আস্তে করে প্ল্যাটফর্ম থেকে অরনি এক পা নামিয়ে দিল রেল লাইনের স্লিপারের উপর, তারপর আরেক পা । বেলা এখন দশটা, এরই মাঝে গরম হয়ে উঠেছে রেলের পাতগুলো। সাবধানে একটা একটা করে মোট পাঁচ/ছ'টি লাইন পেরিয়ে গেল সে। শেষের ভাংগাচোড়া লাইনটায় কয়েকটা পুরোনো মালগাড়ীর জং ধরা বগি বহু বছর ধরে দাঁড়ানো, তার মাঝে একটি গার্ড রুমও আছে। ওটার বারান্দায় মাঝে মাঝে সে পা ঝুলিয়ে বসে কুড়িয়ে আনা শিউলী ফুলের মালা গাথে।
স্টেশনের অন্যদিকে রেলের কিছু পতিত জমি পার হয়ে এলাকার সবচেয়ে পুরোণো এক বসতি এলাকায় এসে দাড়ালো অরনি। দুপাশে অনেক পুরোনো মোটা মোটা গুড়িওয়ালা বট, পাকুড় আর সেগুনের সারি। নীচে মেঠো পথের দুপাশে কত রকমের ছোটো খাটো জংলী গাছের ঝোপ। তারই ভেতর দিয়ে শক্ত পায়ে চলা মাটির পথ একে বেকে চলে গেছে আরো গভীরে অদুরের পাহাড়ে।
মা আজ দুদিন ধরে অরনিকে বলছে স্বপনের মায়ের খোজ নিতে। আজ কদিন হলো স্বপনের মা আসেনা। এমনিতে কামাই করে না বড় একটা, কিন্ত কি হলো এমন,যার জন্য চার/পাঁচ দিন ধরে একেবারে উধাও !
অরনি হেটে যাচ্ছে ঝরে পড়া বটের লাল লাল ফলগুলো দুপায়ে মাড়িয়ে। দুপাশে বড় বড় সবুজ পাতার ভেতর থোকা থোকা সাদা ভাঁটফুল ফুটে আছে। রান্নাবাটি খেলার সময় যার পাতা দিয়ে ওরা প্লেট বানিয়ে মিছি মিছি খাবার খায়।
বাঁক নিতেই হাতের ডানে মালতীদের বসত-বাড়ী, বিশাল উঠোনের চারধারে উচু উচু মাটির ঘর যার দাওয়ায় উঠতে দুটো সিড়ি ভাংতে হয়। ওদের বাসার পাশ দিয়ে যেতেই বেলী ফুলের হালকা মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা দিয়ে গেলো। বাঁশ আর কাঁটাওয়ালা মাদাঁরগাছের বেড়ার ও পাশ থেকে চার পাঁচটা সাদা টগর আর লাল জবা ফুলে ছেয়ে থাকা গাছের মাথাগুলো উকি দিচ্ছে । মালতীর মুখে শুনেছিল প্রতিদিনই নাকি ওদের পুঁজোয় ফুল লাগে।
মালতী আর ও একই স্কুলে একই ক্লাশের সাথী। অরনি জানে ওকে দেখলেই মালতী ওর সাথে খেলার জন্য ডাকবে। আর কিছুক্ষণ পরই খেলার মাঝে মাসীমা কাঁসার থালায় করে দুটো চিড়ের নাড়ু আর কয়েকটা নারিকেলের ফালি নিয়ে আসবে অরনির জন্য। সাথে কাঁসার গ্লাসে করে পানি। এগুলো খাবার অরনির অনেক প্রিয়, কিন্ত ওদের নাড়ুতে কেমন একটা ঔষধের গন্ধ। একদিন মালতীর কাছে জানতে চাইলে বলেছিল অনেকদিন রাখার জন্য ওতে নাকি ওরা কর্পুর দেয়। কিন্ত এখন মালতীর সাথে কথা বলার একটুও সময় নেই অরনির। স্বপনের মায়ের খোজ নিয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে। কোনো শব্দ না করেই মালতীদের বাসাটা পেরিয়ে গেল সে।
