমন কম সংখ্যক ব্যান্ড-ই বাংলাদেশে পাওয়া যাবে যারা তাদের প্রতিটি অ্যালবামেই এর সফল ধারাবাহিকতা দেখিয়েছে একমাত্র ব্যান্ড ফিডব্যাক ছাড়া। বাংলা ব্যান্ড মিউজিক-এর এক অনবদ্য অ্যালবাম হিসেবে যতদিন বাংলা ব্যান্ড মিউজিক টিকে থাকবে ততদিন এই উল্লাস থাকবে। শুধু উল্লাসই নয় মাকসুদুল হক সহ ফিডব্যাকের প্রতিটি অ্যালবাম বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের এক একটি উজ্জল নক্ষত্র। গতানুগতিক ধারার গান কখনোই ফিডব্যাক শ্রোতাদের উপহার দেয়নি মাকসুদুল হক থাকা অবস্থায়। প্রতিটি অ্যালবামের কথা, সুর ও সঙ্গীতায়োজন ছিল এমনই শক্তিশালী যেঃ যেই ব্যাক্তি প্রথম বারের মত ফিডব্যাকের গান শুনবে, তাকে অবশ্যই অবাক হতে হবে বিষ্ময়ে, সমস্ত দ্বিধা ছুড়ে ফেলে মেনে নিতে হবে তাদের একছত্র সৃষ্টিশীলতাকে, বলতে হবে এক একটি মিউজিক একটি একটি ক্ল্যাসিক। আর প্রতিটি গানের সঙ্গীতায়োজন ও গায়কী যে কাউকেই সহজে বশীভূত করতে বাধ্য।।
এভাবেই অনেক বৈশাখ এলো আর গেলো। রমনা বটমূলে মঞ্চ বানিয়ে রং-চঙ্গা পোশাকে গাওয়া রবিঠাকুরের চমৎকার ঠান্ডা মেজাজের সমবেত সঙ্গীত "পুরানো সেই দিনের কথা/ভুলবি কিরে হায়/ও সে চোখের দেখা/প্রাণের কথা সেকি ভোলা যায়" দিয়ে বর্ষ বরণ হতে থাকল। যেখানে নেই বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢোলের বাড়ি, নেই রমণীর খোঁপার সেই হরেক রকমের ফুলের মালা'র কথা, নেই উন্মত্ত রোদে আনন্দ মিছিলের কথা, নেই কোন হট্টগোলের কথা, নেই রমণীদের উৎপাত করা বখাটে ছেলেদের কথাঃ যখন প্রেমিক মন বিদেশী সুগন্ধী মেখে ঘুড়ে বেড়ায় ভালবাসার মানুষটি জন্য। নেই কোন নতুন প্রাণের কথা, নেই প্রকৃতি'র রুপে আগুন ধরে যাবার কথা। সর্বোপরি নেই প্রাণ খুলে সুতীব্র চিৎকারে জানানো বৈশাখের কথা। এরপর এলো ১৯৯০। বাঙ্গালী ১৩৯৭ সালের বৈশাখ ছিল অন্য সব বৈশাখ থেকে পুরো আলাদা। বাংলা ব্যান্ড মিউজিকে নতুন ধারার এক অনন্য ও সর্বযুগের উপযোগী সংযোজন হিসেব আত্মপ্রকাশ পেল ফিডব্যাকের তৃতীয় অ্যালবাম "মেলা"। বৈশাখের দিনে ঘরে ঘরে, পাড়াতে পাড়াতে, বাজারে বাজের, মেলার মাঠে, ক্লাব ঘরে বাজতে থাকল মাকসুদুল হকের লেখা ও কন্ঠ দেওয়া গানঃ "মেলায় যায়রে, মেলায় যায়রে, মেলায় যায়রে, মেলায় যায়রে/বাসন্তী রং শাড়ি পড়ে ললনারা হেটে যায়/মেলায় যায়রে, মেলায় যায়রে, মেলায় যায়রে, মেলায় যায়রে/ঐ বখাটে ছেলের ভীড়ে ললনাদের রেহায় নাই/ . . . মেলায় যায়রে, মেলায় যায়রে, মেলায় যায়রে, মেলায় যায়রে" (এ অংশটুকুতে যেই সময়ের কথা বলেছি, সেই সময়ের কথা আমি জানিনা। পরিবেশ কেমন ছিল তাও জানা নেই। প্রথম বৈশাখে "মেলায় যায়রে" গানটা সারা বাংলাদেশের মানুষ কতবার করে শুনেছে তাও জানা নেই। তবে ঠিক এইরুপ একটি অভিজ্ঞতা আমার ব্যাক্তিগত ভাবেই আছে। সেখান থেকেই কল্পনায় ১৩৯৭ এ চলে গিয়েছি। প্রতিটি বৈশাখে ঘুম থেকেই উঠেই আমি ফিডব্যাকের "মেলা" গানটা শুনে নিজেকে মাতিয়ে নেই উল্লাসে)। বৈশাখের আনন্দ-উৎসবের সাথে যেতে পারে এমন চমৎকার, মানানসই, আবেদনময়ী উল্লাসের গান বোধকরি এই বাংলা মিউজিকে নেই, একমাত্র ফিডব্যাক ও মাকসুদুল হকের "মেলা" ছাড়া। আসবে সেরকমও কিছু নিশ্চিত বলা যায় না।। মাকসুদুল হক, শুধুই শিল্পী নন, একাধারে তিনি গীতিকবি, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ও সর্বোপরি একজন সামাজিক যোদ্ধা।। যিনি গানের মাধ্যমে সামাজিক জাগরণের জন্য কাজ করেছেন, তুলে এনেছেন স্বদেশের কথা, তুলে ধরতে চেয়ে ধূর্ত রাজনীতিবিদতের ষড়যন্ত্রের কথা, তুলে ধরেছেন প্রিয়ার নিষ্ঠুরতাকে তাও আবার মধুর আঘাতে আঘাত করা পুরোনো ক্ষতে, গানের কথায় ফিরে এসেছে জীবন-জ্বালার কথা, স্মরণ করেছেন চিরতরে বিদায় দেওয়া বন্ধু "হ্যাপি আকন্দের কথা", কৌতুহলী হয়ে জানতে চেয়েছেন মৌসুমির