প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
দশ
গাড়ি চলছে।আমি গাড়ি চালাচ্ছি, আমার পাশে বসে আছে শরীফ আর পেছনের সীটে নাঈম।
-আচ্ছা, কষ্ট করে কেউ বলবি আমাকে ব্যাপারটা কি? আমাকে এভাবে অফিস থেকে ডেকে নিয়ে আসলি কেন? আর আমরা যাচ্ছিই বা কোথায়?
-নাইসার গ্রামের বাড়িতে।আমি জবাব দিলাম।
-কেন?
-কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে।
-কেন? নাইসা কি পরকীয়া করছে?
নাঈমের কথা শুনে এমন সিরিয়াস পরিস্থিতিতেও আমি বা শরীফ-কেউই হাসি আটকে রাখতে পারলাম না।
-হাসির কি হল?
-পরকীয়া ছাড়া তোর মাথায় ভাল কিছু এল না?
-পরকীয়ার চেয়ে ভাল কিছু মানে? পরকীয়া কি ভাল কিছু?
শরীফ হয়ত কোন জবাব দিতে যাচ্ছিল, আমি ওকে থামিয়ে দিলাম।
-আমরা ওখানে যাচ্ছি নাইসার অতীত সম্পর্কে জানতে। আমি জবাব দিলাম।
-তো ওর অতীত সম্পর্কে জানতে গ্রামে যেতে হবে কেন? নাইসা তোর বিয়ে করা বউ, সরাসরি ওকে জিজ্ঞেস করলেই পারিস।
-আমি ব্যাপারটা নাইসাকে জানাতে চাই না।
-ওহহো, বউয়ের ওপর গোয়ান্দাগিরি।এতদিন জানতাম মেয়েরা স্বামীদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করে আর এখানে ঘটছে তার উল্টোটা। ওহ, দিস ইজ গেটিং এক্সাইটিং।
আমি আর শরীফ-দুজনেই বুঝতে পারছিলাম নাঈম ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছে না।
-নাঈম।আমি ডাকলাম।
-বল।
-মাহফুজ সাহেবের খবর জানিস?
-ওই ঘাড়ত্যাড়া পুলিশটার কথা বলছিস?
আমি হ্যা-সূচক মাথা নাড়লাম।
-জানি না। কি হয়েছে?
-মাহফুজ সাহেব গতকাল রাতে আমার বাসায় এসেছিলেন।
-তাই নাকি? তারপর?
-আমাকে ইনডাইরেক্ট হুমকি দিয়ে গেলেন শামীমার মৃত্যুর জন্য আমাকে দেখে নেবেন।
-তুই কি বললি?
-আমি কিছু বলিনি।খালি ঘর থেকে বেরুবার দরজাটা খুলে দিয়েছি।
-তারপর? লোকটা নাইসার সাথে উলটাপালটা কিছু করেছে নাকি?
-না।
-তাহলে এই লোকের কথা আসল কেন?
-কারণ মাহফুজ সাহেব গতকাল রাতে অ্যাকসিডেন্ট করেছেন। উনি এখন আছেন হাসপাতালে।ঠিক শামীমার মত অবস্থা উনার। একেবারে সেম টু সেম।
-সেম টু সেম হয় কিভাবে?
-কারণ উনারও ব্লিডিং বন্ধ হচ্ছে না-যেমনটা হয়েছিল শামীমার।
-শিট।কিন্তু এটাতো কোইন্সিডেন্সও হতে পারে।
-নো মাই ফ্রেন্ড, দিস ইজ নট কোইন্সিডেন্স।
-তুই কিভাবে জানিস?
আমি শামীমা, ওয়ার্ড কমিশনারের ছেলে আর মাহফুজ আহমেদ-তিনজনের ঘটনাই বললাম নাঈমকে।শরীফও মনোযোগ দিয়ে শুনল।
-যার ওপরই নাইসা আপসেট হচ্ছে সে-ই প্রথমে অ্যাকসিডেন্ট করছে, তারপর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু।পরপর দুইদিনের ব্যবধানে একই প্যাটার্নে তিনটা ঘটনা। এটা কিভাবে কোইন্সিডেন্স হয়?
-ছোট্ট একটা কারেকশান-মাহফুজ সাহেব এখনো মারা যান নি।
-তুই কিভাবে জানিস? আমরা তিনজনই হাসপাতালের বাইরে।
-তা ঠিক। তারমানে তুই কি বলতে চাইছিস এসবই নাইসা ঘটাচ্ছে? কিন্তু কিভাবে?
