সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় পাইটাল নদীর ঘাটে বাঁধা দৃষ্টিনন্দন শিক্ষা তরনী
আমরা সবাই জানি যে কোন জাতির ভাগ্য উন্নয়নে এবং মেধা ও মননের বিকাশে শিক্ষার বিকল্প কিছু নেই। যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত এ কথা প্রাচীন কাল থেকেই স্বীকৃত।বহু প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস খুজে দেখা গেছে যাদের নিজস্ব লিপি ছিল, এবং লিখতে পড়তে জানতো তারা তাদের সমসাময়িকদের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। এটা বর্তমান কালের বেলায়ও প্রযোজ্য।
গ্রামের পথে সার বেঁধে ভোরের বেলায় স্কুলে যাওয়া
আশার কথা এই যে ইদানীং আমাদের দেশের শহর ছাড়িয়ে নিভৃত গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ শিক্ষার মুল্য উপলদ্ধি করতে পেরেছে।তবে অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে আমাদের দেশে আজ পর্যন্ত একটি সার্বজনীন শিক্ষা ব্যাবস্থা চালু হয়নি। বাংলা, ইংরেজী,আরবী ভাষায় আনুষ্ঠানিক, উপআনুষ্ঠানিক ও মাদ্রাসা ইত্যাদি একাধিক পাঠক্র্ম সেই প্রাথমিক স্তর থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত প্রচলিত।
ছোট ছোট ছেলেগুলো মাদ্রাসায় যাচ্ছে
যেমন বিচিত্র আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থা তেমনি আকার, আকৃতি, নির্মান শৈলী, বিভিন্ন উপকরনের ব্যবহারেও বৈচিত্রময় আমাদের বিদ্যালয়। ইট কাঠের দালান থেকে টিন, বাশ, বেড়া, মাটির ঘর ছাড়াও খোলা আকাশের নীচে গাছের তলে স্কুল পরিচালনার করার কথাও আমরা জানি।
অভিনব এই স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের সাথে ব্লগ লেখিকা
তবে এসব কিছু ছাপিয়ে এক অভিনব স্কুলের সাক্ষাৎ মিললো সুনামগঞ্জের হাওড় ভ্রমণে গিয়ে। তাহিরপুর উপজেলার ছোট্ট একটি গ্রাম মুরাদনগরে প্রবেশ করতেই বেশ খানিকটা দূর থেকে নজরে পড়লো নদীর ঘাটে বাঁধা গোলাপী আর নীল রঙে রাঙ্গানো অভুতপুর্ব ডিজাইনে তৈরী এক দৃষ্টি নন্দন জলযান।কাছে এগিয়ে গেলাম দেখি উপরে লেখা আছে শিক্ষাতরী।
শিক্ষাতরী
আমি বিস্ময় প্রকাশ করতেই পাশেই আমাদের জন্য অপেক্ষারত ট্রলারের মাঝি জানালো এটা একটা স্কুল। মাঝির আশ্বাসে আমি লোহার সিড়ি বেয়ে তীরে বাধা সেই তরীতে উঠে আসলাম।একটি মাত্র কক্ষ তাতে মাটিতে মাদুর পেতে দুদিকে সাঁর বেধে বই খাতা সামনে নিয়ে বসা গোটা পনের শিশু শিক্ষার্থী। আমাদের দেখে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম জানিয়ে ভেতরে যাবার জন্য আহবান জানালো।
স্কুলের ক্ষুদে ছাত্র ছাত্রী
একজন মাত্র শিক্ষিকার তত্বাবধানে স্কুলটি পরিচালিত হচ্ছে। আলাপ হলো সেই শিক্ষিকার সাথে।হাওড় অঞ্চলে নৌকা ছাড়া চলাচল করা যায়না এছাড়াও প্রতিটি গ্রামে বিদ্যালয় না থাকায় বিশেষ করে কন্যা শিশুরা লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল।তাদের লেখাপড়ায় অন্তর্ভুক্তির জন্যই বাংলাদেশের বৃহত্তম একটি বেসরকারী সংগঠন শিক্ষাতরীর মাধ্যমে এ সমস্ত অঞ্চলে শিক্ষা কার্যক্রম হাতে নেয়।
কন্যা আর পুত্র সন্তানের প্রতীক গোলাপী আর নীল রঙ্গে রাঙ্গানো ভাসমান স্কুল
সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছাড়া এই শিক্ষাতরীতে প্রতিদিন চার ঘন্টা করে ক্লাশ হয়। শিক্ষার সমস্ত উপকরণ শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয় থেকেই সরবরাহ করা হয় বলে জানালো শিক্ষিকা ।
চার বছরের এই পাঠক্রমটি এমন ভাবে তৈরী করা হয়েছে যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা চার বছর পড়া শেষ করে যে কোন মাধ্যমিক স্কুলে সরাসরি ক্লাস সিক্সে ভর্তি হতে পারে।
পরিস্কার পরিচ্ছন্ন শিক্ষা তরীর ছাত্র ছাত্রী
এই শিক্ষাতরী কর্মসূচী বাংলাদেশের বিস্তীর্ন হাওড় এবং বিল অর্থাৎ চলন বিল এলাকায় শিশুদের শিক্ষার অন্তর্ভুক্তিতে ব্যাপক অবদান রাখছে।
প্রচলিত ধারণা হলো শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে যায়, কিন্ত এখানে বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছে যাচ্ছে যা ঝড়ে পরা এবং শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের শিক্ষা নিশ্চিত করছে, শিক্ষায় আগ্রহী করে তুলছে এবং তাদের জীবনকে আলোকিত করে দেশ গঠনে তাদের অবদানকে নিশ্চিত করছে।
এ ধরণের উদ্যোগ আরো হবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৩৩