কিছুদুর গিয়েই পাতাবাহারের সারির মাঝ দিয়ে আরো সরু এক ফালি পথ।ঐ পথ ধরে কিছুদূর এগুতেই পাশপাশি অনেকগুলো মাটির ঘর। দুটো ঘরের মাঝখানে সরু ফাক দিয়ে বের হয়ে এক বিশাল চাতালে এসে দাড়ালো অরনি। চাতাল পেরোলেই রয়েছে বিশাল সব গাছে ঘেরা এক বিরাট পুকুর । সেই গাছগুলোর গোড়ার মাটি সরে মোটা মোটা শিকড় বের হয়ে পানির উপর ঝুলে আছে। কেউ কেউ ওগুলোকেই ঘাট হিসেবে ব্যবহার করছে। ছোট ছোট বাচ্চারা ওখান থেকে পানিতে ঝাপিয়ে পরে।
পুকুর পার হয়ে খানিকটা এগুলেই ঘন গাছের ঝোপের মাঝে স্বপনদের উচু ভিটেওয়ালা একটি মাটির ঘর। কিন্ত অরনি ঐ পুকুর পাড়ে শিকড়ের উপর বসে সব সময়ের মত একটু পা না চুবিয়ে থাকতেই পারলো না। কি ঠান্ডা শীতল পানি। মনে মনে ভাবলো ইশ এখন যদি একটা ডুব দেয়া যেত।
কিন্ত বেলা হয়ে যাচ্ছে, জানে মা ওর জন্য অপেক্ষা করছে। লাফিয়ে উঠে তাড়াতাড়ি পা চালালো স্বপনদের বাসার উদ্দেশ্যে। গিয়ে শুনলো ওর মায়ের নাকি আজ তিন দিন ধরে ভীষন জ্বর। স্বপন জানালো ওর বাবা বুড়ো মানুষ কিছুই করতে পারে না। একমাত্র কিশোর ছেলে স্বপনই মা এর সেবা যত্ন থেকে শুরু করে বাসার সবকিছু করছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল অরনির। অন্য সময় ওরা আসলে স্বপনের মা কি করবে না করবে ভেবে অস্থির হয়ে উঠে। আর আজ ছেঁড়া খোড়া একটা মলিন কাথায় শুয়ে আছে, চোখ মেলতেও কষ্ট হচ্ছে তার।
'আপা খালাম্মারে চিন্তা করতে না করবেন, জ্বরটা কমলেই আমি যামু', কোনো রকমে বলে উঠে স্বপনের মা।
'আচ্ছা তোমাকে ভাবতে হবেনা খালা, যখন সুস্থ হবে তখনি যেও, আমি মাকে বলবো এখন'।
বিদায় নিয়ে আবারো সেই ছায়া ছায়া পুকুরের পাশ দিয়ে যেতেই দেখলো গাঢ় সবুজ রংয়ের চিকন এক ছোট্ট সুতানলী সাপ। টগর গাছের সবুজ চিকন ডালের সাথে পেঁচিয়ে আছে। অরনি সাপকে দারুন ভয় পায়। কিন্ত ভারী সুন্দর এই সাপটি দেখে আজ একটুও ভয় করছে না। কালো পুঁতির মত চকচক করছে চোখ দুটো। মাথাটা এদিক ওদিক হেলিয়ে একটু পরেই কোথায় জানি নিমিষে উধাও হয়ে গেলো।
সূর্য এখন প্রায় মাথার উপর, যদিও ঘন গাছের ছাতা সেই প্রখর তেজকে আটকে রেখেছে। তাড়াতাড়ি পা চালালো অরনি বাড়ীর দিকে।
মনে পড়লো আজ বিকেলে তারা সবাই মিলে নতুন কাকার বাসায় যাবে। তারা মানে তাদের ছোটদের দলবল। তবে ইলা আপুও যাবে।নতুন কাকা বার বার করে বলে দিয়েছে, ইলা আপুরও বেশ আগ্রহ মনে হলো। ইলা আপুদের বাসা অরনিদের বাসার ঠিক সামনেই, ইলা আপু এবার বি এ পড়ে প্রথম বর্ষে।
আর নতুন কাকা হলো রেলের ইন্জিনিয়ার। সদ্য নতুন নতুন বদলী হয়ে এসেছেন, তাই তিনি অরনিদের নতুন কাকা। দেখতে সুদর্শন, মিশুক, হাসিখুশী নতুন কাকাকে এলাকার সবাইর বেশ পছন্দ। নতুন কাকাও অরনিদের ভীষন পছন্দ করতেন। উনি বিয়ে করেন নি। অরনিরা জানতে চাইলে বলতো সে নাকি মেয়ে খুঁজে পায়নি বিয়ে করার জন্য। কি জানি হতেও পারে ভাবে অরনি।
