এক।
বর্তমান সময়।
-তারপর? মাহরীন জানতে চাইল।
-তারপর কি? আমি পাল্টা প্রশ্ন করি।
-এত বছর পর হঠাৎ দেশে?
-বাহ, নিজের দেশে আসব না? আমি হেসে জবাব দিলাম।
-এতদিনতো আসোনি। মাহরীনের কন্ঠটা কেমন যেন তীক্ষ্ণ শোনায়।
আমি কোন জবাব দেই না, একটু মুচকি হাসি। হয়ত মনে মনে আশা করি পুরনো দিনগুলোর মত এই মুচকি হাসি মাহরীনকে শান্ত করবে।
কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমানিত হয়।
মাহরীন এখনো স্থির চোখে চেয়ে আছে। ও কি সত্যি আশা করছে আমি ওকে জবাব দেব? নিজেকে ঠিক প্রমানের চেষ্টা করব? কিংবা নিজের ভুল স্বীকার করব?
-আসলে... আমি বলার চেষ্টা করি।
-আসলে কি? মাহরীনের কন্ঠ এখনো তীক্ষ্ণ।
-আহ, এমন করছ কেন? নাহিয়ান এতদিন দেশে আসেনি, নিশ্চয়ই ওর কোন কারণ আছে। আগে ওর পুরো কথা শোন। শামসীর আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে।
শামসীরের কথায় মাহরীন কিছুটা শান্ত হয়।
-ঠিক আছে।
আমি শামসীরের দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকাই।
এই সুযোগে পাঠককে জানিয়ে রাখি, শামসীর আমার ছোটবেলার বন্ধু এবং ক্লাসমেট আর মাহরীন ওর স্ত্রী। বহুবছর পর দেশে ফিরে এসেছি আমি, আজ রাতে শহরের একটা নামকরা একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছি বন্ধু আর বন্ধুপত্নীর সাথে।
-তো বল কেন এত বছর দেশে এলে না। মাহরীন আবার তাগাদা দেয়।
-ও হ্যা। আমি বলতে শুরু করি। আসলে পিএইচডির প্রেশার ভয়ানক জিনিস।আমেরিকা যাওয়ার পর প্রথম পাঁচ বছর ঠিকমত নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগও পাইনি।
-কিন্তু ঠিকই একটা সাদা চামড়ার মেয়েকে বিয়ে করে ফেললে। মাহরীন খোঁচা দেয়।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে চিনি, মাহরীন এমনই। সুযোগ পেলে জীবনেও খোঁচা মারতে ছাড়বে না।
-ভ্যালেন্টিনাকে ঠিক সাদা চামড়া বলা চলে না, ওর বাবা ইউরোপিয়ান, মা মেক্সিকান। মিক্সড রেস।
-তাই নাকি? ফেসবুকে মাঝেমাঝে তোমাদের ছবি দেখি, আমিতো টিপিক্যাল সাদাদের সাথে কোন পার্থক্য করতে পারি না।
-আহ... শামসীর আবার মাহরীনকে থামানোর চেষ্টা করে। নাহিয়ানকে বলতে দাও।
মাহরীন কিছু বলে না, মুখ বাকিয়ে অন্যদিকে তাকায়।
পরিবেশটা কেমন যেন গুমোট হয়ে যায়, আমারও কিছু বলতে ইচ্ছা করে না।
-নাহিয়ান।শামসীর ডাকে।
-বল। আমি জবাব দেই।
-এই রেস্টুরেন্টে আগে খেয়েছিস?
-আমি দেশে আসলামইতো মাত্র কয়দিন। এই দোকানের নামটাও সাজেস্ট করলি তুই।
-তাওতো ঠিক। তুইতো থাকিসই না এখানে, এখানকার রেস্টুরেন্ট সম্পর্কে জানবি কি করে? নরমালি অর্ডার দেয়ার পর ওরা খাবার আনতে এত দেরী করে না। আজ কি হল কে জানে।
-এই। হঠাৎ মাহরীন ডাকে।
-বল। শামসীর জবাব দেয়।
-তুমি না বললা নাহিয়ান আমাদের সাথে দেখা করতে চায়।
-হ্যা।তো?
-তো ওকে এই রেস্টুরেন্ট সাজেস্ট করলা কখন? ওর সাথে তোমার আগে দেখা হয়েছে?
-আসলে... আমতা আমতা করতে থাকে শামসীর।
-শামসীর আমাকে ফোনে নামটা সাজেস্ট করেছিল। আমি জবাব দেই। আমার কথা শুনে শামসীর হাফ ছেড়ে বাঁচে।
-তা তোমরা ফোনে যোগাযোগ করলা কিভাবে? নম্বর পেলা কিভাবে?
-কেন? ফেসবুকে।
আমার জবাব শুনে মাহরীনের মুখ কালো হয়ে যায়। অনেকক্ষণ ধরে আমাকে কথার মারপ্যাচে আটকানোর চেষ্টা করছে, পারছে না।
-আহ, এমন করে কথা বলছ কেন? শামসীরের বিরক্তি স্পষ্ট।
-কেমন করে কথা বলছি? মাহরীনের কন্ঠে রাগ এবার আমি স্পষ্ট টের পাই।
-শোন... মাহরীন কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়।
খাবার চলে এসেছে।
-স্যার, খাবার কি সার্ভ করে দেব? ওয়েটার জানতে চায়।
-প্লিজ। শামসীর জবাব দেয়।
তিনজন নিঃশব্দে খেতে শুরু করি।
আধ ঘণ্টা পর।
-আচ্ছা, তোমার বউ আর ছেলেমেয়েরা দেশে আসছে? মাহরীন জানতে চায়।
-আমার শুধু এক ছেলে। মেয়ে নেই।
-অ। তা আসবে ওরা?
আমি কোন জবাব দেই না। মাহরীন কি তবে জানে না? নাকি ইচ্ছা করেই এই প্রশ্ন?
-আসলে... শামসীর বলার চেষ্টা করে।
-শামসীর। আমি ডাকি।
শামসীর তাকায়। আমি বলছি।
মাহরীন কৌতুহলী চোখে তাকায়।
-ওরা দেশে আসবে না।
-কেন? ছেলেকে বাপ-দাদার দেশ দেখাবে না?
-সম্ভব না। আমি ছোট্ট করে জবাব দেই।
-কেন?
-ডিভোর্স হয়ে গেছে আমার। ছেলের কাস্টডী পেয়েছে ওর মা।
-তাই নাকি? আই অ্যাম সো সরি।
মুখে বলল বটে, তবে মাহরীনের চোখে আমি দুঃখিত হওয়ার কোন লক্ষন দেখতে পাই না। বরং ঠোঁটের কোণে কেমন যেন তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে।
তবে কি মাহরীন আমার ডিভোর্সে খুশি হয়েছে?
ওর খুশি হওয়ার কারণ কি?
প্রতিহিংসা?
ঘৃণা?
নাকি ঈর্ষা?
নাকি কোনটাই নয়? হয়ত পুরোটাই আমার মনের ভুল।
দুই।
পনের বছর আগে।
ফোনটা বেজে উঠল। মাহরীন।
-হ্যালো।
-রাখ তোমার হ্যালো।কোথায় তুমি?
ব্যাপার কি? মেয়েটাকে খুব অস্থির মনে হচ্ছে আজ।
-এইতো, ক্যাম্পাসে।
-ক্যাম্পাসে কি কর?
-ক্লিয়ারেন্সের জন্য আসছিলাম।
-কাজ শেষ?
-আপাতত।
-আপাতত মানে?
-দুজন স্যারের সাইন নেয়া বাকি। উনারা ডিপার্টম্যান্টে নাই, লাঞ্চের পর আসবেন।
-এখন কোন কাজ আছে?
-লাঞ্চ পর্যন্ত ফ্রী।
-তাহলে তাড়াতাড়ি চলে আস।
-কোথায়?
-কোথায় আবার? আমার হলের সামনে।
ফোনটা কেটে দিল।
কি প্রেম করি, কল শেষে মিষ্টি হেসে ‘বাই’ও বলে না। অবশ্য ৭ টাকা/মিনিট, ‘বাই’ বলার সুযোগ কোথায়?
মেয়েদের হলে ছেলেদের প্রবেশাধিকার নেই। নেই বলাটা ভুল। আছে, তবে গেস্টরুম পর্যন্ত। সেই গেস্টরুমে ঢোকার জন্য প্রভোস্টের পারমিশন নেওয়ার জন্য প্যারা, তাতে প্রবেশাধিকার নেই বলাটাও ভুল কিছু হবে না।
বাধ্য হয়ে তাই ওদের হলের সামনে দাঁড়ালাম।
এখানে দাঁড়িয়ে থাকারও ভাল প্যারা, ওপর থেকে কাউয়ার দল মিসাইল মারতে থাকে। বাধ্য এই মাথা থেকে ওই মাথা পর্যন্ত পায়চারী করতে হয় ননস্টপ।
আমি এবং আমার মত যারা- তাদের দেখে গেটের দারোয়ানটা মুচকি হাসতে থাকে।দেখলে ইচ্ছা করে কানের নিচে দেই একটা। তাও পারি না- আবার ডিপার্টম্যান্টে অভিযোগ করে বসবে। ছাত্র হয়ে প্রেম করার অনেক জ্বালা।
অবশেষে মহারাণীকে আসতে দেখা গেল।
-এতক্ষণ লাগে? সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। আমি বিরক্ত হয়ে বলি।
অন্যদিন হলে মাহরীন একটা দাঁতভাঙ্গা জবাব দিত, আজ কিছু বলল না।ঘটনা কি?
