অচেনা শিল্পীর হাতে আকা সান মার্কো প্লাজা
ব্রেড এন্ড ব্রেকফাস্ট, সুতরাং নাস্তাটা হোটেলেই হলো,
রুটি যে কতরকম হতে পারে তাই দেখলাম। আমার প্রিয় রুটি croissants তো ছিলই,
দু দিন পরে খেয়ে একটু তৃপ্তি পেলাম।
মাখন, জেলী, পনির, আর ডিমের স্বাদে তো কোনো পরিবর্তন নেই,
সাথে দু তিন রকম জুস আর ফল।
দু কাপ ক্যাপুচিনো দিয়ে নাস্তা পর্ব শেষ করে দুজন বের হোলাম গন্তব্যের দিকে---
ডজেস প্যালেস
ডজেস প্যালেস
ফেরোভিয়া থেকে জলবাসে সান মার্কো প্লাজা। ডজেস প্যালেস বর্তমানে এখন মিউজিয়াম, ওখানে ঢোকার টিকিট বেশ দামী। সেখানে দাড়িয়ে আমি ইতস্তত করছি,
আমার স্বামীকে বল্লাম, 'বাদ দাও, না দেখলে কি আর এমন হবে! দেখেছি তো অনেক'।
ও বল্লো 'ঠিক আছে তুমি দেখে আসো আমি বাইরে দাড়িয়ে থাকি'।
যখন ও দেখলো আমি একা যাচ্ছিনা তখন দুটো টিকিটই কিনে আনলো।
দেখে আসার পরে মনে হলো সত্যি না দেখলে মিস করতাম ।
গথিক ডিজাইনের ডজেস প্যালেস অনেকটা দূর্গের আদলে তৈরী যা শত্রুর আক্রমন প্রতিহত করার ব্যবস্হা যুক্ত। লেগুনের দিকে মুখ করে থাকা সামনের অংশ দিয়ে ভেতরে যাওয়ার দুটো প্রধান দরজা। তার একটি হলো প্রবেশপথ সেই স্বর্নালী অপূর্ব কারূকার্য মন্ডিত প্রাসাদে ঢোকার। নবম শতাব্দীতে শুরু হওয়া এই প্যালেস বর্তমান রূপ লাভ করে ১৪২৪ সনে ফিলিপ্পো ক্যালেনডারিওর ডিজাইনে।
ডজেস প্যালেসের করিডোরের কারুকাজ করা ছাদের একটি অংশ
ডজেসদের বাসভবন ছাড়াও প্রাসাদটি ব্যবহার করা হতো প্রজাতান্ত্রিক ভেনিসের প্রশাসনিক কার্যালয় হিসেবে। সাধারন মানুষের অভিযোগ জানানোর জন্য কাঠের বাক্স রাখা যে কক্ষটি ছিল তার নাম হলো hall of the bussola.
প্রত্যেকটি রুম সোনালী রংয়ের গিল্টি করা ভারী কারূকাজ, ছাদ থেকে চারদিকের দেয়াল পর্যন্ত।
একেকটি হলরুমের একেকটি নাম, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সালা ডেল সিনাটো, সালা ডেল এ্যান্টি কলেজিও, সালা ডেল ম্যাগিওর কনসিলিও ইত্যাদি ।
সালা ডেল ম্যাগিওর কনসিলিওর ছাদের অপূর্ব কারূকাজ।
অবাক বিস্ময়ে আমি শুধু দেখেই যাচ্ছি তাদের দম বন্ধ করা প্রাচূর্য আর শান শওকত।
আর হল ঘরের পর হল ঘর পার হয়ে যাচ্ছি।
যেতে যেতে একটি দরজা দিয়ে ছোট্ট একটা সেতুর উপর আসলাম,
যার অপর পারে বন্দীশালা ।
Bridge of sighs
এই সেতুটির নাম "Bridge of sighs " যার বাংলা করলে দাড়ায় দীর্ঘশ্বাসের সেতু!