তাছাড়া ওনার লাল টালির ছাদওয়ালা বাংলোটির চারিদিক ঘেরা বিরাট বাগানটিও অরনিদের খুব প্রিয় একটি খেলার জায়গা।
আগের ইন্জিনিয়ার ছিলেন এক অবাংগালী ভদ্রলোক। অনেকগুলো ছেলে মেয়ে সহ বেশ বড় এক পরিবার নিয়ে তিনি বাস করতেন সেখানে। কয়েকটা ছেলে মেয়ে ছিল অরনিদেরই সমবয়সী। তাদের সাথে ওরা সামনের বাগানটায় খেলতো কত রকম খেলা। লুকোচুরি, ফুল টোকা,কুমির কুমির এসবই ছিল তাদের খেলা। শবনম, লুবনা, তারেকরা অরনিদের মত পরিস্কার বাংলা বলতে পারতো না ।অবশ্য তাতে তাদের খেলাধুলায় কোনো বিঘ্ন ঘটে নি।
মালির সযত্ন চর্চায় লুবনাদের সবুজ ঘাসে ছাওয়া সুন্দর লনের চারিদিকে নানা রকম মৌশুমী ফুল ছাড়াও গোলাপ, টগর,দোঁপাটি বেলী, দোঁলন চাপার সৌন্দর্যে আর সুগন্ধে বাগানটা ছিল ভরপুর।
অরনিদের এই ছোট্ট শহরটির প্রান কেন্দ্রই ছিল এখানকার রেলস্টেশনটি। একে ঘিরেই যেন সকলের উত্তেজনা। ওদের বাড়ী থেকে মাত্র দু পা দুরে স্টেশনটি সারাক্ষনই গম গম করতো মানুষের কোলাহলে। বড় বড় মেইল ট্রেনগুলো হুইশেল বাজিয়ে কুঊউ ঝিক ঝিক শব্দ তুলে সেখানে এসে থামে। সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় যাত্রীদের উঠা নামা,আর সেই সাথে শুরু হয় প্ল্যাটফর্ম জুড়ে কুলি আর হকারদের ছুটোছুটি, হাঁকডাক। ট্রেন আসার খানিকক্ষন আগে থেকেই পাকা লাল রংয়ের ছোট্ট রেলের ক্যান্টিনটিতেও সাজ সাজ রব পরে যায়। মোটা মোটা পাউরুটিতে পুরু করে লাগানো মাখন, জেলী আর সেদ্ধ ডিম সাথে গরম চা এর কেটলি নিয়ে ফার্স্টক্লাস বগির সামনে শুরু হয় বেয়ারাদের দৌড়াদৌড়ি। আব্বু মাঝে মাঝে এখান থেকে রুটি-মাখন কিনে নিয়ে যায়। ওরা অবশ্য মাখনের ওপর অনেকখানি মোটা মোটা দানার চিনি বিছিয়ে নেয়। কি যে স্বাদ তার অরনি বোঝাতে পারবে না।
এ ছাড়াও বিধবা দুই বুড়ি প্রতিদিন অনেকদুর থেকে মুড়ির মোয়া নিয়ে আসে বিক্রির জন্য। একদিকে কাঁচ লাগানো বড় টিনের কৌটায় মোয়াগুলো বাইরে থেকেই দেখা যায়। অরনি মাঝে মাঝে কিনে খায় মুড়ি আর গুড় দিয়ে বানানো সেই গোল গোল মোয়াগুলো।
অরনি আর তার বন্ধুদের জন্য অবারিত দ্বার ছিল স্টেশন মাষ্টারের রুমটি, ওরা সটান ঢুকে কাকুর চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে মনিটরে দেখতো ট্রেনের আসা যাওয়া। বয়স্ক, সৌম্যদর্শন,মিশুক টাইপ,আচার ব্যাবহারে অত্যন্ত মার্জিত স্টেশন মাষ্টার ও তার পরিবারের সাথে অরনিদের খুবই ঘনিস্ঠতা ছিল। কিন্ত উনি অবসরে যাবার পর যে আসলো তার সাথে প্রতিবেশী কারো কোনো যাতায়াত ছিল বলে অরনির মনে পড়ে না।
