অপেক্ষা...
চা গবেষণা ইন্সটিটিউট, শ্রীমঙ্গল
১২ নভেম্বর ২০২২, ১১-০২ পূর্বাহ্ন
প্রথম পর্বটি পড়তে পারবেন এখানেঃ শ্রীমঙ্গলে আড়াই দিন - প্রথম পর্ব (ছবি ব্লগ)
পরদিন সকালে রওনা হ’লাম মাধবকুণ্ডের উদ্দেশ্যে। সেখানেও এর আগে কয়েকবার গিয়েছি। কিন্তু এবারে পথ ঘাটের অবস্থা আগের চেয়ে অনেক উন্নত দেখতে পেলাম। মাত্র ছয় মাস আগে প্রয়াত মায়ের কথা মনে পড়ে যাওয়াতে মনটা কিছুক্ষণ ভারাক্রান্ত হয়ে রইলো। আজ থেকে ২২ বছর আগে মাকে এখানে বেড়াতে নিয়ে এসেছিলাম। দিনটা বৃষ্টিস্নাত ছিল, ফলে ভরা প্রপাতের গর্জন বেশ দূর থেকেই শোনা যাচ্ছিল। তখন রাস্তাটা কাঁচা ও পিচ্ছিল ছিল, এখনকার মত কোন রেলিঙও ছিল না। আমার দুই ছেলে ওদের ৭০ বছর বয়স্কা (তখনকার বয়স) দাদীর দুই হাত ধরে অতি ধীরে ধীরে প্রপাত পতনের জায়গাটা পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। মা অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর সে মুগ্ধ মুখটা মনের পর্দায় ভেসে উঠলো!
আগের চেয়ে দর্শনার্থীদের ভিড় এখন অনেক বেশি। বয়সের পার্থক্যের কারণে গ্রুপের সদস্যদের সেখানে পৌঁছাতে সময়েরও তারতম্য ঘটেছিল। কম বয়েসীরা আগে পৌঁছেছিল, বয়স্করা কিছুটা পরে। যাহোক, একসময় সবাই একত্রিত হওয়ার পর সেখানে একটা গ্রুপ-ছবি তোলা হলো। যে যার মত ছবি তোলার পর হাকালুকি হাওড় দেখার উদ্দেশ্যে রওনা হ’লাম। পথিমধ্যে ‘বড়লেখা’য় একটা রেস্টুরেন্টে বসে সবাই লাঞ্চ সেরে নিলাম। আমরা যে চারজন এক টেবিলে বসেছিলাম, আমরা সবাই ছিলাম মাছ-খেকো। অন্যরা কেউ কেউ মুরগি বা অন্য কিছু নিয়েছিলেন। আমাদের চারজনের মধ্যে তিনজন নিলেন বোয়াল মাছ। মাছের বাকি অপশনগুলোর মধ্য থেকে আমি বাছাই করলাম বাইম মাছ ভুনা। ভেবেছিলাম, হাওড় এলাকার কাছাকাছি এ হোটেলের বাইম মাছ নিশ্চয়ই খুব মজা হবে। আর তাছাড়া এ মাছটা বাসায় সাধারণতঃ আনা হয় না। কিন্তু “প্রথমে দর্শনধারী, পরে গুণ বিচারি” বলে কথা। যখন প্লেট দিয়ে গেল, দেখলাম বাইম মাছের পরিমাণটা খুবই অল্প ছিল। ইচ্ছে করলে সেটা বদলে আমিও তখনো বোয়াল মাছ নিতে পারতাম, কিন্তু ইচ্ছে করলো না। যাহোক, ক্ষুধার্ত পেটে ওটুকু দিয়েই যথেষ্ট খেলাম। কিন্তু আমার মাছের প্লেটটার দিকে সহযাত্রী সাজন ইসলাম খেয়াল করেছিলেন। তিনি বললেন, “ভাই, আমাদের বোয়াল মাছের পিসগুলো বেশ বড় ছিল। আপনি একটু টেস্ট করে দেখেন”। এই বলে তিনি তার পিস থেকে একটি অংশ আলাদা করে আমার আপত্তি আমলে না নিয়ে জোর করেই আমার প্লেটে তুলে দিলেন। আমি তার এই সৌহার্দ্যে শুধু মুগ্ধই হ’লাম না, অভিভূতও হ’লাম।
