
পাহাড়ের ঢাল , সবুজ ঘাসে আবৃত টিলাগুলো। ছোটো ছোটো আমলকী গাছগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাড়িয়ে আছে ঝিরিঝিরি পাতার কাঁপন তুলে। দু একটা আমলকী নীচে পড়ে আছে।আমরা ভাই বোনেরা তার ফাকে ফাকে ছুটোছুটি করছি । কখনো দৌড়ে উপরে উঠছি, কখনও বা নীচে।
আমাদের সিপাহী ভাই একটু দুর থেকে আমাদের দিকে নজর রাখছে , কোনো বিপদজনক কান্ড ঘটাচ্ছি কিনা ! গাছের আড়ালে দু একটা হরিণ সাহস করে আমলকী খাচ্ছে আর ভয় চকিত চোখ তুলে মাঝে মাঝে আমাদের দিকে দেখছে। অনেক দুরে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে।
আর অনেক লম্বা চুলগুলো দিয়ে মোটা মোটা দুই বেনী করা ভারী মিস্টি দেখতে আমার মা এই টিলা থেকে একটু নীচে পাহাড়ের উপর শংকর মঠে বসে গেরুয়া পড়া ভীষন হাসি খুশী প্রৌঢ়া এক সন্ন্যাসীনির (উনি ছিলেন মনে হয় সেখানকার প্রধান) সাথে বারান্দায় বসে গল্প করছেন।
আমরা খেলা শেষে ফিরে আসলে উনি ( আমরা ওনাকে দাদু ডাকতাম,) আমাদের খোরমা বা পেপে কেটে দিতেন খাবার জন্য। উনি আমাদের ভীষন আদর করতেন।
কখনোও দেখতাম লম্বা চুল ওয়ালা সন্ন্যাসী ভদ্রলোকটি আম্মাদের সাথে যোগ দিয়েছে গল্পে। মাঝে মাঝে দেখতাম সে আমার মা কে কোরান শরীফ পড়ে তার অনুবাদ করে শোনাচ্ছে। সব ধর্মের উপরেই ওনার অনেক জ্ঞান ছিল। আমরা যখন সীতাকুন্ড ছেড়ে চলে আসি তখন উনি আমার মা কে সে একটা কোরান শরীফ, বার্মা থেকে আনা শ্বেত পাথরের একটি বুদ্ধ মুর্তি, আরেকটা সচিত্র রামায়ন উপহার দিয়েছিলেন।
অত্যন্ত অভিজাত এবং শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে ছিলেন আমার মা। আমাদের জীবনের সবচেয়ে শ্রেস্ঠ এবং আনন্দের সময়টুকুই ছিল এই সীতাকুন্ডে থাকা কয়েকটি বছর।
স্কুল টীচার আমার মা কলকাতা থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে ঢাকায় এসে বিয়ের পর আরো কিছুদুর পড়াশোনা চালিয়ে যান এক প্রতিকূল পরিবেশে।
আমাদের চার ভাই বোনকে নিয়ে সুখের সংসার আমার বাবা মা র। কোনো অভাব অভিযোগ ঝগড়া ঝাটি কিছু নেই আমাদের বাসায়, আনন্দেই দিন কাটছে। আমরা ঢাকায় বদলী হয়ে এসেছি।
কিছুদিন ধরেই আমার মা র বুকের মধ্যে ছোটো একটা চাকার মত। আমার মা র পিঠাপিঠি যে বোন,উনি একজন ডাক্তার, সে নিয়ে গেল এক বিখ্যাত সার্জেনের কাছে। সে অপারেশন করে বায়াপসি করে বল্লো 'নাথিং এটা একটা সামান্য টিউমার'। আমরা তখন ছোটো ছোটো কিছুই বুঝিনা এসব। কিছুদিন পর ঐ জায়গাতে আবার একটা টিউমার ।
এবার ঢাকা মেডিকেল কলেজে অপারেশন হলো।ঘা শুকিয়ে গেছে অপারেশন সাকসেসফুল পরদিন ছেড়ে দেবে। আমরা গেলাম মা কে বাসায় নিয়ে আসতে। দেখি দু তিনটা বেড আগে একটা বিছানায় বসে আছে ব্যাগ নিয়ে মুখটা কেমন অসহায়।অনেক বড় বড় চোখ ছিল আমার মা র কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। বল্লাম 'চলো তোমাকে নিতে এসেছি '।
মা বল্লো 'না সকালে যে ডাক্তার রিলিজ দিয়েছে তাকে এক ধমক দিয়ে দুপুরে রাউন্ডে এসে বিভাগীয় প্রধান মা কে এই সীটেই আবার ভর্তি করে নিয়েছে। বলেছে 'এই রোগীকে কে ছেড়েছে '?
