রেহানা ঘরের ভিতর পাগলের মত দৌড়াদৌড়ি করছে। তার চুলগুলো এলোমেলো, শরীরের কাপড় ঠিক নেই, তার ২ বৎসরের শিশু পুত্রের মুখের দিকে তাকাচ্ছে আর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছে, এখনতো কান্নার সময় নয়? সে ঘরের দরজা খোলার চেষ্টা করছে কিন্তু দরজা বাহির থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সে শরীরে যত শক্তি আছে তা দিয়ে চেষ্টা করছে ঘরের কাঠগুলো ভেঙ্গে ফেলতে কিন্তু পারছে না, একে তো নারী জাতি তার উপর কয়েকদিন ধরে অনাহারে রয়েছে, ক্ষিদের জ্বালায় সে অনেক দূর্বল হয়ে পড়েছে। বুকের দুধ পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে, বাচ্চাটাকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারছে না, দুধের বদলে বাচ্চাটাকে ২ দিন ধরে পানি পান করিয়ে বাচিয়ে রেখেছে। বাচ্চাটাও দূর্বল হয়ে পড়েছে। রেহানা চিৎকার করছে, চিৎকার করছে বাচার জন্য। কিন্তু কেউ কি তার চিৎকার শুনতে পাচ্ছে? মনে তো হয়না। আগুনের লেলিহান শিখা তার বাড়ীর চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে, সে তার শিশু পুত্রকে নিয় আগুনের মাঝখানে পড়ে গেছে, তার পাশের রুমে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে, ঘরের লেপ তোষকের সাহচার্যে আগুনের তীব্রতা বহুগুন বেড়ে গেছে। রেহানার শরীরে আগুনের তাপ স্পর্শ করছে, সে তার শিশু পুত্রকে বুকে জড়িয়ে ধরে আছে, সে কান্না ভুলে গেছে, ভুলে গেছে সকল দুঃখ বেদনা। ঘরের দরজায় খিল দেওয়া, বের হওয়ার রাস্তা বন্ধ। ঘরের দরজায় খিল দিল কে?

বাবা মায়ের অতি আদরের মেয়ে রেহানা, রেহানা দেখতে যেমন ছিল সুন্দরী, তেমনি ছিল গুনবতী। সারাদিন মায়ের আশপাশে ঘুরঘুর করতো আর বলতো মা তুমি ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও, আমি তোমার কাজ করে দিচ্ছি, তুমি তো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, মা বলতেন আরে পাগলী মেয়ে, কোথায় দেখলি আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, আমাকে কাজ করতে দে, তুই গিয়ে খেলাধুলা কর, রেহানা নাছোড়াবান্দার মত বলতো, না আমি তোমার সাথে কাজ করবো। আমার খেলাধুলা ভাল লাগে না। এভাবে সে সারাদিন মায়ের কাজে সাহায্য করতো। মা রেহানার পাগলামীতে রাগ করার চেষ্টা করতো কিন্তু পারতো না। মা বলতেন পাগলী মেয়ে আমি যখন থাকবো না, তখন তোর কি হবে, রেহানা মাকে জড়িয়ে ধরে বলত, তুমি আমাকে ছেড়ে কোথায় যাবে, যেদিকে যাও আমাকে সাথে করে নিয়ে যেও। মা মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করে, হে আল্লাহ আমার মেয়েকে তুমি দেখে রেখ। এভাবে একদিন যায় দুদিন যায় বছর ঘুরে বছর চলে যায়। একদিন রেহানার মা কাউকে কিছু না বলে চলে যায় না ফেরার দেশে, যেখানে গেলে কেউ আর ফিরে আসে না। রেহানা একা হয়ে যায়। এখন রেহানাকে কেউ খাবারের জন্য ডাকে না, জোর করে গোসল করিয়ে দেয় না, রান্নাঘরে তাকে এখন ভাজা মাছ খেতে ডাকে না। রেহানা সারাদিন মায়ের কবরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো।
