
ঢং, ঢং, ঢং তিনটা ঘন্টার শব্দ, পাঁচ মিনিট পরে আবার দুটো। শীতের ভোর ৫টা। অন্যদিন হলে আমি কম্বল টা আরো পেঁচিয়ে নিয়ে শুয়ে থাকি । আর আমার স্বামী পাশ থেকে উঠে চলে যায় এক ঘন্টা বাধ্যতামূলক কাজে যোগ দিতে। আর আজ সে বলছে ' এই উঠো, উঠো মর্নিং ওয়ার্কে যাবে না '! আমার কান্না পেতে লাগ্লো শুনে।
ঢাকার অদুরে বিশাল এলাকা জুড়ে দেয়াল ঘেরা এদেশের একটি বেসরকারী সংস্থার ট্রেনিং সেন্টার। দেয়ালের ভেতরে বাইরে চারিদিকে কাঠাল আর তালগাছের সারি ।জনবিরল নীরব নিঝুম এলাকা। অনেক অনেক দূরে দূরে দু এক ঘর স্থানীয় লোকের বাস।
আমরা চল্লিশ পঞ্চাশ জন স্টাফ। ট্রেনিং থাকলে তখন শ দু এক লোক হয়। ভালোই কাটছে আমার জীবন । আমাদের জন্য ২০ টা ফ্ল্যাটের দোতলা বিল্ডিং। চল্লিশ পন্চাশ জন স্টাফের মধ্যে মাত্র তিন চার জনই বিবাহিত এবং বৌ নিয়ে থাকতো। বিবাহিত রা ছাড়া সবাই মেসে খেত। ভালো রান্না হলে আমাদের ও দাওয়াত থাকতো। খুব মজার জীবন ছিল আমাদের ।
সকাল দশটা বাজে সেদিন । শুনেছি ঢাকা থেকে ট্রেনিং ডিভিশনের হেড শফিক ভাই এসেছেন। উনি প্রায়ই আসেন, খুব হাসি খুশী মিশুক টাইপের। উনি সেই সংস্থার প্রধান তিন জনের একজন এবং দেশ বিদেশ থেকে অনেক বিদ্যার্জন করা কিন্ত তার আচার আচরনে কখনোই তা ফুটে উঠতোনা। সবার সাথে ছিল সে খুবই আন্তরিক। সবার রুমে রুমে গিয়ে খোজ খবর নিত কে কেমন আছে।
হঠাৎ দরজায় খট্ খট্ শব্দে শতবার পড়া বিভুতিভূষনের অপরাজিত টা বিছানায় রেখে উঠে আসলাম । ভাবলাম বৌদি বুঝি। না দরজা খুলে দেখি শফিক ভাই হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে, পেছনে আমার স্বামী।
আমি তাড়াতাড়ি একপাশে সরে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বল্লাম 'কি খবর শফিক ভাই ! আসেন আসেন ভিতরে আসেন' ।
'অয়ালাইকুম, কি খবর জুন, তা আছেন কেমন "? খাস বরিশালের ভাষায় সে বলে উঠলো।
'ভালো আছি'।
তা ঘরের মধ্যে বসসিয়া করেন কি কয়েন দেহি' ? শোফায় বসতে বসতে প্রশ্ন ছুড়ে দিল আমার দিকে।
' কিচ্ছু না, এইতো গল্পের বই পড়ছি'।
'এইয়া কি কন শুনি! এমন করিয়া গল্পের বই পড়িয়াই কি আপ্নের জেপন কাটবে'! আশ্চর্য হন উনি ।
