এই বিনোদন কেন্দ্রটির নামটা ইকটু স্পুকি। আমাদের জামালপুর, শেরপুরের মানুষগুলো এতটাই সহজসরল যে নাম রাখার ব্যাপারে তারা মোটামুটি উদাসীন। তাই দর্শনীয় এ স্থানটি যে গ্রামে তার নাম তারা দিয়েছে "লাউচাপড়া"। এই নাম নিয়েই পর্যটনকেন্দ্রটির নামও "লাউচাপড়া বিনোদন কেন্দ্র"। চারদিকে পাহাড়ঘেরা এই এলাকাটি অসম্ভব সুন্দর একটি জায়গা। ক্ষণিকের জন্য মনে হতে পারে আপনি রাঙামাটি অথবা সিলেটের কোন পাহাড়ি এলাকায় আছেন।
শেরপুর বলতেই আমরা গজনী অবকাশ কেন্দ্র এবং মধুটিলা ইকো পার্ককে বুঝি। কিন্তু এই দুটি স্থানের পর সবচাইতে বেশি পর্যটক টানে এই স্পটটি। গজনীর আর আগের মত সেই জৌলুস নেই। মধুটিলাতে অনেকেই হয়ত এসেছেন। তাই এটি কমন হয়ে গেছে। কিন্তু লাউচাপড়া বিনোদন কেন্দ্রটি তুলনামূলক নতুন হওয়ায় পরিচিতি কম। আজকে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেই স্থানটির সাথে-
অবস্থানঃ জামালপুর জেলা থেকে ৫০ কিলোমিটার এবং বকশীগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তরে ভারতের তুরা পাহাড়ের পাদদেশে সরকারি প্রায় ১০ হাজার একর জায়গা জুড়ে গারো পাহাড়। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের পাহাড়ি এ বনভূমিতে জামালপুর জেলা পরিষদ ৯৬ সালে ২৬ একর জায়গা জুড়ে গারো পাহাড়ের চূড়ায় নির্মাণ করেছে ক্ষনিকা নামের পর্যটন কেন্দ্র । জেলার একমাত্র বিনোদন কেন্দ্রটি বকশীগঞ্জের কামালপুর মিদ্যাপাড়া মোড় থেকে লাউচাপড়া পর্যটন কেন্দ্র পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার পাহাড়ি সড়কটি শেরপুর জেলা সড়ক ও জনপথ বিভাগের আওতাধীন। এক যুগ আগে রাস্তাটি নির্মিত। ছোট দুটি ব্রিজ ও সড়ক হয়ে লাউচাপড়া পর্যটন কেন্দ্রে আসতে হয়।
দর্শনীয় যা আছেঃ প্রকৃতির রূপ লাবন্য মনোমগ্ধকর ছোট বড় অসংখ্য সবুজ পাহাড়ে ঘেরা বকশীগঞ্জের এই গারো পাহাড়। প্রকৃতির উজার করা সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত ভারতের মেঘালয় সীমান্তঘেঁষা এ পাহাড়ি জনপদ আনন্দ জুড়িয়ে দেয় প্রকৃতি প্রেমিক মানুষের মন। এ পাহাড়ের ২৬ একর বনভূমি জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে লাউচাপড়ার ক্ষনিকা পর্যটন কেন্দ্র । অপার সম্ভাবনাময় এ পর্যটন কেন্দ্রটিকে ঘিরে বিনোদন পিয়াসী মানুষের প্রবল আর্কষণ রয়েছে। আমি আগেই বলেছি পুরো এলাকাটি পাহাড় ঘেরা। প্রচুর গাছ-গাছালিতে পরিপূর্ণ সবুজের এই সমারোহে নিজের খেই হারিয়ে ফেলবেন। চারদিকে পাহাড়ঘেরা এই এলাকাটি অসম্ভব সুন্দর একটি জায়গা। ওয়াচ টাওয়ারের ওপর থেকে পুরো এলাকাটি দেখলে যেকোন নাস্তিকও বিশ্বাসী হয়ে উঠবে। পাহাড়ী রাস্তার মাঝে মাঝে ঘুড়তে গিয়ে হয়ত নিজের শৈশবও ফিরে পাবেন। আঁকাবাকা সিড়ি বেয়ে উঠতে পারেন প্রিয় মানুষটির হাত ধরে। তবে আমি মনে করি একদিনে পুরো এলাকা ঘুড়ে দেখা সম্ভব না। সৌন্দর্য রয়েছে প্রতিটি দিকে। কোন দিকেরটা আগে দেখবেন ভেবে কিনারা করতে পারবেন না।
