♣♣♣♣ An Occurrence at Owl Creek Bridge ♣♣♣♣
আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় নিয়ে লেখা "An Occurrence at Owl Creek Bridge" কে বলা হয় Ambrose Bierce এর সবচেয়ে বিখ্যাত ছোট গল্প। ১৮৯০ সালে "San Francisco Examiner" এ গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে ১৮৯১ সালে গল্পটি সংকলিত হয় Bierce এর "Tales of Soldiers and Civilians"-এ।
এক
উত্তর আলবামা। একটি লোক রেলরোড ব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে বিশ ফুট নিচের স্বচ্ছ পানির দিকে চেয়ে ছিল। লোকটার হাত দুটো পিছনের দিকে, দুহাতের কবজি একসাথে একটা তার দিয়ে বাধা।গলায় একটা মোটা দড়ি দিয়ে ফাঁস লাগানো। মাথার ওপর একটা বিশাল গাছের মোটা ডাল পেচিয়ে রেখেছে দড়িটা, দড়ির অপর প্রান্ত নেমে এসেছে তার হাটুর কাছে। লোকটা দাঁড়িয়ে আছে কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরী অস্থায়ী ফাঁসির মঞ্চে।
লোকটার শাস্তি কার্যকর করার দায়িত্ব পড়েছে ফেডারেল আর্মির দুজন সৈনিক আর একজন সার্জেন্টের ওপর। একটু দূরে সামরিক পোশাকে আরেকজন সশস্ত্র লোক দাঁড়িয়ে আছে, পোশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে লোকটা একজন ক্যাপ্টেন। ব্রীজের দুপাড়ে দুজন সৈনিক রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, দেখে মনে হচ্ছে না ব্রীজের মাঝখানে কি হচ্ছে তা জানার বা দেখার তাদের কোন আগ্রহ আছে। ব্রীজের দুই মুখ বন্ধ করে দিয়েই তারা খুশি।
একজন সৈনিককে অতিক্রম করে রেলপথ চলে গেছে কয়েকশ ফুট, এরপর বাক নিয়ে হারিয়ে গেছে জঙ্গলের ভেতর, দৃষ্টসীমার বাইরে।দেখা না গেলেও এরা সবাই নিশ্চিত একটু দূরে নিশ্চয়ই আরো কোন আউটপোস্ট আছে।
রেলপথের আরেক প্রান্ত পাহাড় বেয়ে ওপরের দিকে উঠে গেছে, তার শেষে প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে একটা প্রতিরক্ষা দুর্গ।দুর্গ আর ব্রীজের ওপর দাঁড়ানো কয়েকজন লোকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একদল দর্শক-প্যারেড শেষ করে 'আরামে' দাঁড়ানো একদল সৈন্য।তাদের রাইফেলের বাটগুলো মাটির ওপর দাঁড়ানো আর রাইফেলের শীর্ষভাগ ধরে রেখেছে তাদের ডান হাত। সৈন্যদের এই দলটাকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন একজন লেফটেন্যান্ট।তার ডান হাতে একটা তলোয়ার, বাম হাতটা ডান হাতের ওপর রাখা।
সৈন্যদের পুরো দলটাই নদীর দিকে মুখ করে পাথরের মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, দেখলে মনে হবে যেন একদল তরুন অবাক হয়ে নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করছে। ক্যাপ্টেন তার হাত দুটো ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছেন, নীরবে লক্ষ্য করছেন তার আধীনস্থদের কাজ। মৃত্যু যখন আসে, তখন তাকে সম্মানের সাথে অভ্যর্থনা জানাতে হয়। নীরবতা আর স্থিরতাই সামরিক বাহিনীতে মৃত্যুকে সম্মান জানানোর মাধ্যম।
যে লোকটাকে ফাসি দেয়া হবে তার বয়স পয়ত্রিশের আশেপাশে। লোকটা বেসামরিক-হাবভাব দেখে সহজেই বোঝা যায়।সম্ভবত বাগানের মালিক ছিল সে। লোকটা দেখতে শুনতে ভালই-খাড়া নাক, ভরাটা মুখ, বড় কপাল আর পেছন দিকে আচড়ানো ঘন কালো চুল। সামনের চুলগুলো কান পেরিয়ে ঘাড় পর্যন্ত চলে গেছে, স্পর্শ করেছে তার ফ্রক কোট। লোকটার মুখে অভিজাত গোফ আর ঘন দাড়ি। চোখে মায়াবি চাহনি নিয়ে সে চেয়েছিল।একটু পরেই যার ফাঁসি হবে তার চোখে ভয়ের লেশমাত্র নেই!