-কি হল? আমি জানতে চাই।
-চল।
-কোথায়?
-কোথাও বসতে হবে। নাকি? এভাবে রাস্তায় দাড়িয়েতো আর কথা বলা যায় না।
ওর কথার টোনে কি যেন ছিল, আমি আর কথা বাড়ালাম না। চুপচাপ রিকশায় চড়ে বসলাম।
মাহরীন নিঃশব্দে খেতে থাকে।
-কিছু বলবা? আমি জিজ্ঞেস করি।
-আমি কি বলব? বলবাতো তুমি।মাহরীনের ঝাঁঝালো উত্তর।
-মানে কি?
-তুমি চাকরীতে জয়েন করলা না কেন?
-কোন চাকরীতে?
-গিলডেনে। কেন? আর কোন চাকরীর অফার পেয়েছ নাকি?
আমি চুপ করে থাকি। এর মধ্যে আরও একটা কোম্পানীকে ‘না’ করে দিয়েছি, ওকে বলা হয়নি।
-কি সমস্যা? কথা বল না কেন?
-হ্যা।
-হ্যা মানে?
-হ্যা মানে আমি গিলডেনে জয়েন করি নাই।
-কেন?
-মাসখানেক পর চলে যাব, শুধুশুধু জয়েন করে কি লাভ?
আমার কথা শুনে মাহরীনের হাত থেকে চামচটা পড়ে যায়।
-কি হল?
-লজ্জা করেনা?
-কি আশ্চর্য! লজ্জা করবে কেন?
-এত বছর প্রেম করে আমাকে একা ফেলে চলে যাবা আর বলছ লজ্জা করে কেন?
-আমিতো পার্মানেন্টলি চলে যাচ্ছি না।
-তুমি আমার বাসার অবস্থা জান?
-কি অবস্থা?
-আমি বাসার বড় মেয়ে, আমার পর আরো দুটো ছোটবোন আছে।
-তো?
-তুমি কি বুঝতে পারছ বাসায় বিয়ের জন্য কি পরিমাণ প্রেশারে আছি?
-মাহরীন।
-বল।
-তুমি যেমন বাসার বড় মেয়ে, আমি তেমনি বাসার ছোট ছেলে।আমার বড়বোনের এখনো বিয়ে হয়নি।
মাহরীন কিছু বলে না, ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।
-দেখ মাহরীন, আমার স্ট্যানফোর্ডে এডমিশন হয়েছে, ফুল ফান্ডিং সহ। এমন সুযোগ বারবার আসে না।এই সুযোগ যদি আমি মিস করি, তবে সারাজীবন পস্তাতে হবে।
-আর আমাকে বিয়ে করার সুযোগ কি সারাজীবন পাবে?
-দেখ...
-তুমি দেখ। তুমিতো ভাল ছাত্র, একাডেমিক ট্র্যাকরেকর্ডও ভাল। এবছর স্কলারশীপ পেয়েছ, আগামীবারও পাবে।
-মানে কি?
-এই বছরটা অন্তত থাক, একটা চাকরীতে জয়েন কর। বিয়েটা হয়ে যাক। বিয়ের পর আমিও জিআরই দেব, এপ্লাই করা শুরু করব। আগামী ফলে আমরা একসাথে আমেরিকা যাব।
-আর স্ট্যানফোর্ড?
তিন
বর্তমান সময়।
-কি হল? কোথায় হারিয়ে গেলি? শামসীর জানতে চায়।
-কিছু না।আমি জবাব দেই। আসলে মাথায় অনেক চিন্তা ঘোরে তো।
-কিসের এত চিন্তা তোর?
-খাবারটা ভাল হয় নাই। মাহরীন হঠাৎ বলে ওঠে।
আমরা দুজনই চমকে যাই। মাহরীন কখনোই তেমন খাদক ছিলনা, আজ হঠাৎ কি হল?
-এই। শামসীর ডাকে।
-বল। মাহরীনের ছোট্ট জবাব।
-আর কিছু খাবে? অর্ডার দেব?
-না।
-ড্রিংকস নেবে?
-না।
-তাহলে অন্যকিছু?
-বললামতো না।
মাহরীন হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়, সোজা হাঁটা দেয় ওয়াশরুমের দিকে।
শামসীরও উঠে দাঁড়ায়, আমি ওর হাত চেপে ধরি।
-যেতে দে।
-কেন?
-সব মানুষেরই কিছু একা একা সময় কাটানো উচিত, তাতে মন হালকা হয়।
-ভাই, ওসব হয়তো আমেরিকায় হয়। এখানে আমরা শেয়ার করেই মনের দুঃখগুলো হালকা করি।শেয়ারিং ইজ কেয়ারিং।
-বস। আমি তবুও শামসীরের হাত চেপে ধরে রাখি।
শামসীর বসে পড়ে।
-লেকচার দিবি? দে।
-খামাখা লেকচার দেব কেন?
-তাহলে আমাকে ধরে রাখলি কেন?
-এখানে বস। মাহরীনকে একা থাকতে দে, ওর মনের দুঃখগুলো হালকা হোক।
-এটা একা একা কাঁদার দুঃখ নয়, দুজনের একসাথে কাদতে হবে।
-বুঝলাম না।
-বুঝলি নাতো আমাকে ধরে রাখলি কেন?
আমিতো ভেবেছিলাম সাবেক প্রেমিককে দেখে মাহরীনের পুরনো দিনের কথা মনে পড়েছে, আর সেই দুঃখে বেচারী কাদছে। এখনতো মনে হচ্ছে অন্য কেস।
-নাহিয়ান।
-বল।
-তুই কি জানিস আমাদের কোন সন্তান নেই?
এই কথাটা শুনে ইচ্ছা করল নিজেকে চড় দেই একটা। দেশে আসার পর শামসীরের সাথে কয়েকবার দেখা হয়েছে, ফোনে কথা হয়েছে, আজকে ওদের দুজনের সাথে ডিনার করতে আসলাম, অথচ ওদের বাচ্চাকাচ্চার কথা জিজ্ঞেসই করা হয়নি।
আমি চুপ করে রইলাম।
-আসলে সন্তান নেই কথাটা ভুল। ছিল, এখন নেই।
-মানে?
-তিন বছর বয়স হয়েছিল রিয়াদের, তখন ও পানিতে ডুবে মারা যায়।
-কিভাবে?
-গ্রামে গিয়েছিলাম, দুপুরে ছেলেটা পুকুরঘাটে চলে গেল নিজে নিজে, কেউ টেরই পেল না। বিকেলে আমরা লাশ খুঁজে পাই, পানিতে ভাসছিল।
আমি ঠিক কি বলে সান্ত্বনা দেব না, বুঝতে পারি না।
-নাহিয়ান।
-বল।
-জানিস, এর কয়েকদিন পর মাহরীন একসিডেন্ট করে, ওর মা হওয়ার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।
-শিট। তোরা এডপ্ট করিস নি কেন?
-তুই করতি?
-মানে?
-মানে আমাদের পরিস্থিতিতে পরলে তুই বাচ্চা এডপ্ট করতি।
আমি কিছু বলি না, এইসব বিষয়ে তর্ক কিংবা যুক্তি খাটে না।
-জানতাম, কোন জবাব নেই তোর কাছে।
-শামসীর।
-বল।
-একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। হঠাৎ এই ইস্যুটা আসছে কেন?
-তুই খেয়াল করিস নি?
-কি খেয়াল করব?
-আগের মত স্বার্থপরই আছিস দেখি। নিজের বাইরে অন্যকিছু ভাবতে পারিস না।
-মানে কি?
-তুই যখন তোর ছেলের কথা বললি, তখন থেকেই ও মাথা নীচু করে কাঁদছিল। খেয়াল করিস নি?
আমি চুপ করে রইলাম। মাহরীন কি সত্যি সত্যিই আমার জন্য কাঁদছিল না?
হায়।
চার
বর্তমান সময়।
-আর? মাহরীন বলল।
-আর কি? আমি বললাম।
-আর কি খবর?
-কোন খবর নাই।
-কেন?
-কি ধরণের খবর আশা করছ?
-দেশে কি পার্মানেন্টলি চল আসছ?
-এখনো শিওর না।
-কেন?
-ওখানে একটা ভাল চাকরি আছে, বাড়ি আছে। সব ছেড়ে চলে আসাটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না।
-তাহলে দেশে আসছ কেন? বিয়ে করতে?
