কলাতলী মোড়ের শার্ক ফোয়ারা
প্রায় বছরই আমাদের প্রিয় পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজার যাওয়া হয় বেড়ানোর জন্য। কোন এক পোষ্টে বলেছিলাম যে সেখানকার ধুলোবালিও মনে হয় আমাদের পায়ের চিন্হ চিনে ফেলেছে।
কক্সবাজার বিমানবন্দর
কিন্ত এই রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যেও সেই প্রিয় কক্সবাজারে এবার এক জরুরী কারনে যেতে বাধ্য হোলাম। নইলে এ অবস্থায় বেড়ানোর কথা ভাবাও অসম্ভব।
আমাদের বহন করে নিয়ে যাওয়া এয়ারক্র্যাফট
যাই হোক অবরুদ্ধ ঢাকা থেকে ১০ই ডিসেম্বর ইউনাইটেড এয়ারে আমরা তিনজন দুপুর বেলা কক্সবাজার পৌছালাম, সময় লাগলো এক ঘন্টা ।
নীরব জনশূন্য কলাতলী রোড
ব্যাটারির অটো রিকশা করে রওনা হোলাম আমাদের বুকিং দেয়া হোটেলের উদ্দেশ্যে।শহরে ঢুকেই চমকে গেলাম আমার প্রিয় কক্সবাজারের রূপ দেখে। চাঁদের গাড়ী থেকে শুরু করে বিশাল বিশাল শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাস আর ব্যাক্তিগত গাড়ী, অটো রিকশায় যেখানে রাস্তাঘাট জমজমাট।পর্যটকের পদভারে মুখরিত থাকে সমস্ত এলাকা। সেখানে এ কোন শহর ? মনে হলো এক মৃতপুরীতে প্রবেশ।
পর্যটক বিহীন একটি হোটেল যা অন্য বছর থাকে কলকাকলী মুখর
তারকা বিশিষ্ট হোটেল থেকে ছোট বড় সব হোটেলের বারান্দাগুলোতে তো এখন সমুদ্র স্নানে ভেজা কাপড় শুকাতে দেয়ার কথা। সেই সারি সারি রেলিং গুলো শূন্য পরে আছে। বারান্দার দিকের সব দরজা জানালা শক্ত করে বন্ধ হয়ে আছে।
কলাতলী রোডের সি প্যালেস হোটেল
যেই দু একটা হোটেলে ঢুকলাম শুস্ক ম্লান মুখ ম্যানেজাররা সাদরে ডাকছিল তাদের হোটেলে থাকার জন্য।কিন্ত সেই খালি নির্জন হোটেল গুলো কেমন ভীতিকর ।
একের পর এক জনমানব শূন্য হোটেল পার হয়ে যাচ্ছি।
ওসেন প্যালেস হোটেল
হোটেল ওসেন প্যালেস পার হয়ে আসলাম শেষ পর্যন্ত আমাদের স্কুটার চালক জানালো কলাতলী মেইন রোডের উপরেই ভালো হোটেল এর সন্ধান। বছর দেড়েক আগে উদ্ভোধন হওয়া পাঁচ তারকা হোটেল ওসেন প্যারাডাইস থেকে একটু আগে।
ওসেন প্যারাডাইস দেখে মনে হয়নি সেখানে কেউ আছে
কিন্ত সেই শূন্য নগরীতে আমরা চাচ্ছিলাম একটু নিরাপত্তা, আশেপাশে খাবার হোটেল আছে এমন। সেই চালকের কথা মতই শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো আমাদের থাকার জায়গা।
জনমানবহীন কলাতলী রোড
এগুলো সব এক বেড, এক লিভিং এমন দুই রুমের স্টুডিও এপার্টমেন্ট। বেশিরভাগ মালিকরা সমিতির মাধ্যমে এই এপার্টমেন্টেগুলো হোটেল হিসেবে ভাড়া দিয়ে থাকে।
স্টুডিও এপার্টমেন্ট
