আগামীকাল জেদ্দার উদ্দেশ্যে রওনা দিবো তাই আজ সকালে মক্কার গুরুত্বপুর্ন ধর্মীয় স্থানগুলো জিয়ারত করতে যাবো। এর মাঝে ছিল আরাফাত, মিনা, মুজদালিফা, সাওর বা তোরা পর্বত ও জাবালে নুর পর্বত।
আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল ১২ কিমি দূরে ইসলামের ইতিহাসে বিখ্যাত সেই থর বা তোরা পর্বত। সেখানে পৌছালাম সাড়ে দশটায়, সুর্য্য দিগন্ত ছেড়ে ধীরে ধীরে মাঝ আকাশের দিকে উঠে আসছে সাথে খরতাপও বেড়ে উঠছে। একসাথে দুটো নাপা এক্সট্রা খেয়েও আমার ব্যাথা কমে নাই, সুতরাং এবরো খেবড়ো কঠিন শিলা পাথরে সৃষ্টি অনেক উচু থর পর্বত আমার অধরাই থেকে গেল। আমাদের সাথীদের মাঝে দু একজন অবশ্য গেল। আমি শীতাপনিয়ন্ত্রিত বাসে বসে বসে ভাবছি প্রিয় নবিজী কেমন করে সুচালো কঠিন এই রুক্ষ পাহাড় বেয়ে উঠেছিলেন! মরুর এই তীব্র গরমে গুহার অন্ধকারে পানি আর খাবার ছাড়া তিন দিন তিনি থেকেছিলেন শুধু পৃথিবীতে ইসলামের বানী ছড়িয়ে দেয়ার জন্য।
থর পর্বতে প্রবেশের গেট। সাথীরা জানালেন এর আগে তারা বাসে করে আরও অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলেন। এখন সেই নিয়ম পালটে গেছে, নিজ পায়ে হেটে যেতে হবে অনেকটা পথ।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য এবং সহী হাদীস থেকে জানা যায় যে ইসলাম ধর্ম প্রচার থেকে যখন নবিজীকে কোনভাবেই নিবৃত্ত করতে না পেরে কুরাইশ গোত্রের অন্যতম দলপতি,রাসুলের আপন চাচা আবু লাহাব তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। এছাড়াও ঘোষনা করে জীবিত বা মৃত মোহাম্মদকে ধরতে পারলে পুরস্কার হিসেবে দেয়া হবে ১০০ উট। এমন ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে আল্লাহর নির্দেশে নবিজী সেই রাতেই আবু বকর(রাঃ)কে নিয়ে মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।
চারিদিকে পাহাড় ঘেরা মক্কা শহরটি একটি উপত্যকায়। মদীনাবাসীরা তাকে সাদর আমন্ত্রন জানাচ্ছেন কিন্তু সেই মদীনা শহর তো অনেক দূর। মদীনার পথে যেতে নবিজী প্রথমে ১২ কিলোমিটার দূরে থর বা তোরা পাহাড়ের এক গুহায় আশ্রয় নেন। এদিকে পুরস্কারের লোভে মক্কার মানুষরা হন্যে হয়ে আশেপাশে নবিজীকে তন্ন তন্ন করে খুজতে শুরু করলো। এমনকি একদল সেই গুহার সামনে গিয়েও হাজির হয়। বিভিন্ন তথ্য থেকে শুনেছিলাম সে সময় আল্লাহর ইশারায় গুহার মুখে মাকড়সা জাল বুনে রাখে আর তাতে বন্য কবুতর ডিম পাড়ে। এসব চিনহ দেখে দেখে তারা গুহাটিকে পরিত্যক্ত ভেবে ফিরে আসে।আমাদের এক সাথী বোন ঘটনাটি বলছিলেন যা আমি আপনি সবাই জানেন। কি্ন্ত সেই পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে ঘটনাটি শুনে যে অনুভুতির সৃষ্টি হয়েছিল তা ভাষায় বর্ননা করার মত নয়।
তিন দিন পর নবিজী আবু বকর(রাঃ)কে নিয়ে থর ছেড়ে রাতের আধারে মদীনার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সাত দিন পর তিনি মদীনার কুবা শহরে উপস্থিত হন।আর এখানে কিছুদিন থেকে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন পৃথিবীর প্রথম মসজিদ যার নাম মসজিদে কুবার ভিত্তি প্রস্তর। নবিজীর নিজ হাতে প্রতিষ্টিত পৃথিবীর প্রথম এই মসজিদটি জিয়ারত করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
এই সেই পবিত্র আরাফাতের ময়দান যেখানে লাখো হাজীর লাব্বায়েক লাব্বায়েক আমি হাজির হাজির ধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠে ৯ই জ্বিলহজ্ব ।