-বিয়ের কথা আসছে কেন?
-বাহ, ইউএসএ-তো চাকরি-বাড়ি-গাড়ি সব আছে তোমার। আংকেল-আন্টি কেউ বেঁচে নেই। তোমার দেশে আসার কোন লজিক খুঁজে পাচ্ছি না আমি।
-আহ, এভাবে বলছ কেন? শামসীর বাধা দেয়ার চেষ্টা করে।
-শামসীর, সমস্যা নাই। আমি শামসীরকে থামাই।
-তো বল, কেন আসছ এই দেশে? আবার মাহরীনের প্রশ্ন।
-কারণ এটা আমার দেশ।
-তোমার মত স্বার্থপর লোকের কোন দেশ নাই। যে ফুলে মধু থাকবে, তুমিও সেখানেই থাকবা।
-উদাহরণটা ভালগার হয়ে গেল না?
-আমার উদাহরণটাই অশ্লীল? আর কারো কারো পুরা অস্তিত্বটাই অশ্লীল-তার কি হবে?
-এভাবে বল কেন? শামসীর আবার বাধা দেয়ার চেষ্টা করে।
-তুমি সত্যি জানতে চাও আমি কেন দেশে আসছি?
-হ্যা।
-আব্বা দুই বছর আগে মারা গেছেন-তুমি জান?
-হ্যা, আংকেলের মৃত্যুর খবর পত্রিকায় আসছিল।তুমি দেশে আসছিলা তখন?
-সেটা ভিন্ন ইস্যু।
-আম্মা মারা গিয়েছিলেন তার পাঁচ বছর আগে।
-জানি।
-আম্মা মারা যাওয়ার পর আব্বা খুব একা হয়ে গিয়েছিল। আপার বিয়ে হয়ে গেছে, আমিও বিদেশে। আব্বুর সময় কাটতেছিল না।
-তো?
-নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য আব্বু একটা হোটেল কিনে নিয়েছিল।
-তাই নাকি? কোন হোটেল?
-হোটেল একশ তলা।
-একশ তলা আংকেল কিনছিল? কিন্তু আমিতো জানি ওটা চালুই হয় নাই।
-ঠিকই শুনেছ।
-তাহলে?
-আসলে আমি আসছি হোটেলটা চালু করতে।
-ওটার কন্সট্রাকশন শেষ? আমিতো জানতাম ওটা অসম্পূর্ণ হোটেল।
-ঠিকই জান। আমি এবার আসছি হোটেলটা দেখতে আর দুয়েকজন ইনভেস্টরের সাথে দেখা করতে।
-তো আমাদেরকে এই রেস্টুরেন্টে দাওয়াত করার মানে কি?
-ইনভেস্টরদের সাথে আমার সব মিটিং আর সিটিং এরেঞ্জ করে দিচ্ছে তোমার প্রাণপ্রিয় স্বামী, আমার বন্ধু, শামসীর হায়দার।
মাহরীন অবাক হয়ে শামসীরের দিকে তাকায়।
তবে কি শামসীর কিছুই বলেনি মাহরীনকে?
পাঁচ
-এতরাতে হোটেলে যাওয়ার কোন দরকার আছে? মাহরীন বিরক্ত হয়ে জানতে চায়।
-আহ, চলই না। সমস্যা কি? শামসীর জবাব দেয়।
মাহরীন লাল চোখে শামসীরের দিকে তাকায়, কিছু বলে না।
-শামসীর, দেখে ড্রাইভ কর। আমি পেছন থেকে বলি।
-হ্যা, ঠিক আছে। শামসীর আস্তে করে জবাব দিয়ে রাস্তায় মনযোগ দেয়।
-নাহিদ সাহেব ‘হোটেল একশ তলা’র মালিক ছিলেন। তাই না? মাহরীন জানতে চায়।
-হ্যা। আমি জবাব দেই।
-উনার কাহিনী জান?
-কি কাহিনী?
-তারমানে জান না?
-কি কাহিনী তাইতো বুঝতে পারছি না। বুঝতে পারলে হয়ত বলতে পারব, তার কাহিনী জানি কি জানি না।
-কথার মারপ্যাচ তুমি ভালই জান। এখনো স্বাভাব যায়নি দেখি।
মাহরীনের সাথে আর খোচাখুচি করতে ভাল লাগছিল না। চুপ করে রইলাম।
-নাহিয়ান।
-বল।
-আংকেল হোটেলটা কিনেছিলেন কখন?
-আম্মা মারা যাওয়ার এক বছর পর, আজ থেকে চার বছর আগে।
-আর আংকেল নিজে মারা গেছেন দুই বছর আগে?
-হ্যা।
-তারমানে আংকেল হোটেলের কাজ পুরা করার জন্য দুই বছর সময় পেয়েছেন।
-হিসাব তা-ই বলে।
-তাহলে হোটেল এর মধ্যে চালু হল না কেন?
-প্রশ্নটা বুঝলাম না।
-দেখ ‘হোটেল একশ তলা’র ডিজাইনই ছিল একটা একশ তলা হোটেল তৈরী করা হবে। নাহিদ সাহেবের জীবদ্দশায় নিরানব্বই তলা কমপ্লিট হয়ে গিয়েছিল। দুই বছরের মধ্যে আংকেল একশ তলা পুরো করে হোটেলটা চালু করতে পারল না?
-মাহরীন।
-বল।
-তুমি কি জান নাহিদ সাহেবের কি পরিমাণ ব্যাংক লোন ছিল?
-কেন?
-নাহিদ সাহেবের মৃত্যুর পর ব্যাংক দখল করে নিয়েছিল হোটেলটা।
-তো?
-এদিকে উনার ছেলেমেয়েরা ওটার মালিকানা দাবী করেছিল। মামলা হয়েছিল।
-ওই হোটেল বানানোর সময় শ্রমিক মারা গিয়েছিল বিল্ডিং থেকে পড়ে। ওটারও মামলা হয়েছিল।
-তাহলে বোঝ। এসব মামলা স্যাটেল হতে সময় লাগবে না?
-আংকেল হোটেল কিনেছিলেন কার কাছ থেকে?
-ব্যাংক।
-ওরা সব স্যাটেল করে তারপর বিক্রি করেনি।
-ব্যাংকের কাছ থেকে কেনার সময় নাহিদ সাহেবের ছেলেমেয়েদের সাথে আব্বা একটা স্যাটেলম্যান্ট করে নিয়েছিলেন। ফলে ওরা ওদের মামলা উইথ ড্র করে নেয়। এসব লিগ্যাল ঝামেলাতেই আব্বুর লম্বা সময় চলে গেছে। তাছাড়া আব্বার বয়স তখন আশির কাছাকাছি, দৌড়াদৌড়ি করার জন্য আমি কিংবা আপা কেউই দেশে ছিলাম না। এজন্যই আসলে সময় চলে গেছে।
-আর ওই শ্রমিকের মামলাটা?
-কোন শ্রমিক?
-ওই যে বললাম বিল্ডিং থেকে পড়ে মারা গিয়েছিল।
-এই তথ্য আমি প্রথম পেলামই তোমার কাছ থেকে।
-বল কি? পুরা শহর জানে আর তুমি জান না?
-কিভাবে জানব? গত পনের বছর শহরে ছিলাম না কিনা।
আমার জবাব শুনে মাহরীন চুপ হয়ে যায়। আমিও আর কিছু বলি না। কিন্তু মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরতে থাকে। মাহরীন জানে মানে শামসীরও এই মামলার কথা জানে। তাহলে আমাকে বলল না কেন?
ছয়
দশ মিনিট পর।
গাড়ি এখনো ফুলস্পীডে চলছে, কিন্তু রাস্তা শেষ হওয়ার কোন নাম নিচ্ছে না।
-শামসীর। আমি ডাকলাম।
-বল।
-আর কতক্ষণ ভাই?
-এইতো, কাছাকাছি চলে এসেছি।
আমরা দুজনই চুপ হয়ে যাই। হঠাৎ মাহরীন হেসে ওঠে।
-কি হল? শামসীর জানতে চায়।
-তুমি কি জান নাহিদ সাহেব কিভাবে মারা গেছেন? মাহরীন প্রশ্ন করে।
-না। কিভাবে?
-বল কি? এই শহরে থেকে তুমি এই বিখ্যাত কাহিনী জান না?
শামসীর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় মাহরীনের দিকে।
-কি এমন বিখ্যাত কাহিনী? আমিও একটু শুনি।আগ্রহী হয়ে আমি বলি।
-নাহিদ সাহেব ছিলেন এই শহরের বিখ্যাত ব্যবসায়ী। মূলত গার্মেন্টস ব্যবসা, ইপিজেডে অনেকগুলো ফ্যাক্টরী ছিল। পাশাপাশি আরো কিছু সাইড ব্যবসা ছিল।
-ওকে।
-তো একবার উনার কিছু বায়ার এল আমেরিকা থেকে। বুঝতেই পারছ, আমেরিকান সাহেব, ফাইভ স্টার হোটেল ছাড়া চলে না। এদিকে আমাদের ছোট শহরে কোন ফাইভ স্টার হোটেল নেই।
-তো কি হল?