ফাঁসির এই আয়োজনকে ঠিক অমানবিক বলা চলে না।সামরিক আইনে সব শ্রেনীর মানুষের অপরাধের শাস্তি আছে, অভিজাত শ্রেনীর লোকেরা এই আইনের ঊর্ধ্বে নন।
প্রস্তুতি সম্পন্ন হল। সৈন্য দুজন দুটো তক্তার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। সরানো হল তক্তা দুটো। সার্জেন্ট ক্যাপ্টেনের দিকে ফিরলেন, স্যালুট করে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। এখন কাঠের তক্তার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে অভিযুক্ত লোকটা আর তক্তার অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে সার্জেন্ট, ধরে রেখেছে তক্তার ভর। ক্যাপ্টেনের নির্দেশ পেলেই সে তক্তার ওপর থেকে সরে যাবে, তক্তাটা পড়ে যাবে নদীতে আর লোকটা ঝুলে পড়বে তার গলায় লাগানো ফাঁসে।
লোকটার মুখে কোন যমটুপি পড়ানো হয়নি, তার চোখও কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়নি। লোকটা একবার চারপাশে তাকিয়ে তার মৃত্যুর আয়োজন দেখল, এরপর তার পায়ের নীচ দিয়ে বয়ে পানির স্রোতের ওপর চোখ বোলাল।লোকটার চোখ আটকে গেল নদীর পানিতে ভাসমান এক টুকরা কাঠের ওপর।
সময় বয়ে চলেছে অসহ্য ধীরগতিতে।লোকটা চোখ বন্ধ করল।এই নদী, নদীর পানিতে ভেসে চলা কাঠের টুকরা, সোনালি রোদ দেয়া সূর্য, এই দূর্গ, সৈন্যদের দল-সব বারবার তার মনকে বিক্ষিপ্ত করেছে। মৃত্যুর আগে, শেষ সময়ে লোকটা তার স্ত্রী-সন্তান আর আপনজদের কথা ভাবতে চায়। কিন্তু তখনই শুরু হল নতুন উপদ্রব। তার চিন্তা চেতনাকে আঘাত করতে শুরু করল তীক্ষ্ণ একটা শব্দ। শুনে মনে হচ্ছিল কামারের হাতুড়ি দিয়ে উত্তপ্ত লোহাকে আঘাত করার শব্দ, এই শব্দটাও ঠিক একই সুরে বেজে চলেছে। লোকটা বুঝতে পারছিল না এটা কিসের শব্দ।একবার মনে হয় কাছেই কোথাও শব্দটা হচ্ছে, ঠিক পরমুহূর্তেই মনে হচ্ছে দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসছে শব্দটা। শব্দটা হচ্ছিল অনিয়মিতভাবে, প্রতিটি শব্দের মধ্যেকার বিরতি বাড়ছিল। সময়ের সাথে সাথে শব্দের তীব্রতা আর তীক্ষ্ণতা-দুটোই বাড়ছে। অসহ্য যন্ত্রনায় মনে হচ্ছিল কেউ যেন ছুরি দিয়ে বারবার তার কানে আঘাত করছে। হঠাৎ লোকটা বুঝতে পারল এটা আর কিছুই নয়, তার বুকপকেটে রাখা ঘড়ির কাঁটার শব্দ।মৃত্যুর আগ মুহূর্তে ঘড়ির চেনা শব্দও তার কাছে অচেনা মনে হচ্ছে!