রেহানার বাবা কিছুদিন পর আরেকটি বিয়ে করে নতুন বউ ঘরে নিয়ে আসে। কিন্তু রেহানাকে সে নতুন মা দেখতে পারে না, সারাদিন উঠতে বসতে গালাগালি আর মারধর করতো। তার বাবা সব কিছু দেখেও না দেখার ভান করতো। পাড়া প্রতিবেশিরা বলতো মা মরে গেলে বাবা হয় তালই, রেহানার বাবা আজ রেহানার তালই। রেহানার আগের সে চঞ্চলতা নেই, নেই তার সারা বাড়ীতে ছুটাছুটি। সারাদিন মনমরা হয়ে পড়ে থাকে, তার কিছুতে আর ভাল লাগে না। ভাল লাগেনা আর কোন কাজ করতে, যে কাজে আনন্দ নেই সে কাজ কিভাবে তার ভাল লাগবে। যখন মা বেচে ছিল তখন সারাদিন মায়ের সাথে কাজ করে রেহানার এতটুকুও ক্লান্তি অনুভব হতো না। কিন্তু সে এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারে না, ক্লান্তিতে তারা সারা শরীর ভেঙ্গে গেছে। তার খাওয়া দাওয়ার কোন ঠিক ঠিকানা নেই, তার নতুন মা ঠিকমত মত খেতে দেয় না। একদিন তার বাবা কোন কিছু না জানিয়ে রেহানাকে হঠাৎ করে বিয়ে দিয়ে দেয়। রেহানা অবাক হয়, তাকে কিছু না জানিয়ে তার বাবা তাকে এভাবে না দেখে, না শুনে একটি ছেলের হাতে তুলে দিচ্ছে, ছেলে ভাল না মন্দ সেটার কোন খবর রাখার প্রয়োজন অনুভব করলো না। রেহানার পিতাও যেন রেহানাকে বিয়ে দিতে পেরে হাফ ছেড়ে বাচলো।
রেহানার নতুন সংসার, নতুন জীবন, নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন। বেচে থাকার স্বপ্ন, নিজের একটি জগৎ তৈরী করার স্বপ্ন। স্বামীর আদর-সোহাগ পাওয়ার স্বপ্ন তাকে নতুন করে বাচার প্রেরণা যোগায়। স্বামী, শ্বশুড়-শ্বাশুড়ী, ননদ-দেবর তাকে খুব ভালবাসে। রেহানার ভিতর আবার সেই চঞ্চলতা ফিরে আসে, বেচে থাকার স্বার্থকতা বুঝতে পারে। এভাবে কিছুদিন পেরিয়ে যায়। একদিন রেহানার স্বামী বলে, রেহানা তুমি তোমার বাপের বাড়ী থেকে আমাকে ৫০ হাজার টাকা এনে দাও, আমি ব্যবসা করবো। এখন মনে কর নতুন ফলের সিজন, এই সিজনে ফল বিক্রি করতে পারলে মেলা টাকা আসবো। তখন আমাদের সংসারটা আরও একটু গুছিয়ে নিতে পারবো, আমাদের ঘরের পুরোনো টিনগুলো পাল্টিয়ে নতুন টিন লাগাতে পারবো, তুমিতো দেখতেই পারছো, ঘরের টিন জায়গা জায়গায় ছিদ্র হয়ে গেছে, বৃষ্টির দিনে সেখানে চুয়ে চুয়ে পানি পড়ে। ঘরের পিছনে পুকুরটা একটু বড় এবং চওড়া করতে হবে, সেখানকার পানি নোংরা এবং ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। সে পানি ব্যবহার করা যায় না পুকুরটা যদি আর একটু বড় করা যায় তাহলে পানি সবসময় পরিস্কার থাকবে। আমাদের বাড়ীতে একটা নতুন টিউবওয়েল লাগাতে হবে, তুমিতো পরের বাড়ী থেকে কলস ভরে পানি নিয়ে আসো, তোমার যেমন কষ্ট হয়ে যায় তার উপরে সে বাড়ীর মানুষের মুখ চোখও কালো হয়ে যায়। আমাদের পুকুরটা বড় হলে, নতুন একটা টিউবওয়েল হলে, ঘরের পুরাতন টিনগুলো বদলে নতুন টিন লাগালে একটু স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করতে পারবো। আর ব্যবসাটা ঠিকমত করলে আমারও পরিশ্রম অনেক কম হবে। রেহানা তার স্বামীর কথা শুনে কিছুটা ঘাবড়ে যায়, সে এত টাকা কোথা থেকে আনবে, তার বাবা তো তাকে টাকা দিবে না। তার বাবাও তো গরীব মানুষ, তার তেমন একটা জায়গা জমি নাই, পরের জমিতে বর্গা