সকাল থেকেই তোড়জোর চলছে কারন আজ আমরা নবীজীর প্রান প্রিয় সোনার মদীনা ছেড়ে মক্কা রওনা হবো পবিত্র ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে। মোয়াল্লেম সকালে নাস্তার সময়ই জানিয়েছিলেন আমরা যেন সকাল দশটার মধ্যে রেডি হয়ে লাগেজ নিয়ে লাউঞ্জে বসে থাকি।আমাদের জন্য রিজার্ভ বাস আসবে ঠিক দশটায়, আর সেই বাসে সাড়ে চারশ কিলোমিটার দূরে পবিত্র মক্কা নগরীতে পৌছাতে আমাদের সময় লাগবে পাক্কা সাড়ে চার ঘন্টা। দল নেতা বললেন যেতে যেতে যেহেতু দুপুর হয়ে যাবে তাই আমরা যেন সবাই হাল্কা কিছু খেয়ে নেই। সর্ব ব্যাপারে আমার পাংচুয়াল গৃহকর্তা আমাকে ধমকে টমকে লাগেজপত্র নিয়ে সকাল সাড়ে নটার মধ্যে লাউঞ্জে এনে হাজির হলো। এদিকে আমাদের সহযাত্রী কারো কোনই পাত্তা নেই,নেই মোয়াল্লেমের, এমনকি নেই বাসেরও।
মদীনার হোটেলের লাউঞ্জে মসজিদে নববীর দিক নির্দেশনা
এগারোটায় প্রায় সবাই লাউঞ্জে আসলো জানালো লিফট নাকি প্রচন্ড জ্যাম ছিল ওমরাহ যাত্রী আর তাদের লাগেজে। এদিকে আমরা অপেক্ষা করতে করতে সেই বাস আসলো বিকেল তিনটায়।আমরা নিজেদের লাগেজ চেক করার পর বাসের পেটে চালান করে দিল হোটেলের বেল বয়রা । এজেন্ট ফোনে জানালো বাস সময় মতই রওনা হয়েছিল কিন্ত মসজিদে নববীর চারিদিকে প্রচন্ড জ্যাম থাকায় দেরীর জন্য দুঃখিত। মোয়াল্লেম শুকরান শুকরান বলে বাসে উঠে আমরা সবাই উঠেছি কি না গুনে গেথে ড্রাইভারকে ইশারা করতেই বাস চলা শুরু হলো।সেই অল্প একটু জায়গার যানজট পার হতে সময় গেল ৪০ মিনিট।
মক্কার পথে
আমরা চলছি মক্কার দিকে,এই সেই মক্কা যেখানে রয়েছে কোটি কোটি মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় স্থাপনা কাবাঘর যা স্থানীয়রা বেশিরভাগই হেরেম বা হারাম শরীফ বলে উল্লেখ করে। আমরা হারাম বলতে জানি নিষিদ্ধ কিন্ত আরবী ভাষায় হারাম বা হেরেম অর্থ হলো পবিত্র। কিছুদুর চলার পর একটি মসজিদে বাস থামলো।একে বলে মিকাত মসজিদ যেখানে দু রাকাত নফল নামাজ পরে আমরা ওমরাহর নিয়ত করলাম।আমাদের সাথী ভাইরা সহ অন্যান্য সমস্ত পুরুষরাই ছিল ইহরাম পরা।এখানে নামাজ পরার কারন হলো মক্কার সীমানার বাইরে থেকে আপনাকে ইহরাম পরে পবিত্র হজ্ব বা ওমরাহর জন্য নিয়ত করতে হবে। এজন্যই বাংলাদেশের হাজীরা হজ্বের সময় হাজী ক্যাম্প থেকে ইহরাম পরে যায়। উড়ন্ত অবস্থায় একটি স্থান আছে ইহরাম পরার কিন্ত সেটা সুবিধাজনক নয়।