আমরা যখন হাকালুকি হাওড়ে পৌঁছালাম, তখন বেলা পড়ন্ত, চারটের মত বাজে। হাওড় দেখার জন্য বছরের এ সময়টা বেস্ট সময় নয়। মাস দুয়েক আগে আসলে সবচেয়ে ভালো হতো। যাহোক, এ সময়ে যেটা দেখার জিনিস তা হলো সন্ধ্যার প্রাক্কালে দূর দূরান্ত থেকে পাখিদের দল বেঁধে আপন কুলায় ফিরে আসা। সেটা শুরু হবে সূর্যাস্তের ২০-৩০ মিনিট আগে থেকে। আমরা দেখলাম, হাওড়ের জল অনেক দূর পর্যন্ত নেমে গেছে। জল সরে যাওয়া ভূমিতে নতুন ঘাস গজিয়েছে, সেখানে ছেড়ে দেয়া শ’য়ে শ’য়ে গবাদি পশু চড়ে বেড়াচ্ছে, কয়েকটা গরু ঘাস খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে বসে আপন মনে জাবর কেটে চলেছে। তিন/চারজন জেলে তাদের ‘ঘের’ (বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি এক ধরণের ‘বাঁধ’ যা একটা নির্দিষ্ট এলাকা গোল করে ঘিরে ফেলে মাছ আটকানো হয়) রৌদ্রে শুকাতে দিয়ে নিজেরাও ঘাসের উপর শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে। তাদের একজনের নাম বিশ্বম্ভর বিশ্বাস, পাশের গ্রাম ‘কুটাউড়া’য় তার নিবাস। তিনি জানালেন, এ বছরের জন্য ঐ ‘ঘের’গুলোর ব্যবহার শেষ, তাই সেগুলোকে রৌদ্রে শুকিয়ে এবারের মত তুলে রাখবেন। আবার আগামী বছরের বর্ষা মওশুমের প্রাক্কালে নামাবেন। ঘাসের উপরে বিছানো সেই কঞ্চি-বিছানার উপর ক্লান্ত শ্রান্ত আমরা কয়েকজনও শুয়ে পড়ে খানিক জিরিয়ে নিলাম।
রোদের আলো স্তিমিত হওয়া শুরু করলে আমরা নিকটস্থ হাক্কা নামক স্থানে জড়ো হ’লাম, কুলায় প্রত্যাবর্তনরত পাখি দেখার জন্য। সেখানে বনবিভাগের অনেক গাছপালা রয়েছে, দিনশেষে পাখিরা সেখানেই ফিরে আসে। সে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা! ঝাঁকে ঝাঁকে দূর দূরান্ত থেকে পাখির দল আসতে শুরু করলো। তাদের দলের ওড়ার পৃথক পৃথক প্যাটার্ন ছিল। হাজারে হাজারে পাখি দল বেঁধে আসতেই থাকলো, দলপতিরা যে যার দল নিয়ে উড়ে এসে আমাদের মাথার উপর একটা চক্কর দিয়ে তাদের চেনা গাছে বসতে শুরু করলো। প্রথমে আসলো পানকৌড়ির দল। পরে আসলো বকের দল। তার পরে আরও অন্যান্য ছোট ছোট পাখির দল। গাছে বসে তারা সমস্বরে কলতান শুরু করলো। আমার মনে হলো, তারা স্রষ্টার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা সঙ্গীত নিবেদন করছে। ঠিক মাগরিবের আযানের আগে আগে তাদের কলতান বন্ধ হলো। আযান শুনে আমিও একটা স্থানীয় মাসজিদে প্রবেশ করে মাগরিবের নামায পড়ে নিলাম। উল্লেখ্য, পাখিদের গাছগুলোর নীচে দাঁড়িয়ে আমি সেখানে একটা শ্যাওলামাখা খুঁটির উপরে ভেজা দাগের একটা চিহ্ন দেখতে পেলাম, যা ভূমি থেকে অন্ততঃ দশ ফুট উঁচুতে হবে। স্থানীয় কয়েকজন জানালো, ওটা হাওড়ের পানির দাগ। অর্থাৎ কয়েক মাস আগেও এখানে দশ ফুটের মত পানি ছিল।