খাটে, তার উপরে ঘরে সৎমা। রেহানার বুক এক অজানা আতঙ্কে কেপে উঠে। সে এত টাকা কিভাবে তার বাবার কাছ থেকে নিয়ে আসবে। সে তার স্বামীকে হাসিমুখে বলে, বুঝলাম আপনার কথা, আপনার কথায় যুক্তি আছে, আমাদের সংসারে ওসব জিনিস খুবই প্রয়োজনীয়। কিন্তু আপনি একটু চিন্তা করে দেখেন, আমার বাবা এত টাকা কোথা থেকে দিবেন। শুনেছি আমাদের বিয়ের সময় আমার বাবা আপনাকে ৫০ হাজার টাকা নগদ দিয়েছিলেন। সে টাকা থেকেই তো আপনি ব্যবসা করতে পারেন। আমার বাবা কি আমাকে চাওয়া মাত্রই টাকা দিবে। রেহানার স্বামী এবার একটু কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলো, অত কিছু আমি জানি না, তোমাকে যা বলেছি তুমি তাই করবে। আমার ৫০ হাজার টাকা চাই, এই টাকা না পেলে আমার মাথা ঠিক থাকবে না। তুমি আগামীকাল তোমার বাবার বাড়ীতে যাবে এবং ৫০ হাজার টাকা নিয়ে বাড়ীতে ফিরে আসবে। রেহানার তার স্বামীকে বুঝাতে গিয়ে তার রুদ্রমূর্তি দেখে ভয়ে আর কোন কথা বলে না। কিন্তু পরেরদিন রেহানা বাপের বাড়ীতে যাইনি দেখে স্বামী, শ্বাশুড়ী-ননদ মিলে তাকে চুল ধরে মেঝেতে ফেলে দেয় এবং যে যেভাবে পারে তাকে মারতে থাকে। মাইরের চোটে রেহানার নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে যায়, সে চিৎকার করে বললো আমাকে আপনারা মারবেন না, আমার মা বেচে নেই, আমি এতিম একটি মেয়ে, আপনারা আমার উপর এমন জুলুম করলে আমি যাবো কই, দোহাই লাগে আমাকে মারবেন না। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, আমার গলা শুকিয়ে আসছে, আমাকে মারবেন না। আমি সহ্য করতে পারছি না কিন্তু রেহানার কথা তাদের মন গলাতে পারে না, তাদের উপর মনে হয় ভুতে আছর করেছে, নইলে রেহানাকে এত নির্মমভাবে পিটানোর পর রেহানার অনুনয় বিনয় সত্ত্বেও তাদের মনের ভেতর কোন দয়া মায়ার উদ্রেক হয়না। রেহানার তার স্বামীর পায়ের উপর আছড়ে পড়ে বলতে লাগলো ওগো শুনেন আপনি আমাকে আর মারবেন না, আপনি আমার স্বামী, আপনি আমার মাথার তাজ, আমি কখনো আপনার অবাধ্য হইনি, আপনার সাথে কোনদিন মুখে মুখে তর্ক করিনি। দয়া করে আপনি আমাকে মারবেন না, আপনি ছাড়া পৃথিবীতে আমার আর কেউ নাই। কিন্তু তার পাষণ্ড স্বামী তাকে লাথি মেরে মেঝেতে ফেলে দেয়। এক সময় পাড়া প্রতিবেশীরা দৌড়ে এসে রেহানাকে উদ্ধার করে কিন্তু ততক্ষণে রেহানা জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে আছে।
পরদিন রেহানার তার বাবার বাড়ীতে ফিরে আসে, সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য তার বাবার কাছে টাকা চায়। তার বাবা বলে মা, আমি তোকে এত টাকা কোথা থেকে দিব, তোর বিয়ের সময় মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে টাকা ঋণ করে দিয়েছি, সে টাকা এখনও শোধ দিতে পারিনি, সে টাকার সুদের জন্য আমাকে প্রতিনিয়ত হেনস্তা হতে হয়। এখন আমি তোকে এত টাকা কোথা থেকে যোগাড় করে দেব। তুই তোর স্বামীরে বুঝিয়ে বল। রেহানা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাবাকে বলে, বাবা আমি তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু সে আমার কোন কথা শুনতে