এমনি দুটি পাশাপাশি এপার্টমেন্ট ভাড়া নিলাম প্রতিটি ৮০০ টাকা করে। উল্লেখ্য যে অন্য সময়ে এগুলোর ভাড়া চার হাজার টাকা প্রতিদিন।
রুমে উঠে ফ্রেশ হয়ে খাবারের সন্ধানে বের হোলাম। পাশেই কক্সবাজারের বিখ্যাত চালু খাবার রেস্তোরা ধানসিড়ি যেখানে খালি টেবিল পাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হয় অন্য বছর ।
দুপুরবেলার ধানসিড়ি রেস্তোরা
আজ সেই ধানসিড়ি ভর দুপুরে নিশঃব্দ নীরব হয়ে আছে।ম্যানেজার ঝিমুচ্ছে, পরিবেশকরা পাংশু মুখে অসহায় দাঁড়িয়ে আছে চেয়ার ধরে। আমাদের প্ল্যান ছিল সেন্ট মার্টিন যাবার। টেকনাফ যাবার কোন পরিবহন নেই, বন্ধ হয়ে আছে সব জাহাজ সাথে তাদের অফিসগুলোও।
কেয়ারী সিন্দাবাদের বন্ধ অফিস
কক্সবাজার থেকে সেন্ট মার্টিন চলাচলকারী জাহাজ কেয়ারী সিন্দাবাদের বন্ধ অফিস। এমনি ভাবে বন্ধ হয়ে আছে সব কটি পরিবহনের কলাতলী শাখা অফিস। বুথে টাকা তোলার কোন লোকই দেখলাম না।
শূন্য রেস্তোরায় চা এর অপেক্ষায়
পাশের রেস্তোরায় বিকেলে চা খেতে গেলাম। ম্যানেজার জানালো সেদিন আমরাই ছিলাম সারাদিনে তাদের রেস্তোরার তিন কাপ চা এর দাম ষাট টাকার একমাত্র ক্রেতা। লজ্জিত হয়ে উঠলো যখন একশ টাকা থেকে চল্লিশ টাকা ফিরিয়ে দিতে পারছিল না সে।
কক্সবাজারের এক শূন্য রেস্তোরা
ড্রয়ার ঘাটতে ঘাটতে এক সময় বিক্ষুদ্ধ হয়ে বলে উঠলো 'এভাবে চল্লে দেখবেন আর দুদিন পর মানুষ লুট পাট করতে নামবে', প্রতিমাসে ১০ লক্ষ টাকা লস দিচ্ছে তাদের মত মাঝারী মানের হোটেলই। আরো জানালো সেই স্টুডিও এপার্টমেন্টগুলো সমিতির কাছ থেকে নিয়ে হোটেল হিসেবে তারা ভাড়া দিচ্ছে এবং মে মাস থেকে লোকসানের মধ্যে দিয়ে চলছে।
অন্য সময় এই টিউব নিয়ে থাকে পর্যটকদের কাড়কাড়ি
১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীনতা দিবসের ছুটি। আমরাও সকালে এসে ৫০টাকা ঘন্টার চেয়ার কুড়ি টাকা করে ভাড়া নিয়ে বসলাম।আমরা ছাড়া আর কাউকে দেখলামনা।তারপর ও বিনোদন এর সাথে জড়িতরা কিছু কিছু জিনিস এনে সাজাতে বসলো। একজন সেই নীরব নিঝুম বীচে টিউবগুলো এনে সাজিয়ে রাখলো, যদি হঠাৎ কেউ এসে নীল সাগরে ঢেউয়ের দোলায় ভাসতে চায় ক্ষনিকের তরে।
পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত এখন জন মানবশূন্য
অতীতে যতবারই এখানে এসেছি অর্থাৎ লাবনী, সুগন্ধা বা কলাতলী বীচে সবসময় থাকতো লোকে লোকারন্য।একটু হেটে এগুতে থাকতাম একটু নির্জনতার আশায়।মনে মনে ভাবতাম ইশ বীচটায় যদি একটু কম লোকজন থাকতো তাহলে কত ভালোই না লাগতো।থাকতোনা কোন ঝিনুক কন্যাদের ঝিনুক মালা আর দুল বিক্রির আবদার।
