মা'র দিনটা শুরু হয় ফজরের নামায দিয়ে।
বাড়ি থাকলে সকালে সুরেলা কোরানের
আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে। বাবা আর মা ই
থাকেন বাড়িতে। বাবার ক্যামোন লাগে
জানিনা। আমি বাড়ি গেলে, রাতে ঘুমোই অথবা জেগে থাকি,
সকাল বেলার ওই কোরান পাঠের শব্দটুকু না শুনলে আমার ভাল লাগে না....মা বোঝে মনে হয়। কোরআন পড়া হলে, মা এসে বিছানায় আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে তিনবার ফু দেয়। অনেকের কাছে কুসংস্কার মনে হতে পারে, আমার কাছে ওটাই জীবনী শক্তি মনে হয়...
বাড়ির সামনে বকুলের গাছ।
তেলওয়াত শেষে মা গুণে গুণে তাজা
কিছু ফুল কুড়িয়ে টেবিলে এনে রাখেন।
বকুলের গন্ধে ময়ময় করতে থাকে বাড়ি।
ওটাই আমার মায়ের গন্ধ...
তারপর শুরু হয় মায়ের দিন। খুব নিষ্ঠুর দিন
যায় আমার মায়ের। ঢুকে যান রান্না ঘরে।
প্রায় ঘন্টা দেড়েক রান্না ঘরের টুকটাক
শব্দ ছাড়া আর কিছুই কানে আসে না।
তারপর হঠাৎ ই সেই চেনা কোন খাবারের
গন্ধ নাকে ধাক্কা দিতে থাকে। আলসেমি
নিয়ে গন্ধের টানে যেয়ে দেখি, পানি
ঝরার শব্দ...
পেশায় মা স্কুল শিক্ষক। খেতে বসে গেছি।
মায়ের চুল তখন ও ভেজা। ডাইনিংয়ে কে
কি করবে সারাদিন, কে কি খাবে, কার কি
কাজ, বলতে বলতে কোনদিন তার কিছু
খাওয়া হয়, কোনদিন হয় না.. খাওয়া শেষে
বের হয়ে যেতে যেতে ওই একই কথাগুলো
মনে করিয়ে দিতে দিতে তিনি বেরিয়ে
যান । এমনই যায় আমার মায়ের সকাল। সেই বিশটা বছর থেকে দেখে আসছি..
হোক প্রচন্ড রোদ অথবা ভীষণ বর্ষা নতুবা
কনকনে ঠাণ্ডা, মায়ের রুটিনে কোন
ব্যাতিক্রম আসে না... সকাল নয়টা চারটে ক্লাস নিয়ে, মা যখন ক্লান্ত হয়ে ধুকতে ধুকতে
ফেরেন, তখন মাকে আমার দেবী মনে হয়।
দুরর থেকে দেখলে, মনে হয় আলোর জ্যোতি নিয়ে কেউ ফিরছে। আমি হলফ করে বলতে পারি, মা যখন ফিরেন ওই সময়টা যদি আধার থাকতো, তাহলে নির্ঘাৎ ওই অলোচ্ছটা সবাই দেখতে পারতো..
মা ফিরে আসতে আসতে বিকেলটা হেলে
পড়ে। কোন রকম হাতে মুখে পানি দিয়ে
লেগে যান, সবার জন্যে সান্ধ্য
জলখাবারের জোগাড়ে। সারাদিন রোদে
পোড়া ফুলের গাছ গুলো অথবা আম বাগগানটা নয়তো লিকলিকে খরগোশ গুলো মায়ের জন্যেই চেয়ে থাকে। কখন ফিরবেন দেবী, কখন দিবেন জল, আর ওরা আকন্ঠ পান করবে। তখনো কোন ক্লান্তি তাকে ছুতে পারে না। তবে তখন মাঝে মধ্যে মাকে দেখে আমার গলাটা শুকিয়ে যায়। কিছু বলতে ইচ্ছে করে। বলতে পারিনা..
রাতের আটটা নয়টা পর্যন্ত মায়ের ঠিকানা
আবারো বাড়ির উত্তপ্ত ছোট্ট ঘরটাতে।
আমাদের খাই ফরামায়েশ তৈরী করেন।
আবারো মায়ের অমৃতের গন্ধে বাড়ি ময় ময় করে। রাত এগারোটা পর্যন্ত কি কি সব যেন পড়েন। বাড়ি থাকলে আমার শারিরীক সমস্ত ত্রুটি তার আলোচ্য প্রধার বিষয়। কেন সিগারেট টেনে ঠোট কালো করি, পিঠে কি সব যেন উঠেছে। হাত পায়ের নখ
এত বড় কেন ? মোটা হচ্ছিস কেনন?