এখানকার পাহাড়ে এসে দেখা যাবে হাজারো প্রশান্তির বৃক্ষরাজি পাখিদের কোলাহল, ঝর্ণার কলতানে মুখরিত এ পর্যটন কেন্দ্রে ১শ ৫০ফুট উচুঁ পাহাড়ের চূড়ায় নির্মাণ করা হয়েছে ৬০ ফুট সুরম্য পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, টুরিস্ট কমপ্লেক্সসহ নানা স্থাপনা। টাওয়ারে দাড়িয়ে চারদিকে তাকালে চোখ পড়ে শুধু পাহাড়ের দূরের ও কাছের আকাশ ছোয়াঁ উচুঁ উচুঁ চূড়া। এ যেন সবুজ গালিচার মোড়া প্রকৃতি। এসব পাহাড়ের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে স্বচ্ছ পানির ঝর্ণার ধারা। শোনা যায় অসংখ্য পাখির কলকাকলি। কোথাও গহীন জঙ্গল আবার কোথাও দেখা যায় বৃক্ষহীন ন্যাড়া পাহাড়। আরও দেখা যায় ওপাড়ে সীমানা পেরিয়ে ভারতের মেঘালয়ের অসংখ্য পাহাড়। ভারত সীমান্ত পাহাড়ের কূলে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের অপূর্ব দর্শন। এছাড়া পায়ে হেটে চারদিকে ঘুরে পাহাড়ের উচুঁ নিচু ও আঁকা বাঁকা পথ চলতে চলতে দেখা যাবে সৌন্দর্যে মাখা বি¯তৃত অঞ্চল। এসব দৃশ্যাবলী দেখে মনে হবে কোন নিপুন চিত্রকর তার রঙের ভান্ডার উজার করে পরম যতেœ অংকন করেছেন মনোলোভা আলপনা। পাহাড়ের বিরাট এলাকা জুড়ে রয়েছে আকাশমনি বেলজিয়াম ইউক্যালিপটাস উডলট কড়ইবৃক্ষ ছাড়াও চেনা অচেনা নানা জাতের লতাগুল্ম আর বাহারি গাছ গাছালির সৌন্দর্য মন্ডিত সবুজের সমারোহ। লাউচাপড়া , সাতানিপাড়া , দিঘলাকোনা , গারোপাড়া, বালিজোড়া, মেঘাদল শোখনাথপাড়া প্রভূতি গ্রামের গহীন গারো পাহাড়ের চূড়ায় কিংবা পাশের কুল ঘেষেঁ সবুজের আড়ালে খড়ের অথবা মাটির ঘরে বসবাসরত গারো কোচদের চোখে পড়বে। আর এরই টানে অসংখ্য পর্যটক শীতের কুহেলিকা আর গানের টানে এখানে এসে ভিড় জমায় প্রতিবছর। শীত মৌসুমের প্রতিদিন অসংখ্য অতিথিদের পদভারে নির্ভিত অঞ্চলটি হয়ে ওঠে উৎসবমুখর।
যেভাবে আসবেনঃ ঢাকা থেকে বা অন্য যেকোন এলাকা থেকে বাস যোগে শেরপুর অথবা জামালপুর আসতে হবে। সেখান থেকে সিএনজি যোগে আসতে হবে বকশীগঞ্জে। এখানে আসার পর যেকোন অটোরিকশা বা রিকশাযোগে চলে আসতে পারেন লাউচাপড়ায়। সবাই এক নামে চেনে....
খরচ যেমন পরবেঃ শেরপুর বা জামালপুরে আসতে এলাকা ভেদে ভাড়া ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তাই সেটা সম্পূর্ণ আপনাদের ওপর ডিপেন্ড করে। জামালপুর অথবা শেরপুর নামার পর এই দুই এলাকা থেকেই সিএনজিতে বকশীগঞ্জ আসতে ৫০ টাকা লাগবে। তারপর অটোরিকশাতে ২০ টাকা খরচ হবে একদম গেটে এসে নামতে। এই বিনোদনকেন্দ্রের ভেতরে গাড়ি রাখার ব্যবস্থাও রয়েছে। মজার ব্যাপার হল এখানে যে গাড়িই ঢোকান না কেন তার জন্য জিপি দিতে হবে ৪০ টাকা। আর জনপ্রতি প্রবেশ মূল্য মাত্র ৫টাকা। ভেতরে রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। টাওয়ার থেকে পুরো এলাকা অবলিলায় দেখা সম্ভব। সেখানে উঠতে হলে ১০ টাকা দিতে হবে। আশা করি এই অল্প খরচে এমন একটি স্থান ঘুরে যেতে কার্পণ্য করবেন না।
কেউ পরিবার অথবা বন্ধুবান্ধব সমেত থাকতে চাইলে থাকতেও পারবেন। ওই যে বললাম একদিনে সব দেখা সম্ভব না। এখানে থাকার জন্য কর্তৃপক্ষ বেশ সুন্দর ব্যবস্থা করেছে। নামমাত্র টাকায় আপনি হোটেলে থাকতে পারেন। তবে হানিমুনের জন্য আমি কাউকে এই জায়গাটি সাজেস্ট করবো না। বেশ লোক সমাগম হয় তাই আপনাদের প্রাইভেসি ক্ষুণ্ণ হতে পারে। যদিও কর্তৃপক্ষ ভিআইপি লাউঞ্জের ব্যাপারে বেশ কড়া। হোটেলের আশেপাশে মানুষকে কমই ঘেষতে দেয়।
তাই আর দেরি কেন ? অনেক তো ঘুরলেন রাঙামাটি-কক্সবাজার। আসুন দেখে যান এই সুন্দর জায়গাটি। স্বল্প খরচে বেশ ভাল একটি জায়গা বটে। অবশ্যই ভাল লাগবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ৯:৫৫