-এখানেইতো টুইস্ট বাছাধন।মনে আছে যে রাতে শরীফের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল, শরীফ বলেছিল শামীমার কাঁধের কাছে একটা বুড়িকে দেখছে ও।
-হ্যা।কিন্তু ও তখন একটা শকের মধ্যে ছিল।
-এগজ্যাক্টলি। আজকে আমিও ঠিক সেই বুড়িকেই দেখেছি মাহফুজ সাহেবের কাঁধের কাছে বসে থাকতে।আমিতো শকের মধ্যে নাই। তাহলে আমি কেন দেখলাম ওই বুড়িকে?
-শরীফ।নাঈম ডাকল।
-বল।শরীফ জবাব দিল।
-তুইও কি ওই বুড়িকে দেখেছিস রাফির সাথে?
-হ্যা।
-দুজন কি একসাথে গাঁজা খেয়েছিস?
-নাঈম, আমরা দুজনেই সিরিয়াস।
-আরে ভাই, আমিও সিরিয়াস। সেই তখন থেকে গাঁজাখুরি গল্প শুনিয়ে যাচ্ছিস।এর জন্য আমাকে অফিস থেকে বের করে নিয়ে এলি-আশ্চর্য।
-তারমানে আমাদের কথা তোর বিশ্বাস হচ্ছে না?
-বিশ্বাসযোগ্য কথা বল, তবেই না বিশ্বাস করব।
-নাঈম।এবার আমি কথা বললাম।
-বল।
-ওই বুড়িটার ট্যাটু আমি দেখেছি নাইসার হাতে। গতকাল রাতে।
এগার
নাইসার গ্রামের বাড়িতে পৌছাতে দুপুর হয়ে গেল।
নাইসার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে ছয় মাস, দেশে ফিরে এসেছি মাস দুয়েক আগে। এই দুই মাস কেটে গেছে নতুন ঘর গোছানো, আত্মীয়স্বজনের বাসায় দাওয়াত আর নিজের নতুন চাকরীতে সেটেল্ড হতেই।তাই গ্রামের দিকে আসার সুযোগই হয়নি।
নাইসার দাদা-দাদি কেউ বেঁচে নেই। ওর বাবা-মা আর ভাইয়েরা সব আমেরিকায়। নাইসার চাচ-ফুফুরা শহরে সেটেল্ড। গ্রামের বাড়িতে থাকেন ওর দূর সম্পর্কের এক চাচা তার পরিবার নিয়ে। মূলত বাড়ি আর জমিজমা দেখাশোনা করেন আর বিনিময়ে এই বাড়িতে থাকতে পারছেন, দুবেলা খেতে পারছেন।
আমাদের পরিচয় জানতে পেরে খুব খাতির করলেন।
নদীতে জাল ফেলার ব্যবস্থা করলেন, ঘরের মুরগি জবাই করা হল। দুপুরে চমৎকার খাওয়া দাওয়া হল।খাওয়া শেষে আমাদের জন্য বিশাল একটা কামরা খুলে দেওয়া হল। তিনজন একসাথে শুয়ে পরলাম।
-রাফি।নাঈম ডাকল।
-বল।
-খাওয়াটা জম্পেশ হল।অফিস কামাইয়ের দুঃখটা আর থাকল না।
আমি হাসলাম।
-রাফি।এবার শরীফ ডাকল।
-বাড়িটাতো বিশাল।
-বিশালতো হবেই। নাইসার পূর্বপুরুষ জমিদার ছিল। এটা জমিদার বাড়ি।
-তোদের বাংলোটাও কি তোর শ্বশুরের?
-হ্যা।ওয়েডিং গিফট। আমি মুখ বাঁকালাম।
-শালা, আমার পোড়া কপাল।এমন শ্বশুর-শাশুড়ি পেলাম-মাসে এক সপ্তাহ আমার ঘরে থেকে যায়। নাঈমের কন্ঠে হতাশা।
-আর তুইও বাড়িটা নিয়ে নিলি? শরীফ অবাক।
-আমি নিতে চাইনি।কিন্তু উনারা বললেন বাংলাদেশে গিয়ে কোন সাধারণ ঘরে নাইসা খাপ খাওয়াতে পারবে না।ঢং।উনারাই জোর জবরদস্তি করে গছিয়ে দিলেন।
-নাইসা কি বাই বর্ন আমেরিকান?