মৃত সৈকত
চা -কফি চিপস হকারদের কিছুক্ষন পর পর এসে বিরক্ত করা। ফটোগ্রাফারদের অসাধারন ছবি তুলে দেবার জন্য গর্বিত অনুরোধ। এবার আমরা সেই কক্সবাজার সৈকতকেই পেলাম যেমনটি কল্পনা করতাম। কিন্ত আশ্চর্য্য যে বাস্তব অনুভূতিটি সম্পুর্ন বিপরীত। কেমন যেন গা ছম ছম করা নীরবতা ।
উলটে রাখা চেয়ার
মোট সাতদিনের একদিনও কাউকে দেখিনি সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে খেলায় রত বা পা টুকু সামান্য ভিজাতে। সারি সারি খালি চেয়ার পরে আছে পর্যটক বিহীন সৈকতে।
এবার একটি ছোট্ট মেয়ে তার ঝুড়িটি নিয়ে আমার গা ঘেষে দাঁড়িয়ে ঝিনুকে গাথা মালা আর দুল দেখিয়ে বল্লো ' তিন পাতা কুড়ি টাকা দেব, আমি সকাল থেকে নাস্তা খাইনি'।
যথারীতি ঢাকার মানসিকতায় আমি তার কথা অবিশ্বাস করলাম। আমার স্বামী বল্লো ' এসবের দরকার নেই, তুমি দশ টাকা এমনি দিয়ে দাও',
আমাকে অবাক করে একটু পরেই দেখলাম সত্যি সে এক হাতে রুটি পেচিয়ে খেতে খেতে হেটে যাচ্ছে।
খালি চেয়ারের সারি
ম্লান মুখ ফটোগ্রাফাররা দাঁড়িয়ে আছে ক্যামেরা হাতে, তবে একবারও বলেনি আগের মত " ছবি তুলবেন"?
দু একজন ছাড়া আর কেউ সাজিয়ে বসেনি ঝিনুকের পসরা।
বন্ধ ঝিনুকের দোকান
লাবনী পয়েন্টের দোকানগুলোতে পর্যটকদের ভীড়ে কখনোই ঢোকা যেতনা। এখন তারা দোকান খুলে বসে আছে। আমি প্রায় সাতদিনই গিয়ে একই দৃশ্য দেখেছি। জানতে চাইতাম কেন তারা দোকান খুলে বসে আছে ? একজন উত্তর দিল ' আপা কি করবো ? কাজ নেই তাই '।
আমাকে দেখলেই ডাকতো করুন সুরে 'আপা/আন্টি একটা আবার এসে দেখে যান, কিছু পছন্দ হয় নাকি দেখেন'।
জনশুন্য লাবনী ঝিনুক মার্কেট
সেই সকরুন ডাক শুনে এত মায়া লাগতো যে অপ্রয়োজনেও কিছু কিছু কিনলাম। আমার স্বামী বল্লো "এক এক দোকান থেকে এক একটা কিনছো কেন ? ঐ দোকানেই তো সেই স্যান্ডেল্টা ছিল"।
ক্রেতা শুন্য দোকান
আমি উত্তর দিলাম, 'আমি তো কেনার জন্য কিনছি না, ওরা যে এই ভর সন্ধ্যায় বউনি করলো তার জন্য কিনেছি।
কক্সবাজার গিয়ে এত নিরানন্দ আর কোনবার অনুভব করিনি। আশারাখি সামনে আরো যাওয়ার ইচ্ছা রাখি।তখন যেন আমাদের প্রান প্রিয় সমুদ্র সৈকত নগরীকে তার আগের প্রানচঞ্চল রূপেই দেখতে পাই। সেই বর্নিল আলো ঝলমল কক্সবাজার।
বিজয় দিবসে আলোক সজ্জিত হেলিপ্যাড সমৃদ্ধ শুন্য ওসেন প্যারাডাইস
বিজয় দিবসে আলোক সজ্জিত পর্যটক শুন্য ওসেন প্যারাডাইস হোটেল
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৯:৪৭