কথা---কারো বুকের আলিঙ্গনে লুকিয়ে প্রিয়া আজও কি আমায় মনে করে???।। ফিডব্যাকের "মেলা" বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের এক অনন্য সংযোজন। ১২ টি গানের প্রতিটি গানই প্রথম শ্রেণীর মিউজিক। (মাকসুদুল হক ও ফিডব্যাকের গান নিয়ে লিখতে গেলে অবশ্যই গানের লিরিকে ভিন্নতা, বাস্তবধর্মী, গানের লিরিকে চমৎকার কথার শক্তিশালী ব্যাবহার বারবার লিখতে হবে নতুন করে। আর প্রটিটি গানের কম্পোজিশান সেই আগের কথা থেকে বলতে চাইঃ যেন স্বর্গীয় কোন অনুভূতি থেকে পাওয়া। ফুয়াদ নাসের বাবু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিকের ইতিহাসে এক অনন্য ও অনবদ্য সঙ্গীত পরিচালক। বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীত নিয়মিত শোনের এবং একটু খোজ খবর রাখেন যারা তারা আমার সাথে একমত পোষণ করবেন খুব সহজেই, এই আশা করা অর্বাচীন কিছু নয়।)

মেলা অ্যালবামের গানগুলো হলঃ "মেলা", “মৌসুমী পর্ব -২”, ”জীবন-জ্বালা”, ”গৌধুলী”, ”নীল-নক্সা”, ”পালকী পর্ব -১”, ”স্বদেশ”, ”জন্মেছি-এই যুগে”, ”ময়ূরী আকাশ”, ”ছোট্ট পাখি”, ”মন বুঝিয়া” ও “ফিরে এসো”। অধিকাংশ গানে কন্ঠ দিয়েছেন মাকসুদুল হক ও নিজের কন্ঠে গাওয়া প্রায় এই অ্যালবামের সব গানই উনার নিজের লেখা। জন্মেছি এই যুগে গানটিতে মাকসুদুল হক সুতীব্র চিৎকারে আর্তনাদ করে বলেছেনঃ “শুনিনা পুরোনো দিনের ঐ গান/আমি বুঝিনা তোমার রাগ-রাগিনীর গান/প্রথম যেদিন হল আর্তনাদ/আর পাগল পাগল বলে দিলে অপবাদ আমাকে/আমি জন্মেছি এই যুগে/আমার অহংকার আমি গান গাই এই যুগে”। ব্যান্ড সঙ্গীতের আধুনিকায়নে ও ব্যান্ড সঙ্গীতকে বাংলাদেশে জনপ্রিয় করার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান যার তিনি হলেন অসামান্য প্রতিভাধর বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের অগ্রদূত এই মাকসুদুল হক ও ফিডব্যাক। ব্যাক্তি জীবনে ব্যান্ড সঙ্গীতকেই লালন করেছিলেন দীপ্ত প্রতিভায়। ব্যান্ড সঙ্গীত আন্দোলনের প্রধান ও একমাত্র সংঘঠন বামবা (বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ব্যান্ড অ্যাসোসিয়েশান) এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে ব্যান্ড সঙ্গীত আন্দোলনকে ত্বরাণ্বিত করেছিলেন।

১৯৯২, এইচ.এম.ভি/কলকাতা থেকে ফিডব্যাকের সর্বাধিক জনপ্রিয় গানগুলো নিয়ে প্রকাশ পায় "জোয়ার"। পুরোনো জনপ্রিয় গানগুলো যেমনঃ মৌসুমী-১, মৌসুমী-২, এই দিন চিরদিন, ঐ দূর থেকে দূরে, দিন যায় দিন চলে যায়, মাঝি তুমি, মাঝি-৯১(মাঝি তোর রেডিও নাই), চিঠি, জীবন-জ্বালা ও মেলা গানগুলো রিকম্পোজ করা হয় এই অ্যালবামে শুধুমাত্র মাঝি-৯১ ছাড়া। সবগুলো গানেই কন্ঠ দেয় মাকসুদুল হক। ফিডব্যাকই বাংলাদেশের প্রথম কোন ব্যান্ড যারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইন্ডিয়াতে ততকালীন সময়ে অডিও প্রকাশ করে।। কলকাতায় জোয়ার অ্যালবাম প্রকাশের পরপরই ইন্ডিয়াতে ফিডব্যাক একটি Open Air Concert এ অংশ নেয়।। হাজার হাজার উন্মত্ত শ্রোতা অংশ নেই সেই কনসার্টে। সেই সময়ে আগে ইন্ডিয়ায় এমনটি ছিল বিরল।। ঐ কনসার্টের পর জ়োয়ার অ্যালবামের কাটতি বেড়ে যায় বহুগুনে।। শ্রোতারা হুমড়ি খেয়ে পড়ে ক্যাসেটের দোকানে। কিন্তু দুঃখ ও আক্ষেপ এই যেঃ ঐ সময়ে ওপাড় বাংলার (কলকাতার) এক শিল্পীকে সুযোগ করে দিতে সমস্ত জোয়ার অ্যালবাম প্রচুর চাহিদা থাকা সত্বেও মার্কেট থেকে তুলে নেওয়া হয় এইচ.এম.ভি।।

বাংলা ব্যান্ড মিউজিকে ফিডব্যাক ও মাকসুদুল হকের করা জোয়ার অ্যালবামটি এক অনন্য সংযোজন। তখনও ফিডব্যাকের লাইন আপে ছিলঃ ফোয়াদ নাসের বাবু (কিবোর্ডিস্ট ও দলনেতা), মাকসুদুল হক (ভোকাল), পিয়ারু খান (ভোকাল ও ড্রামার), লাবু রহমান (ভোকার ও গিটারিস্ট) এবং সেকান্দর আহমেদ খোকা (বেইজ) এবং বাউলিয়ানা পর্যন্ত একই লাইন-আপ ছিল ফিডব্যাকের।। (ব্যাক্তিগত ভাবে আমি ফিডব্যাক ও মাকসুদুল হকের করা প্রতিটি অ্যালবাম শুনে মুগ্ধ হয়েছি অজস্রবার এবং প্রতিবারই নতুন নতুন করে)।