চোখ খুলে লোকটা নিচের দিকে তাকায়-প্রবল স্রোতে নদী বয়ে চলেছে।"যদি একবার হাতের এই বাঁধন আমি খুলতে পারি" লোকটা মনে মনে ভাবল "তাহলে গলা থেকে এই ফাঁস সরিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিতাম, ডুব সাঁতার দিয়ে ঠিক পৌছে যেতাম নদীর পাড়ে। সৈনিক আর ক্যাপ্টেনের বন্দুককে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দৌড় দিতাম বাড়ির দিকে।তারপর বউ-বাচ্চা নিয়ে চলে যেতাম এইসব হানাদারের নাগালের বাইরে।"
লোকটা যখন জীবন বাঁচানোর কথা ভাবছে তখন ক্যাপ্টেন আর সার্জেন্টের মধ্যে চোখেচোখে কথা হয়ে গেছে। ক্যাপ্টেন ইশারা করলেন।সার্জেন্ট সরে দাঁড়াল তক্তার ওপর থেকে।
দুই
পেটন ফারকুহার একজন বাগানের মালিক, আলবামা শহরের এক অভিজাত পরিবারের সন্তান। তার অনেকগুলো দাস আছে। অন্যসব দাসমালিকদের মত তিনিও দক্ষিনের নেতাদেরকেই সমর্থন করেন। করিন্থ (মিসিসিপি অঙ্গরাজ্যের একটি শহর) এর পতনের পর আর সবার মত তিনিও তেঁতে আছেন, অপেক্ষা করছেন যুদ্ধে যোগ দেয়ার সুযোগের জন্য।তিনি জানেন যেকোন মুহূর্তেই এই সুযোগ তার আসবে। বাস্তবে একজন বেসামরিক লোক হলেও মনেপ্রানে তিনি একজন যোদ্ধা।
এক বিকেলে পেটন এবং তার স্ত্রী তাদের বারান্দায় বসেছিলেন। এমন সময় ধুলোয় জড়ানো এক সৈনিক সদর দরজায় উপস্থিত হয়ে পানি চাইল। মিসেস পেটন খুশি মনে পানি আনতে ভেতরে চলে গেলেন, এই বাদামী সৈনিককে তিনি নিজের সাদা হাতে পানি পান করাতে চান। স্ত্রী ভেতরে যাওয়ার পরপরই পেটন সাহেব যুদ্ধের খোজ খবর নিতে শুরু করলেন।
"ইয়েংকীরা(Yankee-আমেরিকানদের ব্যঙ্গ করতে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়) রেলপথ মেরামত করছে" লোকটা বলল "ওরা আরো সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে।আউল ক্রীক আর উত্তর পাড়ের দূর্গ ওরা এর মধ্যেই দখল করে ফেলেছে।ওরা একটা নতুন আদেশ জারি করেছে। যদি কোন বেসামরিক লোককে আউল ক্রীক ব্রীজ, রেলপথ বা দূর্গের আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়-তবে তাকে সাথেসাথে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে।আমি নিজে ওটার লিখিত কপি দেখেছি। "
"এখান থেকে আউল ক্রীক ব্রীজ কত দূরে?"
"এইতো, ত্রিশ মাইলের মত।"
"ওখানে পাহারা কিরকম?"
"ব্রীজ থেকে আধ মাইল দূরে একটা আউটপোস্ট আছে। ওখানে একজন মাত্র সৈন্য পাহারা দেয়।"
"ধর একজন বেসামরিক লোক যদি এই পাহাদারের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিংবা তাকে খুন করে যদি আউল ক্রীকে পৌছায়, তাহলে সে ক করতে পারবে?"
"আমি ওখানে একমাস আগে ছিলাম। গত শীতে বন্যার পানিতে ভেসে আসা কাঠের টুকরাগুলো এখনো ওখানে রাখা আছে। কাঠগুলো সব শুকিয়ে জঙ্গলের পাড়ে পড়ে আছে।যেকেউ চাইলেই সেখানে দাবানল ছড়িয়ে দিতে পারবে।"
ইতোমধ্যেই পেটন সাহেবের স্ত্রী পানি নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। পানির জন্য সৈন্যটা তাদের ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেল। এক ঘন্টা পর, সূর্য ডুবে যখন আধার নেমেছে, তখন বাগান পেরিয়ে সে উত্তরের দিকে চলতে শুরু করল।
তিন
ব্রীজ থেকে পড়েই পেটন ফারকুহার জ্ঞান হারিয়েছিল।জ্ঞান ফিরতেই তার মনে হল বহু যুগ পেরিয়ে গেছে।তার ঘাড়ে তীব্র ব্যথা আর একটা দমবন্ধ অনুভূতি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ঘাড় থেকে এই তীব্র ব্যথা দেহের প্রতিটি কোষে ছড়িয়ে পড়ছে। এই তীব্র যন্ত্রনার সাথে তার মস্তিষ্কের চিন্তাশীল অংশের কোন সংযোগ ছিল না। মনে হচ্ছিল তার মস্তিষ্ক এখন আর চিন্তা করতে পারছে না, শুধু অনুভব করতে পারছে আর সবগুলো অনুভূতিই ছিল তীব্র যন্ত্রনার।
