তখন বিয়ে করেছি কতদিন হয়েছে?
এক বছর?
হয়ত। কিছুদিন কমবেশি হতে পারে।
কত কয়েক বছরে জমানো টাকা আর অফিস থেকে হোম লোন-এই দিয়ে নতুন বাড়িটা কিনে ফেললাম। আমার সারাজীবন কেটেছে ভাড়াবাড়িতে।বাড়িওয়ালার সাথে সামান্য কথা কাটাকাটি-পরদিন বাড়ি ছাড়ার নোটিশ।এভাবে আজ এখানে, কাল ওখানে-এভাবেই যাযবর জীবন কেটেছে আমার। তাই মৌসুমী যখন বলল ও বাবু নিতে চায়, তখন ওটাই মনে হল বাড়ি নেয়ার সঠিক সময়।
দেশের বড় শহরগুলোতে গত অনেক বছর ধরেই চলছে ফ্ল্যাট সংস্কৃতি।বাড়ি করবার ঝামেলায় আর কেউ যেতে চায় না। আমি কখনোই ফ্ল্যাট কেনায় আগ্রহী ছিলাম না।তাই সৌরভ ভাই যখন বললেন, একটা বাড়ি আছে, মালিক বেশ সস্তাতেই ছেড়ে দিচ্ছে, তখন তড়িঘড়ি করেই রাজি হয়ে গেলাম।
আগে থেকেই জানতাম বাড়িটা শহর থেকে একটু দূরে। তবে সমস্যা নেই, এদিকটায় রাস্তা তুলনামূলক ভাল আর জনবসতিও কম। তাই জ্যামেরও ভয় নেই।
বাড়িতে পৌছেই মন খারাপ হয়ে গেল। সৌরভ ভাই যেরকম বলেছিলেন বাড়িটা তার ধারেকাছেও নেই। বাড়ির সামনের গাছগাছালি এককালে বাগান হলেও এখন ছোটখাটো জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। আর দেয়ালগুলোতে রঙ এর ছিটেফোটাও নেই।বাড়ির আগের মালিকের অবস্থা বোধহয় খুব একটা সুবিধার ছিল না, তাই পুরানো দেয়াল্গুলোতে রঙ করা বা শ্যাওলা সরানোর দিকে যাননি। বরং শর্টকাট হিসেবে বাড়ির সবগুলো দেয়াল আর সিলিং ঢেকে দিয়েছেন রঙ্গিন ওয়ালপেপার দিয়ে।
মৌসুমী আমার মত নয়। বাড়িটা দেখে বেশ কিছুক্ষন নাচানাচি করল।
আমরা নিজেদের কাজ ভাগ করে নিলাম। আগামী দুদিনের ভেতর মৌসুমী রান্নাঘর আর শোবার ঘরকে বসবাসের উপযুক্ত করবে আর আমি বাড়ির সব দেয়াল আর সিলিং থেকে ওয়ালপেপার সরিয়ে রঙ করার জন্য তৈরী করব।
অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। পরদিন থেকেই কাজে নেমে পড়লাম।
আমেরিকা-ইউরোপে লোকজন ওয়ালপেপার ব্যবহার করে বলে শুনেছি।আমার নিজের ওয়ালপেপার লাগানোর বা সরানোর-কোন অভিজ্ঞতাই নেই।প্রথমবার হাত বুলিয়ে কাগজ বলে মনেই হল না।অনেক মসৃণ,মনে হল অনন্তকাল জুড়ে হাত বুলিয়ে যাই।
প্রথম টুকরোটা অনেক কায়দা করেও দেয়ালের গা থেকে আলগা করতে পারলাম না।শেষে একটা খুন্তি দিয়ে দিয়ে খুচিয়ে তুলতে হল। খুন্তির খোচায় ওয়ালপেপারটা বেশ কয়ে জায়গায় ছিড়ে গেল, বেশ কিছু আচড় পড়ল।সবচেয়ে অবাক হলাম পুরো ওয়ালপেপারটা সরানোর পর।ওয়াল্পেপারটার গা বেয়ে লাল রং-এর আঠালো তরল গড়িয়ে পড়ছে। এ আবার কেমন আঠারে বাবা? এত বছর পরেও কাগজের গা থেকে গড়িয়ে পড়ছে?
-এতক্ষনে মাত্র একটা ওয়ালপেপার সরালে?
চেয়ে দেখি মৌসুমী দাঁড়িয়ে আছে, চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট।
-তোমার কাজ কদ্দূর এগোল?
-আমার কাজ ভালই চলছে। তোমার একি অবস্থা?
-কেন? কি হল?