- বলেন, তুই তোর সমস্ত ময়লা
কাপড় ব্যাগে করে নিয়ে আসতে পারিস
না ? আহারে মা...
বাড়ি ফিরতে যদি কোনদিন রাত হয়ে যায়,
মা যদি ঘুমিয়ে ও যায়, প্রাচীর টপকে
কিংবা গেট খোলা পেয়ে আমি আমি
সিড়ি দিয়ে মেইন ফটকে আসতে আসতেই
দরজাটা খুলে যায়.. দেখি সামনে দাড়ানো,
ঘুমে জড়ানো ছোট্ট কোন দেবী দাড়িয়ে
আছেন, - এত দেরী করিস, তোর বাবা টের পেলে বকবে। মাথাটা কাচুমাচু করে ঢুকে পড়ি, প্রচণ্ড জোরে জড়িয়ে ধর্তে ইচ্ছে করে..
জড়াতে পারিনা..
আমি চিন্তা করতে চাই না কোন একদিন মা
থাকবে না। প্রচন্ড জ্বরে পানি ঢালবে না।
বাবা যখন আমাকে মারবে মা আর ঢাল হয়ে দাড়াবে না.. সকালে আর কোরানের
তেলওয়াত শুনবো না। বকুলের ফুল গুলো আর কেউ কুড়োবে না। তৃজ্ঞার্ত গাছ গুলো তে আর কেউ জল ঢালবে না.. এপাশ থেকে
হ্যালো বললে ওপার থেকে কেউ বলবে না,
- কিরে তোর গলাটা ধরা ধরা লাগছে কেন,
কেদেছিস নাকি ?
বিশ্বাস করেন কথা শুনলেই মানুষটা সব টের পেয়ে যায় ! চোখ দেখলে সব বলে দিতে পারে, কিচ্ছু লুকাতে পারি নাহ আমি....
তুমি না থাকলে আমি ক্যামনে বাচবো
মা ?
লেখাটা ২০১৫'র ১০ই মে।
মেমোরী শেয়ারিং এ ভাসলো,
পড়ে মনে হলো.... অনেক কিছুই
আম্মারে দুই মাস হচ্ছে দেখিনা,
আগে বোধ কম ছিলো, তাকাইতাম না ফিরে, অামার সব প্রয়োজন মিটিয়ে দিলেই অামি ছুট, অাম্মা পিছন দিয়ে ডাকতে ডাকতে কিছু বলে যাচ্ছে সেই গদ বাধা, অামার সেসব মুখস্থ স্বত্বেও রাত করে ফেরা, কিংবা দুই বেলা শেষে অনেক রাতে অাম্মারে থুম থেকে তুলে হৃলিয়া জারী করেছি; গালে তুলে না দিলে রাতে ও খাবোনা! অাম্মার সারাদিনের যে ধকল তা অামার তখন মনেই অাসতোনা, মা ও কোনদিন তা বলেনি মুখ ফুটে।
এখন হঠাৎ হঠাৎ বাড়ি গেলে, সকাল সন্ধ্যে সময় যাই হোক দরওয়াজা টা খুলে সামনে অাম্মা দাড়ানো সেই অাগের মতই দ্বিধা নিয়ে চেয়ে অাছে। তবে মার মুখে ইদানীং চোখ অামার আটকে যায়, চামড়ায় কেমন টান ধরা লাগে, একটু যেনো নুুয়ে পড়েছে দেহটা, চুলে পাক ধরা, অাগের মত রাগেনা মা, বকেনা অামারে, কণ্ঠে কেমন ক্ষীণতা; বোধহীন অামার পেটের ভীষণ ক্ষুধা উধাও হয়ে কেমন কান্না অাসে
কিছুই করা হয়নি মার জন্যে- তারপর কত অনাচার, অাবদার জীবন অতিষ্ট কারী অামি এখনো শিশুর মতই উপদ্রব হয়েই অাছি।
মা রে কখনো জড়ায়ে ধরে বলিনি ভালোবাসি...