অবশেষে ধীরে ধীরে তার চেতনা ফিরে এল।তার মনে পড়ল সার্জেন্ট কাঠের তক্তা থেকে সরে যাওয়ার পরই সে দড়ি ছিড়ে নদীতে পড়ে যায়, ওই সরু দড়ি তার বিশাল দেহের ভার নিতে পারেনি। গলায় তখনও ফাঁসের দড়িটা জড়িয়ে আছে, কোনভাবেই তাকে নিঃশ্বাস নিতে দিচ্ছে না।গলায় ফাঁসের দড়ি জড়িয়ে পানিতে ডুবে মরা-ব্যাপারটা খুবই হাস্যকর মনে হল তার কাছে।
চোখ খুলতেই সে আলো দেখতে পেল, কিন্তু মনে হল যেন হাজার মাইল দূর থেকে সেই আলো আসছে। আলোর কাছে সে কোনদিনই পৌছাতে পারবে না। সে তখনও পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে আর আলোটা ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে আসছিল।একটা সময় আলোটাকে মনে হল ছোট্ট একটা বিন্দুর মত।"গলায় ফাঁস লেগে পানিতে ডুবে মৃত্যু", সে ভাবল, "এটা আসলে তেমন খারাপ কিছু নয়। কিন্তু গুলি খেয়ে মৃত্যু? না, না, আমি গুলি খেয়ে মরতে চাইনা। খুবই অমানবিক হবে ব্যাপারটা।"
সে সজ্ঞানে চেষ্টা করছিল না, তবে কব্জির তীব্র ব্যথা তাকে জানিয়ে দিল হাত দুটো মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। এবং অনেক চেষ্টার পর, মোটা দড়িকে হারিয়ে দিয়ে তার দুটো মুক্ত হয়ে গেল।অসাধারন। লোকটা অবাক হয়ে তার হাত দুটোকে দেখছিল।তাদের তীব্র প্রচেষ্টায় অবশেষে তার গলার চারপাশ থেকে ফাঁসের দড়িটাও সরে গেল। "না,না, দড়িটাকে গলার চারপাশে পেচিয়ে দাও।এখন ভেসে উঠলেই সৈন্যরা সব গুলি করে মারবে।"
কিন্তু তার অবাধ্য হাতের এসব শোনার সময় ছিল না।মস্তিষ্কে মনে হচ্ছিল আগুন লেগেছে, বাতাসের অভাবে মনে হচ্ছিল ফুসফুসটা গলা দিয়ে বেরিয়ে আসবে। বেঁচে থাকার তীব্র তাড়নায় তার হাত দুটো উপরে ওঠার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।অবশেষে লোকটা বুঝতে পারল তার মাথা ভেসে উঠেছে পানির ওপর, সূর্যের তীব্র আলোয় তার চোখ দুটো ধাধিয়ে গেল। আর মুখটা হা করে ফুসফুসে বাতাস পাঠাতে শুরু করল।
এবার তার পূর্ন চেতনা ফিরে এল। নদীর পাড়েই জঙ্গল। সে চেয়ে দেখল ব্রীজ, ব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ক্যাপ্টেন, সার্জেন্ট আর দুটো সৈন্য। দূর থেকে তাদের চেহারা বোঝা যাচ্ছে না, কেবল কালো ছায়ার মত মনে হচ্ছে। তারা তার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছে। ইতিমধ্যেই ক্যাপ্টেন তার পিস্তল বের করে নিয়েছে, তাক করেছে তার দিকে।কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার। ক্যাপ্টেন তার পিস্তল থেকে গুলি ছুড়ল না।
হঠাৎ করেই লোকটা একটা তীব্র শব্দ শুনতে পেল, কিছু একটা নদীর জলে আঘাত করেছে, তার মাথার কাছ থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে আর তাতেই পানির ছিটা এসে পড়েছে তার মুখে।এরপর সে দ্বিতীয় শব্দটা শুনতে পেল, দেখল দুজন সৈনিকের একজন তার কাঁধের রাইফেলটা তুলে তার দিকে তাক করেছে, রাইফেলের ধোয়া জানিয়ে দিচ্ছে দ্বিতীয় গুলিটা ছোড়া হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। কিন্তু লোকটার কপাল।এবারের গুলিটাও মিস হয়ে গেল।
ফারকুহার শুনতে পেল, নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে কি আশ্চর্য শীতল আর নিষ্ঠুর কন্ঠে লেফটেন্যান্ট তার সৈনিকদের আদেশ দিচ্ছেঃ
"Attention, company! . . Shoulder arms! . . . Ready! . . . Aim! . . . Fire!"
