।।এক।।
-হ্যা, মেয়েটিকে আমি চিনি। লোকটা জবাব দিল।
লোকটার বেশভূষা দেখে পাগল ভেবে নিয়েছিলাম, তারওপর যখন নিজ থেকে কথা বলতে আসল, ভেবেছিলাম হাত পাতবে, টাকা পয়সা চাইবে।তা না, নিজ থেকে এগিয়ে এসেই লোকটা বলল, শুনলাম আপনি নাকি একজনকে খুজতেছেন।
জবাব দেয়ার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু এই টাইপ লোকজন জবাব না পেলে পিছে লেগেই থাকবে। তাই জবাব দিয়ে যত তাড়াতাড়ি কথা শেষ করা যায়-এই সিদ্ধান্ত নিলাম।
-হ্যা। আমি জবাব দিলাম।
-কারে খুঁজেন? লোকটা আবার জানতে চায়।
-একটা মেয়েকে।
-মাইয়া মানুষ? হলুদ দাঁতগুলো বের করে লোকটা একটা কুৎসিত হাসি দেয়।অবশ্য আপনের বয়সে আমিও মাইয়া মানুষই খুজতাম। মাথায় তখন অন্য কিছু ঢুকত না।
-বাজে কথা বলবেন না।
-আপনারা সাহেব মানুষ, আপনাদের কাছে বাজে কথা হইতে পারে। আমরা ছোটলোক, এমনেই কথা কই।
-আপনি যানতো, কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
-যাইতে তো চাই-ই। কিন্তু আপনারে সাহায্য করব বলে ঠিক করছি, সাহায্য না করে তো যাইতেও পারতেছি না।
-মানে কি?
-গত কয়েকদিন ধরে দেখতেছি আপনি এই এলাকায় ঘুরাফিরা করতেছেন, লোকজনরে খালি একটা ছবি দেখাইয়া কি সব জিজ্ঞেস করতেছেন। আমারে একবার দেখান ছবিটা, যদি কোন সাহায্য করতে পারি।
-লাগবে না। আপনি এখান থেকে যান। আমি অন্যদিকে মুখ ফেরাই।
-লাগবে না বললে তো হবে না। সাহায্য করব বলে মন ঠিক করে ফেলেছি, এখন ফিরা যাওয়ার উপায় নাই।
লোকটা হাত বাড়িয়ে দেয়, আমার হাতে থাকা ছবিটা দেখতে চায়।সেরেছে, পাগলটা ক্ষেপে গেল নাকি?
আমি হাত উচিয়ে ছবিটা দেখাই। এই যে।
-একটু হাতে নিয়া দেখি স্যার।
-আমার হাত থেকেই তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন।
-কিছু মনে কইরেন না, কিন্তু বয়স হইছে, দূরের জিনিস ভাল দেখি না।
আমি পাগলটার গা ঘেষে দাড়াই, ছবিটা ওর চোখের সামনে ধরি।
-এই যে , ভাল করে দেখ।
-একটু হাতে নিয়ে দেখতে চাইছিলাম স্যার। লোকটা হাত কচলাতে থাকে।
-না। আমি দৃঢ় কন্ঠে জবাব দেই।
-আইচ্চা, আপনের যা মর্জি। আমার হাত লাগলে যদি ওই ছবি ময়লা হইয়া যায়, তাইলে আর হাত লাগামু না।
-এত কথা কিসের? ছবি দেখে বলুন মেয়েটাকে চেনেন কিনা।
-স্যার কি অনেকদিন ধরে এই মাইয়ারে খুঁজেন?
