মিউজিয়ামের সামনে অপরূপা বানপো রমনীর ভাস্কর্য নির্মিত ফোয়ারা
ইতিহাস থেকে জানতে পারি যে প্রাচীন কাল থেকেই আমাদের এই বিশ্বের বিভিন্নস্থানে বিভিন্ন ধরনের সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল। এর মধ্যে চৈনিক সভ্যতা, সিন্ধু নদের তীরের হরপ্পা মোহেঞ্জোদারো সভ্যতা,দজলা ফোরাতের তীর ঘেষে সুচিত মেসো্পটেমিয়ান সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা, গ্রেইকো-রোমান সভ্যতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।সাধারনতঃ চীনের যে সভ্যতার কথা আমরা সচরাচর জেনে থাকি তাহলো পাচঁ হাজার বছর আগের। কিন্ত তার চেয়েও হাজার বছরের পুরোনো সেই নতুন প্রস্তর যুগ অর্থাৎ যাকে চিনহিত করা হয় নিওলিথিক যুগ বলে সেই নিওলিথিক যুগে চীনের শিয়ান প্রদেশে উন্মেষ ঘটেছিল বানপো নামে মাতৃতান্ত্রিক এক সভ্যতার।
মানচিত্রে চীনের প্রাচীনতম সভ্যতার সুতিকাগার শিয়ান প্রদেশ
বছর পাঁচেক আগে আমরা যখন বেইজিং থেকে ১২০০ কিলোমিটার দুরত্বে প্রাচীনতম ঐতিহাসিক শহর শিয়ান ভ্রমনে গিয়েছিলাম তখন বেইজিং এর ট্যুর কোম্পানী তাদের ভ্রমন তালিকায় বানপোর নামও উচ্চারন করেনি। আর এ সম্পর্কে জেনেছিলাম তখন যখন সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা টেরাকোটা সোলজারের মিউজিয়াম দেখার জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। যার জন্য বানপো সভ্যতার ইতিহাস সম্পর্কে আগে থেকে আমাদের কোন তথ্য জেনে নেয়া সম্ভব হয়নি।
বানপোদের গৃহের আদলে তৈরী মিউজিয়ামের দৃষ্টিনন্দন গেট।
গাইড জানালো এখন সে আমাদের নিয়ে যাবে এক প্রাচীন প্রত্নতাত্বিক যাদুঘর যার নাম বানপো মিউজিয়াম। ক্ষুন্ন মনে চল্লাম তার সাথে বাসে করে। মন পড়ে রইলো টেরাকোটা সোলজারে।কিন্ত সেই বানপো মিউজিয়ামে প্রবেশ করে সব বিরক্তি ভুলে গেলাম এক লহমায়। দৃষ্টিনন্দন গেট পেরিয়ে প্রবেশ করলাম পৃথিবীর প্রাচীনতম এই প্রত্নতাত্বিক যাদুঘরে যার উদ্ভোধন হয়েছিল ১৯৫৮ খৃষ্টাব্দে। নাম লিখালাম সেই তালিকায় যেখানে প্রতিমাসে ছেচল্লিশ হাজার দর্শকের প্রবেশ ঘটে। তার মধ্যে বাঙালি পর্যটকের পদচিনহ কখনো পড়েছিল কি না জানতে পারিনি । দেখলাম বিদেশী পর্যটকদের সুবিধার জন্য যাদুঘরের ভেতরের চারিদিকে ইংরাজীতে এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লেখা রয়েছে।
এমন ধাতু ফলকে লেখা বানপো ইতিহাস