'কি করবো বলেন, আসে পাশে তো কোনো কিছুই নেই, কোথাও যে কিছু একটা করবো' আমি উত্তর দেই।
'এই শোনেন একটা সাদা কাগজ আনেন দেহি ' আমার স্বামীকে আদেশ দিলেন আর আমাকে বললেন ' ভালো করিয়া এক কাপ চা বানান , ক্যান্টিনে চাচার চা খাইয়া মোর মুখটাই নস্ট।
পাশেই ছোট্ট কিচেন, আমি চা বানাতে লাগলাম ।
শফিক ভাই বলছে, 'জুন শোনেন, আসাদ ভাই( সংস্থার প্রধান) কইছে" মোর্শেদের বউ এম, এ পাশ করিয়া ঘরে বসিয়া করেডা কি! তারে কাল হইতে অফিসে জয়েন করতে বলবেন ট্রেইনার হিসাবে'।
'বোজলেন আমি আপ্নের জয়েনিং লেটার হাতে লেখতেয়াছি, পরে অফিসিয়াল চিঠি আসবো হ্যানে' ।
আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম সাদা কাগজে কালো কালির আঁচড়ে আমার সুখ, শান্তি, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব সব কিছু কি ভাবে মিলিয়ে যাচ্ছে।সবশেষে তার এক স্বাক্ষরের মাধ্যমে তা বিলীন হয়ে গেলো।
হাসিমুখে এপয়েন্টমেন্ট লেটার টা ধরিয়ে দিয়ে চা সিগারেট খেয়ে উনি আমার স্বামীকে নিয়ে ঘর থেকে নিস্ক্রান্ত হলেন।
সেখানকার স্টাফদের প্রতিদিন সকালে একঘন্টা মর্নিং ওয়ার্ক করা বাধ্যতামুলক ছিল।
এর মধ্যে অফিস, হোস্টেল ঝাড়ু, ক্ষেত নিড়ানো, সবজি তোলা, গাছে পানি দেয়া কম্পাউন্ডের চারিদিক পরিস্কার এরকম হরেক রকম কাজ।যখন ট্রেনিং চলতো তখন ট্রেনিং এ অংশগ্রহনকারীদের জন্য ও এটা বাধ্যতামুলক ছিল।
নন ফর্মাল এডুকেশনের পাইলট স্কুলের একজন টিচার ছিল লাবন্য দি উনি আমাকে খুব ভালবাসতো। আমি আর লাবন্য দি সবসময় একসাথে কাজ করতাম।
আমার আরেক বরিশালি কলিগ ফরিদ ভাই এই মর্নিং ওয়ার্কের প্রতি প্রচন্ড বিরক্ত ছিলেন ।উনি ঘন্টা পড়ার অনেক পরে উঠে একটা খুরপী নিয়ে ওনার বারান্দার সামনে বসেই চোখ বন্ধ করে কোপাতে থাকতো। কিসে কোপ দিচ্ছে সেদিকে তার কোনো খবর নেই।
আমাদের দেখলেই বলতো, 'ভাবী এই দিকে আয়েন দেহি, ঐ দিকে যান কোম্মে ? তারপর মুখটা করুন করুন করে বলতো , 'কয়েন দেহি এইয়া কি কোনো চাকরী অইলো ! সক্কাল বেলা উড্ডিয়া বিনা পয়সার এই কামলাগিরি করতে অইবে' !