এর বেশ কিছু দিন পর বিরতিহীন ট্রেন চালু হবার পর সেই স্টেশনের গুরত্ব কমে গেল। ভাংগাচুড়া, রং চটা লোকাল ট্রেনগুলোই শুধু এখন থামে। লোকজনের আনাগোনাও কমে গেল। শহরের বেশীরভাগ লোক এখন বিভিন্ন জায়গায় বাসেই যাতায়াত করে।
ক্যান্টিনটাও বন্ধ হয়ে গেল একদিন, লোকাল ট্রেনের যাত্রীরা তো আর অত দামী নাস্তা করেনা বা করার দরকারও হয়না।রেলের অনেক কর্মচারী বদলী হয়ে গেল।ছোটোখাটো পদে যারা ছিল তাদের অনেকেরই চাকরী নেই। ওর প্রিয় বান্ধবী শাহানার বাবার চাকরী চলে যাওয়ায় ওর বাবা ওদের নিয়ে দেশের বাড়ি চলে গেল । সেদিন অনেক মন খারাপ লেগেছিল অরনির।
ওর মনে হতো জমজমাট স্টেশনটা বুঝি মরে যাচ্ছে। পরিচর্যার অভাবে স্টেশনের দুপাশে সুন্দর ফুলের বাগানগুলো শুকিয়ে যেতে লাগলো। স্টেশনের পেছনে চায়ের ছোটো ছোটো স্টলগুলোতে তেমন একটা আড্ডা আর জমে না। মিজানের মুদী দোকানের বেন্চটা খালি পরে থাকে দিনের পর দিন।
মেইল ট্রেনগুলো বন্ধ হয়ে যাবার মাত্র মাস ছয়েক আগে নতুন কাকা সেখানে বদলী হয়ে এসেছিলেন। ট্রেন বন্ধ হবার পর থেকেই জায়গায় জায়গায় ভেংগে পড়া প্রাচীরের মাঝখানে ওনার বাংলোটাও কেমন ভুতুড়ে হয়ে উঠতে লাগলো। চারিদিকটাও আস্তে আস্তে ঢেঁকি শাক আর আঁশ শ্যাওড়ার জংগলে ছেয়ে গেল। নানা রকম ফল আর শাল সেগুনের বিশাল বিশাল গাছগুলো কেমন যেন ঝুপসী হয়ে উঠতে লাগলো। ওগুলোর ওপর থেকে লম্বা লম্বা বুনো লতা ঝুলে থাকতো। ওগুলোতে মাঝে মাঝে ঝুল খেতো ছেলেরা ।সেখানে দিনের বেলাও আম কুড়াতেও অরনিদের ভয় করতো। সামনে বাগানের ফুলের গাছগুলো সব মরে যাচ্ছে। নতুন কাকা ভারী ব্যাস্ত। তার সময় নেই ওদিকে খেয়াল করার। অরনির অনেক কষ্ট হতো যখন দেখতো গোলাপের ডালগুলো শুকিয়ে কালো হয়ে আসছে। আগের মত আর মালিরা আসতো না।
'কাকা গাছগুলোতে পানি দাও না কেন', মাঝে মাঝেই বলতো অরনি?
'সময় পাই না যে কাকামনি,।
'না না কাকা তার পর ও একটু পানি দিও, সেদিন ক্লাসে স্যার বলেছে গাছের ও নাকি জীবন আছে,'।
'তাই নাকি! গাছের যে জীবন আছে জানতাম না তো! আচ্ছা ঠিক আছে দেবো, এখন এই বিস্কিটের প্লেটটা নিয়ে বন্ধুদের দাও তো লক্ষী'
কপট বিস্ময় প্রকাশ করে নতুন কাকা মুচকি হেসে প্লেটটা অরনির হাতে ধরিয়ে দেয়।অরনি প্লেটটা নিয়ে সামনের বারান্দার দিকে এগিয়ে যায়।
আজ ইলা আপুকে নিয়ে প্রথমবারের মত ওরা তিন চার জন যাবে বিকেলে ঐ নতুন কাকার বাসায় । বাসায় এসেই বারান্দায় পা রাখতে না রাখতেই ওর মা দৌড়ে আসলো।'কি হলো অরনি, দেখা হয়েছে স্বপনের মায়ের সাথে'?