ফারকুহার যতটা গভীরে সম্ভব ডুব দিল। তার কানের কাছে পানি নায়াগ্রার মত গর্জন করে চলেছে, তবুও সে বন্দুকের হিংস্র গর্জন শুনতে পাচ্ছিল। একবার সে নিঃশ্বাস নিতে পানির ওপরে উঠে এল আর দেখতে পেল ছোট ছোট ধাতুর টুকরা তার দিকে ছুটে আসছে।এদের মাঝে একটা বুলেট তাকে ঘাড় আর কাঁধের মাঝখানে স্পর্শ করে বেরিয়ে গেল।
দ্বিতীয়বার পানির ওপর এসে সে দেখতে পেল সৈন্যরা তাদের রাইফেল রিলোড করে নিয়েছে। সূর্যের আলোর মত ঝলকানি দিয়ে রাইফেল থেকে আবার বুলেট বেরিয়ে এল।কিন্তু এবারও পেটনকে লক্ষ্য না করে তারা ছুটে গেল এদিক সেদিক।
পেটন ফারকুহার তার ঘাড়ে হাত বুলিয়ে নিল, তারপর সাঁতার কাটতে শুরু করল স্রোতের সাথে।তার মস্তিষ্কও এখন তার হাত আর পায়ের মত সতেজ হয়ে উঠেছে, মাথায় ভাবনা চলেছে এখন আলোর গতিতে।"অফিসার দ্বিতীয়বার আর ভুল করবে না।সে নিশ্চিত তার সব সৈন্যকে ওপেন ফায়ারের নির্দেশ দিয়েছে। একটা দূটো বুলেটকে হয়ত ফাঁকি দেয়া সম্ভব, কিন্তু এতগুলো বুলেটকে আমি কিভাবে ফাঁকি দেব?"
হঠাত একটা বিশাল ঢেউ তার দিকে ছুটে এল, সেই সাথে ফাটানো শব্দ। ঢেউয়ের তোড়ে পেটন তাল হারিয়ে পানিতে হাবুডুবু খতে শুরু করল, ঢেউয়ের ধাক্কায় চোখ খোলা রাখাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল তার জন্য।
অনেক কষ্টে চোখ খুলে সে দূর্গের দিকে তাকাল, মাঠে নতুন খেলোয়াড় এসে পড়েছে-একটা বিশাল কামান! ভয়ের একটা তীব্র স্রোত তার শিড়দাড়া দিয়ে বয়ে গেল। কপাল ভাল হলে গুলি খেয়ে তবুও বেঁচে থাকা সম্ভব, কিন্তু কামানের সাথে সে লড়বে কি করে?
"ওরা নিশ্চয়ই আর কামানের গোলা ছুড়বে না," মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দিল পেটন, "আমাকে বন্দুকের দিকে নজর রাখতে হবে। রাইফেল থেকে গুলি বের হওয়ার অনেক পড়ে শব্দ শোনা যায়, আমাকে রাইফেলের ধোঁয়া দেখেই সাবধান হয়ে যেতে হবে।"
হঠাত করেই পেটন পানির মাঝেই ঘুরপাক খেতে শুরু করল। নদীর পানি, নদীর পাড়, নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা জঙ্গল,
বহুদূরে দাঁড়িয়ে থাকা আউল ক্রীক ব্রীজ, দূর্গ আর দূর্গের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সৈন্যের দল-সবকিছু তার কাছে অস্পষ্ট হতে শুরু করল। কোন কিছুই সে আর স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল না, সবকিছু তাকে চিনতে হচ্ছিল রং আর অবয়ব দেখে। পেটন বুঝতে পারছিল সে ঘূর্ণপাকের মাঝখানে পড়েছে, ব্যাপক ঘূর্ননে সে অসুস্থ হয়ে পড়ছিল।
কয়েক মুহূর্ত পরেই ঘূর্ণিপাকটা তাকে ছুঁড়ে ফেলল নদীর দক্ষিণ পাড়ে, একটা বিশাল গাছের পেছনে। দূর্গ বা ব্রীজ থেকে পেটনকে আর দেখা যাচ্ছিল না। আনন্দের আতিশয্যে পেটন কেঁদে ফেলল। তার হাতে লেগে থাকা কাদাকে তার একবার মনে হল হীরা, আবার মনে পান্না। এই একতাল কাদাই এখন তার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আর দামী বস্তু বলে মনে হল।