নারাজ। আমাকে বলে দিয়েছে টাকা ছাড়া তার বাড়ীতে ফিরে যেতে পারবো না। যদি আমি খালি হাতে ফিরে যাই, তাহলে সে আমাকে বাড়ীতে ঢুকতে দিবে না। তুমিই বলো আমি এখন কি করব। আমি তো তোমার মেয়ে, তোমার মেয়ের জন্য কিছু একটা কর বাবা, আজ যদি আমার মা বেচে থাকতো তাহলে তুমি কি তোমার মেয়েকে অবহেলা করতে পারতে। তুমি না বুঝে, না শুনে আমাকে বিয়ে দিয়েছো। এখন অত্যাচার হলে আমার উপর হয় বাবা, ব্যথা পেলে আমি পাই, সারাদিন মানসিক অশান্তিতে থাকি। আমার কাছে এত অত্যাচার, এত লাঞ্চলা, গঞ্জনা সহ্য হয়না। তাদের কথার মাঝে হঠাৎ রেহানার সৎমা এসে খুবই কর্কশ কণ্ঠে বলে, তোকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি, আমাদের দায়িত্ব শেষ। তুই কেন এখন আবার এখানে এসেছিস, তোর বাবা টাকা কোথা থেকে দিবে, আমরা কি টাকার গাছ লাগিয়েছি যে, চাওয়া মাত্রই দিয়ে দিব। বিদেয় হও আমাদের বাড়ী থেকে, মরলে তুমি মরবে তাতে আমাদের কি। তার বাবা তার সৎমাকে মৃদু ধমক দিয়ে থামাতে চায় কিন্তু সে ধমকের ভিতরে কোন তেজ নেই। তার সৎমা উল্টো তার বাবাকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। রেহানার বাবা তার ২য় স্ত্রীর কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে। মেয়ের জন্য দরদ লাগলেও সে মেয়ের জন্য কিছুই করতে পারবে না। রেহানার বাবা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেদে উঠে বলে “মা, আমি তোর জন্য কিছুই করতে পারলাম না, তোর স্বামী যে একজন জুয়াড়ী সেটা আমি আগে জানতাম না, তোর সৎমার পীড়াপীড়িতে তোকে আমি তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে বাধ্য হই, মা আমার অক্ষমতার জন্য তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি আজ অসহায় হয়ে পড়েছি। তোকে ভাল ছেলের হাতে তুলে দিতে পারলাম না।” এতটুকু বলার পরই তার বাবা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। রেহানার আর্তচিৎকারে আকাশ বাতাস কেপে উঠে।
রেহানা তার শশুরবাড়ীতে অনেক নির্যাতন, অনাদর সহ্য করে টিকে থাকার লড়াই করে যাচ্ছে। এখন রেহানার পেটে তিনবেলা খাবার জুটে না, সারাদিন দাসী বান্ধীর মত খাটে, স্বামীর অত্যাচার, শ্বাশুড়ীর অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে নীরবে চোখের পানি ফেলে সংসারে টিকে আছে। পান থেকে চুন খসলেই শ্বশুড় বাড়ীর নির্মম অত্যাচার নেমে আসে। এভাবে সময় গড়িয়ে যায়, রেহানার কোল আলো করে একটি পুত্র সন্তান আসে। রেহানা কিছুটা সান্তনা খুজে ছেলের মুখের দিকে চেয়ে, তার হাসিমাখা মুখ দেখলে রেহানা সকল দুঃখ কষ্ট ভুলে যায়। কাজের ফাকে ফাকে সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেহানা কিছুটা আত্মতৃ্িপ্ত লাভ করে। একসময় রেহানা জানতে পারে, তার স্বামী আরেকটি বিয়ে করাতে যাচ্ছে। রেহানা অসহায়ত্বের ভেতরেও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। সে এর তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং বলে আমার জীবন থাকতে আমি আপনাকে বিয়ে করতে দেব না। তার স্বামী তার চুলের মুঠি ধরে বলে, তুইতো