-স্বাভাবিকভাবেই ডিলটা হয়নি, নাহিদ সাহেব অর্ডারটা পাননি। পেয়েছিল নাহিদ সাহেবেরই কোন এক প্রতিদ্বন্দ্বী, ঢাকা বেসড একটা ফ্যাক্টরী।
-তারপর?
-নাহিদ সাহেব খুব ইগোবাজ লোক ছিলেন, ব্যাপারটা উনি স্বাভাবিকভাবে নেননি।
-তারপরেই কি একশ তলার কাজ শুরু হয়?
-একজেক্টলী। নাহিদ সাহেব প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, এই দেশের না, পুরা এশিয়ার সেরা হোটেল উনি এই শহরে বানাবেন।
-তো কাজ শুরু হয়ে গেল?
-হ্যা।কিন্তু সমস্যা হল আমাদের শহরে যেখানে কোন বিশ তলা বিল্ডিং-ই নেই, সেখানে একশ তলা ইমারত দাড় করানো মুখের কথা না। তারওপর নাহিদ সাহেব গার্মেন্ট ব্যবসায়ী, হোটেল ব্যবসার কিছুই উনি জানেনা। বাইরে থেকে আর্কিটেক্ট আর স্ট্রাকচালার ইঞ্জিনিয়ার আসল, হোটেল বানানোর জন্য একটা চাইনিজ ফার্মকে ভাড়া করলেন।
আমি আর শামসীর চুপ করে শুনে যাচ্ছিলাম।
-শহরের বুকে এত বড় অট্টালিকার জন্য বিশাল জমি দরকার। তারওপর কনস্ট্রাকশন ম্যাটেরিয়াল, ইঞ্জিনিয়ার আর ওয়ার্কারদের থাকা-খাওয়া- সব মিলিয়ে নাহিদ সাহেবের টাকা যাচ্ছিল পানির মত।
-অথচ তখন পর্যন্ত কোন রিটার্ন নেই।
-এগজ্যাক্টলি। তাছাড়া উনার গার্মেন্টস ব্যবসাও ভাল যাচ্ছিল না। শুনেছি বিশাল লোনের বোঝা চেপে বসেছিল কাঁধে।
-উনি মারা গিয়েছিলেন কিভাবে? হার্ট এটাকে?
-না।
-তবে?
-অধিকাংশ লোক বলে আত্মহত্যা, হোটেলের ছাদ থেকে লাফিয়ে। আমি কিন্তু সেটা বিশ্বাস করি না।
-তো কি বিশ্বাস কর?
-উনাকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল।
-হোয়াট? কে?
-জানি না।তবে আমি দুজনকে সন্দেহ করি।
-কারা ওরা?
-ওই মৃত শ্রমিক অথবা ওর মৃত স্ত্রী!
সাত
গাড়িটা মেইন গেটের সামনে এসে থেমে গেল।
-নাহিয়ান।শামসীর ডাকল।
-বল।
-গেটতো বন্ধ। ভেতরে কেউ আছে?
-থাকারতো কথা। কেয়ারটেকারকে বলে দিয়েছিলাম আমরা আসছি।
-তাহলে কোথায় লোকজন? দারোয়ান বা সিকিউরিটি গার্ড টাইপের কাউকে দেখছি নাতো।
-বুঝতে পারছি না। নেমে দেখছি।
নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। নামার সময় মনে হল মাহরীনের ঠোঁটের কোণে মৃদুহাসি। নাকি আমার মনের ভুল?
নেমে অবাক হয়ে গেলাম। গেটে কোন তালা নেই। গেটের আশেপাশেও কেউ নেই।
ঘটনা কি?
গেট খুলে ভেতরে ঢুকলাম।
কোন জনমানবের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
গার্ড হারামজাদাগুলো কোথায়?
মেইনগেটের ঠিক পাশেই গার্ডরুম। অন্ধকার।
হাতঘড়িতে সময় দেখলাম। সাড়ে দশটার মত বাজে।
এত তাড়াতাড়ি সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে?
নব ঘোরাতেই গার্ডরুমের দরজা খুলে গেল। এই দরজাও আনলকড অবস্থায়!!!
দেয়াল হাতড়ে লাইট জ্বালাতে সময় লাগল না।খালি।
রাত সাড়ে দশটার সময় আমার শতকোটি টাকার হোটেলে একজন গার্ডও নেই।বাহ।
মোবাইলটা বের করলাম। নম্বর ডায়াল করলাম আফসার সাহেবের। পুরো বিল্ডিং-এর সিকিউরিটি এরেঞ্জম্যান্টের দায়িত্ব উনার ওপর।
-হ্যালো।
-হ্যালো, আফসার সাহেব, আমি নাহিয়ান বলছি।
-আসসালামুআলাইকুম স্যার। ভাল আছেন?
-এতক্ষণতো ছিলাম। এখন আর থাকতে পারছি না।
-কেন স্যার? কি হয়েছে?
-আপনি কোথায়?
-এইতো স্যার, বাসায়।
-কি করেন? ঘুমিয়ে পড়েছেন?
-স্যার যে কি বলেন।মাত্র সাড়ে দশটা বাজে। এইমাত্র খেতে বসেছি।
-ও আচ্ছা। তা সাইটে কতক্ষণ ছিলেন।
-আমিতো স্যার আটটা পর্যন্ত ছিলাম। এশারের নামাযের পর বাসায় আসলাম।
-আটটায়?
-জ্বি।
-তা দায়িত্ব কাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন?
-ফাহাদকে।
-ফাহাদ?
-জ্বি স্যার, খুব ভাল ছেলে।
-ও কোথায় এখন?
-হোটেলেই আছে স্যার।
-আপনি শিওর।
-অবশ্যই স্যার। কেন?
-আমি এখন হোটেলে দাঁড়িয়ে আছি। কাউকে দেখছি না এখানে।
-তাহলে মনে হয় গার্ডরুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।সারাদিন খুব পরিশ্রম যায়, বুঝতেইতো পারছেন স্যার।
-আমি সবই বুঝতে পারছি, আপনি মনে হয় বুঝতে পারেননি।
-মানে?
-আমি এখন গার্ডরুমে দাঁড়িয়ে আছি, একটা প্রানী আমার চোখে পড়ছে না।
-তাহলে মনে মেইন বিল্ডিং-এর লবিতে বসে আছে।
-লবিতে?
-জ্বি স্যার। আপনি কেন কষ্ট করতে আসতে গেলেন স্যার? আমাকে বললেই হত।
-আফসার সাহেব, লবিতে কেউ নাই।
-স্যার, আপনি চিন্তা করবেন না। নিশ্চিন্ত মনে বাসায় চলে যান, আমি এক্ষুণি আসছি।
-তারপর?
-আমি পুরো ব্যাপারটার খোঁজ খবর নিচ্ছি।ছেলেগুলো আছে ওখানেই কোথাও, আপনার মনে হয় চোখে পড়ছে না।
-আফসার সাহেব।
-আপনার আসার দরকার নাই।
-আমি আসছি স্যার। বাসা থেকে বের হয়ে গেছি, গাড়িতে উঠে পড়ব এখুনি।
-আফসার সাহেব।
-জ্বি। আপনার আসার আর দরকার নেই। না আজ রাতে, না আগামীকাল, না আর কখনো।
ফোনটা কেটে দিলাম।
আট
গার্ডরুম থেকে বেরিয়ে দেখি শামসীর গাড়ি ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলেছে, মাহরীন গাড়ি থেকে নেমে এল।
-এত বড় প্রপার্টি, একটা লোকও দেখছি না যে? মাহরীন জানতে চায়।
-বের করে দিয়েছি।
-সবাইকে?
-হ্যা।
মাহরীন অবাক হয়ে চেয়ে থাকে।
-কখন? এবার প্রশ্ন করেছে শামসীর।
-এক্ষুনি।
-কেন?
-ডিউটি যখন করবে না, তখন আর রেখে লাভ কি?
-পাগল হয়ে গেছস?
-কেন?
-এত বড় প্রপার্টি, দেখে রাখবে কে?
-কেন?
-এই ১০ জন গার্ড পেতে এক মাস সময় লাগছে, আগামী একমাস কি তাহলে গার্ড ছাড়া চলবে?
-তো সমস্যা কি?
-নাটক করবি না নাহিয়ান। খবরদার। তোর জন্য বাপের সম্পত্তি, কিন্তু আমি গত চার বছরে এই হোটেলের পেছনে অনেক সময় দিয়েছি। যা ইচ্ছা তা-ই করে আমার সব চেষ্টা বৃথা করে দিবি, সেটা আমি হতে দেব না।
-ওয়েইট, গত চার বছরে তুই এই হোটেলের পেছনে সময় দিয়েছিস? মানে কি?