'হ্যা মা, ওর ভীষন জ্বর, এক্কেবারে বেহুশ অবস্থা'।
তাই নাকি কি বলিস ! তা ওর ছেলেকে দিয়ে একটা খবর পাঠালেও তো পারতো', মা উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠে,কিন্ত কন্ঠ থেকে বিরক্তর ভাবটা লুকোতে পারে না।
মা কে অরনির কেমন যেন একটু স্বার্থপরের মত লাগলো।
'কি যে বলো মা স্বপন ছাড়া ওদের কেউ নেই দেখার মত, আর তুমিতো জানোই ওর বাবাটা একদমই থুর থুরে বুড়ো। কিছুই পারে না,'।
মেয়ের কথায় মা ও লজ্জিত হয়ে পড়লো।
কথা পাল্টে বল্লো 'যাও তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকো। টেবিলে ভাত বাড়া হয়েছে'।
চারটা বেজে গেছে ইলা আপু এসেছে অরনিদের সাথে যাবার জন্য। কি সুন্দর লাগছে আপুকে আজ। ছিপছিপে শরীরে হাল্কা সবুজ কলাপাতা রংয়ের শাড়ি পড়া আপুকে একটা কচি কলা গাছের মতই লাগছে। লম্বা চুল গুলো বেনী করা ,মুখে হাল্কা পাউডারের ছোঁয়া, কপালে ছোট্ট একটা লাল টিপ আপুর মিষ্টি মুখটিকে আরো মিষ্টি করে তুলেছে।
অরনির মনে হয় নতুন কাকা আর ইলা আপুর মাঝে কিছু একটা আছে কিন্ত ঠিক বুঝতে পারে না। নতুন কাকা অরনিদের বাসায় আসলে ওদের বিরাট লম্বা বারান্দায় আব্বার সাথে চেয়ারে বসে চায়ের পেয়ালা হাতে গল্প করে। সে সময় মাঝে মাঝে ইলা আপুকে ওনাদের বাসার জানালায় দু এক ঝলক দেখা যায়। গল্পের ফাকে ফাকে নতুন কাকার চোখটা বারবার ওদিকে ঘুরে আসে। কিন্ত কখোনো কথা বলে না ওনারা।
'দাড়াও আপু, চুলটা বেধে নেই এক মিনিট'।
ও জানে চুল না আচড়ালে মা ওকে কিছুতেই বের হতে দেবে না। ঝটপট একটা পনি টেইল করে স্যান্ডেলে পা গলিয়ে ইলা আপুর হাত ধরে বাইরে আসলো। গেটের কাছে আসতেই দিনা, বেবী, পুস্পিতার সাথে দেখা। সবাই মিলে ইলা আপুকে ঘিরে হৈ হৈ করতে করতে রেল লাইন পেরিয়ে চল্লো বাংলোর দিকে।
ওদের গলার আওয়াজ পেয়ে নতুন কাকা বের হয়ে আসলো গেটের কাছে।
'আসুন আসুন কি সৌভাগ্য আমার'। চোখে মুখে হাসির ঝিলিক ফুটিয়ে আহ্ব্বান জানালো অরনিদের অর্থাৎ ইলা আপুকে।
'তাই নাকি' ! লাজুক হেসে উত্তর দিল ইলা আপু।
অরনিরা দৌড়ে বাগানের দিকে যেতে যেতে বল্লো '
এ দিকে আসো আপু, এদিকটা ভারী সুন্দর'।
'আসছি অরনি'।
শুনতে পেলো কাকা বলছে 'হু সেটাই, আজ আমার মরে যাওয়া বাগানটা আবার সবুজ হয়ে উঠলো'।
অরনিরা দেখলো ইলা আপুর লজ্জা রাংগা মুখটি নত হয়ে আছে। অন্য দিনের মত আজ কাকার ওদের সাথে খেলায় অংশগ্রহনের কোনো আগ্রহই নেই। কি যেনো চুপি চুপি বলে যাচ্ছে দুজন বাইরের চাতালে দুটো বেতের চেয়ারে বসে।
একটু পর কাকা উঠে গেল অরনিদের জন্য নাস্তা বানাতে, পেছনে ইলা আপু । অরনিরা দৌড়ে ঘরে ঢুকতেই দেখলো দুজনে মিলে প্লেট সাজাচ্ছে,শরবত বানাচ্ছে। দুজনেরই লাজুক লাজুক মুখ। কি সুন্দর মানিয়েছে, ইশ নতুন কাকা যদি ইলা আপুকে বিয়ে করতো কি ভালোই না হতো। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতে ফিরতে অরনি মনে মনে ভাবে।
কয়েকদিন পর মা র মুখে অরনি শুনলো ইলা আপুর নাকি বিয়ে । বর বিদেশে থাকে। ইলা আপুর আব্বুর বন্ধুর ছেলে, অনেক আগেই নাকি কথা দিয়ে রেখেছে।
শুনে অরনিতো এক পাক নেচে উঠলো কি মজা কি মজা । অনেক মজা করা যাবে।
এক দৌড়ে ইলা আপুর বাসায় গিয়েই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো অরনি। তারপর মুখ তুলেই চমকে উঠলো এ কে !!