হঠাত করেই তীব্র শব্দ শুনে পেটন পেছন ফিরে তাকাল।সৈন্যরা পেটনকে দেখতে না পেয়ে কামানের আরেকটা গোলা ছুড়েছে, সেই গোলা এসে নদীর এই পাড়ে জঙ্গলের একটা গাছে আঘাত করেছে।পেটন বুঝতে পারল তার লাশ না দেখা পর্যন্ত সৈন্যরা আক্রমন চালিয়ে যাবে, এই জঙ্গলে থাকাটা কোনক্রমেই নিরাপদ নয়। দ্রুত পা চালিয়ে পেটন ঢুকে পড়ল জঙ্গলের ভেতরে।
সূর্য দেখে নিজের দিক ঠিক করে সারাদিন হাঁটল পেটন।জঙ্গলটার মনে হল কোন শেষ নেই, সারাদিন হেটে এমনকি কাঠুরের তৈরী কোন রাস্তাও তার চোখে পড়ল না। পেটন জানতই না এমন জংলা এলাকায় সে তার জীবন কাটিয়েছে। বিষয়টা বুঝতে পেরেই ভয়ে তার গা-টা ছমছম করে উঠল।
রাত নামতেই তার দেহটা অবশ হয়ে এল। কিন্তু নিজের স্ত্রী আর সন্তানদের কথা ভেবে সে জোর করে তার পা দুটো চালিয়ে নিতে লাগল। অবশেষে পেটন একটা চেনা পথের দেখা পেল। রাস্তাটা শহুরে পথের মত চওড়া আর প্রশস্ত, কিন্তু মনে হয় এই পথ দিয়ে কখনও কেউ হাটেনি। এমনকি কোন গৃহপালিত কুকুরের শব্দও শোনা যাচ্ছিল না- যা শুনে বোঝা যায় আশেপাশে লোকালয় আছে। রাস্তার দুপাশের গাছের সারি দাঁড়িয়ে আছে বিশাল কালো দেয়ালের মত।অচেনা শব্দ ভেসে আসছে এই গাছগুলো থেকে, পেটন নিশ্চিত এই শব্দগুলোর কোন লুকানো মানে আছে।
পেটনের ঘাড়ে তীব্র ব্যথা করছিল।ঘাড়ে হাত দিতেই সে বুঝতে পারল জায়গাটা ভিজে গেছে-এটা সেই জায়গা যেখানে ওরা ফাঁসির দড়ি পেচিয়ে দিয়েছিল। তীব্র ঘুমে তখন পেটনের চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে, প্রবল তৃষ্ণায় শুকিয়ে গেছে তার জিহ্বা। পা দুটো আর চলছিল না, পেটন কোনভাবেই তার পায়ের নিচে পথের অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছিল না।
নিঃসন্দেহে, প্রবল যন্ত্রনা সত্বেও হাটার মাঝেই পেটন ঘুমিয়ে পড়েছিল।কেননা চোখ খুলেই সে দেখতে পেল ঘরের সদর দুয়ারে সে দাঁড়িয়ে আছে, সবকিছু তেমনটাই আছে যেমনটা সে রেখে গিয়েছিল।সকালের মিষ্টি রোদে কি চমৎকারই-না দেখাচ্ছে তার বাগানবাড়িটা। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই সে দেখতে পায় বাতাসে উড়ছে এক সুন্দরীর কাপড়, তার প্রিয়তমা স্ত্রী। পেটনকে দেখতে পেয়েই সে সিড়ি বেয়ে নামতে শুরু করে। তার মিষ্টি হাসিতে পেটনের সব যন্ত্রণা দূর হয়ে যায়। প্রিয়তমাকে জড়িয়ে ধরার জন্য পেটন তার দুহাত বাড়িয়ে দেয়, ঠিক তখনই সে অনুভব করে একটা কামানের গোলা এসে তার ঘাড়ে আঘাত করেছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:২৬