নব্বইয়ের দশকের শুরুতে 'পাগল মন' গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান দিলরুবা খান। গানের 'জনপ্রিয়তা'ই দর্শকরা দেখেছেন কিন্তু এর পেছনেও রয়েছে অনেক গল্প। পাগল মনের পেছনের গল্প নিয়ে কথা বলেছেন বিডি এক্সপ্রেসের সাথে-
১৯৯০ সালের কথা। আমার বাসায় আসলেন গীতিকার আহমেদ কায়সার, সুরকার আশরাফ উদাস। বললেন একটা গান করেছি। সেটা আপনাকে গাইতে হবে। তখন মানুষ আমার টুকটাক নাম চেনে। আমি বললাম কোথায় গাইতে হবে? জনালেন রেডিওতে। আমি স্বাভাবিক একটা গানের মতোই গানের মতোই রেডিওতে গেয়ে এলাম। আমার মধ্যে আলাদা কোনো প্রতিক্রিয়া নাই। কিছুদিন পর একটা স্টেজ প্রোগ্রাম করতে গেছি, খেয়াল করলাম সেখানে কিছু মানুষ 'পাগল মন' গান শোনার আহবান জানাচ্ছে। আমি গাইলাম। দর্শকেরা বেশ মজা করল। এরপরে যেখানেই স্টেজ প্রোগ্রাম করতে যেতাম সেখানেই পাগল মন গানের অনুরোধ আসতে থাকে। তখন চিন্তা করলাম আমার গানের একটা অ্যালবাম করলেই তো হয়। যদিও তখন অ্যালবাম ছিল আমার।
১৯৯২ সালের কথা। তখন ডন মিউজিকের বাবুল চৌধুরীর কাছে গিয়েছিলেন দিলরুবা। বাবুল চৌধুরী অ্যালবাম বের করবেন তবেঁ শর্ত দিলেন যে টাকা পয়সা দিতে পারবেন না। দিলরুবা রাজি হয়ে গেলেন। 'আমি রাজি হলাম তবেঁ তাঁকে বললাম আমার মিউজিকের খরচটা দিতে। সেটা তিনি দিলেন। আলী আকবর রূপুর সঙ্গীত আয়োজনে গান দাঁড় করানো হয়। অ্যালবাম বের হলো। আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম।' তখন দেশজুড়ে গ্রামে গঞ্জে 'পাগল মন' বেজেই যাচ্ছে। রাজধানীসহ সারাদেশে পাগল তুমুল আলোড়ন তোলে। প্রবাসেও পাঠানো হতে থাকে প্রচুর ক্যাসেট।
দিলরুবা বলেন, ডন মিউজিকের একটি সূত্রে জেনেছিলাম 'পাগল মন' অ্যালবাম দেড়কোটি বিক্রি হয়েছিল। তবে এককোটি বিক্রি হওয়ার ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম। তখন একটা গানের ক্যাসেটে লাভ ছিল ৮টাকা। সেই অনুযায়ী 'পাগল মন' নুন্যতম লাভ করে ৮কোটি টাকা। টাকা পয়সার ব্যাপাপারে আমার কোনো মোহ নেই। আমাকে দেশবাসী চিনেছে এটাই আমার কাছে অনেক।
পাগল মন তো ছবিও হয়েছিল- দিলরুবা খান বলেন, হ্যাঁ সেটাও একটা মজার ঘটনা বটে। ১৯৯৩ সালের ঘটনা। তোজাম্মেল হক বকুল তখন বেশ জনপ্রিয় পরিচালক। বেদের মেয়ে জোসনা'র কল্যাণে বকুলের নাম ছড়িয়ে পড়েছে। বকুল একদিন বাসায় এসে বললেন 'দিলরুবা আপা আমি তো এ জানেরজান নামে একটি ছবি করছি, ছবির শুটিং অর্ধেক শেষ। কিন্তু এখন আমার ছবিটির নাম পরিবর্তন করতে চাচ্ছি। আমি বললাম কি নাম দিতে চাচ্ছেন? তিনি বললেন, 'পাগল মন' এবং ওই ছবিতে আমাকেই গানটা গাইতে বললেন নতুন করে। সেটাসহ দুইটা গান গাইলাম ছবিতে। কণ্ঠ দেওয়ার পরে বকুল বললেন আপা আপনাকে তো টাকাপয়সা দিতে পারলাম না, তবেঁ ছবি হিট করলে একটা চাবি দিব, আমি বললাম কিসের চাবি? বকুল হেসে বললেন 'গাড়ি চাবি।'
দিলরুবা হতাশ কণ্ঠে বলেন, ছবিটি ৫কোটি টাকা মুনাফা করেছিল সেসময়। তোজাম্মেল হক বকুল গাড়ির চাবি কেন, এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়েও আমার বাসায় আসেন নি। না আমাকে কোনো টাকা পয়সাও দেওয়া হয় নি। আগেই বলেছিলাম টাকা পয়সার মোহ আমার নেই। এর ২৬ বছর পরের ঘটনা। ডিজে রাহাত একদিন আমাকে বলল, আপা, আপনার 'পাগল মন' গানটি করতে চাই। ভাবলাম আজকাল তো কেউ কারো গান করতে জানানোরই প্রয়োজন মনে করে না। সেখানে রাহাত দায়িত্বের পরিচয় দিয়েছে।' বললাম সেটা তো গতবছরের কথা। রাহাতের কাছ থেকে কোনো টাকা পয়সা পেয়েছেন? দিলরুবা বলেন, না রাহাতও আমাকে কোনো টাকা পয়সা দেয় নি। একটা গান নিয়ে এতো ব্যবসা হলো আপনি একটাকাও পেলেন না? প্রবীণ এই সঙ্গীত শিল্পীর উত্তর 'না।
শেষ অংশে নিজের ব্যক্তিগত উপলব্ধি ব্যক্ত করতে চাই। আমরা এমনিতেই উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির চাপে কোনঠাসা। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই ভারতীয় সংস্কৃতিকে গলার মালা করে নিয়েছে। নিজেদের সিনেমা, গান দেখেন না বললেই চলে। আমাদের শিল্পী ও কলাকুশলীরা ন্যায্য পাওনা টুকুও যদি না পান তবে সেটা হবে আমাদের জন্য চুড়ান্ত লজ্জার। এব্যাপারে সরকারের যথাযথ দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।
তা না হলে শেষ বয়সে এসব শিল্পী কলাকুশলীরা যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যান তা খুবই আক্ষেপের। আবদুর রহমান বয়াতীর নাকি ১৬ কোটি টাকা পাওনা ছিল মোবাইল কোম্পানিদের কাছে। অথচ মারা গেছেন বিনা চিকিৎসায়। তাই বলতে চাই সকল শিল্পীই তার প্রাপ্য সম্মান ও সম্মানীটুকু বুঝে পাক এতেই সান্তনা। বেঁচে থাকতে হয়ত তাদের আমরা যথাযথ সুযোগ বা সম্মান দিতে পারবোনা বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনের কারণে। অন্তত ন্যায্য প্রাপ্যটুকুর নিশ্চয়তা দিলে শেষ বয়সে আরেক জনের দ্বারস্থ হতে হবেনা। নাই মামার থেকে তো অন্তত কানা মামা ভাল।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৫:৫৪