-আরে না, না।নাইসার জন্ম-বেড়ে ওঠা সব বাংলাদেশেই। গ্রাজুয়েশনের পর আমেরিকা গিয়েছিল মাস্টার্স করতে।ওর সাথে ওর মাও ছিল। আর আমার শ্বশুরের আমেরিকায় ব্যবসা আছে। উনিতো বাংলাদেশ-আমেরিকা জার্নির মধ্যেই থাকেন।
-তারপর?
-তারপর আর কি? আমি তখন পিএইচডি করছিলাম ওখানে। আমি ছিলাম টিএ মানে টিচিং এসিস্টেন্ট।আমি নাইসাদের একটা কোর্স নিয়েছিলাম।তখনই পরিচয়।
-পরিচয়-প্রনয়-পরিনয়?
-আরে নাহ।নাইসার বাসা থেকে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। আমি এর আগে কখনও নাইসাকে খেয়ালও করিনি।
-এমন দুর্দান্ত সুন্দরীকে খেয়াল করিস নি? বলিস কি?
-বাদ দে।
-বাদ দেব কেন? বল।
-আসলে আমার তখন একটা ইতালিয়ান মেয়ের সাথে বেশ একটু ইয়ে চলছিল।ভ্যালেন্টিনা।ওই মেয়েটাও মাস্টার্স করতে এসেছিল।ওদেরও একটা কোর্স নিতাম আমি।
-তাহলে?
-তাহলে আর কি? বাসায় কিভাবে যেন জেনে গিয়েছিল একটা সাদা মেয়ের সাথে আমার ইটিশপিটিশ চলছে।তাই নাইসাদের বাসা থেকে প্রস্তাব পাওয়ার ওরা সেটা লুফে নেয়। বাসার সবাই চাইছিল একটা বাঙ্গালী বউ ঘরে আনতে।
-আর তুই কি চাইছিলি?
-আমি কি চাইছি সেটা নিয়ে কথা বলে লাভ আছে? এখন আমি ম্যারিড, নাইসা আমার বউ-এটাই সত্য।যে কাজ আমরা করতে এসেছি সেটা করা দরকার।সামথিং ইজ রং উইথ নাইসা। উই হ্যাভ টু ফাইন্ড আউট।
বার
-বাবাজিরা, উঠে পড়েন।
চোখ খুলে দেখি নাইসার চাচা ডাকছেন।
-কয়টা বাজে?
-মাগরিবের আযান হচ্ছে। আপনারা তিনজন একসাথে ঘুমায় পড়ছিলেন।
-তাইতো দেখছি।
আমি শরীফ আর নাঈমকে ডেকে তুললাম। এই শালার ভাইয়েরা, উঠে পর।
নাঈম আর শরীফ চোখ খুলল।
-আপনেরা রাতে থাকবেন? ভদ্রলোক জানতে চাইলেন?
-না, না, আমরা রাতে থাকব না, শহরে ফিরে যাব। শরীফ তাড়াতাড়ি জবাব দিল।
-আইচ্চা।
-চাচা।আমি ডাকলাম।
-বলেন বাবাজি।
-ঘরে কোন পুরনো এ্যালবাম আছে?ফটো এ্যালবাম?
-আছে দুই তিনটা। আনব?
-হ্যা, নিয়ে আসুন।
লোকটা ফটো এলবাম আনতে চলে গেল।
-ফটো এ্যালবাম দিয়ে কি করবি? শরীফ জানতে চাইল।
-কি করব জানি না। একট চান্স নিয়ে দেখি। যদি সূত্র পাওয়া যায়।
চাচা মিয়া তিনটা ফটো এ্যালবাম নিয়ে এলেন। আমরা তিনজন তিনটা নিয়ে বসে পড়লাম।
-আমি আপনাদের চা-নাস্তা নিয়ে আসি।
-আচ্ছা।
লোকটা বেরিয়ে গেল।
-রাফি, আমরা এই ফটো এ্যালবামে কি খুঁজছি?