এই ব্যপারে ফাঁকিবাজ বলে অফিসে ওনার একটা বদনাম ছিল। তার দল ভারী করার জন্য উনি সব সময় আমাদের টানতো।
মর্নিং ওয়ার্কে আমার বেশী ভাল লাগতো পুকুরে মাছ ধরা আর পোলট্রি ফার্মে ঢেকিতে ঝিনুক গুড়া করা। ফিশারী বিভাগের বংশীদা সিলেটের সুনামগঞ্জের শাল্লার বাসিন্দা ।আমাদের ডাকতো, 'ভাবী মাছ ধরতে যাইবেন নি কিতা '? আমি আর দিদি দৌড় বংশী দার পেছন পেছন।ডিঙ্গি নৌকায় ঊনি ঝাকি জাল ফেলে বিশাল পুকুরে মাছ ধরতো। আমরা জাল থেকে মাছ বাল্টিতে রাখতাম।
আমাদের একটা প্রিয় জায়গা ছিল ডাইনিং এর পেছনে কিচেনের সামনে একটা বেঞ্চ। সেখানে বসে আমরা আড্ডা দিতাম। বিশাল দুটো ঝুড়িতে সারাদিন ধরে তরকারি কাটা হতো । রাতে ওটা নিরামিষ রান্না হতো। ঝুড়ি আর বিশাল দুটো বটি সবসময় রেডি থাকতো।
আমি সুযোগ পেলেই বটি তে বসে ঘচ ঘচ করে দু একটা তরকারি কাটতাম ।
আমাকে দেখলেই বাবুর্চি চাচা দৌড়ে এসে চেচামেচি করে আমাকে উঠিয়ে দিত।
অমনি জামালপুরের চাচার বরিশালি কিশোর এসিস্টেন্ট রাগ হয়ে বলে উঠতো, 'চাঁচা মিয়া, ভাবী বডিতে বইলেই আম্নে একছার চিক্কুর পারতে থাহেন, ঘটনা কি কয়েন দেহি, ভাবী তরকারি কাডলে আম্নের সমেস্যাডা কি '!! চাচা কৈফিয়ত দিত ধারালো বটিতে আমি হাত কেটে ফেলবো তাই।
একদিন ওখানে বসে আমি দিদি আর দু এক জন ভাবী, বৌদি চা খাচ্ছি।
চাচার সহকারী বেগমের মা তরকারী কুটছে। সে সময় ফরিদ ভাইয়ের প্রবেশ।
'বেগমের মা এইয়া কাডো কি '?
'বাঙ্গি' বেগমের মা র সরল উত্তর।
'কি! বাঙ্গি ! চাঁচা মিয়া এদিক জলদি আয়েন দেহি, নেরামিষের ভেতর এইয়া কি দেতে আছেন শুনি'!
'আমরা কি করমু কন ! কৃষ্ণ চাচা ( কৃষি বিভাগের প্রধান) পাঠাইছে। হ্যার খেতের বাঙ্গি নাকি আপনেরা কেউ কিন্না খাইতাছুইন্না তাই ক্যন্টিনে বিক্রী কইরা নিরামিষে দিতে কইছে', চাচার উত্তর।
ফরিদ ভাই তো মনে হলো সেখানেই অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা।হতভম্ব ফরিদ ভাই আমাদের দিকে তাকিয়ে সমর্থন আদায়ের ভঙ্গীতে প্রশ্ন করে;
'এই কৃষ্ণ বাবু পাইছেডা কি কয়েন দেহি ভাবী ! হের বাঙ্গি ছাঙ্গি বিক্কিরি হয়না , হেয়ার লেইগ্গা এইয়া কি মোগো তরকারী রান্ধিয়া খাইতে অইবে !! গত সপ্তাহে তার কলমী শাক বেঁচা হয় না কইয়া হ্যায় আমাগো পাঁচদিন ধরিয়া সকালের নাস্তায় শাক খাওয়াইলো'!
বলতে বলতে ভোজন রসিক ফরিদ ভাই প্রচন্ড বিরক্তি সহকারে ঝুড়ির দিকে চেয়ে রইলো।
আজ কয়েকদিন ধরে দেখছি আমাদের কোয়ার্টারের পাশে একটা প্লট কৃষ্ণ দা লেবার নিয়ে পরিস্কার করছে। আজ ছুটি, বিকেলে প্রিয় বেঞ্চে যথারীতি চা পান আর গল্প করছি। তাকিয়ে দেখলাম সেই প্লটের পাশে কৃষ্ণ দা কি যেন করছে। আমাদের দেখে হাসি দিল।
আমি জানতে চাইলাম 'কি করছেন কৃষ্ণ দা'?