এরপর এল বঙ্গাব্দ ১৪০০ (খ্রিস্টাব্দঃ ১৯৯৪সাল)। ফিডব্যাক নিয়ে এল ফিডব্যাকের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যালবাম বঙ্গাব্দ ১৪০০। গীতিকবিতার শুরু এই অ্যালবাম থেকেই। বঙ্গাব্দ ১৪০০ এর কথা আগেই উল্লেখ করেছি। (তবে কিছু কিছু ব্যাপার নতুন করে তুলে আনার একটা প্রবল আকাংখা আমার।) এই অ্যালবামের চারটি গান সচরাচর ধারাবাহিকতার বাইরে সবচেয়ে বেশী ভাললাগত। আগেই উল্লেখ করেছি মাকসুদুল হক বরাবরই সামাজিক অসংগতি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তার গানে। গানের মাধ্যমে করতে চেয়েছিলেন সামাজিক বিপ্লব। গান করেছেন ব্যান্ড আন্দোনল নিয়ে। বঙ্গাব্দ ১৪০০ তে করা "কোথাও রোমাঞ্চ নেই/খাঁটি করুণ বাস্তবতা/আর এই বাংলাদেশেরই কথা/ . . . দিয়ে শুরু(উচ্চ পদস্থ তদন্ত কমিটি)" ও "সামাজিক কোষ্ঠকাঠিণ্য" সামাজিক আন্দোলনের ব্যান্ড মিউজিকের ভূমিকা অনেক শক্তিশালী ও প্রশংসনীয় করে তোলে। এছাড়া একই অ্যালবামে করা "আপন দেশে চল" শিরোনামের গানটি চিরাচরিত বাংলার গরিমা গানের প্রতিনিধিত্ব করে। সেই সাথে মাকসুদুল হক-ই বাংলাদেশের প্রথম ব্যাক্তি যিনি বাংলার বাউল ও গরিমা গান গুলো ব্যান্ড সঙ্গীতের ছত্রছায়ায় নতুন প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন। এছাড়াও "জীবন সুন্দর/আকাশ বাতাস-পাহাড় সমুদ্র সবুজ বনানী ঘেরা প্রকৃতি সুন্দর/আর সবচেয়ে সুন্দর এই বেঁচে থাকা/তবুও কি আজীবন বেঁচে থাকা যায়/বিদায়ের সানায় বাঁজে/নিয়ে যাবার পালকী এসে দাড়ায় দুয়ারে/সুন্দর প্রকৃতি ছেড়ে এই যে বেঁচে ছিলাম/দীর্ঘশ্বাস নিয়ে যেতে হয় সবাই কে অজানা গন্ত্যবে/হঠাৎ ডেকে উঠে নাম না জানা পাখি/অজান্তেই চমকে উঠি জীবন ফুরালো নাকি" চমৎকার আবৃতি অংশটুকু দিয়ে শুরু হয় পালকী-২। জীবনের সবচেয় নির্মম সত্য কথাটা স্মরণ করিয়ে দেয় এই গানটি। আর এই গানটির সঙ্গীত পরিবেশনাও চমৎকার। ভাল না লাগার কোনই অবকাশই নেই। আর সব কটি গানের চমৎকার পরিবেশনা ফিডব্যাকের। ফিডব্যাকের বাইরে এর কোন অস্তিত্ব নেই। এছাড়া এই অ্যালবামে লাবু রহমানে কন্ঠ গাওয়া "এখন আমি বিদ্রোহী" ও "সুখী মানুষের ভীড়ে" গান দুটি এবং পিয়ারু খানের কন্ঠ গাওয়া হাইলি মেলোডিয়াস "ও আশা" গানটা শুধুই শ্রুতি মধুর নয়, পাশাপাশি গানের সঙ্গীতায়োজন ও উপস্থাপনের ভঙ্গী পুরো ব্যাতিক্রম ও অসাধারণ। (লাবু রহমান ও পিয়ারু খানের কথা আমার এই পোষ্টে অনেক গুলো কারণেই তুলে আনিনি। অন্য কোন পোষ্টে নিয়ে আসব নাহয় ফিডব্যাক এর এই দুই যোদ্ধাকে।)



চিরাচরিত বাংলার আদি সঙ্গীতের একটা বিশাল অংশ জুড়েই রয়েছে বাউল গান ও গরিমা গান। হাছন রাজা, লালন সাঁই, সিরাজ সাঁই, বাউল আব্দুর রহমান বয়াতী এবং শাহ আব্দুল করিম সহ আরো অনেকেই সমৃদ্ধ করে গেছেন এই পুণ্যভূমি। জীবন, প্রেম, ভালবাসা, বিরহ, দেহতত্ত্ব, আলেক দর্শন সহ অনেক ক্ষেত্র সমৃদ্ধ আছে সেইসব গান দিয়ে। মাকসুদুল হক সেই দর্শন পেয়েছিলেন। বাংলাদেশর ব্যান্ড মিউজিকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থেকে শ্রোতাপ্রিয়তা হারাতে পারে জেনেও বানিজ্যিকতার কোন মানসিকতা না রেখে শুধুমাত্র বাংলার ব্যান্ড সঙ্গীত দিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে বাউল গানগুলো পৌছে দিতেই ফিডব্যাক শুরু করে বাউলগান নিয়ে অ্যালবামের কাজ।। ঐ সময়ের আগে ফিডব্যাক ছাড়া বাংলার অন্য কোন ব্যান্ড এত বড় সাহসীকতার পরিচয় দিতে পারেনি।। এই প্রজেক্টের আওতায় প্রথমেই ফিডব্যাক নিয়ে আসে বাংলাদেশের মিউজিকের ইতিহাসে সিঙ্গেল ট্র্যাকের একটি পুরো অ্যালবাম যার এপিঠ-ওপিঠ দুপিঠ জুড়েই শুধু একই গান বাজতে থাকে এবং সেটি গানটি হল বিখ্যাত বাউল সঙ্গীত "মন আমার দেহঘড়ি" এর ফিউশান ভার্সন। দেহঘড়ি শিরোনামের অ্যালবামটিতে ফিডব্যাকের সাথে প্রথমবারের মত পরিবেশনা করে বিখ্যাত বাউল শিল্পী আবদুর রহমান বয়াতী এবং অ্যালবামের স্বার্থে গানের লিরিকে একটু পরিবর্তন আনা হয়।