-জানি না।ছবিগুলো দেখ। যদি কিছু অস্বাভাবিক বা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় তো বলবি।
-আচ্ছা।
আমরা তিনজন তিনটা ফটো এলবাম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ইতিমধ্যে আমাদের চা-বিস্কুট দেয়া হয়েছে।কাপে চুমুক দিচ্ছি আর প্রতিটা ছবি খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছি।
নাইসা জমিদার পরিবারের মেয়ে। ব্রিটিশ আমলের ওদের জমিদারি থেকে শুরু করে মোটামুটি আশির দশক পর্যন্ত ছবি আছে।
-রাফি।
-বল।
-এখানেতো নাইসার কোন ছবিই দেখছি না।
-নাইসার কোন ছবি নেই, তবে ওর বড় ভাইদের বেশ কয়েকটা ছবি আছে। মনে হয় নাইসার জন্মের পরের কোন ছবি এ্যালবামগুলোয় নেই।
-হুম।
আমরা এ্যালবামের পাতা উলটে চললাম।
-রাফি।শরীফ চিৎকার করে উঠল।
আমি শরীফের পাশে গিয়ে দাড়ালাম।কি হয়েছে?
-দেখ।
নাইসার ফ্যামিলি ফটো। নাইসার বাবা-মা আর ওর ভাইয়েরা। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে দেলোয়ার আর আর এক যুবতী।অবিকল দেখতে ঐ ডাইনীটার মত!
-এটা কে? ছবিটা দেখিয়ে নাইসার চাচার কাছে জানতে চাইলাম।
-তুমিতো এদের চেনই বাবাজি।
-আব্বা-আম্মা আর ভাইয়াদের কথা বলছি না। দেলোয়ারের পাশে দাঁড়ানো এই মেয়েটা কে?
হঠাৎ করেই উনার মুখ কঠিন হয়ে গেল।জানি না।
-জানি না মানে? একটা অজানা অচেনা মেয়ে এমনি এমনি ফ্যামিলি ফটোতে ঢুকে গেল?
-আমি জানি না। আপনেরা রাতে খাইবেন?
মেজাজ খারাপ হচ্ছিল, তবুও শান্ত কন্ঠে বললাম, আমরা রাতে খাব না, শহরে ফিরে যাব না।
-তাইলে রেডি হইয়া নেন। এশার আযান হচ্ছে, নামায পড়ে শহরে রওয়ানা দেন। দিনকাল ভাল না। যত তাড়াতাড়ি শহরে পৌছানো যায় ততই মঙ্গল।
নাইসার চাচা সেই যে ঘরের ভেতরে ঢুকলেন, আর আমাদের সামনে আসেননি। আমাদেরকে মসজিদে নিয়ে গেল মোর্শেদ নামে একটা আঠার-বিশ বছরের ছেলে।
নামায শেষে মোর্শেদ বললেন, আসেন, আপনাদের ইমাম সাহেবের সাথে পরিচয় করায় দেই।
-ইমাম সাহেব কি স্পেশাল কেউ?
-হ্যা, উনার বয়স একশ’র উপরে।আব্বার আগে উনিই জমিদার বাড়ির দেখাশোনা করতেন।যা কিছু জানতে চান, উনি সব বলতে পারবে।
মোর্শেদের কথা শুনে মনে আশার সঞ্চার হল।ইমাম সাহেবকে আমাদের আসার কারণ ব্যাখ্যা করলাম। এ্যালবাম থেকে আগেই ছবি বের করে নিয়েছিলাম, সেটা দেখালাম ইমাম সাহেবকে।
-এই মেয়েটার পরিচয় বলতে পারবেন?
-পারব না কেন? এই মেয়ের নাম শাকিলা, দেলোয়ারের বউ।
-দেলোয়ারের বউ? দেলোয়ার বিবাহিত? আমি অবাক।
-বিবাহিত ছিল, বউটা মরার আগ পর্যন্ত।
-মেয়েটা মৃত?
-হ্যা।
-কিভাবে মারা যায়?
-রোড অ্যাকসিডেন্ট। শুনছি আক্সিডেন্টের পর মেয়েটার নাক-কান দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছিল।ওই অবস্থায় মেয়েটা মারা যায়।
-কি হয়েছিল?
-দেলোয়ার মেয়েটাকে কোত্থকে এনেছিল কেউ জানেনা।হঠাৎ একদিন মেয়েটাকে এনে বলে, এটা আমার বউ, একে আমি বিয়ে করছি।দেলোয়ারের বাবা-মা কেউ বেঁচে ছিল না, তাই আপত্তি করারও কেউ ছিল না। দুজনে সংসার শুরু করল।
-তারপর?