-মানে আংকেলকে এই হোটেল বিক্রির খবর কে দিয়েছিল? ব্যাংক আর নাহিদ সাহেবের ছেলেমেয়েদের মধ্যেকার লিগ্যাল ডিসপিউট কে মীমাংসা করে দিয়েছে? হোটেলের জন্য যা চাচ্ছিস, তা-ই পাচ্ছিস। এসব কে এরেঞ্জ করছে? সব করছি আমি, এই শামসীর।
-তুই? কেন?
-হোটেলের কাগজগুলা একবারও পড়ে দেখেছিস বলেতো মনে হয় না। পড়লে আর এই প্রশ্ন করতি না। আমারও এই হোটেলে চার ভাগ শেয়ার আছে।
-এই হোটেলের মনিটারি ভ্যালু কত জানিস? চার পার্সেন্ট শেয়ার কেনার টাকা কোথায় পেলি তুই?
-দ্যাটস নট ইয়োর কনসার্ন।
-অফকোর্স ইট ইজ। এখন বুঝতে পারছি কেন বারবার আমাকে তুই দেশে আসার জন্য নক্ করতি। এই হোটেল চালু না হলে তোর টাকাগুলোও আটকে থাকবে।
এতক্ষণ মাহরীন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার আর শামসীরের চিৎকার চেচামেচি দেখছিল। হঠাৎ ও চিৎকার করে হেসে ওঠে।
-কি সমস্যা? শামসীর জানতে চায়।
-তুমি কি জান এটা একটা অভিশপ্ত জায়গা?
-হোয়াট?
-এখানে দাঁড়িয়ে নাহিদ সাহেবের চরিত্রের সব নেগেটিভ সাইড প্রকাশিত হয়েছিল, এখন তোমাদের হচ্ছে। একটা স্বার্থপর ছেলে, একজন সূযোগসন্ধানী চ্যালা বন্ধু। ওয়াও।
-আমি সুযোগসন্ধানী? চ্যালা? শামসীর জানতে চায়।
মাহরীন কোন জবাব দেয় না, স্থির দৃষ্টিতে শামসীরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
-কি হল? জবাব দাও। শামসীর চিৎকার করে ওঠে।
পরিস্থিতি দ্রুত খারাপের দিকে যাচ্ছে, যেকোন মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
-মাহরীন। আমি ডাকি।
-বল। শামসীরের অগ্নিদৃষ্টি উপেক্ষা করে মাহরীন জবাব দেয়।
-তুমি এই হোটেল সম্পর্কে কিভাবে এত কিছু জান?
-ভুলে যেও না আমি একজন ইন্টেরিয়র ডিজাইনার।এই হোটেলের ইন্টেরিয়র করার দায়িত্ব পেয়েছিল আমাদের অফিস। তখনই এই হোটেল সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছিলাম।
-এটা কি আব্বার সময়কার কথা?
-নাহ, নাহিদ সুলতান।
-আর?
-আর কি?
-আর কি জান এই হোটেল সম্পর্কে?
-রাতের বেলা নাকি এই হোটেলের ছাদে দুজনকে হাটতে দেখা যায়। একজন পুরুষ, একজন মহিলা। মহিলাটি সেই নিহত শ্রমিকের স্ত্রী-তাতো কোন সন্দেহ নেই। তবে পুরুষটার পরিচয় নিয়ে একটু সন্দেহ আছে।
-কেন?
-কেউ কেউ বলে ওটা সেই মৃত শ্রমিক, তবে আমার ধারণা লোকটা আসলে নাহিদ সুলতান।
আমার পক্ষে আর হাসি আটকে রাখা সম্ভব হয় না। হো হো করে হেসে উঠি।
-বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা?
-তোমার পুরো গল্পের প্লটটা কতটা কমন-সেটা কি তুমি জান?
-এটা আমার গল্প?
-না তো কি? নাহিদ সুলতান মারা গেছে আমি জানি। আর সব হাইরাউজ বিল্ডিং ওঠার সময়ই দুয়েকটা শ্রমিক মারা যায়। এসবকে পুজি করে এমন সস্তা গল্প ফাদলে কিভাবে হবে?
-এটা আমার গল্প?
-একই প্রশ্ন বারবার করলে কিভাবে হবে? বললাম তো এটা তোমার বানানো গল্প।এসব গার্বেজে আমি বিশ্বাস করি না।
-ফাইন। তাহলে তোমার গার্ডগুলো কোথায়?
-নাই।
-কেন নাই? দিনের বেলা ছিল, তাহলে রাতে কি সমস্যা?
-এই লোকগুলা কামচোর।
-ওরে আমার দায়িত্বশীলরে। এই লোকগুলো পালিয়েছে, কারণ রাতে ছাদে ওরা অস্বাভাবিক, অতিপ্রাকৃতিক কিছু দেখছে।
-হাউ ডু ইউ নো দ্যাট?
-আই এম গেসিং।
-আর তারা ছাদে কি দেখছে?
-জানি না।
-তাহলে চল দেখে আসি।
-হোয়াট?
-বাংলায় বললাম, বুঝ নাই।সেই তখন থেকে নাটক করতেছ, চল এবার একটা ফয়সালা হয়ে যাক।
-না।
-না কেন? ছাদে উঠলেই তোমার মিথ্যা ধরা পড়বে। সেজন্য?
-না। কারণ লিফট চালু আছে নব্বই তলা পর্যন্ত। এরপরের ফ্লোরগুলাতে লিফট এখনো কাজ করে না।নিরানব্বই তলার ছাদে উঠতে হলে আমাকে আরো নয় তলা সিড়ি ভাঙ্গতে হবে। আমার হাটুতে সমস্যা আছে, আমি পারব না।
মাহরীনের জবাব শুনে আমরা দুজনেই অবাক হয়ে যাই। লিফট নিয়ে আজ সকালে আমরা দুজন ফেসবুকে আলাপ করেছি, কিন্তু মাহরীনেরতো সেটা জানার কথা নয়।
-তুমি এই কথা কিভাবে জান? শামসীর প্রশ্ন করে।
মাহরীন এই প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। আ... আসলে...
-ইউ হ্যাকড ইনটু মাই অ্যাকাউন্ট?
-শোনা... আসলে...
-এখানে শোনানোর কিছু নাই আর। এবার আমি কথা বলি। নব্বই তলার পর যদি উঠতে না পার তাহলে আমি তোমাকে কোলে করে তুলব। যৌবনটাতো আমার কোলে বসেই পার করছ। আবার নাহয় আমার কোলে বসে পার করলা।
-নাহিয়ান, ইনাফ। শামসীর চিৎকার করে ওঠে। ভুলে যাবি না আমার স্ত্রীর সাথে কথা বলছিস।
আমি চুপ হয়ে যাই। মাহরীনের চোখের কোণে পানির মত কিছু একটা আমি দেখতে পাই।
নয়
হোটেলের লবি পার হয়ে আমরা তিনজন লিফটের দিকে এগিয়ে চলছি।
-দেখ, এখনো সময় আছে। চল আমরা ফিরে যাই। মাহরীন শামসীরকে বোঝানোর চেষ্টা করে।
শামসীর কিছু বলে না। শুধু অগ্নিদৃষ্টিতে শামসীরের দিকে তাকায়।
মাহরীন আর কিছু বলতে গিয়েও বলে না।
-দেখ মাহরীন, তুমি অযথাই ভয় পাচ্ছ। ভুত-প্রেত যতসব বাজে কথা। এই হোটেলের কাজ অনেকদিন আটকে ছিল আইনগত ঝামেলার কারণে। জগতের কোন ভূতের সাধ্য নাই এই ঝামেলা তৈরী বা মিটমাট করার। আমি মাহরীনকে শান্ত করার চেষ্টা করি।
-তাহলে নাহিদ সাহেবের আত্মহত্যাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবে?
-কে বলল তোমাকে নাহিদ সাহেব আত্মহত্যা করেছেন? উনি বিল্ডিং থেকে পড়ে মারা গেছেন। আমারতো পুরো ব্যাপারটাকে দূর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু মনে হয় না।
-তা একজন বয়স্ক লোক মাঝরাতে হোটেলের ছাদে কি করছিলেন?
-আমরা কি রাতের বেলা হোটেলের ছাদে যাচ্ছি না? ঘড়ির দিকে তাকাও। অলমোস্ট রাত ১২টা বাজে।
মাহরীনের বোধহয় সময়ের খেয়াল ছিল না। হাতঘড়িতে সময় দেখে আরো প্যানিকড হয়ে পড়ে।
-গেলে তোমরা যাও। আমি যাব না।
-আহ, পোলাপানের মত আচরণ করলে কিভাবে হবে? আমি বিরক্ত হয়ে বলি।
-আমি যথেষ্ট আচরণ করছি। তোমাদের আচরণই ইম্যাচিউরড।
-আমরা লিফটের কাছে চলে আসছি। শামসীর ঘোষণা দেয়।
শামসীরের কথা শুনে আমি আর মাহরীন-দুজনই চুপ হয়ে যাই। তখন পার্কিং-এ আমার সাথে চিৎকার করার পর গত বিশ মিনিটে শামসীর কোন কথাই বলেনি।
-শামসীর বাদ দে। আমি বলি। মাহরীন যখন চাইছে না, তখন আমরা আর ছাদে না যাই।
-কেন? বীরপুঙ্গবের সব সাহস কি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল? যা, মাহরীনের আচল তলে গিয়ে বসে থাক।
-দেখ শামসীর, মুখ সামলে।
শামসীর কিছু বলে না, ওর মুখে আমি উপহাসের হাসি দেখতে পাই।
মাথার ভেতর হঠাত আগুন জ্বলে ওঠে। সামান্য একটা ছাদইতো, যাব আর আসব।এমন কোন ব্যাপারতো না।
-চল। কোন লিফট?