দেয়াল বেষ্টিত শিয়ান শহরের বাইরে চারিদিকে শুকনো পরিখাবেষ্টিত এই ওভাল আকৃতির গ্রামটি ৫০,০০০ হাজার স্কয়ার মিটার জায়গা জুড়ে অবস্থিত।সেই গ্রামে বড় মাঝারী এবং ছোট এরকম নানা আকারের ৫০০ ঘরের সন্ধান পাওয়া গেছে যা কিনা পাঁচটি ভাগে ভাগ করা।এছাড়াও সেখানে ছিল দুশটি খাবার মজুদ করার ভান্ডার ঘর, ছটি মৃত শিল্প কারখানা এবং আড়াইশোটি কবর।
বানপো গ্রামের একটি মডেল
প্রত্নতাত্বিকদের ধারনা সেই গ্রামে বিভিন্ন জাতির নৃ গোষ্ঠীর বসবাস ছিল।
এখানে বসবাসরত বানপোদের সমাজব্যাবস্থা মাতৃতান্ত্রিক ছিল বলে প্রত্নতাত্বিকদের দৃঢবিশ্বাস।তাদের সমাধিক্ষেত্রের বিভিন্ন নিদর্শন পর্যালোচনা করেই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন বিশেষজ্ঞ্ররা।বানপোদের কবরস্থানটিই বর্তমানে মিউজিয়াম।
সিড়ির পর সিড়ি বেয়ে উঠতে হবে বানপো সমাধিস্থল তথা বর্তমান মিউজিয়ামে
সব মাতৃতান্ত্রিক সমাজের মত এখানকার সমাজেও পুরুষরা ছিল মায়ের পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। পুরুষ সদস্যরা মারা গেলে তাদের অন্য কোন পুরুষের সমাধিতে সমাহিত করা হতো। এর প্রমান রয়েছে বানপোদের সমাধিক্ষেত্রে।
প্লেনের হ্যাঙ্গারের মত আচ্ছাদিত বানপো প্রত্নতাত্বিক মিউজিয়াম
বেশ বড় একটি জায়গাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত বানপোদের সমাধিক্ষেত্রে রয়েছে ১৭৪ টি কবর যা কিনা সব প্রাপ্তবয়স্কদের। এর একটিতে রয়েছে একাধিক মৃতদেহ, আরেকটি কবরে রয়েছে চারটি একই বয়সী যুবতীর মৃতদেহ।
একটি কবরে চারজন যুবতী নারীর শবদেহ
আরেকটি সমাধিতে দুটো প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের মৃতদেহ। এছাড়া বাকি সবগুলো সমাধিতে একটি করে মৃতদেহ আর তা ছিল নারীদের।একক কবরে শুধুমাত্র নারী এবং এক কবরে একই লিঙ্গের একাধিক শবদেহ মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের চিনহ বুঝিয়ে থাকে।এখানে কোন কবরেই নারী পুরুষের যৌথ মৃতদেহ পাওয়া যায়নি।
একক নারী সমাধিক্ষেত্র
গাইড আধ ভাঙ্গা ইংরেজীতে সেই প্রাচীনতম সভ্যতার বিভিন্ন দিকগুলো নিয়ে বিস্তৃত বর্ননা দেয়ার পন্ডশ্রম করে যাচ্ছিল।আমাদের সাথী দশ পনের জন পাশ্চাত্যের পর্যটক ছিল যারা গাইডের জ্ঞ্যানের উপর ভরসা না করে যার যার হাতের বইটিতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল। চীনারা নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা মেনে নিয়ে মিউজিয়ামের কোনায় বিশাল মনিটরে বানপো সভ্যতা সম্পর্কে ইংরাজীতে ধারাবাহিক বর্ননা আর তাদের জীবনযাত্রার কাল্পনিক ছবি দেখিয়ে যাচ্ছিল। বিশাল প্লেনের হ্যাঙ্গারের মত আচ্ছাদিত সেই সমাধিক্ষেত্রের মনিটরের ধারা বর্ননায় জানলাম তাদের সমাজে বিয়ে প্রথার আদৌ কোন প্রচলন ছিল কি না ?