-প্রথম থেকে গ্রামের লোকজনের সন্দেহ ছিল মেয়েটা হয় ডাকিনী বিদ্যার চর্চা করে না হয় এর ওপর জ্বিন ভূতের আসর আছে। প্রায় রাতেই দেখা যেত ওদের ঘরের উঠানে আগুন জ্বলতেছে আর তার সামনে দেলোয়ারের বউ শাকিলা বসে আছে।
গ্রামের একটা বাচ্চা অস্বাভাবিকভাবে মারা যায়। বাচ্চাটার মা শাকিলাকে তার সন্তানের মৃত্যুর জন্য দায়ী করে। গ্রামের লোকজন আগে থেকেই শাকিলার ওপর ক্ষেপে ছিল, এবার সুযোগ পেয়েই ঝাঁপিয়ে পরে।গ্রামবাসী ওকে মেরেই ফেলত-যদিনা জমিদারসাহেব ওকে বাঁচাতেন।
-জমিদার সাহেব?
-তোমার শ্বশুর।উনি শহরের মানুষ, লেখাপড়া জানা লোক। উনি এইসবে বিশ্বাস করতেন না। উনি তখন গ্রামে ছিলেন।সব শুনে উনি শাকিলাকে বাঁচান। গ্রামের লোকজন শাকিলাকে মেনে নেবে না, তাই সেই রাতেই উনি দেলোয়ার আর শাকিলাকে নিয়ে শহরে রওয়ানা হন।
-তারপর কি হল?
-ওই সময় জমিদার সাহেব উনার স্ত্রী আর তিন ছেলেকে নিয়ে গ্রামে এসেছিলেন ছুটি কাটাতে।উনি উনার পরিবার আর দেলোয়ার-শাকিলাকে নিয়ে শহরে রওয়ানা হন।
-আর তখনই কি অ্যাকসিডেন্ট হয়?
-হ্যা। শুনছি ওই আক্সিডেন্টেই শাকিলা মারা যায়। এরপর দেলোয়ার আর গ্রামে ফেরে নাই। জমিদার সাহেবের সাথেই থেকে যায়।ওই আক্সিডেন্টে শুনছি জমিদার সাহেবের ঘরের কারো কিছু হয় নাই।
-মানে শাকিলা ছাড়া আর কারো কিছু হয় নাই?
-সেরকমইতো শুনছি।
-ইমাম সাহেব এটা কবেকার ঘটনা বলতে পারবেন?
-আমার একটা খাতা আছে।ওইটা দেখে বলতেছি। ১১ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৯।
তের
গাড়ি চলছে।চালাচ্ছি আমি, পাশে শরীফ আর পেছনে নাঈম।
-রাফি।শরীফ ডাকল।
-বল।
-ইমাম সাহেবের মুখে আক্সিডেন্টের তারিখ শুনে তুই এত অবাক হয়ে গেলি কেন?
-কারণ ১১ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৯ সালে নাইসার জন্ম।
-হোয়াট?
-হ্যা। এখন মোটামুটি সব ক্লিয়ার হয়ে এসেছে।ওইদিন রাতে রোড অ্যাকসিডেন্টে শাকিলা মারা যায়। মারা যাওয়ার কারণ ছিল ননস্টপ ব্লিডিং। সেদিনই নাইসার জন্ম।
-এর থেকে আমরা কি বুঝতে পারলাম?
-আরে ভাই, ইজি ইকুয়েশান।যারাই নাইসাকে আপসেট করছে, তারাই একইভাবে মারা যাচ্ছে।আমিও নাইসাকে মাঝরাতে ঘরের সামনে আগুন জ্বালিয়ে বসে থাকতে দেখি।
-বলিস কি?
-তারমানে বলতে চাইছিস শাকিলাই ফিরে এসেছে নাইসা হয়ে?
-জানি না। তবে দেলোয়ার হারামজাদাটা কখনো নাইসাকে চোখের আড়াল হতে দেয় না। নাইসার প্রতি ওর এত ভালবাসা কিসের?
-সেটাও প্রশ্ন।
-কিন্তু তোরা দুজনেইতো দেখেছিস একটা বুড়িকে আর শাকিলা মারা গেছে ইয়াং বয়সে। নাঈম বলল।
-সেটা ঠিক। কিন্তু সেই বুড়ি আর শাকিলার চেহারা হুবহু এক।শাকিলা এতদিন বাঁচলে বুড়ি হত না?