চোখের সামনে দুটো লিফট।
-বামেরটা। ওটাই অড ফ্লোরগুলোতে থামবে।
আমি লিফটে ঢুকে পড়ি। আমার পর শামসীর।
-আমি যাব না। মাহরীন আবার বলে।
শামসীর ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে মাহরীনকে চুপ থাকার ইশারা করে।
-কোন কথা নয়। লিফটে উঠে পড়।
মাহরীন লিফটে উঠে পড়ে। শামসীর ঊননব্বই প্রেস করে।
দশ
লিফট থামল।
শামসীর, মাহরীন আর আমি নব্বই তলায় নেমে এলাম।
-এবার তাহলে? আমি শামসীরের দিকে তাকালাম।
-ছাদ। শামসীরের ছোট উত্তর।
-পানি। মাহরীন হাপাতে হাঁপাতে বলল।
-ব্যাপার কি? লিফট দিয়ে উঠেই হাপিয়ে গেলে? আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।
-আসলে... মাহরীন কথাটা শেষে করতে পারল না।
আমি মাহরীনের দিকে তাকালাম। মেয়েটার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে।
আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত মেয়ে মাহরীন। শেষ পর্যন্ত সেও এভাবে ভূতের ভয়ে কাবু হয়ে পড়ল!
-শামসীর। আমি ডাকলাম।
-বল।
-পানির ব্যবস্থা করা যাবে?
-প্রত্যেক ফ্লোরেই ফিল্টার বসানো আছে, অবশ্য চালু কিনা শিওর না। দাড়া, দেখি।
শামসীর দরজা ঠেলে ভেতরে চলে গেল। আমি আর মাহরীন দাঁড়িয়ে রইলাম।
-মাহরীন।
-বল।
-দাঁড়িয়ে থাকতে পারবা? নাকি বসতে হবে কোথাও?
-আমি ঠিক আছি।বলতে বলতে মাহরীন একটু সরে দাঁড়াল।
ব্যাপারটা কি?
মেয়েটা সরে দাঁড়াল কেন?
ও কি আমাও সাথে একা থাকতে অস্বস্তিবোধ করছে?
-মাহরীন।
-হু।
-একটা পার্সোনাল প্রশ্ন করি। কিছু মনে কর না।
-বল।
-শামসীর স্বামী হিসেবে কেমন?
-তোমার চেয়ে বেটার।
-হাউ ডু ইউ নো?
-তোমারতো স্বামী হওয়ার সাহসই ছিল না।
-এত বছর হয়ে গেল। তবুও কথা শেষ হয় না নাকি?
শামসীর কখন চলে এসেছে, খেয়ালই করিনি। ওর হাতে একটা ওয়ান টাইম গ্লাস, তাতে টল টল করছে স্বচ্ছ পানি।
-নাও। শামসীর গ্লাসটা এগিয়ে দেয় মাহরীনের দিকে।
মাহরীন ঢক ঢক করে পানি খেয়ে নেয়।
-শামসীর। আমি ডাকি।
শামসীর কোন জবাব দেয় না। শুধু চোখ তুলে তাকায়।
-মাহরীনকে বাদ দে। তুই আর আমিই বরং ছাদে যাই।
-কেন? মাহরীন বাদ যাবে কেন? আমার বউ, আমার সাথে ছাদে যাবে। ওর তাতে কোন সমস্যা নেই, তোর কেন সমস্যা হচ্ছে?
-এভাবে কথা বলছ কেন? এবার মাহরীন জবাব দেয়।
-তো কিভাবে কথা বলব? চ্যালা স্বামীর কাছে কি আশা কর? সারাক্ষণ জ্বি হুজুর, জ্বি হুজুর করব?
-শামসীর, ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট।
-আই এম উইদিন মাই লিমিট, সো শুড বি ইউ।
-ওকে ফাইন। কিন্তু তোর বউয়ের হাটুতে সমস্যা আছে, সে কি সিড়ি ভেঙে নব্বই থেকে নিরানব্বই তলায় উঠতে পারবে?
-আমি পারব। আমার জন্য অন্য কেউ চিন্তিত না হলে খুশি হব। মাহরীন দৃঢ় কন্ঠে ঘোষণা করে।
মাহরীনের কথায় শামসীরের ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে। কি যেন ছিল সেই হাসিতে, ভাষায় বর্ণনার বাইরে।
এগার
অবশেষে আমরা আটানব্বই তলায় পৌছে গেলাম।
নব্বই থেকে আটানব্বই-সিড়ি ভেঙে আটতলা উঠেছি। মাহরীন আর শামসীর- দুজনই হাপাচ্ছে।
আমি নিয়মিত ব্যায়াম করি, তাছাড়া ওঠানামাও করি সিড়িতে। আমার তেমন কোন সমস্যা হল না।
-তুমি ঠিক আছ? আমি মাহরীনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
মাহরীন আমাকে হাত তুলে থামিয়ে দিল।
আমি আড়চোখে শামসীরের দিকে তাকালাম। ওর ঠোঁটের কোণে আবার সেই হাসিটা ফুটে উঠেছে। আমার সাহায্য মাহরীন প্রত্যাখ্যান করেছে-এটাকে কি ও নিজের পৌরুষের বিজয় হিসেবে দেখছে?
-নাহিয়ান।
-বল।
-আরও একতলা বাকি আছে। তারপরেই ছাদ।
-হু।
-যাওয়া যাক।
-তোর বউ পারবে?
-আমার কোন অসুবিধা নেই। মাহরীন আরেকবার ঘোষণা করে।
আমরা আবার উঠতে শুরু করি।
অবশেষে নিরানব্বই তলা।
আর একতলা পেরুলেই ছাদ। আমি দাঁড়িয়ে পড়ি।
-কি হল? শামসীর জানতে চায়।
-চল, একটা সেলফি তুলি।
-সেলফি? এখন? এখানে?
-সমস্যা কি? শহরের সর্বোচ্চ উচ্চতায় দাঁড়িয়ে আছি। একটা সেলফি তুলতেই পারি।
শামসীর আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। মাহরীন গিয়ে তার স্বামীর পাশে দাঁড়ায়।
আমি ক্লিক করি।
-শিট। আমি বিরক্ত হয়ে বলি।
-কি হল? শামসীর জানতে চায়।
-নেটওয়ার্ক নাই। আপলোড দেব ক্যামনে।তোর নেটওয়ার্ক আছে?
শামসীর পকেট থেকে মোবাইল বের করে। নাই।
মাহরীন এবার ওর ফোন বের করে। নো সার্ভিস।
-শামসীর, নেটওয়ার্ক জ্যামার বসানো আছে?
-আরে নাহ।
-ওয়াই ফাই আছে?
-হোটেলের কনস্ট্রাকশন শেষ হয় নাই আর উনি আসছে ওয়াই ফাই ইউজ করতে।
-তাহলে আপলোড করব কিভাবে?
-কালকে করিস।
আমি মোবাইলটা পকেটে ঢোকাই।
-চল, ছাদে যাওয়া দরকার।
দুই মিনিট পর।
-এটা কি হল? আমি বলি।
-কি হইছে? শামসীর জানতে চায়।
-আমরা আবার নিরানব্বই তলায় কিভাবে?
-আবার নিরানব্বই তলায় মানে?
-মানে আমরা একটু আগে নিরানব্বই তলা পার করে আসছি।আমাদের এখন একশ তলা, মানে ছাদে থাকার কথা।
-কিসব আজেবাজে কথা বলছিস। আমরা এখন নিরানব্বই তলাতেই আছি, আর একতলা পার করলে ছাদে পৌছাব।
-ভাই বিশ্বাস কর, আমরা এর আগের ফ্লোরে যখন ছিলাম, তখনই আমরা নিরানব্বই তলায় ছিলাম। এখন আমাদের একশ তলায় থাকার কথা।
-এখন আমাদের একশ তলায় থাকার কথা?
-হ্যা।
-কিভাবে?