বল্লো 'বাদাম বোনতে আছি'।
আমরা দৌড়ে গিয়ে বল্লাম। 'দাদা আমরা বুনি, বুনবো ?"
'আইচ্ছা বোনেন দেহি, নজরুল (কৃষি লেবার) ওনাগো হাতে বাদাম দাও আর কইয়ে দাও কেমনে বোনা লাগপে ' প্রসঙ্গত দাদাও বরিশাল বাসী।
ঝুর ঝুর মাটিতে আল কাটা, আমরা খালি পায়ে খোসা ছাড়ানো বাদামের দানা বুনছি গল্প করতে করতে।কি যে ভালো লাগছে বলার নয়। এমন সময় দাদা র গলায় আমাদের সম্বিত ফিরলো ' অইছে ভাবী, দিদি আম্নেরা ওডেন দেহি , আম্নেগো আর বাদাম বোনা লাগবেনা, এই নজরুল তোরা নাম' ।
'কেনো, কেনো ' ! আমরা অবাক হয়ে যাই !
'পাঁচটা করিয়া বাদাম ফালানোর কথা আর আপ্নেরা চাইরটা মুখে দেতে আছেন আর একটা কইরা বোনতে আছেন। আর হেইয়া যদি এন্দুরে খায় তয় টার্গেট ফুলফিল তো দুরের কথা মোর বাদাম খেতে ঘাসও গজাইবে না '।
বলে আমাদের দিকে তাকিয়ে এক চোখ বন্ধ করে একটা মুচকি হাসি দিলেন। আমরা মুখ নিচু করে অপরাধীর মত ক্ষেত থেকে উঠে আসলাম।
কিছুদিনের মধ্যে সেই বাদাম ক্ষেত সবুজ হয়ে উঠল। পরে আমাদের বাদাম তোলার জন্য ডেকেছিল দাদা । প্রচুর বাদাম হয়েছিল। কিন্ত নখে মাটি ঢুকে যাচ্ছিল দেখে আমরা একটু পর উঠে যাই।তবে মর্নিং ওয়ার্কে উনি অন্যদের দিয়ে উঠিয়ে ছেড়েছিল।
শেষ করি আমার আরো দুই বরিশালের কলিগের কাহীনি দিয়ে। ছুটির দিন দুপুরে হাসান ভাই তার নীচ তালার রুমে শুয়ে আছে । এমন সময় দেখলো একটা ছায়া জানালার পাশ দিয়ে সরে যাচ্ছে। উনি তাড়াতাড়ি উঠে দেখলেন আমাদের গার্ড সোলায়মান নাকে একটা হলদে কছমছ ফুল ধরে হেটে যাচ্ছে। কালো কুচকুচে সোলেমান তেল চুকচুকে কালো চুল ব্যকব্রাশ করা । ইয়া গোঁফ পাকিয়ে পাকিয়ে উপরের দিকে সারাক্ষন টেনে তুলছে।
'ওয়া কি সোলেমান ! এইয়া করছো কি !
'কি কন হাসান ভাই, মুই কি করছি '! বিস্মিত উত্তর সোলেমানের।
'তুমি ফুল ছিড়ছো কা '!
'মুই ফুল ছিড়ছি ! এইডা আপ্নে কি কইত্থে আছেন' !
'তয় তোমার হাতে এইয়া কি' !
লাউয়ের বিচির মত বিশাল কালো কালো পান খাওয়া দাত বের করে একটা হাসি দিয়ে সরে সরে যেতে ফুল টা নাকের কাছে ধরে সোলেমান বল্ল,
'ও এইয়া ! এহ্ হাসান ভাই ফুলডা র কি সুউবা..স '।
আমাদের কাছে হাসান ভাইয়ের প্রশ্ন, 'ভাবী, এইয়া কইত পারবেন কছমছ ফুলের সুবাস কেমুন' !
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ৮:২৯