আমাকে টাকা এনে দিতে পারিস না, তোর এই সংসারে থাকার কোন অধিকার নাই, তুই বের হয়ে যা আমার সংসার থেকে, তুই যদি না যাস তাহলে তোকে গলা টিপে হত্যা করবো। রেহানা তার হুমকিতে বিন্দুমাত্র ভয় পায় না। অত্যাচার, নির্যাতন, মারধর খেতে খেতে রেহানা আজ একটা পাথরে পরিণত হয়েছে। সে কোন অত্যাচার বা হুমকিকে পরোয়া করে না। তার কোল জুড়ে একজন মানিক এসেছে, তার নয়নের মনিকে বুকে নিয়ে সারা জীবন অত্যাচারের মাঝেও বেচে থাকার অনুপ্রেরণা পাচ্ছে। তার আর কোন ভয় নেই।
স্বামীর বাড়ী থেকে তাকে খাবার দাবার বন্ধ করে দিয়েছে। সে এখন সারাদিনে একবেলা খাবারও ঠিকমত খেতে পায়না। ধীরে ধীরে রেহানা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে, তার শরীরের হাড়গোড় গোনা যায়, কংকালের মত তার শরীরের অবস্থা। অথচ তার মা বেচে থাকতে তার সহপাঠীরা তাকে ‘মোটকি রেহানা’ বলে ক্ষেপাতো। সেই রেহানা আজ একটা কংকালে পরিণত হয়েছে। গত ৩দিন ধরে তার শ্বশুড়বাড়ীর লোকজন তাকে মারধর করে ঘরে বন্দি করে রেখেছে। তার বুকের দুধ শুকিয়ে গেছে, তার আদরের সন্তানকে দুধ খাওয়াতে পারছেনা। এরই মাঝে ঘরের চারপাশে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে, আগুনের তীব্রতা বাড়তে থাকে, রেহানা অসহায়র মত চিৎকার করে বলতে থাকে, তোমরা ঘরের দরজা খুলে দাও, আমাকে পুড়িয়ে মারতে চাও, মার আমার কোন দুঃখ নেই কিন্তু আমার সন্তানকে তোমরা মেরো না। আমার সন্তানকে তোমরা বেচে থাকার অধিকার দাও। রেহানার ক্ষীনকণ্ঠের আবেদন কারও কানে পৌছায় না। বাহিরে মানুষের শোরগোল রেহানার কানে ভেসে আছে, অনেকে চিৎকার করে বলছে পানি মার, পানি মার, আগুন খুব ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। যেই যেভাবে পারো পানি মারো, কেউ একজন বলে উঠলো তোরা কে কোথায় আছিস জলদি আয়, ভেতরে রেহানা আর তার শিশুপুত্র আছে তাদের উদ্ধার কর। কিন্তু আগুনের তীব্রতায় কেউ সামনে আসতে সাহস করছে না। রেহানা শক্তিহীন হয়ে পড়ে আছে, সে তার আদরে ধন কলিজার টুকরার চেহারার দিকে তাকিয়ে আছে, সন্তানটি আগুনের তাপে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে, শিশুটি এখন আর কাদতে পারছে না। শুধু একবার তার মায়ের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে চোখ দুটি বুঝে এলো। রেহানা তার মানিককে বুকে জড়িয়ে ধরে মৃদু মৃদু হাসছে, এই হাসির অর্থ কি, কেউ বলতে পারবে না। আগুনের লেলিহান শিখা, সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে, ঘরের কয়েকটি খুটি হেলে পড়েছে, আগুনের একটি ফুলকি ছিটকে এসে রেহানার শাড়ীতে আগুন ধরে যায়, ধীরে ধীরে সেটি সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, রেহানা নির্লিপ্ত, কোন নড়াচড়া নেই শুধু একটুকরো হাসি তার মুখে লেগে আছে, কোন যন্ত্রনা তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। সে শুধু তাকিয়ে আছে উপরের দিকে, সে শেষ মুহূর্তে কি ভাবছে? সেকি তার মাকে দেখতে পাচ্ছে? সে কি আল্লাহর কাছে এই হত্যার বিচার চেয়ে তাকিয়ে আছে উপরে অনেক উপরে, যেখানে গেলে কেউ কখনো ফিরে না।