আব্বা সিস্টারের কাছে গেল সেখানে জানলো আমার মা র ক্যান্সার। কি ভাবে যে সেখান থেকে আমার বাবা আমাদের বের করে আনলো আজ আর কিছু মনে নেই। শুধু মার সেই অসহায় চোখ দুটো ছাড়া।
জানলাম একদিন পরে সিস্টার ভুলে মা র পায়ের কাছে রিপোর্টগুলো রেখে এসেছিল আমার শিক্ষিত মা পড়ে দেখলো বায়াপসি রিপোর্ট ম্যালিগনেন্ট। তার আর বুঝতে বাকী রইলোনা।খালি আমরা ছোটো ভাইবোনরাই কিছু বুঝিনি।
এর পর এক দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। সৎ পুলিশ অফিসার আমার বাবা ঘুষ খেতোনা বলে উপর ওয়ালাকে কিছু দিতে পারতোনা, তার জন্য এখান থেকে সেখানে, সেখান থেকে ওখানে কিছুদিন পরপর পানিশমেন্ট ট্রান্সফার।
পাঁচ বছর পর আমি এস এস এসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছি। একদিন ক্লাস করি তিন দিন যেতে পারিনা। মায়ের সাথে হাসপাতালে। আমি আর আমার ছোটো বোন পালা করে থাকতাম। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ঐ কেবিনটা যেন আমাদের বাসা হয়ে পড়েছিল মাসের পর মাস থাকতে থাকতে।
আব্বার পেনশন ফান্ডের সব টাকা শেষ ।অফিসে আর ছুটি ছিলনা।
অনেক শখ করে আমার মাকে বিয়ে করেছিল আমার আব্বা। সম্পর্কে আত্মীয় ছিল।আমার মা কিছুতেই রাজী ছিলনা এই বিয়েতে। আমার আব্বার ধৈর্যের কাছে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়েছিল আমার নানা নানু।
আব্বার ধারণা ছিল আমার মা আবার সুস্হ হয়ে যাবে। কিন্ত তখন আমরাও বুঝেছিলাম মা যাচ্ছে অনেক দুরের দেশে যেখান থেকে কেউ কখনো ফেরে না। এর মধ্যে ও আমরা চার ভাইবোন লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
ডাবল কেবিন ছিল ।এক রোগী আসলো বেশ বয়স্কা। তার দু ছেলে ওখানকার ডাক্তার না ছাত্র আজ আর মনে নেই। তারা সারাক্ষন সাত আটজন বন্ধু নিয়ে বেশীরভাগ সময়ই সেখানে আড্ডা মারতো। এত বিরক্ত লাগতো বলার মত নয়। কতক্ষন বারান্দায় দাড়িয়ে থাকা যায়। ওরা না থাকলে খালাম্মাকে বলেছি আপনি তো সিংগেল কেবিনেই থাকতে পারেন।উনি বলতো না সেখানে ওনার ভালো লাগেনা।
সেদিন ভীষন জ্বর আমার।আব্বাকে ফোন করে বলেছি আমার বোনকে নিয়ে আসার জন্য, ও থাকবে আমি বাসায় যাবো। আজ কেবিন খালি। ওরা ওর মাকে নিয়ে আজ দুপুরে অন্য কেবিনে চলে গেছে। দেখা করার সময় শেষ।নার্স এসে ওয়ার্নিং দিয়ে গেল। আমি ব্যাগ গুছিয়ে বের হবো হঠাৎ পিছন ফিরে চেয়ে দেখি মা বিছানায় বসে (বেশীরভাগ সময় বসে থাকতো লাংসে পানি চলে এসেছিল) কেমন অদ্ভুত ভাবে গভীর এক দৃস্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে।আমি ফিরে এসে জড়িয়ে ধরে বল্লাম 'আমার জ্বর চলে গেলে আমি আবার আসবো'।
আমি বুঝিনি ।ঐ ছেলেগুলো বুঝেছিল, তাই তার মাকে তারা সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেদিন। আমার সেভেনে পড়া ছোটো বোনের হাতের উপর সেদিনই ভোর রাতে আমার মা চলে গেল সেই কোন না ফেরার দেশে। আমি ভোরে গিয়ে দেখি একটা পাতলা কম্বল দিয়ে ঢেকে রেখেছে। আমি শুধু কম্বলটা সরিয়ে একবারই বলেছিলাম 'এটা সরাও আমার মা র যে দম বন্ধ হয়ে আসবে...'।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ১২:১৭