বিশাল প্লেনের হ্যাঙ্গারের মত আচ্ছাদিত সেই সমাধিক্ষেত্র
না ছ হাজার বছর আগে বানপোদের সেই মাতৃতান্ত্রিক সমাজে আজকের মত এক নারী এক পুরুষের মধ্যে কোন বিয়ের প্রচলন ছিলনা। উপযুক্ত মেয়েরা একাকী এক ঘরে বসবাস করতো। রাতে তাদের ঘরে যে কোন পুরুষের অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল।সকালে তাদের সেই সম্পর্কের ইতি ঘটতো।
ছেলেরা আবার ফিরে যেত মায়ের কাছে, থাকতো নানা রকম সাংসারিক কাজে ব্যপৃত। এযুগের মত তাদের সমাজে কোন স্থায়ী সম্পর্কের স্থান ছিলনা। প্রত্যেক নারী পুরুষই একাধিক নারী পুরুষের সাথে সম্পর্কিত ছিল। তবে তাদের মধ্যে যদি ভালোবাসা তৈরী হতো তাহলে সম্পর্কটা হয়তো কিছুদিন দীর্ঘস্থায়ী হতো। এ নিয়মের ফলে এদের সন্তাদের কাছে পিতৃ পরিচয় চিরদিনই অজানা থেকে যেত। এমনকি মায়েরাও জানতোনা তাদের সন্তানের পিতা কে ! সন্তানরা তাদের মাকেই চিনতো এবং মায়ের দ্বারাই সমাজে পরিচিত হতো।
নদী থেকে পানি আনার পাত্র
কবর দেয়ার সময় মৃতদেহের সাথে জিনিসপত্র দেয়ার প্রথা বা রীতি প্রাচীনকালের অনেক দেশেই লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে মিশরের ফারাওদের কবরে বিভিন্ন দামী দামী জিনিসপত্র দান করার রীতি ব্যাপকভাবে বিস্তারলাভ করে । এই রীতিটি আমরা বানপো সমাধিগুলোতেও লক্ষ্য করে থাকি। তবে তাদের যে সমাজ ব্যাবস্থা ছিল মাতৃতান্ত্রিক তার আরেকটি প্রমান নারী পুরুষের কবরে পাওয়া বিভিন্ন জিনিসপত্রের পার্থক্য।
নারী বানপোর সমাধিতে দান করা তৈজসপত্র
বানপো সমাধিক্ষেত্রে একটি তিন চার বছরের শিশু কন্যার সমাধিতেও ৭৯টি বিভিন্ন জিনিস দেখা যায় যেখানে একজন পুর্নবয়স্ক পুরুষের সমাধিতে রয়েছে দুটো কি তিনটি জিনিস। এসব নিদর্শন বিশ্লেষন করে প্রত্নতাত্বিকরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে সেই হাজার হাজার বছর আগে বানপো সমাজে নারীদের ছিল উচ্চ মর্যাদা আর পরিবার ও গোত্রের মধ্যে তাদের ছিল সর্বোচ্চ আসন।
কৃষিকাজ আর শিকারে ব্যাস্ত বানপো। শিল্পীর কল্পনায় আকাঁ
বানপোদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা আবর্তিত ছিল অন্যান্য প্রাচীন নৃ গোষ্ঠীর মানুষদের মতই শিকার, কৃষিকাজ আর মাছধরাকে কেন্দ্র করে। পাথর দিয়ে তাদের তৈরী কুড়াল, ফসল কাটার কাঁচি থেকে শুরু করে প্রায় ৫,২৭৫ টি কৃষি যন্ত্রপাতি মাটির গর্ভ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।এ সমস্ত তথ্য প্রমান করে যে সেই নিওলিথিক যুগেই বানপো গোত্রের মানুষরা কৃষি বিপ্লবের সুচনা করেছিল।অন্যান্য নৃ গোষ্ঠির মত শুধুমাত্র শিকার করার উপরই তাদের জীবনযাত্রা নির্ভরশীল ছিলনা। এছাড়া মাছ ধরাও যে তাদের অন্যতম জীবিকা ছিল তার প্রমান পাওয়া যায় ছিপ এবং বড়শীর প্রাপ্তি থেকে। রান্নার বিভিন্ন তৈজসপত্র থেকে অনুমান করা যায় যে তারা আগুনের ব্যাবহার জানতো অর্থাৎ কিনা তারা কাঁচা খাবার খেতোনা।
বানপোদের তৈরী রঙ্গিন নকশা করা হাড়িকুরি
