.
.
.
সেই তখন থেকেই অভ্র বসে আছে পুকুরপাড়ে। মনটা খারাপ। বাবার কাছে বায়না ধরেছিল বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যাবে খুলনা। সেখানে ওর এক বন্ধুর বড় বোনের বাড়িতে কয়েকজন মিলে যাবে। ওরা প্ল্যানিং ও করে ফেলেছে খুলনা থেকে ওরা সুন্দরবন যাবে ঘুরতে। বনাঞ্চল, পাহাড় অভ্রের খুব পছন্দের। তাই সে খুব খুশি এই প্ল্যানিং এ। কিন্তু কারো পরিবারের বড়রা এটা জানে না। বন্ধুর বোনের বাসায় যাবে বলে সবার পরিবারই রাজি হলো। ভাবলো ছেলেরা তো কলেজে উঠেছে। মাঝে বেশ লম্বা ছুটিও পেয়েছে। যাকনা একটু ঘুরে আসুক।
কিন্তু অভ্রের বেলায় বাধা দিলো ওর বাবা। বাবা বেশ কিছু নিতিবাক্য শুনিয়ে অভ্রকে যেতে দিল না। কারণ অভ্রের মা ভাই বোন কেউ নেই। আপন বলতে বাবা ছেলেই একে অপরের আপন। কিন্তু বাবা যেতে দিচ্ছে না এই নিয়ে অভ্র মন খারাপ করে বসে আছে পুকুরপাড়।
.
পুকুরটি অনেক পুরোনো আমলের। অনেক বড়, পুকুরটির চারপাশে অনেকগুলো ঘাট রয়েছে। সবগুলো কাঠ আর বাশ দিয়ে তৈরি। এই ঘাটটি পাঁকা করা। সেই বৃটিশ দের আমলে ওরাই এই ঘাটটি করেছিল। অনেকটা ভেঙে চুরে আছে। শেওলাও পরে আছে পুরো ঘাট জুরে। তাই এই ঘাটটি কেউ ব্যাবহার করে না। এই পুকুরটি তেই অনেকে আসে না। পুকুরটি নিয়ে নাকি নানান গুজব আছে। কিন্তু অভ্রের খুব ভালো লাগে পুকুরপাড়ে এসে এই ভাঙা ঘাটটি তে বসে থাকতে।
.
প্রতিদিন এই সময়টা অভ্র এখানে আসে। এতদিনে পুকুরে একটা মাছও নড়াচড়া করতে দেখেনি অভ্র। কিন্তু আজ হঠাৎ একটা পানকৌড়ি এসেছে পুকুরটি তে। অনেক্ষন এদিক থেকে সেদিক ডুবাডুবি করছে পানকৌড়ি টি। অভ্রের দেখে মনে হচ্ছে পানকৌড়ি টি অস্থির হয়ে কি যেন খুজছে। হঠাৎ পানকৌড়ি টি ডুব দিয়ে আবার ভেসে উঠে মুখে কি যেন নিয়ে। অভ্র একটু অবাক হয়। পানকৌড়িটির মুখে যা আছে সেটা একটা ঘরির মত। আর সেটা ধিরে ধিরে অভ্রের দিকেই আসছে।
.
ঘাটের ঠিক কাছে এসেই একেবারে নিচের সিরিতে মুখের জিনিস টি রেখে পানকৌড়ি টি আবার পুকুরে ডুব দেয়। অভ্র ভাবে ওটা আবার ফিরে আসবে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষন হয়ে গেলো পানকৌড়ি টি ভাসছে না। অভ্র আবারো অবাক হয়। এতক্ষন তো ডুব দিয়ে থাকার কথা না। তবে এটা কি অন্যকিছু? আর কিছু না ভেবে নিচের সিরিতে যায় অভ্র।
--আরে হ্যা এটা তো একটা ঘড়িই।
ঘড়িটি হাতে নেয় অভ্র।
--কিন্তু এ কি? ঘড়িটি এমন অদ্ভুত কেন? সাধারণ ঘড়িতে ১-১২ পর্যন্ত সংখ্যা থাকে আর তিনটা কাটা ঠাকে। কিন্তু এ ঘড়িতে ১০০-১০০০ পর্যন্ত সংখ্যা, আর মাত্র একটা কাটা। এর মানে কি? অবাক হয়ে ভাবে অভ্র।
.
হঠাৎ অভ্র দেখতে পায় ঘড়ির পাশে একটা চাবি আছে যেটা দিয়ে কাটা টা ঘুরানো যায়। অভ্র কি মনে করে চাবিটি ঘুরাতে লাগলো। কাটাটিও ঘুরছে সাথে। কাটাটি যখন এক হাজাড় এর ঘরে আসলো তখন অভ্র থামলো।
--একি? আমার এমন লাগছে? মনে হচ্ছে মাথাটা ছিড়ে যাচ্ছে। আর সবকিছু এত দ্রুত পালটে যাচ্ছে কেন?