-প্রত্যেক ফ্লোরে কত তলা-সেটা লেখা আছে। আমি নব্বই তলা থেকে প্রত্যেক ফ্লোরে ওঠার সময় খেয়াল করেছি। এই নিয়ে আমি দুইটা ফ্লোরে নিরানব্বই দেখলাম।
-নাহিয়ান, তুই ভয় পেয়ে প্যানিকড হয়ে গেছস।
-মোটেই না।
-তাহলে ছবি আপলোড করতে না পারার শোকে তোর ব্রেইনে উল্টপাল্টা সিগন্যাল যাওয়া শুরু করছে।
-বাজে কথা বলবি না। আমার কথা বিশ্বাস না হলে মাহরীনকে জিজ্ঞেস কর।
মাহরীন এতক্ষণ চুপ করে আমাদের দুজনের কথা শুনছিল।আমরা দুজন এবার ওর দিকে তাকাই।
-মাহরীন, তোমার জামাইকে বল আমরা এখন কয় তলায়।
-আমি আসলে ঠিক শিওর না।
-কি বললা? শিওর না? কেন?
-আমি আসলে খেয়াল করি নাই।
-শামসীর, চল আমরা নীচের ফ্লোরে যাই। আমি তোকে দেখাব ওখানেও নিরানব্বই তলা লেখা আর এখানেও।
-দুচির ভাই, এত কষ্ট উঠছি। এখন আবার আটানব্বই তলায় যাব, তারপর আবার আটানব্বই, নিরানব্বই তলা পার হয়ে ছাদে উঠব? আমার অত তেল নাই।তোর লাগলে তুই যা।
-আমি একা যাব?
-সমস্যা কি? নীচের ফ্লোরে যাবি, যেখানে নিরানব্বই লেখা তার একটা ছবি তুলবি, তারপর আবার চলে আসবি।সিম্পল।
-ফাইন। তোরা দুইজন দাড়া, আমি যাব আর আসব।
-ওকে, আমরা এখানেই আছি।
মাহরীন আর শামসীর দাঁড়িয়ে রইল, আমি নামতে শুরু করলাম।
কত বড় সাহস? আমাকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করতে চায়! দুচির ভাই শালা। কালকে সকাল হোক। তোর চার পার্সেন্ট শেয়ার আমি পেছন দিয়ে ভরে দেব।
ভাবনা চিন্তার ঠেলায় খেয়ালই করিনি কখন নীচের তলায় নেমে গেছি। কিন্তু যা দেখলাম, তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
এই ফ্লোরেও লেখা নিরানব্বই তলা আর তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে শামসীর আর মাহরীন!!!
-তোর না আটানব্বই তলায় যাওয়ার কথা? উপর থেকে নামলি কিভাবে?
-আমি তো ঠিকই আটানব্বই তলায় নেমে এসেছি, কিন্তু তোরা দুইজন আমার আগে এখানে আসলি কিভাবে? অন্যকোন সিড়ি আছে?
-আমরা দুজন নিরানব্বই তলাতেই আছি। দেয়ালে দেখ, বড় করে লেখা ‘নিরানব্বই’।কিন্তু তুই নীচ তলায় যাবি বলে উপর থেকে নামলি কিভাবে?
-আরে ভাই, আমিতো নিরানব্বই থেকে আটানব্বইয়ে নামলাম।
-ভাল করে দেখ। এটা আটানব্বই না, নিরানব্বই তলা। আমি আর মাহরীন আগে থেকে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। তোর নিরানব্বই থেকে আটানব্বই তলায় নামার কথা।
-আমিতো সেটাই করলাম।
-তাহলে তুই এখানে কেন? তুইতো তাহলে আমাদের সাথে এক ফ্লোরে থাকার কথা না।
-আমিওতো সেটাই বলছি।সামথিং ইজ রং।
-এন্ড হোয়াট ইজ দ্যাট?
-শামসীর।
-বল।
-চল, এবার আমরা তিনজন একসাথে ওপরে যাব। এটা নিরানব্বই তলা। ঠিক?
-ঠিক।
-তারমানে ওপরের ফ্লোরটা হচ্ছে একশ তলা আইমিন ছাদ। রাইট?
-ইয়েস।
-চল তবে।
আমরা তিনজন সিড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করি।
কিন্তু দুই সিড়ির বিশ ধাপ পেরিয়ে যখন আমরা ওপরের ফ্লোরে পৌছালাম তখন যা দেখলাম তার জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
আবার নিরানব্বই তলা!!!
-হোয়াট ইজ দিস? আমি চিৎকার করে উঠি।
শামসীর কোন জবাব দিল না। স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইল।
-ইজ দিস সাম কাইন্ড অফ সিক জোক? তুই কি প্রতি ফ্লোরে নিরানব্বই লাগিয়ে রেখেছিস?
-আমি? আমি কেন এই কাজ করব?
-হয়ত কোন বিকৃত আনন্দের জন্য।
-আর কিভাবে করলাম?
-হয়ত কোন লোক লাগিয়ে রেখেছিস।
-পরো বিল্ডিং-এ আমরা তিনজন ছাড়া আর কোন জনমানবের ছায়া দেখেছিস? আর তাছাড়া তুই নিজেইতো বললি লিফট থেকে নামার পর তুই নিজেই প্রতি ফ্লোরে খেয়াল করেছিস। নব্বই তলার আমরা একানব্বই তলায় গিয়েছি, তারপর বিরানব্বই, তিরানব্বই... এভাবেই নিরানব্বই তলা পর্যন্ত এসেছি। তা না?
-হ্যা।কিন্তু...
-তাহলে বল আমি কিভাবে প্রতি ফ্লোরে নিরানব্বই তলার স্টীকার লাগাব?
কি বলব বুঝতে না পেরে আমি চুপ হয়ে যাই। এর মধ্যে মাহরীন কাঁদতে শুরু করে।
-আমি তোমাদের আগেই বলেছিলাম এটা অভিশপ্ত জায়গা। স্বামীহারা এক মহিলার অভিশাপ লেগে আছে এখানে।তোমরা শুনলা না। তোমাদের একশ তলার ছাদে উঠতে হবে।
-মাহরীন, কান্না বন্ধ কর। লেটস মেক ওয়ান লাস্ট ট্রাই।
-কি? মাহরীন চোখ মুছে জানতে চায়।
আমি পকেট থেকে কলম বের করি।
-কি করছ? মাহরীন আবার প্রশ্ন করে।
-দেখেই যাও না। আমি জবাব দেই।
ইংরেজী নাইন্টি নাইন লেখাটা কলম দিয়ে গাঢ় করে কেটে দেই। সেই কাটাচিহ্ন দিয়ে ইংরেজী ‘এক্স’ এর শেপ ফুটে ওঠে।
-আমরা এবার নিচে নামব, তারপর আবার ওপরে উঠব। যদি আমরা সত্যি সত্যিই নিরানব্বই তলায় আটকা পড়ি, তাহলে উপরে যাই আর নীচে নামি, সবক্ষেত্রেই নিরানব্বইয়ের ওপর এই কাটা চিহ্ন থাকবে। আর যদি না থাকে তাহলে বুঝব দিস ইজ সাম কাইন্ড অফ সিক জোক। আমাদের নিয়ে কেউ খেলছে।
-ওকে।
আমরা তিনজন সিড়ি দিয়ে নামতে শুরু করি। মনে মনে প্রার্থনা করতে থাকি নীচের ফ্লোরে নিরানব্বই থাকলেও যেন কলমের দাগ না থাকে।
কিন্তু যা দেখলাম... নিরানব্বই তলা, তারপর কলমের কালিতে আকা এক্স!!!
-এবার উপরে উঠবি না? শামসীর জানতে চায়।ওর কন্ঠে টেনশান আমি স্পষ্ট টের পাই।
-লাভ নাই। উই আর বিইং ট্র্যাপড।
-চল।
-বললামতো লাভ নাই।
তবুও শামসীর আমার হাত ধরে টানাটানি করতে থাকে।বাধ্য হয়েই উঠে দাড়াই।
ফলাফল জানা-ই ছিল। নিরানব্বই উইথ এন এক্স।
আমি চুপচাপ ফ্লোরেই বসে পড়ি। মাহরীন সিড়িতে বসে নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করে।
শামসীর দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ও হঠাৎ চিৎকার করে হাসতে শুরু করে।
সমস্যা কি? অধিক শোকে বেকুবটা পাগল হয়ে গেল নাকি?
-কি সমস্যা? হাসছিস কেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
-তুই কি জানিস এই মুহূর্তটার জন্য আমি কতদিন অপেক্ষা করেছি?
শামসীরের জবাব শুনে আমি আর মাহরীন অবাক হই। এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করেছে-মানে কি?
-বুঝলাম না।
-সিম্পল। তুই হতাশ, মাহরীন কাঁদছে। আমি অনেকদিন ধরে এই দৃশ্য দেখার জন্য অপেক্ষা করেছি।
-কি বলতে চাইছিস?
-মাহরীন, তুমি কি আমাকে ভালবাস? শামসীর জানতে চায়।
-এটা কি ধরণের প্রশ্ন? ইউ আর মাই হাজবেন্ড। অবশ্যই আমি তোমাকে ভালবাসি। মাহরীন জবাব দেয়। তবে স্বামীর অযৌক্তিক প্রশ্নে বিরক্তি লুকাতে পারে না।
-আর নাহিয়ানকে?