সে-ই শুরু এরপর ১৯৯৬ সালে বাউলদের গান নিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথমবারের মত ফিডব্যাক নিয়ে আসে একটা পুরো বাউল অ্যালবাম। এই অ্যালবামের ১০ গানের ভেতর ৯টি গান নেয়া হয় বাংলার বাউল সঙ্গীতের জনপ্রিয় গানগুলো থেকে। আর সেগুলো হলঃ করিমানা, প্রাণকান্দে, গুরুর ভাব, জনম দুঃখী, লোকসান, কেহই করে বেঁচাকেনা, দিবার কিছু নাই, শ্যাম কালিয়া এবং হাওয়া দমে শিরোনামের গানগুলো।। হাওয়াদমে গানটিতে ফিডব্যাকের সাথে পরিবেশনা করেন বাউল সাধক "হিরু-শাহ)। বাদ বাকী ১ টি গান "ধুয়ার দানা" পিয়ারু খানের লেখা গান। বাউলিয়ানা বাংলাদেশের মিউজিকের ইতিহাসের শুধুই একক ও অনবদ্য সংযোজন নয়। এই অ্যালবামটিই একমাত্র অ্যালবাম, যে অ্যালবামটি যারা বাউলগান শুনতো না কিংবা আগ্রহ বোধ করত না তাদেরকে বাউল গানে আকৃষ্ট করেছে। আমি নিজেও তাদেরই দলে পড়ি। মাকসুদুল হক ও এই ফিডব্যাক না থাকলে হয়ত আমি এই অসম্ভব চমৎকার দর্শনের মুখোমুখি হতাম না কখনোই।। এই অ্যালবামটি বাউল ধারার গানগুলোকে নতুন প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় করতে অসামান্য অবদান রেখেছে এবং আজও আমি তা-ই মনে করি।। এবং বর্তমান সময়ে যারা Experiment Music করছেন তাদের সবার আদিতে কিন্তু ফিডব্যাক ও এক মাকসুদুল হক-ই।
বাউলিয়ানা করার পরপরই মাকসুদুল হক করতে চেয়েছিলেন নিজের পছন্দ মত সেইসব গান, যেই গানগুলো সামাজ গঠনের আন্দোলনে ভূমিকা রাখবে, সমাজ সচেতনতায় এগিয়ে আসবে এক একটি গান, দেশ কাল উঠে আসবে প্রতিটি লিরিকে। ঝংকারে ঝরে পড়বে সমস্ত সংকীর্ণ মানসিকতা। প্রতিটি গানের কথায় থাকবে অন্যায্য ও অন্যায়ের এবং নোংরা রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রখর প্রতিবাদ, থাকবে নিজের অক্ষমতা, থাকবে স্বদেশ প্রেমের কথা। যেই গান গুনলে সমাজ সচেতন হবে। যেই গান জাতি গঠনে উৎসাহিত করবে তরুণ সমাজকে। নিজেও সামাজিক দ্বায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত হবেন কিছুটা। প্রতিবাদ করতে চেয়েছেন গানে গানে।। গলায় গলা মেলাতে চেয়েছিলেন লক্ষ লক্ষ তরুণের কন্ঠের সাথে।। যখন বুঝতে পারলেন ফিডব্যাকে থেকেই এই গানগুলো করার সুযোগ পাববেন না, ঠিক তখনই বাউলিয়ানা করার পরপর ১৯৯৬ সালে ফিডব্যাক ছেড়ে এসে গড়ে তোলেন "মাকসুদ ও ঢাকা" শিরোনামের একটি ব্যান্ড। ঠিক একই সময়ে মাকসুদুল হকের সাথে ফিডব্যাক ছেড়ে চলে আসে বেইজিস্ট সেকান্দর আহমেদ খোকা।। সেকান্দর আহমেদ খোকা এখন অব্দি মাকসুদ ও ঢাকা ব্যান্ডের সদস্য হিসেবে আছেন। ফোয়াদ নাসের বাবু, পিয়ারু খান ও লাবু রহমান এখনো ফিডব্যাকের সাথে জড়িত আছেন।। মাকসুদুল হক ফিডব্যাক ছেড়ে চলে আসার পর ফিডব্যাক আর কখনোই সেই আগের জনপ্রিয়তা নিয়ে দাড়াতে পারেনি। দীর্ঘ বিরতি দিয়ে করেছিলেন ফিডব্যাক ০২ নামের একটি অ্যালবাম। সেই অ্যালবামটিতে ফিচার করা হয়েছিল 'রেশাদ'কে। "আবার মেলায়" শিরোনামে একটি গানসহ সবকটি মৌলিক গান নিয়েও ফিডব্যাক আর দাড়াতে পারেনি। এখন ২০১১ সাল। সময়ের বিবর্তনে অনেকেই জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। হারিয়েছে ব্যান্ড মিউজিকে নিজেদের বর্তমান অবস্থান। ফোয়াদ নাসের বাবুর মত শক্তিমান কম্পোজার থাকা সত্বেও লাবু ও পিয়ারু খান নিয়ে ফিডব্যাক'কে হয়ত আগের সেই স্মৃতিচারণা করেই সময় কাটাতে হয়। সেই খবর আমরা কইজনই বা রাখি। অন্যদিকে মাকসুদুল হক হয়েছে নিষিদ্ধ মাকসুদ সেই খবরই-বা কইজনের জানা।