আবার আজাইরা কথা?লোকটা দেখি পুরাই পেইন ইন দ্যা *স।
-হইছে, বুঝছি তুমি চেন না।আমি ছবিটা পকেটে ঢোকাই।
-স্যার, আপনারে দেইখাতো ভদ্র ঘরের শিক্ষিত পোলাই মনে হয়। কিন্তু এখন কাপড় নোংরা, চুল এলোমেলো। এইসব দেখেই জিজ্ঞেস করছিলাম আরকি। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়া অনেকদিন ধরেই এই মাইয়ারে খুজতেছেন।
-একদম চুপ। আর কোন কথা না। আমি হোটেলের পথে পা বাড়াই।
তখনই হঠাত লোকটা চিৎকার করে ওঠে।
-স্যার, মেয়েটাকে কিন্তু আমি চিনি।
।।দুই।।
মাস ছয়েক আগের কথা।
ফোনটা বেশ ঝামেলা করছিল।এলার্ম দিয়ে ঘুমাই, অথচ এলার্ম বাজে না।
তো সেদিন সকালেও একই ঘটনা ঘটল। এলার্ম বাজেনি।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি আটটা বাজে। নয়টা থেকে অফিস।পরপর দুদিন অফিসে লেট হয়ে গেছে।আজকে যদি লেট হয় তাহলে একদিনের বেতন কাটা যাবে।
কোনরকমে মাথায় দুই মগ পানি ঢেলে মুখে দুটো পাউরুটি গুজে দিয়ে অফিসের দিকে দৌড় দিলাম।
কথায় বলে বিপদ আর দূর্ভাগ্য একসাথে আসে। বাসা থেকে বের হয়ে দেখি রাস্তায় কোন সিএনজি নেই। দুটো রিকশা অলস দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তারা এখন কোন ভাড়া নিতে রাজি না।
বাধ্য হয়েই দৌড় দিলাম।
কতক্ষণ দৌড়েছি জানি না, থমকে দাঁড়াতে হল। জিমে যাওয়া ছাড়ার পর থেকেই ভুড়িটা আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে, সাথে অনেকদিনের অনভ্যস্ততার কারণে কাধে ব্যাগ নিয়ে দৌড়ানোটা বেশ কঠিন লাগছিল।
একটা টং-এর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
-পানি।
-এই যে। লোকটা একটা গ্লাসে পানি এগিয়ে দিল।
এপ্রিল মাস। মাঝে মাঝেই কোন কথাবার্তা ছাড়াই প্রচন্ড বাতাস দিয়ে ঝড় শুরু হয়। আজকেও তাই হল।
হাত দিয়ে চোখ দুটো ঢেকে মিনিট দুয়েক দাঁড়িয়ে রইলাম।
চোখ খুলতেই দেখি লোকটা হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার গ্লাস ফেরত চায়। দিয়ে দিলাম।
আবার অফিসের পথে পা বাড়াব, হঠাৎ দেখি শার্টের সাথে একটা ছবি লেপ্টে আছে।
আরে, এটা আবার এল কোত্থেকে?
ছবিটা হাতে নিলাম।
দূরে কোথাও বাজ পড়ার শব্দ হল। দূরে কোথাও? নাহ, ভুল বললাম।মনে হল যেন আমার ওপরই বাজ পড়ল। এত সুন্দর মানুষ হয় কি করে?
।।তিন।।
বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে।
আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। আমি কবি হলে বাইরের দৃশ্যাবলী নিয়ে চমৎকার কবিতা লিখতে পারতাম। কবি নই বলেই শুধু একটা শব্দই মুখ দিয়ে বের হল, অপূর্ব।
ঘড়ির দিকে তাকালাম। সাড়ে নয়টা বাজে।
এখন নিজের কেবিনে দাঁড়িয়ে কফির কাপে চুমুক দিয়ে বৃষ্টি দেখছি, অথচ কি জঘন্যই না ছিল আজকের দিনের শুরুটা। দেরীতে ঘুম থেকে ওঠা, কোন রকমে গোসল করে অফিসের দিকে দৌড় দেওয়া, রিক্সা-সিএনজি কিছুই না পাওয়া।
অথচ ছবিটা পাওয়ার পরেই সব বদলে গেল।
ছবিটার দিকে চেয়ে আছি, হঠাৎ আমার পাশেই একটা সিএনজি এসে থামল।
-স্যার, কই যাইবেন?
অফিসের ঠিকানা বললাম। কত চাও?
আকাশের দিকে তাকালাম। মেঘ করেছে, যেকোন মুহূর্তে ঝড় উঠবে। ঠিক করলাম, যে ভাড়াই চায় তাতেই চলে যাব। দামাদামি করে এই সিএনজিটাও হাতছাড়া করার কোন মানে নেই।
লোকটার জবাব শুনে সত্যিই অবাক হয়ে গেলাম। স্যার, মিটারে যা আসে।
নিজেকে চিমটি কেটে নিলাম। ঘুমিয়ে নেইতো আমি? স্বপ্ন দেখছি নাকি?
-স্যার ওঠেন, বৃষ্টি আসবে।
উঠে পড়লাম। আবহাওয়ার জন্যই হয়তবা যেখানে জ্যাম থাকার কথা, সেখানে দুএকটা গাড়ি দেখলাম।বাতাস হচ্ছে, কিন্তু বৃষ্টি এখনো শুরু হয়নি। তাই কোথাও পানি ওথজবৃষ্টি এখনো শুরু হয়নি। তাই কোথাও পানি ওঠেনি।
পাঁচ মিনিট লেট হল, তবুও সহি সালামতে অফিসে পৌছে গেলাম।
গেটের কাছে দারোয়ান সালাম দিল।
-স্যার আসছেন? জানতে চাইলাম।
-বড় সাব আহনও আহেন নাই। লোকটা জবাব দিল।
ইয়েস। প্রতিদিন পাংচুয়ালিটি নিয়ে বসের লেকচার শুনতে হয়, আজ বেচে গেলাম।
নিজের কেবিনে এসে ঢুকলাম।
-ইরা, একটা কফি পাঠিয়ে দিও।
-ওকে স্যার।
কফি চলে এল।চুমুক দিয়ে মনটা ভরে গেল। এমন মেঘলা দিনে এইতো চাই।
পকেট থেকে ছবিটা বের করলাম। মায়াবী মুখের এক কিশোরীর ছবি, পরনে একটা মলিন শাড়ি, মাথায় দুটো বেনী করা। মুখে মনকাড়া হাসি, দুটো আঙ্গুল ‘ভি’-চিহ্নের আদলে উচিয়ে ধরা।
ছবিটা সাদাকালো। মেয়েটার সাজপোশাক আর ছবির ধরন দেখে মনে হচ্ছে ছবিটা অনেক পুরনো। এই পুরনো ছবিটা এই শহরে এল কি করে?
