“খালামনি অল্প কিছু সময়ের মধ্যে এসে পড়বে”, ১৫ বছর বয়সী মেয়েটি হেসে জবাব দিল। “এই সময়টুকু আপনি আমার সাথে গল্প করে কাটাতে পারেন।”
নাটেল সাহেব ভাবলেন খালামনি আসার আগ পর্যন্ত মজার কিছু বলে ভাগ্নি কে খুশি রাখা উচিত। কিন্তু মুখ দিয়ে সেরকম কিছু বেরোল না।তার মাথায় তখনো ঘুরছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকের বাসায় এরকম আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার তার স্নায়ুর কোনো উন্নতি করবে কিনা।
“আমি জানি করবে”। গ্রামে পথে যাত্রা শুরু করার সময় তার বোন তাকে বলেছিল। “আমি জানি সেই গ্রামে গিয়ে তুমি একাকিত্বের মাঝে ডুবে যাবে, তাতে তোমার স্নায়ুর আরও অনেক বেশী ক্ষতি হবে। তাই আমি এখানে যাদের চিনি তাদের সবাইকে চিঠি লিখে দিচ্ছি, যতদূর মনে পড়ে ওদের অধিকাংশই চমৎকার মানুষ”।
নাটেল সাহেব ভাবতে লাগলেন যে মিসেস সেপলটনের সঙ্গে তিনি বোনের চিঠি নিয়ে দেখা করতে এসেছেন তিনি কতটা চমৎকার মানুষ।
“আপনি কি এখানে অনেকেই চেনেন?” তরুণীটি জানতে চাইল। নিশ্চয়ই তার মনে হয়েছে অনেক নীরব সময় কেটে গেছে, এবার কিছু বলা উচিত।
“কাউকেই না”।নাটেল সাহেব জবাব দিলেন। “আমার বোন এখানে চার বছর আগে নান হিসেবে কাজ করতেন। উনি আমাকে চিঠি দিয়েছেন এখানকার কিছু মানুষ জনের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য”।
শেষ কথাটি শুনে মনে হলো লোকটি খুব অনুশোচনায় ভুগছেন।
“আপনি তাহলে আমার খালামনি সম্পর্কে কিছুই জানেন না?” তরুণীটি অবাক হয়ে জানতে চাইল।
“শুধু উনার নাম-ঠিকানা” লোকটি স্বীকার করলো।
ফ্রেমটন নাটেল ভাবছিলেন মিসেস সেপলটন বিবাহিত নাকি বিধবা? তবে বাড়ির চারপাশ দেখে মনে হচ্ছে এই বাড়িতে পুরুষ মানুষ বসবাস করেন।
“ওনার জীবনের চরমতম দুর্ঘটনাটি ঘটেছে তিন বছর আগে”। তরুণীটি বলল, “তার মানে আপনার বোন এখান থেকে চলে যাওয়ার পরে”।
“চরমতম দুর্ঘটনা মানে?” লোকটি অবাক হয়ে জানতে চাইল।এরকম শান্ত জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে তা লোকটি ভাবতেই পারছেন না।
“আপনি হয়তো ভাবছেন অক্টোবরের এই বিকেলে আমরা বাগানের দিকের বিশাল দরজাটা খোলা রেখেছি কেন?” বাগানের দিকে মুখ করা একটি ফরাসি দরজার দিকে আঙ্গুল তুলে তরুণীটি বলল।
“বছরের এই সময়টা তো মোটামুটি উষ্ণই থাকে”, নাটেল সাহেব জবাব দিলেন। “তবে এই খোলা দরজার সাথে কি ওনার জীবনের চরমতম দুর্ঘটনার কোন সম্পর্ক আছে?”