ওয়ারফেইজ -
‘ওয়ারফেইজ’ নামটি নূতন করে পরিচয় করিয়ে দিবার দুঃসাহস আমার নেই! গত প্রায় তিন দশক ধরে সমানতালে সব দশকের শ্রোতাদের মাতিয়ে রেখেছে বাংলা হার্ড রক যে ব্যান্ডটি তার নাম ‘ওয়ারফেইজ’।আমার সমবয়সীরা যারা ওয়ারফেইজ এর উত্থান নিজের চোখে দেখেছি তাদের কাছে আজো বাংলা রক গানের কথা আসলেই প্রথমে সবার আগে যে নামটি উচ্চারিত হয় তাঁর নাম 'ওয়ারফেইজ'। আজ যারা বাংলা রক/ হেভি মেটাল গান দিয়ে এই প্রজন্মকে কাঁপাচ্ছে তাঁদের কাছে 'ওয়ারফেইজ' একটি রোল মডেল হয়ে আছে। 'ওয়ারফেইজ' এর মতো এতো নিখুঁত এতো দুর্দান্ত বাংলা রক গান আর কেউ উপহার দিতে পারেনি। ওয়ারফেইজ প্রমান করেছে যে শুধু চিৎকার ,চেঁচামেচি আর বাদ্যযন্ত্রের ধুম ধুম দিয়ে রক গান হয় না। রক গানের নিজস্ব একটা স্টাইল/ ধরন আছে। গানের কথা থেকে শুরু করে সুর, গায়কী সবকিছুতে একটা নিখুঁত কম্পোজিশন আছে। যার কারনে গত তিন দশক ধরে 'ওয়ারফেইজ' বাংলা রক গানের ১নং আসনটি ধরে রেখেছে। এখন সেই 'ওয়ারফেইজ' এর কিছু অজানা গল্প আপনাদের বলবো কিভাবে তাঁরা দেশের শীর্ষ রক ব্যান্ড হলো।
১৯৮৪ সালে ঢাকা শহরের স্কুল পড়ুয়া গানপাগল কয়েকজন ক্ষ্যাপা কিশোর 'ওয়ারফেইজ ' নামে একটি ব্যান্ড গঠন করে। সেই কিশোরদের লাইনাপ ছিল এমন কমল- বেজগিটার , ড্রামস- হেলাল, মীর- লিড গিটার, নাইমুল- লিড গিটার, বাপ্পি- ভোকাল । পরবর্তীতে মির,হেলাল ও বাপ্পি ব্যক্তিগত কারনে ব্যান্ড ছেড়ে চলে গেলে কমল লিড গিটারের দায়িত্ব নেয়, বাবনা বেজ গিটার ,টিপু ড্রামস ও রাসেদ ভোকাল এর দায়িত্ব নিয়ে ব্যান্ড এ যোগ দেয়। পরবর্তীতে নাইমুল ও রাসেদ চলে গেলে রাসেল কিবোর্ড ও সাঞ্জয় ভোকাল এর দায়িত্ব নেয়। অবশ্য তাঁরা দুজন আসার আগে ইন ঢাকা ব্যান্ড এর মাসুক ও ফুয়াদ অথিতি হিসেবে বিভিন্ন শোতে অংশগ্রহন করে। সেই কিশোররা (বাবনা,রাসেল,সাঞ্জয়,কমল টিপু) সবাই তখন স্কুলের ছাত্র। তারা অবসরে তাদের সেই ব্যান্ড নিয়ে অনুশীলন করতো। তখনো বাংলাদেশ এর মানুষরা তাদের চিনতো না। তারা প্রথম থেকেই সবসময় ইংরেজি গান গাইতো। তখন স্টেজ এর পারফর্ম বেশি চলতো। তাই যারা স্টেজ শো গুলো দেখত তাদের সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতো সেই কিশোর রা। এমন কি তখনকার নামিদামি ব্যান্ড ফিডব্যাক, সোলস, অবসকিউর সহ সবাইকে তারা চমকে দিয়েছিলো তাদের অসাধারণ পারফরমেন্স এর কারনে। এইভাবেই চলছিল কিশোরগুলোর ব্যান্ড ‘ওয়ারফেইজ’ যারা তখনো কোন বাংলা গান গাইতে জানতো না। ১৯৯০ সালের এক বিকেলে বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীত এর অন্যতম পুরাধা, জনপ্রিয় মাকসুদ ভাই একদিন মিরপুর পল্লবীতে সেই কিশোরদের নিয়ে বসলেন। আলচনার বিষয় ‘কেন সেই কিশোররা শুধু ইংরেজি গান গাইছে”? সেই কিশোরদের সাথে প্রিয় মাকসুদ ভাই টানা ৪ ঘণ্টা একা তর্কযুদ্ধ করে গেলেন। একসময় সেই কিশোররা বাংলা ব্যান্ড এর এই পুরাধার কথা মেনে নিয়ে রাজি হলো ইংরেজি গান বাদ দিয়ে পুরোপুরি বাংলা গান করার এবং পুরো বাংলায় একটি হার্ডরক অ্যালবাম বের করবে শ্রোতাদের জন্য। প্রিয় বন্ধুরা এতক্ষণ খুব সংখিপ্ত করে বললাম ‘ওয়ারফেইজ’ এর একটি ইতিহাস। আজকের ‘ওয়ারফেইজ’ কে পাওয়ার পেছনে যে মানুষটার সবচেয়ে বড় অবদান তিনি আর কেউ নন একমাত্র আমাদের সবার প্রিয় এবং ব্যান্ড ব্যান্ড সঙ্গীত এর কিংবদন্তি মাকসুদুল হক মাকসুদ ভাই। আমি ‘ওয়ারফেইজ’ এর একজন পাগল ভক্ত হয়ে প্রিয় মাকসুদ ভাইকে এর জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই, কারন তাঁর জন্যই আমরা আজকের এই ওয়ারফেইজ কে পেয়েছি। যারা আজ হার্ড রক ব্যান্ড এর বাংলাদেশের প্রতিকৃতি হয়ে আছে। এই হার্ডরক নিয়ে কত ব্যান্ড এসে হারিয়ে গিয়েছে এবং যাচ্ছে, কিন্তু ‘ওয়ারফেইজ’ শত ভাঙা গড়ার মাঝেও মাথা উঁচু করে আজো টিকে আছে এবং বাংলাদেশ এর ১ম সারির ব্যান্ড হিসেবে গত ৩ দশক ধরে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে।