কালি মোড়ানো মুখ,লালচে চোখের কোনায় পানির চিন্হ শুকিয়ে আছে, লম্বা চুলগুলো যা সবসময় বেনী বাধা থাকে আজ পিঠে ছড়ানো জটা বাধা।
'কি হয়েছে আপু এমন লাগছে কেন তোমাকে '? প্রশ্ন অরনির।
'কিচ্ছু হয়নি সোনা'।
অরনিকে বুকে জড়িয়ে ধরে ইলা আপু।
'তোমার নাকি বিয়ে, মা বল্লো'!
কেমন করে যেন হেসে উঠলো আপু, ভয় পেয়ে যায় সে।
'হু বিয়েই তো, কেন তুই শুনিস নি'?
'না আপু এইতো মাত্রই শুনে দৌড়ে আসলাম'।
'আচ্ছা অনেক মজা করিস যা এখন'।
ট্রেনে করে আব্বু আসছে ঢাকা থেকে। বাড়ীর সামনেই স্টেশন, অরনি এসে দাড়াতেই দেখলো নতুন কাকা। বিষন্ন চেহারা, উস্কোখুস্কো চুল, উদভ্রান্তের মত প্ল্যাটফর্মের উপর দিয়ে হেটে যাচ্ছে।
'কাকা, নতুন কাকা কই যাও'?
ওহ তুমি ! না না কোথ্থাও যাই না এমনি একটু কাজ। কেমন আছো শুনি' ?
ভালো আছি কাকা, আব্বা আসবে আজ, নিতে এসেছি'
'ভালো, ভালো, আচ্ছা আজ আসি কেমন'।
মনে হলো ওনার ভেতর থেকে অন্য কেউ কথা বলছে। এটা ওদের সেই নতুন কাকা নয়।
ওহ কাকাকে তো সেই খুশীর খবরটা দেয়াই হয় নাই।
'জানো কাকা ইলা আপুর না বিয়ে'।
'হ্যা শুনেছি আমি', বলেই মুখটা ফিরিয়ে দ্রুত হেটে চলে গেল।বিস্মিত হয়ে তার যাবার পথের দিকে চেয়ে থাকে অরনি। অদ্ভুত লাগে কাকার আচরণ। অরনির মনটা ভালো নেই। গতকাল স্কুলে গিয়ে শুনলো মালতীরা নাকি চুপি চুপি বাড়ী ঘর বিক্রী করে ইন্ডিয়া না কোথায় নাকি চলে গিয়েছে। অনেক ভালো ছিল ওরা। ওর বাবা মা ওকে অনেক আদর করতো। ওদিকে গেলে আর মালতী ওকে ডাকবে না '
'আয় না অরনি, আমার সাথে রান্না-বাটি খেলবি'।
এদিকে ইলা আপুকে নিয়ে তার বাবা মা কাল ঢাকায় যাবে বিয়ে দেয়ার জন্য। ওখানেই নাকি দুপক্ষের আত্মীয় স্বজন বেশী। যাবার সময় ইলা আপু অরনিকে জড়িয়ে অনেক কাঁদলো, সাথে অরনিও। মা ওর মাথায় হাত রেখে দোয়া করলো, বল্লো সুখী হতে। সুখী কেমন করে হয় অরনি জানে না। ইলা আপু দাঁতে দাঁতে চেপে মাথা নীচু করে বল্লো,
'চেষ্টা করবো খালাম্মা।
অরনি ইলা আপুর কোলে মাথা রেখে ফিস ফিস করে বল্লো, 'জানো আপু, নতুন কাকা নাকি অনেক চেষ্টা চরিত্র করে এখান থেকে কোথায় জানি বদলী নাকি চাকরী ছেড়ে চলে গেছে, পুস্পিতারা কেউ বলতে পারে না'।
ইলা আপু শক্ত করে অরনিকে জড়িয়ে ধরে বল্লো,
'আমি জানি। আমি জানি'।
কিন্ত অরনি ভালো করেই জানে নতুন কাকা কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না, কেউ না।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০১৮ সকাল ১০:০৮