চারিদিক দেয়াল ঘেরা সেতুটির উপরের দিকে
জাফরী কাটা ছোট্ট দুটো ঘুলঘুলি, যার মধ্যে চোখ রেখে ডজেস প্রাসাদের বিচারালয় থেকে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দীরা শেষবারের মতন পৃথিবীর আলো বাতাসটুকু দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে যেত!
তাদের মধ্যে কেউ কেউ আর কোনোদিনও পৃথিবীর আলো দেখেনি!
এই বন্দীশালা দেখে আমারতো দম আটকে যাচ্ছিল,
ছোটো ছোটো এক একটা কক্ষ যেখানে মাথা নীচু করে ঢুকতে হয় দরজা দিয়ে,
দেখলাম নিরেট অন্ধকার ঘরে শুধু কাঠ আর পাথরে তৈরী একটি ছোট বেন্চ!
বাতাস তো দুরের কথা এতটুকু আলো আসার কোনো পথ নেই,
শুধু ঐ ছোট্ট দরজার কঠিন গরাদের ফাক দিয়ে সামান্য আলোর আভা!
ভাবলাম এখানেই শেষ হয়ে গেছে কত অপরাধী আর নিরপরাধীর জীবন!!
এখানে মিউজিয়ামগুলোতে পিছু ফেরার কোনো উপায় নেই। দম বন্ধ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমার স্বামীর হাত আঁকড়ে , সরু গলি পথ ধরে।
আর ভাবছি সেই সব হতভাগ্যদের জীবনের করুন উপাখ্যান।
হাটতে হাটতে অবশেষে বের হয়ে আসলাম উন্মুক্ত একটি প্রাঙ্গনে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম।
পাশেই একটা কফি শপ দুজন দুটো ক্যাপুচিনো নিলাম।
মন থেকে ভারটা কিছুতেই নামাতে পারছিলাম না ।
ছোট্ট একটু পানিপথ দিয়ে বিচ্ছিন্ন পাশাপাশি দুটো স্হাপনা যা কিনা যুক্ত
দীর্ঘশ্বাসের সেতুর মাধ্যমে, কিন্ত কি আকাশ পাতাল পার্থক্য তাদের সর্বাঙ্গে !!
আকাডেমিয়া
আকাডেমিয়ায় সংরক্ষিত একটি ছবি -paolo-da-venezia-র আঁকা
জলবাস থেকে নেমে ব্রীজ পার হয়ে টিকিট কেটে ঢুকলাম বিখ্যাত আর্ট গ্যালারী আকাডেমিয়ায়।
সেখানে ক্রমানুসারে প্রদর্শিত আছে আঠারোশ সালের আগে আঁকা বিখ্যাত সব শিল্পীর ছবি। যেমনঃ জেন্টিলি, বেল্লিনি, লরেন্জো লোট্টো , টিশিয়ান , জর্জিনো এবং ভিন্চির সমস্ত মাস্টারপীস।
এই শিল্পের মহাসাগরে আমার মত একজন সাতার না জানা লোক কার কথা বলবে!!
তবুও এর মধ্যে জর্জিনোর দ্যা টেম্পেস্ট, বেল্লিনির ম্যাডোনা এন্ড দ্যা চাইল্ড আমার ভীষন ভালো লেগেছে। এছাড়া ও এখানে আছে ভিন্চির আকাঁ বিখ্যাত ছবি "Vitruvian Man"ছবিটা।
সব ঘুরে দেখতে অনেক সময় লাগলো । কেমন আচ্ছন্নের মত লাগছিল,
আমি কি হাজার বার ছবিতে দেখা, বইয়ে পড়া এসব বিখ্যাত শিল্পীর ছবি
নিজের চোখে দেখছি!!
অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল !
জিওভান্নি- বেল্লিনির আঁকা ম্যাডোনা এন্ড দ্যা চাইল্ড ছবি টি।
বের হতে হতে দুপুর গড়িয়ে আসলো, ফিরে আসলাম হোটেলে।
বিকালে হোটেল থেকে হেটে হেটে যাচ্ছি বিখ্যাত রিয়াল্টো ব্রীজ দেখতে। পথে পড়লো ছোট ছোটো ঘরে বসে এক একজন নাম না জানা শিল্পী যারা মুরানো (মুর থেকে আসা কাচ শীল্প) কাঁচের এক একটি অপূর্ব শিল্প কর্ম সৃষ্টি করে যাচ্ছে।ওখানে বিক্রীও হয়।অনেক ট্যুরিষ্ট রা কিনছে।
একজন বানাচ্ছে গুবরে পোকা, মাছি, ছোট্ট মলা মাছ, তার শরীরটা ও আবার আশেঁ চিকচিক করছে, এ ধরনের ছোট্ট ছোট্ট প্রানী। কিযে অপূর্ব, তবে অসম্ভব দাম।
আমরা অন্য একটি শিল্পীর কারখানা থেকে আমাদের সামনেই হাতে বানানো মুরানো কাচের ছোট্ট চারটি হাতী আর দুটো পেঁচা কিনলাম।
ছোট ছোটো হাতীর মুর্তি কালেকশন করা আমার স্বামীর হবি। পৃথিবীর নানা দেশের নানান জিনিসে তৈরী এই হাতীর শখ পূরণে কোনো কিছুই তাকে আটকে রাখতে পারেনা।
মুরানো কাচের হাতী ও পেঁচা
রিয়াল্টো ব্রীজ
এই সেই বিখ্যাত রিয়াল্টো ব্রীজ
এবার আস্তে আস্তে বিখ্যাত রিয়াল্টো ব্রীজে এসে হাজির হোলাম।সেখানে বিভিন্ন পশরা সাজিয়ে বসে আছে ভ্রাম্যমান দোকানদাররা। অনেক কিছুর সাথে বিক্রী হচ্ছে অপরুপ সুন্দর এক একটি মুখোশ যা ভেনিসের বিখ্যাত কার্নিভালে ব্যবহার করে থাকে অংশ গ্রহন কারীরা। একটা মুখোশ কিনলাম টোকেন হিসেবে।
কার্নিভালের মুখোশ
থাক মুখোশ আমার হাতে, আমি রেলিং ধরে দাড়িয়ে আছি গ্র্যান্ড ক্যানেলের দিকে চেয়ে। ১১৮১ সনে শুরু হয়ে বিভিন্ন ভাঙ্গাগড়ার পর ১৫৯১ সালে শেষ হয় এই ব্রীজ। এর দু দিকের দেয়ালের মাঝখানে বড় একটা খিলান আর দু পাশে ছয়টা ছয়টা মোট বারোটা খিলান। পাথরের তৈরী ২৮ মিটার দীর্ঘ এই সেতুটি পানির উপর মাত্র ৭.৫ মিটার লম্বা যেখানে গ্র্যান্ড ক্যানেলটি সর্বাপেক্ষা ক্ষীনকায়া।
সন্ধ্যা নেমে আসছে, রেলিং ধরে দাড়িয়ে আছি পানির দিকে তাকিয়ে,
বরফ দেয়া কোকের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছি ।চারিদিকে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পর্যটকের ভীড়।
সারাদিনের প্রচন্ড গরম কমে আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে আসা বাতাস উপভোগ করছি।
ভাবছি রিয়াল্টো আর কোনোদিন তোমার সাথে দেখা হবে কিনা জানিনা !
ক্যানেলে অনেক কিছুর সাথে গন্ডোলাও ভেসে যাচ্ছে তবে আমাদের চড়া হয়নি, কারন ভাড়া সাংঘাতিক! তবে ছবি রইলো।
গন্ডোলা, গ্র্যান্ড ক্যানেলে যাত্রীর অপেক্ষায়
জলযান ছাড়া আরতো কোনো যানবাহন নেই সেখানে,
ধুলিহীন সেই নগরীর পাথর বাধানো সরু সরু গলিপথ দিয়ে ফিরে আসছি,
হঠাৎ অবাক হয়ে দেখি ঘাসে ছাওয়া একটু ছোট্ট খোলা জায়গা যা ভেনিসে অকল্পনীয়, ক্যানেলের দিকে চেয়ে আছে তাতে দু একটা গাছ আর দুটো বেন্চ পাতা ।
বসলাম ক্লান্ত পা দুটোকে জিরিয়ে নিতে।
দেশে রেখে আসা আমার ছেলের কথা মনে করে ভীষন খারাপ লাগছে।কি করছে কে জানে!