-স্যার। ইরা উকি দিল।
আমি ভ্রু নাচালাম। কি ব্যাপার?
-সিইও স্যার ডাকে আপনাকে।
এর মধ্যেই বুড়ো চলে এসেছে? যাও, আমি আসছি।
-ওকে। দরজার ফাক থেকে ইরার মুখটা সরে গেল।
আমিও উঠে দাঁড়ালাম। যাই, বুড়োর চেঁচামেচি শুনে আসি।
-এসো আদনান। বুড়ো হাসিমুখে অভিবাদন জানাল।
একি?সূর্য কোনদিকে উঠল আজকে? বুড়ো ঝাড়ির বদলে হাসিমুখে কথা বলছে কেন?
-দাঁড়িয়ে কেন? বোস।
বসে পড়লাম।
-আদনান।
-জ্বি স্যার।
-সরাসরি কাজের কথায় আসি। আমাদের গত ফিস্কাল ইয়ারে কোম্পানির টোটাল ফিনানশিয়াল কন্ডিশনের ওপর তুমি যে রিপোর্ট করেছিলে, কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টরের মিটিং-এ সেটা নিয়ে বেশ পজেটিভ ফীডব্যাক পাওয়া গেছে। কোম্পানি সিদ্দান্ত নিয়েছে তোমার প্রমোশনের। আজ থেকে তুমি কোম্পানির ফিনান্স ম্যানেজার।
ঠিক কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। মেয়েটার ছবি পাওয়ার পর থেকেই শুধু গুড নিউজ পাচ্ছি। পুরো ব্যাপারটাই কি কাকতালীয়? নাকি অন্য কোন ব্যাপার আছে?
-আরো একটা সুখবর আছে। কোম্পানি তোমাকে ট্রেনিং এর জন্য বাইরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।ফিরে এসেই তুমি হেড অফিসে জয়েন করবে।
-স্যার , কতদিনের ট্রেনিং?
-ছয় মাস।
-সরি স্যার।
-মানে?
-মানে আমার পক্ষে এখন দেশের বাইরে যাওয়া সম্ভব না। তাছাড়া হেড অফিসেও যাওয়া সম্ভব না।
-কেন?
-আমার একজনকে খুঁজে বের করা খুব দরকার।
-কাকে?
আমি ছবিটা বের করে দেখাই। এই মেয়েটিকে।
-কে এই মেয়ে?
-জানি না।
-নাম কি? থাকে কোথায়? তোমার সাথেই বা কি সম্পর্ক?
-কিছুই জানি না স্যার। শুধু জানি, শি ইজ মাই গুড লাক।আই নীড টু ফাইন্ড হার।
এর পরের গল্প খুব সংক্ষিপ্ত।চাকরিটা আমি ছেড়ে দিয়েছি। গত ছয়মাস ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি মেয়েটাকে। চাকরি থাকলে এতদিনে হয়ত ট্রেনিং শেষে দেশে ফিরতাম, সেই আমি এখন পরে আছি এই গ্রামে। অবশেষে দেখা পেয়েছি একজনের, লোকটা চেনে মেয়েটিকে।
আমার অপেক্ষার পালা শেষ হয়ে এসেছে।
আজ পোস্ট করলাম গল্পের প্রথম পর্ব। মোট দুই পর্বে গল্পটি শেষ করার প্ল্যান আছে। সাথে থাকুন। ধন্যবাদ।
==========================================
আমার লেখা অন্যান্য ভৌতিক গল্পগুলোঃ
১.পিশাচ কাহিনীঃ রক্তখেকো ডাইনী পর্ব-১ পর্ব-২ পর্ব-৩
২.পিশাচ কাহিনীঃ জানোয়ারের রক্ত (১৮+)
৩.পিশাচ কাহিনীঃ অন্ধকারে বিলীন
৪.পিশাচ কাহিনীঃ হোটেল একশ তলা
৫.পিশাচ কাহিনীঃ একশ তলায় আবার
৬.পিশাচ কাহিনীঃ রাতের আঁধারে
৭.পিশাচ কাহিনীঃ কন্ঠ
৮.পিশাচ কাহিনীঃ অতিথি
৯.পিশাচ কাহিনীঃ কান্নার শব্দ
১০.পিশাচ কাহিনীঃ শয়তানের পাল্লায়
১১.পিশাচ কাহিনীঃ নির্ঘুম রাত
১২.পিশাচ কাহিনীঃ জঙ্গল মঙ্গলপুর
১৩.পিশাচ কাহিনীঃ একটি ফটোগ্রাফ
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০২৩ রাত ১১:০৬