-সারা সকাল জুড়ে মাত্র একটা ওয়ালপেপার সরালে? এই গতিতে কাজ করলে অন্তত ছয় মাস লাগবে সব ওয়ালপেপার সরাতে।
-কি যে বল।আমি হাসার চেষ্টা করল।
মৌসুমী কিছু বলল না, গাল ফুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
-এই কাগজগুলো পুরাই অন্যরকম, দেয়ালের গায়ে লেগে থাকে।ছাড়ানো যায় না।
-আর কত অজুহাত দিবা?
-অজুহাত? তুমি চেষ্টা করে দেখাও দেখি।
আমি খুব ভাল করেই জানি চ্যালেঞ্জ করলে মৌসুমী খেপে যায়, এবারও ব্যতিক্রম হল না। প্রথমে ও পুরো ওয়ালপেপারটার ওপর হাত বুলিয়ে নিল, তারপর একটা কোনা খুঁজে বের করল। ওটা দেয়ালের গায়ে লেগে নেই। ওই কোনাটা ধরে টান দিতেই পুরো ওয়ালপেপারটা উঠে এল-আস্ত, অক্ষত।
-এভাবে করতে হয়। বুঝলেন জনাব। ওর ঠোঁটের কোনে হাসি।
-তোমার কপাল ভাল, ওটার একটা কোনা বেরিয়ে ছিল।
-তাই?
-জ্বি।
-তাহলে আরেকটা করে দেখাই।
দ্বিতীয় ওয়ালপেপারটার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটল। একটা কোনা বেরিয়ে আছে, ধরে টান দিতেই পূরোটা উঠে এল।
খেয়াল করে দেখলাম প্রতিটি ওয়ালপেপারই এভাবে লাগানো হয়েছে দেয়ালে। একদম কোনায় ছোট একটা অংশ বেরিয়ে থাকে, ধরে টান দিলেই পুরো ওয়ালপেপারটা উঠে আসে।
চতুর্থ ওয়ালপেপারে গিয়ে খেয়াল করলাম ব্যাপারটা। প্রতিটি ওয়ালপেপারই লাল রং-এর আঠা দিয়ে দেয়ালে লাগানো হয়েছে।আঙ্গুল দিয়ে আঠা সরিয়ে দিতেই একটা লেখা ভেসে উঠল।ভাল করে লক্ষ্য করে দেখলাম-একটা নাম। জয়া আহসান। নিচে তারিখ দেয়া। ০১/১০/২০০৮.
-অদ্ভূত।আমি মনে বললাম।
-কি? জানতে চাইল মৌসুমী।
-এই দেখ।
নাম আর তারিখ দেখে মৌসুমীও অবাক হল।
-মানে কি?জানতে চাইল ও।
-বুঝতে পারছি না।
-বাকিগুলোও দেখা দরকার।আস।
বাকি তিনটা দেখা অবাক হয়ে গেলাম।
নায়লা নাইম। ০১/০১/২০০৮.
নূসরাত ফারিয়া। ০১/০৪/২০০৮.
পরীমনি।০১/০৭/২০০৮.
মানে কি?
-চলতো অন্যরুমগুলায় দেখি।
-চল।
বিকেলের মধ্যে আরো আটটা ওয়ালপেপার নামিয়ে ফেললাম।
সবগুলোতেই একই ঘটনা। আঠা সরালেই একটা নাম আর তারিখ। তারিখগুলোও একই। পহেলা জানুয়ারী, পহেলা এপ্রিল, পহেলা জুলাই আর পহেলা অক্টোবর। শুধু সালগুলো ভিন্ন। এক রুমের চারটা ওয়ালপেপারে ছিল ২০০৯ আর অন্যরুমের গুলোতে ২০১০.
একটা কাজ করবে? মৌসুমী বলল।
-কি? আমি জানতে চাইলাম।
-এই নাম আর তারিখ দিয়ে গুগলে সার্চ দাও।
এখানে নেটোয়ার্ক ভাল না, তাই দুজনে বেরিয়ে এলাম।
সার্চ রেজাল্ট দেখে দুজনেরই আক্কেল গুড়ুম। এরা প্রত্যেকেই মিসিং পারসন আর ওয়ালপেপারে দেয়া তারিখ থেকেই এদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
-এখন কি করবে? মৌসুমী জানতে চাইল।
খেয়াল করে দেখলাম ওর গলা কাঁপছে।
-ভয় পেয়োনা। আমি ফোন করছি পুলিশে।
বাংলা সিনেমায় পুলিশ সবসময় শেষেই আসে, তবে ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হল।অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই চলে এল।
আমরা পুলিশকে সব খুলে বললাম।ইন্সপেক্টর সব চুপচাপ শুনলেন।
-শুভ সাহেব, আমরা আপাতত বাড়ির চারপাশে 'ডু নট এন্টার' সাইন লাগিয়ে লোক বসিয়ে দিচ্ছি। আমরা না বলা পর্যন্ত আপনারা আর এই বাড়িতে ফিরবেন না।
-আপনারা কি এটাকে ক্রাইম সিন হিসেবে বিবেচনা করছেন?