এসব ভাবতে থাকে অভ্র। কারণ অভ্রের চারপাশের সবকিছুই কেমন দ্রুত বদলে যাচ্ছে। চারদিকে যেন ঘন থেকে আরো ঘন ঝোপঝাড় জঙ্গল সৃষ্টি হচ্ছে। একসময় প্রচন্ড মাথার যন্ত্রণায় জ্ঞান হারায় অভ্র। জ্ঞান ফিরে বেশ কিছুক্ষন পর।
.
কিন্তু চোখ খুলে যেন অভ্র আরো অবাক, সাথে ভয়ও পাচ্ছিলো।
--এ কি? এ আমি কোথায় আসলাম? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। এর ঝোপঝাড় কেন?
কে আছো আমাকে বাচাও.... আমাকে বাচাও.....
বলে চিৎকার করতে থাকে অভ্র। কিন্তু সে জানে না যে সে আর বর্তমান ডিজিটাল যুগে নেই। সে চলে গিয়েছে সেই এক হাজাড় বছর পূর্বেকার আদি যুগে। যেখানে মানুষ ছিলো খুবই কম। ঝোপঝাড়, জঙ্গল, নানান পশুপাখি, বিষাক্ত সাপ সহ আছে আরো কত হিংস্র প্রজাতির পশু।
.
অভ্র চিৎকার করতে করতে কারো সারা না পেয়ে একসময় ঝোপঝাড় ঠেলে নিজেই সামনের দিকে এগুতে থাকে। কিন্তু যত এগুচ্ছে ততই ভয়ের মাত্রা বেড়েই চলেছে অভ্রের। জঙ্গল যেন ঘন থেকে আরো ঘন হচ্ছে। আর বিভিন্ন পোকামাকড় লাফিয়ে লাফিয়ে অভ্রের উপরে পরছে। আশেপাশে যতদূর চোখ যাচ্ছে শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল।
এখন তো পায়ের নিচে পরছে অজানা বিভিন্ন বিষাক্ত সাপ। ছোবল মারতে আসছে অভ্রকে। এখন অভ্রের মনে হচ্ছে ঐ ঘড়িটি সবকিছুর মূল। ঘড়িটির জন্যই এমন অচেনা অজানা একটা যায়গায় এসে পরেছে অভ্র। মনে মনে নিজেকেও দোষারোপ করছে অভ্র।
--কি দরকার ছিলো ঘড়িটি হাতে নেয়ার? সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি।
.
এসব ভাবতে ভাবতে যখন অভ্র সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন বিশাল এক হুংকার শুনতে পায় অভ্র। মনে হচ্ছে এটা বাঘের হুংকার।
--তবে কি এখানে বাঘও আছে?
ভেবেই আৎকে উঠে অভ্র। আবার মনে কেমন যেন একটু রোমাঞ্চকর ছোঁয়াও লাগে। অভ্র ভাবে বাবা আমাকে ঘুরতে যেতে দেয়নি। তাই হয়তো পানকৌড়ি টি ওর দুঃখ বুঝে ঘড়িটি দিয়েছে। অভ্র এতক্ষনে বুঝতে পেরেছে। ঘড়িটি আসলে সাধারণ কোন ঘড়ি নয়। এটা একটা টাইম মেশিন।
--যাক ভালোই হলো.. আমার বন-জঙ্গল, পশু-পাখি সব দেখা হবে। কিন্তু আগের অবস্থায় ফিরবো কি করে? যা হবার হবে। পরে দেখা যাবে সব। আগে দেখি বাঘটা কোথায়?
.
ভাবতে ভাবতে অভ্র বাঘটি কে খুঁজতে থাকে। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না অভ্র। বাঘ খুঁজতে গিয়ে অনেক জন্তুজানোয়ার দেখেছে অভ্র। কিন্তু কোনটা কেই চিনতে পারছে না সে। অভ্র ভাবে এত অনেক আগের। তাহলে এগুলো হয়ত বইয়ে আবিষ্কার হয়নি। তাই চিনতে পারছে না। কিন্তু সেই হুংকারটি এখনো অভ্রের কানে আসছে। হুংকারের শব্দ ধরে এগুতে থাকে অভ্র। ঝোপঝাড় ঠেলে যেতে অনেক কষ্ট হচ্ছে অভ্রের। অভ্র বইয়ে পড়েছিল আদি যুগের মানুষেরা পাথর দিয়ে, দা ছুরি অস্ত্র বানাতো। অভ্রও পাথর খুঁজতে থাকে আশেপাশে।
.
একটু এদিক সেদিক খুঁজতেই ছোটমত একটা নদী খুঁজে পায় অভ্র। তা দেখে অভ্র খুব খুশি হয়। হাত পা ধুয়ে নেয় নদীর পানিতে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে এখানেই অনেক পাথর। লম্বা চিকন মত একটা পাথর হাতে তুলে নেয় অভ্র। পাথর তুলেও অভ্র অবাক।
--একি এটা কি পাথর? পাথর এত হালকা কেন? যাই হোক ভালোই হলো। লাঠির মত ব্যাবহার করা যাবে এটাকে।
ভেবেই অভ্র নদীর পাড় ধরেই হাটতে থাকে। কারণ অভ্র টিভিতে দেখেছিল নদীর পাড় ধরে তারাতারি এগুনো যায়, লোকবসতি ও পাওয়া যায়।
.