ওয়ারফেইজ ১৯৯১ সালে প্রথম যে অ্যালবাম বের করেছিল সেইটা ছিল তাদের ৩য় বার এর লাইন আপ বদল করার পর।ওয়ারফেইজ এর প্রথম অ্যালবাম সেলফ টাইটেলড যা বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের ইতিহাসে ঠাই করে নেয় অসাধারণ সব হার্ডরক গানের জন্য। সেদিন বাংলাদেশের শ্রোতারাও বুঝতে পারলো যে আমাদের ছেলেরাও পারে হার্ডরক/হেভি মেটাল গান গাইতে। অবশ্য এর আগে রকস্টারটা তাদের অ্যালবাম বের করে কিন্তু ওয়ারফেইজ এর মত এতো আলোড়ন তুলতে পারেনি।তবুও রকস্টারটা বেশ ভালোই গেয়েছিল। প্রথম অ্যালবাম এর ‘একটি ছেলে’ ‘বসে আছি’ ‘কৈশোর ‘ ‘স্বাধিকার’ গানগুলো আজো ২০ বছর পরেও একইরকম নাড়া দেয়। আজো শ্রোতারা ভুলতে পারেনি। সেই অ্যালবাম এ শ্রোতারা সঞ্জয় এর সাথে পায় বাবনা (বর্তমানে আমেরিকায় প্রবাসী) নামের আরেক বিস্ময় কে। যে ‘বৃষ্টি’ গান দিয়ে শ্রোতাদের হৃদয়ে ঠাই করে নেয়। যার গান শুনলে মনে হয় ওয়ারফেইজ এর কেউ না, উদাসী কোন এক শিল্পী নিজের মনে গেয়ে চলেছেন।
আজ ২০ বছর পরেও বাংলা হার্ডরক গানের কথা উঠলেই ‘বসে আছি একা’ ‘একটি ছেলে’ গান দুটোর নাম চলে আসে সবার আগে। ২০ বছরেও এই গান দুইটির বিকল্প কোন গান কেউ করতে পারেনি। ১৯৯২ ও ১৯৯৩ সালে ‘কোকাকোলা ব্যান্ড এ্যাওয়ার্ড’ এর শ্রেষ্ঠ ব্যান্ড এর পুরস্কার লাভ করে ওয়ারফেইজ যা পরপর ২বার তা লাভ করে তারা। ১৯৯৪ সালে বের হয় ওয়ারফেইজ এর ২য় অ্যালবাম ‘অবাক ভালোবাসা’। প্রথমটার মত এটিও শ্রোতারা লুফে নেয় এবং ওয়ারফেইজ আবারো তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করে। এই অ্যালবাম এর কভার ডিজাইনের জন্য ‘কোকাকোলা ব্যান্ড এ্যাওয়ার্ড ‘’ এর শ্রেষ্ঠ কভার পুরস্কার লাভ করে ওয়ারফেইজ এবং শ্রেষ্ঠ ড্রামার হিসেবে পুরস্কৃত হয় টিপু। যিনি আজো বাংলাদেশ এর একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ ড্রামার হিসেবেই আছেন। ‘অবাক ভালোবাসা’ অ্যালবাম এর টাইটেল গানটি গায় সেই বিস্ময় ও উদাসীন শিল্পী বাবনা। যা তারে সারাজীবনের জন্য শ্রোতাদের মনে ঠাই করে দিয়েছে। এই অ্যালবাম এর অন্যতম হিট গানগুলো ছিল ‘ অন্ধ জীবন’ ‘অন্য ভুবন’ ‘যখন মেঘের চাদর ‘ ‘বন্দী নিয়তি’, ‘এক+এক=দুই’’ ‘’শেখানো বর্ণনা ‘’ গানগুলি আজো শ্রোতাদের মনে পড়ে। এদিকে বাবনা মিক্সড অ্যালবাম এ (প্রিন্স মাহমুদ এর) নিজের আলাদা একটা জনপ্রিয়তা তৈরি করে ফেলেছে। মিক্সড অ্যালবাম এর মাঝে বাবনার ‘মেঘাচ্ছন্ন আকাশ (শক্তি)” “ছিলে তুমি জীবনে আমার (শক্তি)” “একা হয়ে যাই (ঘৃণা)” “ কোথায় হারালে (ক্ষমা) “ গানগুলো আজো শ্রোতাদের কাঁদায়! বাবনা আজো শ্রোতাদের কাছে এক বিস্ময় রয়ে গেলো। ১৯৯৬ সালের ঈদে বের হয় ওয়ারফেইজ এর ৩য় অ্যালবাম ‘জীবনধারা’ । যেখানে পুরনো সবার সাথে যোগ দেয় নতুন একজন যার নাম ফুয়াদ ইবনে রাব্বি । এই অ্যালবাম এ ওয়ারফেইজ সম্পূর্ণ হার্ডরক থেকে বের হয়ে একটু সফট রক গান বেশি করেছিলো। শুধু ‘জীবনধারা” গানটি ছিল বরাবরের মত একটি জটিল গান। যা শ্রোতারা তাদের প্রিয় তালিকায় নিয়ে নেয়। এছাড়া বিস্ময় কণ্ঠের বাবনা ‘ মৌনতা’ ‘মা’ গান দুটি ছিল অসাধারণ। আর সঞ্জয়ের ‘ধুপছায়া’ গানটি ছিল মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মত একটি গান। যা আজো শ্রোতাদের সেই দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এই অ্যালবাম বের হওয়ার আগেই বাবনা ও রাসেল আমেরিকায় চলে যায়। শুধু মাঝে মাঝে বাবনা এসে অ্যালবাম এর কাজে নিজেকে জড়াতে পারলেও রাসেল এর তা সম্ভব হয়নি। ‘জীবনধারা’ অ্যালবামটিই বলতে গেলে ওয়ারফেইজ এর সাথে বাবনার শেষ অ্যালবাম। এরপর বাবনা পুরোপুরি প্রবাসী হয়ে যায়। ১৯৯৮ সালের