“ওই দরজা দিয়েই বছর তিনেক আগে উনার স্বামী আর ছোট দুই ভাই শিকারে বেরিয়েছিলেন। তারা আর কখনোই ফিরে আসেননি।সেই বছর বর্ষা ছিল খুবই ভয়াবহ ।যে জায়গাগুলোকে আমরা নিরাপদ ভাবতাম সেগুলো হঠাৎ করেই ভয়ংকর হয়ে উঠল। নিজেদের শিকারের প্রিয় জায়গাটাতে যাওয়ার পথে চোরাবালিতে ডুবে গিয়ে তারা তিনজনই হারিয়ে যান।উনাদের লাশ আর কখনোই উদ্ধার করা যায়নি।এটাই সসবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার”।
বলতে বলতে মেয়েটির গলা হঠাৎ ধরে এল।“বেচারী খালামনি এখনো ভাবে কোন একদিন তারা তিনজন আর আমাদের প্রিয় স্প্যানিয়েলটা (এক প্রজাতির কুকুর) এই দরজা দিয়ে ফিরে আসবে, যেমনি করে প্রতি সন্ধ্যায় তারা ফিরত।একারণেই প্রতিদিন সূর্য ডুবে একেবারে অন্ধকার না হোয়া পর্যন্ত আমরা দরজাটা খোলা রাখি”।
“বেচারী খালামনি আমাকে প্রায়ই বলে কিভাবে উনারা বেরিয়েছিলেন। খালুর হাতে উনার রেইনকোটটা ছিল আর রনি মামা- খালামনির আদরের ছোটভাইটা গান গাইছিল, ‘বার্টি, তুমি কেন চলে গেলে?খালামনি প্রায়ই বলত গানটা মামার মাথা খেয়েছে”।
মেয়েটি হঠাৎ গলা নিচু করে বলল, “জানেন, এতদিন পরেও, এরকম শান্ত বিকালে মাঝে মাঝে মনে হয়, হয়ত দেখব ওই তিনজনই হঠাৎ দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকছে ...”
বলতে বলতে মেয়েটা কেঁপে উঠল। খালাকে আসতে দেখে ফ্রেমটন নাটেল হাঁফ ছেড়ে বাচলেন।মিষ্টি হেসে মিসেস নাটেল দেরীর জন্য ক্ষমা চাইলেন।
“ভেরা বিরক্ত করেনি আশা করি”, মিসেস সেপল্টন হেসে জানতে চাইলেন।
“না, না, ওর সঙ্গে কথা বলে খুবই ভাল লেগেছে”।
“আশা করি দরজাটা খোলা থাকলে আপনার কোন অসুবিধা হবে না”।মিসেস সেপলটন বললেন, “আমার স্বামী আর ভাইরা অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই শাইকার থেকে ফিরে আসবে। ওরা প্রতিদিন এই দরজা দিয়েই ঘরে ঢোকে।আজকে ওরা জঙ্গলের মাঝের জলাভূমির দিকে শিকার করতে গেছে, বুঝতেই পারছেন কাদা আর পানিতে আজ ঘর একাকার হয়ে যাবে।শিকারের মত পুরুষালি ব্যাপারগুলো নিশ্চয়ই আপনার পছন্দ, তাই না?”
মিসেস সেপলটন এরপর খুব উৎসাহ নিয়ে শিকার আর দিনদিন পাখির কমে যাওয়া, শীতের দিনে বুনোহাঁসের ঝাক বেঁধে উড়ে যাওয়া-এসব নিয়ে গল্প শুরু করলেন।ফ্রেমটন নাটেলের মাথায় নরক যন্ত্রণা শুরু হল।নাটেল সাহেব আলোচনার বিষয়বস্তু ঘোরানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোন লাভ হল না।
উনি বুঝতে পারছিলেন মিসেস সেপলটন আসলে উনার কোন কথাই শুনছেন না, উনার চোখ আর মন পড়ে আছে সেই ফরাসি দরজা আর দরজা ছাড়িয়ে বাগানের সামনের রাস্তায়। কি অদ্ভুত ব্যাপার, এমন দূর্ভাগ্যজনক ঘটনার বর্ষপূর্তির দিনই উনি বেচারীর ঘরে এস উপস্থিত হয়েছেন।
“ডাক্তাররা আমাকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে বলেছেন। সব রকম মানসিক উত্তেজনা আর স্নায়ুর উপর চাপ তৈরি করে এমন যেকোন কিছু থেকে দূরে থাকতে” ফ্রেমটন সাহেব ঘোষণা করলেন।“আমার ধারণা ছিল অপরিচিত লোকজনের মাঝে থাকলে উত্তেজক কিছুর মুখোমুখি হতে হবে না। এখন দেখছি পুরোই উলটা ঘটনা ঘটছে”।
“তাই নাকি?” মিসেস সেপলটন অবাক হয়ে গেলেন।হঠাৎ করেই আনন্দে উনার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল, তবে সেটা ফ্রেমটনের কথা শুনে নয়।
“ওইতো ওরা চলে এসেছে” মিসেস সেপলটন আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন। “একদম চা খাওয়ার সময়ে চলে এসেছ। দেখে মনে হচ্ছে না চোখ ছাড়া ওদের সবকিছুই কাদায় লেপ্টে আছে?”