অভ্র যত এগুচ্ছিলো সেই হুংকারের শব্দটা যেন আরো কাছে আসছিলো। একসময় অভ্র ভাবে এতো বাঘের হুংকার নয়। তবে কি এটা? আমাকে খুঁজে দেখতেই হবে। বেশ কিছুটা এগিয়ে অভ্র আবার শুনতে পায় হুংকার এর শব্দটা জঙ্গল থেকে আসছে। শব্দটার নেশা ধরে যায় অভ্রের। কি এটা খুঁজে বের করতেই হবে অভ্রের। তাই আবার জঙ্গলে ঢুকে অভ্র। পাথর দিয়ে গাছে আঘাত করতে করতে এগুতে থাকে। কিন্তু এবার বেশি খুঁজতে হয়নি।
.
হঠাৎ অভ্র দেখতে পায় বিশাল একটা দানবের মত কি যেন এই হুংকার করছে। অভ্র ঠিক চিনতে পারছে না এটা কি। হাতির থেকেও বড় দানবটি। ইয়া বড় দাঁত দেখা যাচ্ছে হুংকারের সময়। অভ্র ভয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। নড়াচড়া করলেই যদি দানবটি দেখে ফেলে আর ওকে আক্রমণ করে বসে? কিন্তু অনেক সাবধানতা বসতও অভ্রকে দেখে ফেলে সেই অচেনা দানবটি। অভ্রকে দেখেই আবার বিশাল হুংকার দিয়ে উঠে দানবটি। ইয়া বড় বড় পা ফেলে এগুতে থাকে অভ্রের দিকে। অভ্র যেন ভয়ে জমে গিয়েছে। পালানোর কথাও ভুলে গিয়েছে সে। নড়াচড়া করতে পারছে না।
.
দানবটি আসতে আসতে ঠিক অভ্রের সামনে এসে দাঁড়ায়। অভ্র কিছুই করতে পারছে না। অভ্রের সামনে দাঁড়িয়ে দানবটি আবার বিকট শব্দে হুংকার ছাড়ে। তারপর বড় একটা হা করে দানবটি। কিন্তু অভ্র ততক্ষণে বুঝে গিয়েছে আজই ওর শেষ দিন। এখনই দানবটি ওকে ছিন্নবিন্ন করে খাবে। এ সময় বাবার কথা খুব মনে পড়ছে অভ্রের। অভ্র মনে মনে প্রার্থনা করছে যদি ওর বাবা কে আর একটিবার দেখতে পেত? দানবটি অভ্রের আরো কাছে চলে আসে। একসময় অভ্রকে গিলে খেতে যাবে তখনই পিছন থেকে অভ্রের নাম ধরে কে যেন ডাকতে থাকে। অভ্রের মনে হচ্ছে কন্ঠটা ওর খুব পরিচিত।
.
--হ্যা বাবার কন্ঠই তো। বাবা এখানে? আরো কয়েকটা ডাক আসে অভ্রের নাম ধরে। কিন্তু পিছু ফিরে তাকাবার মত আর সময় নেই। ততক্ষণে দানবের বিশাল দাঁত ওয়ালা মুখটি অভ্রের ঠিক মাথার কাছে। চোখ বন্ধ করে ফেলে অভ্র। আবার ওর বাবার কন্ঠে জোরে একটা ডাক শুনতে পায়।
হঠাৎ ধরফর করে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে অভ্র।
--তাহলে কে এতক্ষন আমি..??
আর কিছুই ভাবতে পারেনা অভ্র। লাফিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি কে। লোকটি আর কেউ নয়। স্বপ্নেও বিপদ থেকে বাঁচানো সেই লোকটি। অভ্রের বাবা।
.
হ্যা অভ্র এতক্ষন দুঃস্বপ্ন দেখছিলো।
কাল রাতেই অভ্র যখন ওর বাবা কে বলেছিলো খুলনা যাবে তখনই ওর বাবা রাজি হয়েছিলো। একমাত্র মা মরা ছেলে। যদি না করে ছেলের মন খারাপ হতে পারে ভেবেই রাজি হয়েছিলো। অভ্রও সেই খুশি তে ফ্রেন্ডদের জানিয়ে রাতে তারাতারি ঘুমিয়ে যায়। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এই স্বপ্ন দেখে।
স্বপ্নেও ঠিক যখনই ওর বড় বিপদ তখনই বাবা এসে বাঁচিয়ে দেয়।
এটা ভেবে অভ্র খুলনা যাওয়ার কথা মাথা থেকে মুছে ফেলে। বাবা কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। বাবা বারবার জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলেনা। শুধু বলে
--বাবা আমি তোমাকে ছেড়ে খুলনা যাবো না। তোমাকে ছেড়ে দূরে কোথাও থাকতে পারবো না।
অভ্রের বাবা ছেলের পাগলামি দেখে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর বলছে....
→পাগল ছেলে আমার।
.
.
(বাবা নামের মানুষটা সবসময়ই আমাদের মাথার উপর নিরাপত্তার ছায়া হয়ে থাকে)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৬ দুপুর ১২:৩৯