-তা না হয় মানলাম।কিন্তু নাইসার হাতে ওই ট্যাটু এল কি করে?
-সেটাই বুঝতে পারছি না।আরেকটা ব্যাপার আছে।
-কি?
-শাকিলা মারা গেছে ১১ই সেপ্টেম্বর, সে রাতে নাইসার জন্ম আর সব ঘটনা ঘটা শুরুও হয়েছে কিন্তু ১১ সেপ্টেম্বর থেকে।
-গুড পয়েন্ট।তুই কি নাইসার জন্মদিন উপলক্ষে সেদিন আমাদের সবাইকে দাওয়াত করেছিলি?
-হ্যা।
-তাহলে আমাদের বলিসনি কেন জন্মদিনের কথা?
-নাইসার গিফট পছন্দ না।
-আরে ভাই, গিফট-জন্মদিন বাদ দে। আমাদের এখন করনীয় কি সেটাই চিন্তা কর।শরীফ বলল।
হঠাৎ আমার ফোন বেজে উঠল।নাইসা।
-দোস্ত, ধরিস না।নাঈম ফিসফিসিয়ে বলল।
-আরে ভাই, দাড়া।ফোন না ধরলে ও সন্দেহ করবে।সন্দেহ করলেই বিপদ।আমি বললাম।হ্যালো বাবু।
-কোথায় তুমি? নাইসার কন্ঠে রাগ।
-এইতো, একটু বাইরে। কি হয়েছে?
-বাইরে মানে কোথায়?
-এইতো একটু অফিসের কাজ ছিল। ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং ছিল।এখন বাসায় আসছি।
-মিথ্যা কথা বলবা না।
-মানে?
-মানে কলিম চাচা আমাকে ফোন করেছিল। তুমি আমাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলে কেন?
-আমি বাসায় আসি, সব বুঝায় বলতেছি তোমাকে।
নাইসা কোন জবাব দিল না। ফোন কেটে দিল।
-কি হয়েছে? নাঈম জানতে চাইল।
-নাইসা সব জেনে গেছে।
-মানে? নাঈমের চোখে ভয়।
-মানে কলিম চাচা নাইসাকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে আমি তোদেরকে নিয়ে ওর গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম।
-এখন উপায়?
-জানি না।
-সেই রাতটাও ঠিক এরকমই ছিল।কথার মাঝখানে হঠাৎ শরীফ বলে উঠল।
-মানে? আমি জানতে চাইলাম।
-দেখ সামনে কি কুয়াশা।
আরে তাইতো। এই সেপ্টেম্বর মাসে এত কুয়াশা কোত্থেকে?
-রাফি, গাড়ি থামা। দেখ, সামনে একটা লরি।
কুয়াশা ভেদ করে প্রচন্ড গতিতে একটা বিশাল লরি এগিয়ে আসছে। আমি প্রাণপণে ব্রেক চেপে গাড়ি থামানোর চেষ্টা করছি, গাড়িটা থামার নামই নিচ্ছে না!
সমাপ্ত
আমার লেখা অন্যান্য ভৌতিক গল্পগুলোঃ
১.পিশাচ কাহিনীঃ রক্তখেকো ডাইনী পর্ব-১ পর্ব-২ পর্ব-৩
২.পিশাচ কাহিনীঃ জানোয়ারের রক্ত (১৮+)
৩.পিশাচ কাহিনীঃ অন্ধকারে বিলীন
৪.পিশাচ কাহিনীঃ হোটেল একশ তলা
৫.পিশাচ কাহিনীঃ একশ তলায় আবার
৬.পিশাচ কাহিনীঃ রাতের আঁধারে
৭.পিশাচ কাহিনীঃ কন্ঠ
৮.পিশাচ কাহিনীঃ অতিথি
৯.পিশাচ কাহিনীঃ কান্নার শব্দ
১০.পিশাচ কাহিনীঃ শয়তানের পাল্লায়
১১.পিশাচ কাহিনীঃ নির্ঘুম রাত
১২.পিশাচ কাহিনীঃ জঙ্গল মঙ্গলপুর
১৩.পিশাচ কাহিনীঃ একটি ফটোগ্রাফ
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০২৩ রাত ১০:১৭