ফ্রেমটন নাটেল ভাগ্নিটির দিকে তাকালেন।এই মানসিক অবস্থার একজন মহিলার সঙ্গে ছোট মেয়েটিকে থাকতে হচ্ছে ভেবে তার দুঃখই হল।কিন্তু মেয়েটিকে দেখে ফ্রেমটন অবাক হয়ে গেলেন।শুন্য চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটি, সেই চোখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট!
ফ্রেমটন এবার নিজের চেয়ারটা একটু ঘুরিয়ে দরজার দিকে চোখ দিলেন।
শেষ বিকালের মরা রোদে তিনটি পুরুষ অবয়বকে বাগান পেরিয়ে দরজার দিকে আসতে দেখলেন ফ্রেমটন নাটেল।তাদের তিনজন হাতে তিনটি এয়ার গান আর একজনের কাধে একটা রেইনকোট ঝুলে আছে।তাদের পায়ের কাছে ধীরে ধীরে হাটছে একটা স্প্যানিয়েল।নীরব ঘরে বসে এক তরুনের কন্ঠ শোনা যাচ্ছে, “বার্টি, তুমি কেন চলে গেলে?”
ফ্রেমটন সাহেব নিজের হ্যাট আর লাঠিটা নিয়ে বাড়ির সদর দরজার দিকে ছুটে গেলেন। রাস্তায় বিপরীত দিকে ছুটে আসা সাইকেলটার ওপরে আছড়ে পড়তে গিয়ে একটুর জন্য বেচে গেলেন।
“এই, আমরা চলে এসেছি” রেইনকোট কাধে লোকটা বলল। “কাদা-টাদা কিছু লেগেছিল, এখন অবশ্য সব শুকিয়ে গেছে।পাগলের মত একজনকে ছুটে পালাতে দেখলাম। কে লোকটা?”
“নাটেল সাহেব-অসাধারণ লোক” মিসেস সেপলটন জবাব দিলেন, “লোকটা সারাক্ষণ শুধু নিজের অসুস্থতা নিয়েই কথা বল্ল।তোমরা এলে, যাওয়ার সময় একটু বিদায়ও নিয়ে গেল না। মনে হল যেন ভূত দেখে পালিয়েছে”।
“আমার মনে হয় স্প্যানিয়েলের জন্য লোকটা এমন করেছে” ভাগ্নিটি শান্ত কন্ঠে জবাব দিল, “উনি আমাকে একটু আগেই নিজের কুকুরভীতির কথা বলছিলেন।একবার নদীর পাড়ে গোরস্থানের মধ্যে উনাকে কয়েকটা কুকুর তাড়া করেছিল। ওদের হাত থেকে বাচার জন্য একটা নতুন খুড়ে রাখা কবরে উনাকে রাত কাটাতে হয়েছিল।আমার মনে হয় কুকুরভীতির এই অভিজ্ঞতা যথেষ্ট”।
গল্পঃ খোলা দরজা-The Open Window
মূল লেখকঃ H.H. Munro (Saki)
অনুবাদঃ আমি তুমি আমরা
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:০৯