রোজার ঈদে মুক্তি পায় ওয়ারফেইজ এর ৪র্থ অ্যালবাম ‘অসামাজিক’ যা হার্ডরক অ্যালবাম গুলোর ইতিহাসে ওয়ারফেইজ এর আরেকটি চমৎকার সংযোজন। যেখানে ওয়ারফেইজ এর সাথে যোগ দেয় বাংলাদেশের সেরা বেইজ গিটারিস্ট সুমন (অর্থহীন) ও অন্যতম প্রতিভাবান লিড গিটারিস্ট ইকবাল আসিফ জুয়েল (লিজেন্ড) । এই অ্যালবাম এ ‘অসামাজিক’ ‘নেই প্রয়োজন’ ‘বন্ধু’ অশনি সংকেত ‘’ ‘ধুসর মানচিত্র’ ‘প্রতিচ্ছবি (সুমন)’ ‘মহানগর’ ও ‘ এমন দিনে’ গানগুলো তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষ করে ‘অসামাজিক’ ‘নেই প্রয়োজন’ ‘ধুসর মানচিত্র’ ‘’ এমন দিনে’ গানগুলো আমাদের বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতে স্থায়ী আসন নিয়ে নিয়েছে। এই অ্যালবাম এর পরপরই ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারনে মূল ভোকাল সাঞ্জয় ব্যান্ড ছেড়ে চলে যায় যা ছিল শুধু ওয়ারফেইজ এর জন্য নয় পুরো ব্যান্ড সঙ্গীত ও শ্রোতাদের জন্য বিরাট একটি ধাক্কা। এই অ্যালবাম এর একটি চমৎকার ব্যাপার ছিল যে কমল, সুমন ও জুয়েল এর একসাথে চমৎকার দুর্দান্ত পারফর্ম। যা শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। এতো সুন্দর গিটার ও ড্রামের সংমিশ্রণ এখনকার অনেক হার্ডরক ব্যান্ড গুলো করতে পারেনি। এটাই ওয়ারফেইজ কে অন্য সব হার্ড রক ব্যান্ড এর কাছ থেকে আলাদা করে রেখেছে। যে দলে আছে বাংলাদেশ এর শ্রেষ্ঠ এক ড্রামার (টিপু) ও বাংলাদেশ এর শ্রেষ্ঠ একজন গিটারিস্ট (কমল) তাঁরা তো সবার আলাদা হবেই এটাই স্বাভাবিক। ওরাফেইজ এর সবচেয়ে মূল শক্তি তাদের অসাধারণ সব কম্পোজিশন। তাঁরা খুব ভাল করেই জানে যে কোন কথার গানে কেমন কম্পোজিশন করতে হবে। এরপর হলো গানের কথার গভীরতা। যার কারনে এতো ভাঙ্গাগড়ার মাঝেও ওয়ারফেইজ আজো সবার সেরা। অন্য সব হার্ডরক ব্যান্ড গুলোর অনুপ্রেরণা।
আজো বাংলাদেশের বিশ্বমানের হার্ডরক ব্যান্ড বলতে সবাই যে নামটি উচ্চারন করবে তা হলো ওয়ারফেইজ ও সাঞ্জয়। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে একটি হার্ডরক ব্যান্ড এর প্রায় ৩ দশক টিকে থাকা ওয়ারফেইজ এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করে। এই রেকর্ড অন্য কোন হার্ড রক ব্যান্ড ভাঙতে পারবে বলে আমি ব্যক্তিগত ভাবে বিশ্বাস করি না। বাংলাদেশ এর হার্ডরক ব্যান্ড এর ইতিহাসে ওয়ারফেইজ কে ১ নং আসন থেকে সরিয়ে ফেলা কোনদিন সম্ভব নয়।
১৯৯৮ সালের ‘অসামাজিক’ অ্যালবাম দিয়ে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেন অদ্ভুত সুন্দর ও রকগানের সর্বসেরা শিল্পী সাঞ্জয়। সাঞ্জয় এর চলে যাওয়া আমাদের মতো হতভাগা শ্রোতাদের জন্য ছিল এক বিরাট ধাক্কা ও ক্ষতি। যে ক্ষতি আমরা আজো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সাঞ্জয়, সুমন, জুয়েল, ফুয়াদ চলে যাবার পর ওয়ারফেইজ এ বিরাট এক শুন্যতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু দলনেতা কমল এর আন্তরিক চেষ্টায় ও টিপুর পরিশ্রম ফলে তা কাটিয়ে উঠে। মাঝে কিছুদিন পেনটাগন এর রুমেল অতিথি গিটারিস্ট হিসেবে বিভিন্ন শোতে অংশগ্রহন করে। তখন ব্যান্ড এ যোগ দেয় কীবোর্ডিসট –শামস, গিটার ও ভোকাল- বালাম (বাবনার মামাতো ভাই) , বেজ গিটার – বিজু, ভোকাল- মিজান । আর পুরনো দুই যোদ্ধা কমল ও টিপু তো আছেনই। এই লাইনআপ নিয়ে ২০০১ সালের কুরবানির ঈদে মুক্তি পায় ‘আলো’ অ্যালবামটি। যেটার কভার ছিল খুব চমৎকার। নতুন এই লাইনআপ নিয়েও ‘আলো’ অ্যালবাম বাজারে শ্রোতাদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। বলা যায় ‘আলো’ ওয়ারফেইজ এর আরেকটি সফল অ্যালবাম। যেখানে শুরুতেই মিজান এর ‘হতাশা’ গানটি দিয়ে শুরু করেই বালাম এর ‘যত দুরেই থাকো’ গানটি শুনে শ্রোতারা চমকে উঠে। বালাম এর আগেও তার ব্যান্ড নিয়ে থাকলেও