ক্যানেলের ওপাশে রেল স্টেশন দেখা যাচ্ছে,কাল যেখান থেকে ট্রেনে চড়বো ফ্লোরেন্সের উদ্দেশ্যে।
চেয়ে দেখছি পানিতে ভেসে যাচ্ছে বিভিন্ন নৌযান,
হঠাৎ চমকে উঠে দেখি ভয়ংকর গতিতে ছুটে যাচ্ছে পলিজিয়া লেখা পুলিশের স্পীডবোট,
যার তীব্র গতিতে সৃষ্ট বিশাল ঢেউ ক্যানেলের ধারে বেধে রাখা নৌকাগুলোকে প্রচন্ড শব্দে তীরের সাথে আছ্ড়িয়ে ফেলছে।
তাড়াতাড়ি উঠে দেখলাম পুলিশগুলো বিখ্যাত স্কালজী ব্রীজের উপরে,
যেখানে দুদিন ধরে দেখছি কিছু বাংলাদেশী ছেলে আর আফ্রিকান রা
ছোটোখাটো জিনিস বিক্রী করছে।
আমরা আস্তে আস্তে হোটেলে ফিরছি রী র উপর ছোট্ট সেতু পার হবো,
দেখি আমাদের দেশের সেই ছেলেগুলো। মলিন চেহারা। আমরা গিয়ে আলাপ করলাম।
ছল ছল চোখে বল্লো তাদের দুঃখের গল্প,
পুলিশ কেড়ে নিয়ে গেছে তাদের সব মালামাল।
দালালকে নিয়মিত টাকা দিতে হয়, কি ব্যবসা করবে আর কোথায় বসবে তার জন্য।
মেস্ট্রে থেকে প্রতিদিন এখানে আসে তারা, কারণ ভেনিস ভীষন এক্সপেন্সিভ থাকার জন্য।চেহারা দেখে মনে হলো ভালোমত পেটপুরে বোধহয় খাওয়াও হয়না তাদের।
দু একজন বলছিল 'বাড়ীতে এক গ্লাস পানিও ঢেলে খাইনি আর এখানে
জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ'। বাড়ীতে কিছু জানাতেও পারেনা। বাবা মা চিন্তা করবে !
অনেক টাকা খরচ করে আসা মোহে বা বেকারত্ব সইতে না পারা হতভাগ্য ছেলেগুলো।
এদের মধ্যে দু একজন বি,এ, এম, এ পাশ ও ছিল। অসহায় ভাবে শুনলাম এই অসহায় ছেলেগুলোর কাহীনি, মনটা ভীষন খারাপ হয়ে গেল ।
ফিরে আসলাম হোটেলে মন ভার করা এক অনুভূতি নিয়ে।
কাল বারোটায় চেক আউট তবুও ব্যাগ গুলো গুছিয়ে রাখছি কারন
সকালে উদ্দেশ্যহীন ভাবে যদি ঘুরতে বেরিয়ে যাই,
তখন যেন ওগুলো হোটেলের কাউন্টারে রেখে যাওয়া যায়।
আর সেই সাথে গুছিয়ে রাখছি আমার স্মরণীয় ভেনিস ভ্রমনের স্মৃতির পাতাগুলো।
এখানেই শেষ হলো আমার স্বপ্নের ভেনিস ভ্রমন সাথে কিছু দুঃস্বপ্নকে সঙ্গী করে!
আমার সাথে কষ্ট করে ঘুরে বেড়ানোর জন্য সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ জানাই আমার স্বামীকেও,
ছবি সংযোগে তার সহযোগীতার জন্য।
-----০------
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০১৯ সকাল ১১:০৯