দ্রুতগামী বাসের আরামদায়ক সীটে বসে জানালা দিয়ে বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখছি। আমাদের দুপাশ ঘেষে বা কখনো কিছু দূরে রুক্ষ পাহাড়ের সারি দল বেধে আমাদের সাথে যেন পবিত্র মক্কা নগরীতে ছুটে চলেছে । সৌদী আরবের ভু প্রকৃতি সম্পর্কে সব সময় শুনি মরুর শহর। কিন্ত মদীনা থেকে মক্কা সেখান থেকে জেদ্দা যেতে আমি তেমন বিশাল বিস্তৃত মরুভুমি দেখিনি । আমি দেখেছি মিশরের মরুভুমি যা সাহারার অংশ, দেখেছি ভারতের রাজস্থানের মরুভুমি যা লাল বালি ময় আর মাইলের পর মাইল বিস্তৃত। কিন্ত এখানে দেখছি সমতলের চেয়ে শক্ত পাথরের পাহাড় ঘেরা এক রুক্ষ কঠিন নগরী। আমাদের বাস সজোরে ছুটে চলেছে মক্কার পানে। মনে মনে বলছি “লাব্বায়েক, লাব্বায়েক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক” হে আল্লাহ আমি হাজির হতে চলেছি তোমার পবিত্র নগরীতে।
এক সময় মানুষ মাসের পর মাস সমুদ্র পথে জাহাজে করে, অথবা ঘোড়ায় চড়ে বা দুর্গম পথ পায়ে হেটে দেশের পর দেশ পাড়ি দিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে আসতো পবিত্র হজ্ব পালন করতে। কত মানুষ পথেই মারা যেত।তাদের গোর দিয়ে বাকি সংগীরা এগিয়ে যেত তাদের লক্ষ্যে। ছুটে আসতো মৃত্যুর আগে একবার পবিত্র কাবাঘর আর নবীজীর রওজা জিয়ারত করতে।
আর এখন আমরা কয়েক ঘন্টায়
ঢাকা থেকে প্লেনে উড়ে এসে নেমেছি মদীয়ায়। এখন যাচ্ছি আরামদায়ক শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাসে। তবে আরও দ্রুত চলার জন্য সৌদি সরকার নির্মান করেছে পৃথিবীর মাঝে পঞ্চম দ্রুতগতির হাইস্পীড বুলেট ট্রেন নাম আল হারামাইন এক্সপ্রেস।মক্কা থেকে মদীনা এই সাড়ে চারশ কিলোমিটার যেতে আলহারামাইন এর লাগে আড়াই ঘন্টা, বাসের লাগে সাড়ে চার ঘন্টা। আল হারামাইন অর্থ দুটি পবিত্র নগরী যা মক্কা আর মদীনাকে বুঝিয়েছে। ভাড়া অনেক বেশি বলে আমাদের অনেক সহযাত্রী রাজী হলো না ট্রেনে যেতে।ব্যাথায় কাতর সাথে প্রচন্ড ক্ষুধার্ত আমি ভাবছি ৪০/৫০ বছর আগেও মানুষ মক্কা মদীনা যাতায়ত করতো উটে চেপে বা হেটে। সময় লাগতো ৫/৬ দিন। এই রাস্তা পাড়ি দিতে হজ্ব যাত্রীদের চার পাচ দিন সময় লাগতো আর তার সাথে তো ছিলই মরুময় রুক্ষ পাথুরে পথের অবর্ননীয় কষ্ট।
রুক্ষ পাহাড়
আস্তে আস্তে রাত ঘনিয়ে আসছে মক্কা এখনো অনেক দূর,রাত যখন আটটা বাজে আমাদের বাস ড্রাইভার তার নির্ধারিত রেস্তোরায় বাস থামালো খাবার জন্য। আমরা খাই না খাই সে তো খাবেই। বাস বন্ধ করে সে চলে গেল কিন্ত মোয়াল্লেম রাজী না আমাদের এখানে খাবার ব্যাপারে। তার কথা হলো খেতে গেলে আমাদের মক্কা যেতে দেরী হবে। আমি ওনার কথা না শুনেই বাস থেকে নেমে