মুলত ‘আলো’ অ্যালবাম দিয়ে এই দশকের শ্রোতারা সহ পুরনো শ্রোতাদের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা পায়। ‘আলো’ অ্যালবাম এ শ্রোতারা সঞ্জয় এর ঝাঁঝালো বারুদ না পেলেও বেশ কয়েকটি চমৎকার গান পায়। যার কারনে ‘আলো’ অ্যালবামটি ব্যবসাসফল হয়। এই অ্যালবাম এর সবচেয়ে আলোচিত ও জনপ্রিয় গানটির নাম ‘বেওয়ারিশ’ যা মিজান কে বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়। এছাড়াও বালাম এর ‘ সেই সৃতিগুলো’ , ‘সময়ের ছলনায়’ ‘ মিজান এর ‘আলো’, ‘বৃষ্টি’, গানগুলোও বেশ চমৎকার ও শ্রোতাপ্রিয় হয়। এই অ্যালবাম এর হিট গান এর সংখ্যা ৮টি। গানগুলো। যা এই অ্যালবামটিকে সাঞ্জয় ও বাবনার পরবর্তী যুগের সবচেয়ে ব্যাবসাসফল অ্যালবাম বলা হয়। এই অ্যালবাম টি উৎসর্গ করা হয় অ্যালবাম এর কাজ চলাকালীন সময়ে প্রিয় কমল ভাইয়ের আপন ছোট ভাই কনক আমেরিকার এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় তাকে।
এই অ্যালবাম এ হার্ডরক এর পাশাপাশি বেশকিছু সফট রক ও মেলোডি গান ছিল যা সত্যিই চমৎকার। আর সব গানেই অসাধারণ কমল ভাইয়ের গীটারের কথা নাইবা বললাম।
‘আলো’ অ্যালবাম এর পর ভোকাল মিজান এর সাথে অন্য সদস্যদের বনিবনা না হওয়ায় মিজান ব্যান্ড ছেড়ে চলে যায়। তখন মূল ভোকাল হিসেবে বালাম ব্যান্ড এর দায়িত্ব নেয়। বালাম কে মূল ভোকাল করেই ২০০৩ সালে বের হয় ওয়ারফেইজ এর অ্যালবাম ‘মহারাজ’ যার অ্যালবাম এর কভার সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে । তবুও ‘আলো’র মত এই অ্যালবাম এতো ব্যবসাসফল হয়নি। মহারাজ অ্যালবাম এর ‘মহারাজ’ গানটি ওয়ারফেইজ এর এই দশকের একটি জনপ্রিয় ও সফল গান। যা সব কনসার্টে ওয়ারফেইজ কে বসে আছি, একটি ছেলে’র মত নিয়মিত এখনও গাইতেই হয়। মহারাজ অ্যালবাম এর অন্য গানগুলো ছিল ‘বাঙ্গালিরা আর কত দেখবে’ ‘যে পথে সুখ তুমি খুঁজেছ’ ‘সন্ধ্যার আলো ‘ সহ আরও কিছু গান । মহারাজ অ্যালবাম এ শ্রোতারা বালাম এর হার্ডরক গানে বেশ পারদর্শীতা আছে তা বুঝতে পারে। মহারাজ অ্যালবাম এর পর বালাম দল ছেড়ে একক অ্যালবাম নিয়ে নিজেকে গড়তে যায়। অথচ আজকের এই বালাম এর জনপ্রিয়তার পেছনে ওয়ারফেইজ এর অবদান সবচেয়ে বেশি। বালাম কিশোর বেলা থেকে গান করলেও তাকে শ্রোতারা ওয়ারফেইজ এর মাধ্যমেই বেশি গ্রহন করে নেয়। যা তার পরবর্তী একক অ্যালবাম এর সফলতার পেছনেও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এখনও শ্রোতারা বালাম কে ওয়ারফেইজ এর বালাম হিসেবে সহজে চিনে নেয়।
বর্তমানে ওয়ারফেইজ এ আবার মিজান ফিরে এসেছে এবং মূল ভোকাল এর দায়িত্ব পালন করছে। গত রোজার ঈদে (২০১১) মিক্সড অ্যালবাম সমর্পণে ওয়ারফেইজ লালনের তিনটা চমৎকার গান অতি চমৎকার ভাবে পরিবেশন করে। সমর্পণ অ্যালবাম এ মুলত ওয়ারফেইজ এর সবগুলি গানেই একমাত্র দুর্দান্ত হয়েছে যা তাদের শ্রেষ্ঠত্ব আবারো প্রমান করলো।
সবশেষে শুধু এইটুকু বলবো আমাদের দক্ষিন এশিয়া তথা এশিয়ার সেরা একটি ব্যান্ড হলো 'ওয়ারফেইজ'। ইউরোপ, আমেরিকার বিখ্যাত সব ব্যান্ডের সাথে যাদের তুলনা করা যায় তাঁর নাম 'ওয়ারফেইজ'। 'ওয়ারফেইজ' বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের একটি গর্ব এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

ওয়ারফেইজ এর অ্যালবামগুলি -
ওয়ারফেইজ (সেলফ টাইটেল ১৯৯১)
অবাক ভালোবাসা (১৯৯৪)
জীবনধারা (১৯৯৬)
অসামাজিক (১৯৯৮)
ধুন (ব্যান্ড মিক্সড ১৯৯৬)
আলো (২০০০)
মহারাজ (২০০৩)
পথ চলা (আনপ্লাগড ২০০৯)
সমর্পণ (ব্যান্ড মিক্সড ২০১১)
চলবে.........

পরিশেষে সবার কাছে একটি বিশেষ আবেদন জানিয়ে আজকের মতো বিদায় নিলাম।


সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১২ রাত ১১:২৫
২০টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×