-আপাতত তাই।
আমি আর মৌসুমী বাধ্য হয়েই একটা হোটেলে উঠলাম। সৌরভ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। হল না। ফোন বন্ধ, লোকটা অফিসেও আসছে না।
এক সপ্তাহ পর পুলিশের ফোন পেয়ে আমি আর মৌসুমী বাড়িতে উপস্থিত হলাম।
-শুভ সাহেব।
-বলুন।
-সাইকোপ্যাথ সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?
-মানে?
-এই বাড়িতে আমরা দশটা রুমে সর্বমোট ঊনচল্লিশটা ওয়ালপেপার উদ্ধার করেছি। প্রতিটাতেই একটি করে মেয়ের নাম আর তারিখ লেখা আছে। একই প্যাটার্ন। এক রুমের চার দেয়ালে চারজনের নাম আর একই বছরে তিন মাস অন্তর তারিখ।বুঝতে পারছেন?
-জ্বি।
-আমরা এই ঊনচল্লিশ জনের ব্যাপারেই খোজ নিয়েছি। প্রতিটি মেয়েই মিসিং।
-বুঝতে পারছি।
-ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে প্রতিটি মেয়ের নামেই একজন করে নায়িকা আছে এদেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রীতে।
-আচ্ছা, দশ রুমেতো চল্লিশটা ওয়ালপেপার হওয়ার কথা।
-আপনাদের শোবার ঘরে তিন দেয়ালে ওয়ালপেপার ছিল। আরেকটা দেয়াল খালি।
-কিন্তু কেন?
-সে জবাবতো আপনি দেবেন।
-মা.. মা.. মানে?
-আরে ঘাবড়ে গেলেন নাকি?
-না.. না.. ঘাবড়াব কেন?
-গুড।কারণ ঘাবড়ে যাওয়ার মত কথাটা এখন শুনবেন?
-কি কথা? মৌসুমীর কন্ঠে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
-আমরা আমাদের এক্সপার্ট দিয়ে ওয়ালপেপারগুলো পরীক্ষা করিয়েছি। ওগুলো কাগজ নয়, মানুষের চামড়া। সম্ভবত ভিক্টিমদেরই। আর তার গায়ে লেগে থাকা লালচে তরলগুলো আঠা নয়, রক্ত।
ইন্সপেক্টর সাহেব শেষ কথাটা পুরো করতে পারলেন না, তার আগেই মৌসুমী মাথা ঘুরে পরে গেল।ফ্লোরে পড়ার আগেই আমি ওকে ধরে ফেললাম।
-শুভ সাহেব, আপনি উনার কাছে থাকুন।আমি গাড়ি থেকে পানি নিয়ে আসছি।
-গাড়ি কেন, এখানে বাথ্রুম থেকেই নিয়ে আসুন না।
-এই বাড়ির পানির লাইন আগেই কেটে দেয়া হয়েছে।
-জলদি আসুন।
ইন্সপেক্টর বেরিয়ে গেলেন।
আধ ঘন্টা কেটে গেল।
এখনও আসার নাম নেই। হারামজাদা পুলিশটা গেল কই?
এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল।ইন্সপেকটর সাগর।
-কি ব্যাপার? আপনি কি ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন? ইন্সপেক্টরের কন্ঠে উৎকণ্ঠা।
-মানে?
-আমি গত আধঘন্টা ধরে চেষ্টা করছি।দরজা খুলছেই না।
-আচ্ছা, আমি দেখছি।
মৌসুমীকে শুইয়ে দিয়ে দরজার কাছে যাব, মনে হল কে যেন আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তবে কি সাইকোপ্যাথটা তার চল্লিশতম খুন করার জন্য এসেছে?
[বিদেশী গল্পের ছায়া অবলম্বনে]
==========================================
আমার লেখা আরও কিছু পিশাচ কাহিনীঃ
পিশাচ কাহিনীঃ পৈশাচিক প্রতিশোধ
পিশাচ কাহিনীঃ শয়তানের পাল্লায়
পিশাচ কাহিনীঃ রক্তখেকো ডাইনী
পিশাচ কাহিনীঃ কন্ঠ
পিশাচ কাহিনীঃ অতিথি
পিশাচ কাহিনীঃ একটি ফটোগ্রাফ
পিশাচ কাহিনীঃআমাদের নতুন পুরানো ঘর
পিশাচ কাহিনীঃ রাতের আঁধারে
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ১:১৬