পরের দিন, অর্থাৎ ফেরার দিন সকালে আমরা গেলাম জেমস ফিনলে চা-বাগান দেখতে। একদিকে চা-বাগান, আরেকদিকে রাবার বাগান। দেখলাম, কয়েকজন নারী ও পুরুষ শ্রমিক রাবার বাগানের গাছ থেকে সংগৃহীত ‘দুধ’ বা ধবধবে সাদা রস (গাছের বাকল ছেঁচে কিংবা গাছে পেরেক ঠুকিয়ে সেই ক্ষত থেকে নিঃসৃত রস) বয়ে এনে সুপারভাইজারকে দেখিয়ে তরল এ্যামোনিয়া মিশিয়ে একটা ট্রেইলারে ঢালছে। গোয়ালারা যে রকম পাত্রে দুধ বহন করে হাটে নিয়ে যায়, ওদের পাত্রগুলোও দেখতে ঠিক সে রকম ছিল। তাই আমাদের অনেকে প্রথমে রাবারের রসকে দুধ বলে ভেবেছিল। এটাই ছিল আমাদের সফরের শেষ ইভেন্ট, তাই এখানেও একটা গ্রুপ-ছবি তোলা হলো। অনেকে যে যার মত পৃথক ছবিও তুললেন। সেখানকার ঝুলন্ত সেতু থেকে দু’পাশের ছড়ার দিকে তাকিয়ে আমার তরুণ বয়সের কথা মনে পড়ে গেল। আজ থেকে ৪৭ বছর আগে ভানুগাছ-শ্রীমঙ্গল এলাকার বন-জঙ্গলে কয়েকটা দিন জীবনের এক কঠিন সময় পার করেছিলাম। মনে পড়ে ভাদ্র মাসের এক ভ্যাপসা দিনে এমন কিছু ছোট ছোট ছড়া থেকে অঞ্জলি ভরে ভরে শীতল পানি তুলে পান করে প্রাণ জুড়িয়েছিলাম। গরমে পাগল হয়ে পরিধেয় বস্ত্রসহ শীতল ছড়ার উপর শুয়ে থেকে শরীর জুড়িয়েছিলাম। এখনকার চেয়ে তখন ভানুগাছ ও শ্রীমঙ্গল বনাঞ্চল অনেক বেশি ঘন ও গভীর ছিল। দিনের বেলায়ও অন্ধকার লাগতো। পথ হারানোর ভয়ে আমরা দূর থেকে ভানুগাছ-শ্রীমঙ্গল রেললাইনকে চোখে চোখে রেখে আমাদের দিক-নির্দেশনা ঠিক রাখতাম।
ফেরার দিনের ট্রেনের টিকেট ক্রয় করতে আমরা বেশ অসুবিধায় পড়েছিলাম। মাত্র চারটা উচ্চশ্রেণীর টিকেট পাওয়া গিয়েছিল। তাই সবার কথা ভেবে সেগুলো ফেরত দিয়ে অনেক কষ্টে একসাথে দশটা ‘শোভনচেয়ার’ এর টিকেট সংগ্রহ করা হয়েছিল। এটা করতে গিয়ে আগের রাতে শ্রীমঙ্গল স্টেশন মাস্টারের বাসায় গিয়ে (তার সাথে সফরসঙ্গী একজনের পরিচিতির সূত্র ধরে) তার শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। তিনি রাতের বেলায় স্টেশনে এসে সাধ্যমত চেষ্টা করে দশটি টিকেটের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। পরের দিন আমরা আর্লী লাঞ্চ সেরে বেলা একটায় শ্রীমঙ্গল স্টেশনে এসে পৌঁছ্লাম। ‘জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস’ নির্ধারিত সময়ের ৩০ মিনিট বিলম্বে