-দেখ শামসীর, বউকে সম্মান করতে না পারিস, অপমান করিস কেন?
-একদম চুপ। আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝখানে একটা কথাও বলবি না।
আমি চুপ হয়ে যাই। নিরানব্বই তলার ধাক্কা খেয়ে বেচারার স্ক্রু সব ঢিল হয়ে গেছে মনে হয়।
-তো বল মাহরীন, নাহিয়ানকে তুমি ভালবাস? শামসীর প্রশ্ন করে।
-এসব বাজে কথার মানে কি? এবার মাহরীনের কন্ঠে বিরক্তি আর রাগ-দুটোই স্পষ্ট।
-তাহলে ধরে নিচ্ছি তুমি ওকে ভালবাস।
-দেখ, পনের বছর আগে নাহিয়ানের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সেসব এখন অতীত। গত পনের বছর ধরে তুমিই আমার সব।
-আর কত? এসব ভন্ডামী আর কত? আমি যদি তোমার সব হই তবে এখনো কেন তুমি ঘুমের ঘোরে নাহিয়ানকে খোঁজ?
-হোয়াট?
-আচ্ছা বাদ দাও। তুমি কি জান নাহিয়ানের আম্মা কবে মারা গিয়েছিল?
-না। কেন?
-কারণ নাহিয়ান তখন দেশে এসেছিল। আর তার ঠিক নয় মাস পরেই আমাদের একমাত্র ছেলে রিয়াদের জন্ম। তোমার কি মনে হয় পুরো ব্যাপারটাই কাকতালীয়?
-তোমার ধারণা রিয়াদের বাবা নাহিয়ান?
-দেখ শামসীর, আম্মা যখন মারা যায় তখন আমি দেশে এসেছিলাম মাত্র পাঁচদিনের জন্য। তোর সাথেই তখন দেখা হয়নি, মাহরীনের সাথে কিভাবে হবে? গত পনের বছরে মাহরীনের সাথে আমার কোন যোগাযোগ ছিল না। আমি শামসীরকে বোঝানোর চেষ্টা করি।
-বললাম না আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝখানে কোন কথা বলবি না । একদম চুপ। এবার শামসীর মাহরীনের দিকে ফেরে। আমার ধারণা নয়, আমি নিশ্চিত।রিয়াদের চেহারা, চালচলন কোন কিছুই আমার মত ছিল না। ও কোনভাবেই আমার ছেলে হতে পারে না।
-ডিড ইউ কিলড হিম? মাহরীন জানতে চায়। ওর চোখের পানি শুকিয়ে গেছে।আমি রিয়াদকে তোমার কোলে দিয়ে শুতে গিয়েছিলাম। বিকালে তুমি বললে ওকে পাওয়া যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত ওর লাশ পুকুরে ভাসছিল।
-ইন্টেলিজেন্ট গার্ল। আমি সবসময় এজন্যই তোমাকে পছন্দ করতাম। ইয়েস আই কিলড হিম। আমার ঘরে, আমার পরিচয়ে একটা বাস্টার্ড বড় হবে, কোন পুরুষই সেটা সহ্য করবে না।
-আর এক্সিডেন্টের পর আমার অপারেশন? তারপরেইতো আমার মা হওয়ার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেল।
-কিচ্ছু করার ছিল না আমার। এরকম না করলে তুমি বারবার আমার ঘরে হারামজাদা নিয়ে আসতে। কিভাবে সহ্য করি সেটা?
এবার আর মাহরীন কোন জবাব দেয় না। সোজা শামসীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমি দুজনকে ছাড়াতে যাই, তার আগেই শামসীরের এক চড়ে মাহরীন উড়ে গিয়ে দেয়ালের সাথে বাড়ি খায়।
রাগ সামলাতে না পেরে এবার আমি ঘুষি বসিয়ে দেই শামসীরের নাক বরাবর। তাল সামলাতে না পেরে শামসীর ফ্লোরে পড়ে যায়। ওর নাক দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করেছে।
আমি ওর বুকের ওপর বসে পড়ি। কলার চেপে ধরে জিজ্ঞেস করি, সত্যি করে বল আমাদের কেন এখানে নিয়ে এসেছিস? এই গোলকধাঁধা থেকে মুক্তির উপায় কি?
শামসীর কোন জবাব দেয় না। নাক চেপে ধরে পাগলের মত হাসতে থাকে।
-কাম অন, আন্সার মী।
-হ্যা, আমি ইচ্ছা করেই তোদের দুজনকে এখানে নিয়ে এসেছি। আমিই সব সিকিউরিটি গার্ডদের বল রেখেছিলাম আজরাতে ডিঊটি করার দরকার নেই। আমি আগে থেকেই জানি এই হোটেলে কখনো নিরানব্বই তলা থেকে একশ তলায় যাওয়া যায় না। এমনকি নিরানব্বই তলায় উঠলে আর নীচে নামারও সু্যোগ নেই। কেন জানিস? কারণ ওই মৃত শ্রমিকের স্ত্রী বলেছিল সে নাহিদ সুলতানের স্বপ্ন সত্যি হতে দেবে না। এই হোটেল কখনো একশ তলা হবে না।
-এর থেকে মুক্তির উপায় কি?
-একটাই উপায়। ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়া। কেউ যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে সে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়বে, তবেই সে একশ তলার সিড়ি খুঁজে পাবে।
-আর যদি কেউ লাফ না দেয়?
-তবে সে এই নিরানব্বই তলায় আটকে থাকবে।
শামসীর পাগলের মত হাসতে থাকে।
খেয়াল করা হয়নি, মাহরীন এর মধ্যেই উঠে দাড়িয়েছে।ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে ওর।
-কোথায় যাচ্ছ?
-একশ তলায়।
-কিভাবে?
-লাফ দেব।
আমি ওর হাত চেপে ধরি। পাগল হয়ে গেছ?
-হাত ছাড় আমার। এই হাত ধরার অধিকার তুমি পনের বছর আগেই হারিয়েছ।
মাহরীন আমার হাত ছাড়িয়ে সিড়ি বেয়ে উঠতে শুরু ক্রে। আমি মনে মনে প্রার্থনা করি সিড়ি বেয়ে মাহরীন যেন এই ফ্লোরেই ফিরে আসে।
পাঁচ মিনিট পর।
বাইরে থেকে বিকট শব্দ আসে।
-কিসের শব্দ?
-কিসের আবার? শামসীর জবাব দেয়। মাহরীন লাফ দিয়েছে। এটা ওর ল্যান্ড করার শব্দ।
-এ হতে পারে না।
-তাহলে মাহরীন কোথায়? পাঁচ মিনিটের বেশি হয়ে গেছে, নিরানব্বই তলার গোলকধাঁধায় থাকলে এতক্ষণে ওর ফিরে আসার কথা।
আমি শামসীরের মুখ বরাবর একটা লাথি দেই।
-একদম চুপ।
শামসীর তবুও হাসতেই থাকে।মাহরীনের পালা শেষ, এবার তোর পালা। আমার মনে হয় তোরও এবার লাফ দেয়া উচিত। মনে মনে ঠিক করে নে, একশ তলার সিড়িটা তাহলে ঠিকই খুঁজে পাবি। তোর ঠিক পরেই আমি লাফ দেব।
-না।
-না মানে?
-না মানে না। যদি নিরানব্বই তলার এই গোলকধাধায় যদি তোর সাথে আটকে থাকতে হয় তো থাকব, তবু তোকে আমি শেষ হাসি হাসতে দেব না।
===================================================================
এই গল্পটা একশ তলা গল্পের সিক্যুয়াল। অবশ্য দুটো আলাদা স্বয়ংসম্পূর্ণ গল্প। একটা না পড়লে অন্যটা বুঝতে সমস্যা হবে না। একশ তলা পড়ার জন্য ক্লিকান এখানে
===================================================================
আমার লেখা অন্যান্য ভৌতিক গল্পগুলোঃ
১.পিশাচ কাহিনীঃ রক্তখেকো ডাইনী পর্ব-১ পর্ব-২ পর্ব-৩
২.পিশাচ কাহিনীঃ জানোয়ারের রক্ত (১৮+)
৩.পিশাচ কাহিনীঃ অন্ধকারে বিলীন
৪.পিশাচ কাহিনীঃ হোটেল একশ তলা
৫.পিশাচ কাহিনীঃ একশ তলায় আবার
৬.পিশাচ কাহিনীঃ রাতের আঁধারে
৭.পিশাচ কাহিনীঃ কন্ঠ
৮.পিশাচ কাহিনীঃ অতিথি
৯.পিশাচ কাহিনীঃ কান্নার শব্দ
১০.পিশাচ কাহিনীঃ শয়তানের পাল্লায়
১১.পিশাচ কাহিনীঃ নির্ঘুম রাত
১২.পিশাচ কাহিনীঃ জঙ্গল মঙ্গলপুর
১৩.পিশাচ কাহিনীঃ একটি ফটোগ্রাফ
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০২৩ রাত ১০:৪৭