এগিয়ে গেলাম সেই জমজমাট রেস্তোরার দিকে যেখানে শত শত মানুষ বসে খাচ্ছে, কেউবা পার্সেল। মোয়াল্লেম যদি প্রথমেই আমাদের বলতো এখানে বিশ মিনিট খাবার বিরতি তাহলে সমস্যার সমাধান। কিন্ত ওনার সিদ্ধান্তহীনতার ফলে ১ ঘন্টা দেরী হলো সেখান থেকে বের হতে। আর তারা স্বামী স্ত্রী শেষ পর্যন্ত যখন খেতে নামলো তখন আমরা বেরিয়ে আসছি খেয়েদেয়ে।
রাত দুটোর সময় ঘুম ঘুম চোখে লাব্বায়েক লাব্বায়েক আওয়াজে উঠে বসলাম । মোয়াল্লেম বল্লো ভাবী ঐ দেখেন ক্লক টাওয়ার যাতে সবুজ সুউচ্চ মিনারে বসানো ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে। তখনো আমরা হেরেম শরীফ থেকে ১৮ কিমি দূরে। চারিদিকে পাহাড় আর টানেল অতিক্রম করে আমাদের বাস ছুটে চলেছে সেই স্তম্ভের দিকে।
মক্কায় আমাদের হোটেলের ৬ তালার জানালা থেকে পাহাড় কেটে বানানো টানেলের ছবি
এক সময় এসে নামলাম এই টাওয়ারের পেছন দিকের পার্কিং এ। আমাদের হোটেল এই টাওয়ারেই নাম সুইসোটেল মক্কা।এখানে মোট ১৫ টা ৫ তারকা হোটেল আছে। আর এই টাওয়ার এত বিশাল বিস্তৃত যে এর মাঝে নাকি তিনটা এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং ঢুকিয়ে রাখা যায়। এসবে আমার কান ছিল না ক্লান্ত পর্যদুস্ত আমি রুম পাওয়ার জন্য বসে আছি লাউঞ্জে। অনেক কায়দা কানুন সেরে আমরা যখন রুমে উঠলাম তখন রাত বাজে সাড়ে তিনটা।আমাদের কথা ছিল রাত আটটার মধ্যে মক্কা পৌছে গেলে সেদিনই আমরা ওমরাহ পালন করবো কিন্ত সকাল থেকে চলার উপর থাকা আমাদের কারও তখন ওমরাহ পালন করার মত শারিরীক অবস্থা ছিল না। পরদিন সকালে আমরা পবিত্র ওমরাহ পালন করতে যাবো এই সিদ্ধান্ত রইলো।
ক্লক টাওয়ার যেহেতু হেরেম শরীফের আংগিনায় অবস্থিত তাই এখানের রুমে বসে নামাজ পরলেও তা হেরেম শরীফে নামাজ পরা হয়ে থাকে বলে গন্য হয়।
আগামীকাল সকালে কাবাঘর তাওয়াফ করবো অর্থাৎ ওমরাহ করবো ভাবতেই একটা অন্যরকম অনুভুতি হচ্ছিল। মক্কার পবিত্র মাটির উপর দন্ডায়মান পৃথিবীর পবিত্রতম ঘর কাবা শরীফ যার পানে ছুটে ছুটে আসে লাখো কোটি মুসলমান আর তার পাশেই আমি ২১ তালার উপর বসে আছি আরামকেদারায়। কেমন যেন ভয় ভয় করছিল কোন বেয়াদবী হবে ভেবে ভেবে ------
চলবে ।
উল্লেখ্য যে মক্কায় এসে বিশেষ করে কাবা শরীফের কোন ছবি তুলতে আমার মন চায় নি।তাই প্রথমটি সহ মোট চারটি ছবি পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে নেট থেকে নেয়া।
পশ্চিমের পথে এক গুনাহগারের পবিত্র ওমরাহ যাত্রা(শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:১৯