এর পরের গন্তব্য ছিল মক্কা থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে জেবেলে রহমতের পাদদেশে বিশাল বিস্তৃত আরাফাতের ময়দান। বলা হয়ে থাকে বেহেশত থেকে বিতাড়িত হয়ে পৃথিবীতে আসার পর এখানেই আদম আঃ বিবি হাওয়ার সাথে মিলিত হয়েছিলেন।এই আরাফাতের ময়দানেই নবিজী বিদায়ী হজ্বের খুতবা পাঠ করেছিলেন, এখানে অবস্থানই হজ্বের অন্যতম ফরজ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন অংশ। এখানে খুতবা পড়া ছাড়াও যোহর ও আসর নামাজ একসাথে পড়তে হয়।৯ই জিলহজ্ব হলো পবিত্র আরাফাতের দিন আর এদিনেই পবিত্র কোরানের সর্বশেষ আয়াত নাজিল হয়েছিল।তাই রাসুল সাঃ বলেছিলেন আরাফাই হজ্ব।বিশাল সেই আরাফাতের ময়দান এখন খালি সবুজ ঘাস আর ছোটখাটো কিছু গাছ দেখা যাচ্ছিল।কিন্ত আর কিছু দিন পর আসন্ন হজ্বের সময় এর চেহারা পালটে যাবে অগনিত হাজীদের পদচারনায় আর বিভিন্ন রকম তাবুতে।
বিখ্যাত মিনা নগরী যেখানে হজ্বের উদ্দেশ্যে আগত হাজীদের ২ রাত থাকতে হয় ।
মন কেমন করা এক অনুভুতি নিয়ে মিনার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এখানে কেউ নামেনি, বাসের জানালা দিয়ে দেখা গেল রাস্তার দুপাশে সুচালো সাদা সাদা তাবু । এখানে হজ্বের সময় হাজীদের দু রাত থাকতে হয়।যোহরের নামাজের সময় হয়ে আসছিল তাই দূর থেকেই দেখলাম মুজদালিফা যেখানে শয়তানকে প্রতিকী পাথর ছুড়ে মারার স্তম্ভ রয়েছে। আসার পথে পরলো সেই পবিত্র পর্বত জেবেলে নুর যার গুহা হেরায় প্রিয় নবীর উপর নাজিল হয়েছিল আমাদের পবিত্রতম ধর্মীয় গ্রন্থ আল কোরান।
বাসের সামনের জানালার কাচ দিয়ে জেবেলে ই নুর যাতে আছে পবিত্র হেরা গুহা
এবার মক্কা ছেড়ে জেদ্দা যাবার পালা,জোহরের নামাজের পর হোটেল রুম থেকে চেক আউট হতে হবে। মনটা অস্থির অস্থির করছে।মনে মনে বলছি আল্লাহ পাক তুমি যদি চাও তবে আমি আবার আসবো। খুড়িয়ে খুড়িয়ে জিনিসপত্র সকালেই স্যুটকেসে গুছিয়ে নিলাম।মক্কা থেকে জেদ্দার দুরত্ব ৬৭ কিলোমিটার কিন্ত সড়ক পথের দুরত্ব ৭৯ কিলোমিটার।বাসে সময় লাগে দুই ঘন্টা।ট্রেনে ৫৫ মিনিট।
জেদ্দার পথে এগিয়ে চলেছি, দুপাশে শোভিত তাল পাম গাছের সা্রি
জেদ্দার পথে চলতে চলতে নজরে এলো এই স্থাপনাটি, গাড়ি চালকের কাছে জানলাম সেটা বিখ্যাত বাবে মক্কা বা মক্কা গেট। এখান দিয়েই জেদ্দা হয়ে আসা হাজীরা মক্কা যান।
জেদ্দায় লোহিত সাগরের তীরবর্তী এক বন্দরের কাছে অভিজাত এক এলাকায় ছিল আমাদের হোটেল, নাম আলহামরা।লেখা ছিল থ্রি স্টার তবে আতিথেয়তা আর রুমের পরিচ্ছন্নতা ও সার্ভিসে তারা ফাইভ স্টারের সামিল।
এখানে এক সময়ে ছিল আমেরিকার ক্কন্স্যুলেট আর এম্বেসী যা ২০০৪ এর ৯ই ডিসেম্বরে তথাকথিত ইসলামী জংগীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। সৌদি সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষের ফলে জংগীরা সহ বেশ কিছু কর্মাচারী নিহত হয়। এরপর সেখান থেকে দুতাবাস সরিয়ে রাজধানী রিয়াদে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে সেখানে সৌদী রাজপরিবারের একটি প্রাসাদও আছে।
আমি অবশ্য রুম থেকে দুদিন সকালে নাস্তার জন্য বের হয়েছি আর একদিন সেখানকার প্রাচীন এবং সেই সাথে বিখ্যাত জনপদ ও শপিং এরিয়া আল বালাদে গিয়েছিলাম।
আল বালাদে রয়েছে প্রবাল পাথর দিয়ে তৈরি ৭ম শতাব্দীতে তৈরি বাড়িঘর, ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান ।পাওয়া যায় বিখ্যাত আরবী আতর, কাপড় চোপড়, স্বর্ন থেকে নানা পন্য। ইদানীং সুউচ্চ আলো ঝলমলে শপিং মলের কাছে অনেকটা শ্রীহীন হয়ে আছে আল বালাদ। আমাদের হোটেলের নিরাপত্তা রক্ষী অনেক নামী দামি শপিং মলে যাবার অনুরোধ করলেও আমরা বেছে নিয়েছিলাম আল বালাদ শুধুমাত্র একটি প্রাচীন জনপদ যার ঐতিহাসিক মুল্য আমার কাছে অপরিসীম।
পবিত্র ওমরাহ পালন শেষে জেদ্দা থেকে দুবাই হয়ে ঢাকার পথে আমাদের বাহন
আল্লাহর অশেষ রহমতে পবিত্র ওমরাহ পালন করে ফিরে আসতে পেরেছি তার জন্য কোটি কোটি বার শুকরিয়া জানাই। আপনাদের কাছে অনুরোধ থাকলো ধর্মীয় ব্যাপারে কোন ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমার চোখে দেখবেন । গত পোস্টেই শেষ করতে চেয়েও পারিনি তার জন্য আন্তরিক দুঃখিত আমি।
প্রথম ছবিটি নেট থেকে, বাকি সব আমার মোবাইলে তোলা ।