প্ল্যাটফর্মে এসে গেলে আমরা তড়িঘড়ি করে ট্রেনে উঠে আসন গ্রহণ করলাম। স্থানীয় দু’জন সদস্য, শামীম এবং অন্তু আমাদেরকে বিদায় জানাতে এবং সাহায্য সহযোগিতা করতে স্টেশনে এসেছিল। তাড়াহুড়া করে ট্রেনে ওঠার কারণে এই দুইজন সহৃদয় ব্যক্তিকে ঠিকমত ধন্যবাদটুকুও জানাতে পারলাম না। বিমানবন্দর রেল স্টেশনে ট্রেন এক ঘণ্টা বিলম্বে পৌঁছলো। রাত আটটায় বাসায় এসে পৌঁছলাম, পেছনে রেখে এলাম আড়াই দিনের অনেক স্মৃতির পসরা।
ঢাকা
১৬ নভেম্বর ২০২২
জলকেলীরত রাজহংসী
ব্র্যাক লার্নিং সেন্টার ( সংক্ষেপে BLC, যেখানে আমরা দু'রাত থেকেছিলাম ) এর জলাশয়ে
সকাল ৮-৪৮, ১১ নভেম্বর ২০২২
মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত
১১ নভেম্বর ২০২২, সকাল ০৯-২৬
বাল্যবন্ধু ডাঃ আনিসুর রহমান (এনডক্রিনোলজিস্ট, অবসরে যাবার আগে বারডেমে ছিলেন), যার সাথে জীবনের অনেকটা পথ একসাথে হেঁটেছি। আজ থেকে ৫৫ বছর আগে থেকে স্কুল জীবনের সাথী।
মাধবকুণ্ড, মৌলভীবাজার
১১ নভেম্বর ২০২২
হাকালুকি হাওড়ের 'কুটাউড়া' গ্রামের জেলে, বিশ্বম্ভর বিশ্বাস এর সাথে
১১ নভেম্বর ২০২২
সকালে তোলা পেছনের ব্যালকনি থেকে পশ্চিম দিকের একটি ছবি, অষ্টাদশীর চাঁদ তখনো দৃশ্যমান
সকাল ৬-২৬, ১২ নভেম্বর ২০২২
কালীঘাটের কাছে একটি ছড়া, একটি বেইলী ব্রীজে দাঁড়িয়ে তোলা
শ্রীমঙ্গল, ১২ নভেম্বর ২০২২
এবারে ব্রীজের অপর পার্শ্ব থেকে তোলা একই জায়গার ছবি
শ্রীমঙ্গল, ১২ নভেম্বর ২০২২
সেই "কালীঘাট সীমান্ত ফাঁড়ি বেইলী ব্রিজ" এ দাঁড়িয়ে....
১২ নভেম্বর ২০২২
জেমস ফিনলে চা বাগানে
১২ নভেম্বর ২০২২
শ্রীমঙ্গল থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে...
১২ নভেম্বর ২০২২, ০১-০৯, মধ্যাহ্ন
ট্রেন ছাড়ার দশ মিনিট পরে তোলা শ্রীমঙ্গলের একটি গ্রামের ছবি। বনের ভেতরে ঢুকে যাওয়া এরকম সরু পথ দেখতে আমার ভালো লাগে।
শ্রীমঙ্গল, ১২ নভেম্বর ২০২২, ০২-১২, মধ্যাহ্ন
ট্রেন থেকে তোলা গ্রাম বাংলার ছবি
শ্রীমঙ্গল, ১২ নভেম্বর ২০২২, ০৩-৩১, অপরাহ্ন
ট্রেন থেকে তোলা গ্রাম বাংলার ছবি
শ্রীমঙ্গল, ১২ নভেম্বর ২০২২, ০৩-৪০, অপরাহ্ন
পথের পাশে গাছের সারি। হেমন্তের ধানের ক্ষেতে সোনালী রোদ আর গাছের ছায়া।
ট্রেন থেকে তোলা গ্রাম বাংলার ছবি।
শ্রীমঙ্গল, ১২ নভেম্বর ২০২২, ০৩-৪৩, অপরাহ্ন
চা গবেষণা ইন্সটিটিউট, শ্রীমঙ্গল
১২ নভেম্বর ২০২২, ১১-০৯ পূর্বাহ্ন
ট্রেন থেকে তোলা চা বাগানের ছবি
শ্রীমঙ্গল, ১২ নভেম্বর ২০২২, ০২-৩০, মধ্যাহ্ন
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:১৩