তাদের সেই গৃহস্থালী জিনিসপত্র গুলো ছিল বিভিন্ন আকৃতির।যা সে সময়ের জন্য ছিল বিস্ময়কর। যেমন এই পানির পাত্রটি। পদার্থ বিজ্ঞানেও যে তাদের ধারনা ছিল তা এখানে লক্ষ্য করা যায় বলে বিশেষজ্ঞদের মতামত। কুজোর মত এই মাটির পাত্রটি পানিতে ছেড়ে দিলে কাত হয়ে পানি ভরতে পারতো।যখন ভরে যেত তখন নিজে নিজেই সোজা হয়ে যেত। এ থেকে পানি কখনো উপচে পড়তোনা কারন এর মুখটা ছিল সরু। দুদিকে আঙ্গটা লাগানো এই জগটা বহন করাও ছিল সুবিধাজনক। বহন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলে এর সুচালো গোড়াটা মাটিতে গেথে রাখা যেত সহজেই। কি অসম্ভব বুদ্ধিমান ছিল এই জাতি।
অপরূপ ডিজাইনের পানির পাত্র
এছাড়াও বানপোদের সেই গ্রামে বিভিন্ন শিল্প কর্মের প্রচুর নিদর্শনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারের জন্য মাটি দিয়ে বিভিন্ন আকৃতির তৈজসপত্র নির্মানে তারা ছিল সুনিপুন। এমনকি সেই সব ঘর গৃহস্থালীর কাজে ব্যাবহৃত প্রতিটি জিনিসেও তাদের শিল্পী মনের পরিচয় লক্ষ্য করা যায়। যেমন এগুলোতে তারা নানারকম রঙ দিয়ে বিভিন্ন নকশা একেছে, এছাড়াও আকাঁ আছে বিভিন্ন পশু, পাখি বা মানুষের মুখ। তারা হাড়, দাত বা ঝিনুক দিয়ে তৈরি করতে পারতো অসাধারন ডিজাইনের গলার হার, হাতের বালা, কানের দুল প্রভৃতি। এসবের নমুনা পাওয়া গিয়েছিল বানপো নারীদের সমাধিগুলোতে।
সেই প্রস্তর যুগে শিল্পমনা বানপোদের নির্মিত নকশী করা মাটির গামলা
বানপোরা তাদের নিজস্ব হরফে লিখতে পারতো বলেও প্রত্নতাত্বিকদের দৃঢ বিশ্বাস।তবে তা ছিল চীনের প্রাচীনতম সভ্যতা স্যাং রাজত্বের আমলে লেখা হরফের চেয়েও পুরোনো ধারায়।
আমাদের সম্পুর্ন অজানা এই বানপো সভ্যতা সম্পর্কে জানতে পারাটা ছিল বিষেশ করে আমার জন্য এক বিশাল সৌভাগ্যের ব্যাপার। সেই সাথে প্রাচীনতম এক নৃ গোষ্ঠীর সমাজব্যাবস্থা এবং রীতিনীতি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্যাবলী আমা্কে বিস্মিত করেছিল।
ধীরে ধীরে বের হয়ে আসলাম সামনের প্রকান্ড চত্বরে সেই ছ হাজার বছরেরও আগের এক সমাধিক্ষেত্র থেকে।যেই চত্বরে রয়েছে এক অসাধারন নির্মান শৈলিতে নির্মিত ফোয়ারা, যাতে এক বানপো রমনী তাদের নিজস্ব বৈজ্ঞানিক ধারনায় নকশা করা পানির পাত্র থেকে জল ঢেলে যাচ্ছে অবিরাম।
মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে এসে তুলে নিলাম স্মৃতির মনি কোঠায় তাকে
সেই হাজার হাজার বছর আগে নিওলিথিক আমলে চীনের আদি একটি গোত্র বানপোদের সভ্যতার নিদর্শন তুলে ধরা প্রাচীনতম এই যাদুঘরটি না দেখলে আমাদের শিয়ান ভ্রমন হয়তো অসমাপ্তই থেকে যেত।ধন্যবাদ জানাই শিয়ানের ট্যুর কোম্পানীকে আর সেই গাইডকে যে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে তুতলিয়ে আমাদের বোঝানোর আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছিল।
দু একটি বাদে আর সব ছবি আমাদের ক্যামেরায় তোলা
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ৮:১৭